স্বপ্নলোকের চাবি – ৩৯
একটা ভ্যাপসা গন্ধ রুমের ভেতর। অনেকদিন বন্ধ থাকার কারণে রুমে তাজা বাতাস ঢুকতে পারেনি। তার উপর প্রচন্ড গরম পড়ছে। রুমের দেয়াল, মেঝে সবই কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। জানালার সবগুলি পাল্লা খুলে দিলাম। বাইরে ঝকঝকে রোদ। সূর্য মাঝ-আকাশে উঠে গেছে। এই রোদ সরাসরি এখন রুমে ঢুকবে না। বাইরে খুব একটা বাতাস নেই। জুন মাসের তপ্ত দুপুর স্থির হয়ে আছে।
মেঝেতে ছোট ছোট লাল পিঁপড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। চৌকির পায়ের ইটের হাইহিলে লেগে থাকা রক্ত আর ছিঁটেফোঁটা চামড়া কবেই খেয়ে ফেলেছে পিঁপড়েগুলি। তবুও এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন কে জানে।
মেঝে ডেটল দিয়ে ভালো করে মুছে ফেলা দরকার। দুটো টেবিলেই ধুলোর আস্তরণ। টেবিলফ্যানটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। যা গরম পড়ছে – এটাকে এখনই ত্যাগ করার সময় নেই, সামর্থ্যও নেই। তাই এটা দিয়েই কাজ চালাতে হবে। মোটা ইনসুলেটিং ট্যাপ নিয়ে এসেছি। এর পুরো বডি এমনভাবে ট্যাপ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেবো যে ইলেকট্রিক শক দেয়ার কথা ভুলেই যাবে।
ফ্লোর মুছে ফেললাম। ফ্যানে ট্যাপ লাগানোর পরও বেশ সাবধানে হ্যান্ডেল করছি ওটাকে। ফ্যানের বাতাসে ফ্লোর শুকিয়ে গেল দ্রুত। রুমে একটা তাজা ভাব চলে এলো। এবার একটু বইখাতা খুলে বসা উচিত। কিন্তু মনে হচ্ছে শরীরে এক ফোঁটাও শক্তি নেই আর। বিছানায় এলিয়ে পড়লাম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল দরজার শব্দে। চোখ খুলতেই মনে পড়লো – দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কে যেন বাইরে থেকে দরজা টেনে দিল। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দেখি – অজিত। চলে যাচ্ছিলো, শব্দ পেয়েই পেছনে ফিরলো।
“দরজা খোলা রেখে ঘুমাচ্ছিলি! আরো ঘুমাবি?”
“না। হঠাৎ ঘুম চলে এলো।“
অজিত রুমে এসে বসলো খাটের উপর।
“তোর স্বাস্থ্য অনেক খারাপ হয়ে গেছে। ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। পরীক্ষার তো আর মাত্র ছয় দিন আছে।“
মনে হচ্ছে আমার পরীক্ষা নিয়ে আমার চেয়েও তার টেনশান বেশি। পরীক্ষা যত কাছে আসতে থাকে, টেনশানের পরিমাণ ততই বাড়তে থাকে। পরীক্ষা ও টেনশানের মধ্যে সম্পর্কটা স্বাভাবিক নিয়মে বিপরীতানুপাতিক হবার কথা। পরীক্ষার দূরত্ব যত কমতে থাকবে, টেনশান তত বাড়তে থাকবে। কিন্তু আমি দেখলাম – আমার কোন টেনশানই হচ্ছে না। অজিতকে এটা বলার পর সে গোঁফের ফাঁকে “হোঁ হোঁ” করে একটু হেসে বললো, “টেনশান না হওয়া তো খুব ভালো। এই ক’দিন জাস্ট একটু দেখে নে। সব ঠিক হয়ে যাবে।“ অজিতের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে সে আমার নয়, আমার ঠাকুরদার বন্ধু।
অজিত এই বিল্ডিং-এর দোতলায় এসে উঠেছে দিন পনেরো আগে। তাদের অনার্স পরীক্ষা হয়ে যাবার পর সে হোস্টেল ছেড়ে শহরেই একটা মেসে উঠেছিল। এখন এখানে আসাতে আমার জন্য বিরাট সুবিধা হয়ে গেল। অনেকদিন পর বন্ধুর সাথে দেখা হলে এতদিনের জমা কথাগুলি সব একসাথে বের হয়ে আসতে চায় – আমারও সেরকম হচ্ছিলো। কিন্তু অজিত আমার সাথে এখন কথা বলতে কিংবা আমার কথা শুনতে রাজি নয়। সে তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। সে আমাকে পড়ার টেবিলে বসাতে চায়।
২৭ জুন ফার্স্ট পেপার – অপটিক্স। জিওমেট্রিক্যাল অপটিক্স ছাড়া সিলেবাসে আর কী কী আছে তাও মনে পড়ছে না এখন। ছয়দিনে কতটুকুই আর পড়া যাবে? যাত্রাপালার পরাজিত রাজা যেভাবে বলে – “সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কী ভয়” – আমার অবস্থাও এখন অনেকটা সেরকম। সে কারণেই পরীক্ষার টেনশান একেবারেই উধাও হয়ে গেছে।
মুকিতভাই এলেন একটু পরে। ছয় সপ্তাহের বিচিত্রা জমা হয়ে আছে। তিনি সেগুলি নিয়ে এসেছেন। মুকিতভাইয়ের সাথে গল্প করলাম কিছুক্ষণ। তিনিও আমার পরীক্ষার ব্যাপারে সচেতন। বেশ দ্রুতই প্রস্থান করলেন। আমি অপটিক্স বাদ দিয়ে বিচিত্রার পাতা উল্টাতে শুরু করলাম।
ডাকসু নির্বাচন হয়ে গেছে জুনের ছয় তারিখ। এবার ছাত্রদল জিতেছে বেশিরভাগ আসনে। আমানুল্লাহ আমান ভিপি ও খায়রুল কবীর খোকন জিএস নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচিত হয়েই তারা এরশাদের বিরুদ্ধে জোরেশোরে আন্দোলন করার ঘোষণা দিয়েছেন। দেখা যাক – কী হয়। চাকসুর নির্বাচিত সর্বদলীয় নেতারা তো জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখা দূরে থাক – ক্যাম্পাসে শিবিরের বিরুদ্ধেই কিছু করতে পারছে না।
জুনের ৮ তারিখ থেকে বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হয়ে গেছে ইতালিতে। এই এক মাস দেশে কোন আন্দোলন হবে না গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়। সবাই এখন খেলা দেখা ও খেলা নিয়ে কথা বলায় ব্যস্ত। ঘরে ঘরে এখন ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার পতাকা। ব্রাজিল গ্রুপ-সি থেকে গ্রুপ-চ্যাম্পিয়ন হয়ে নক-আউট স্টেজে আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হবে ২৪ তারিখ। আর বেচারা আর্জেন্টিনার অবস্থা এবার বেশ খারাপ। গ্রুপ-বি তে কোন রকমে পরের রাউন্ডে গেছে মাত্র তিন পয়েন্ট পেয়ে। শুধুমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারাতে পেরেছে তারা। ক্যামেরুনের কাছে হেরেছে, রোমানিয়ার সাথে ড্র করেছে। এখন সবার নজর ২৪ তারিখের খেলার দিকে। ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা – কোন একটা দল বিদায় নেবে।
আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ফার্স্ট রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছে – সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। মিখাইল গর্ভাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ গর্ভাচেভকে কী টোপ দিয়েছেন কে জানে – ঘন ঘন মিটিং করছেন দু’জনে। এদিকে দুই জার্মানি এক হয়ে যাচ্ছে আর এক সপ্তাহ পর- জুলাইয়ের এক তারিখ থেকে। পূর্ব-জার্মানি ও পশ্চিম-জার্মানির মধ্যবর্তী বার্লিন-দেয়াল ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
আমার হঠাৎ পৃথিবীর সবকিছু সম্পর্কে কৌতূহল দেখা দিচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই পরীক্ষার পড়া পড়তে ইচ্ছে করছে না। এ কোন্ ঝামেলায় পড়লাম!
সময় চলে যাচ্ছে সময়ের নিয়মে। পড়ার টেবিলে জোর করে বসে থাকার চেষ্টা করছি। দুপুরে রান্না করি, পরদিন সকাল পর্যন্ত চলে যায়। রাতে ফুটবল খেলা দেখতে ছাদে চলে যাই। শিবিরের কর্মীরা টেলিভিশনের অন্য কোন প্রোগ্রাম দেখে না, কিন্তু খেলা দেখার জন্য আগেভাগে গিয়ে বসে থাকে। এখনো বৃষ্টি হচ্ছে না বলে ছাদে কোন টিভি দেখতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। বৃষ্টি হলে হয়তো মুকিতভাইয়ের রুমে দেখবে। খেলা সম্পর্কে আমার যে খুব একটা আগ্রহ আছে তা নয়। ভাবছি আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের খেলাটা দেখার পর আর দেখবো না।
২৪ তারিখ রাতের খেলায় প্রচন্ড উত্তেজনা দেখা গেলো। আমাদের বিল্ডিং-এ ব্রাজিলের সমর্থক বেশি। কিন্তু আর্জেন্টিনার কাছে হেরে গেলো ব্রাজিল। বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হলো তাদের। আর্জেন্টিনা কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেল।
২৭ তারিখ দুপুরে ফার্স্ট পেপার পরীক্ষা হয়ে গেল। অপ্টিক্স - সোবহান স্যারের পেপার। টেনশান ছাড়া পরীক্ষা দেয়ার মধ্যে বিশেষ এক ধরনের আনন্দ পাওয়া যায়। আমার খুব ভালো লাগলো পরীক্ষা দিয়ে।
পরীক্ষার আগে থেকে প্রদীপ নাথ আলাওল হলে উঠেছে। পরীক্ষার পর তার রুমে গিয়ে একটু ঘুরেও এলাম। আমাদের ক্লাসের সুকুমার আর কেমিস্ট্রির ননী তার রুমমেট। আলাওল হল সোহরাওয়ার্দী হলের চেয়ে অনেক সুন্দর। হাফিজও আলাওল হলে থাকে। হলের সামনে দেখা হয়ে গেল তার সাথেও। সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “পরীক্ষার সময় মাথা ছিলে ফেলে ভালো করেছিস।“ মাথার পেছনে ব্যান্ড-এইড লাগানো দেখে বললো, “বাহ্ ছিদ্রও করেছিস দেখছি। ছিদ্র করে ম্যাটেরিয়েল ঢুকিয়েছিস মগজে?”
সেকেন্ড পেপার পরীক্ষা জুলাইয়ের ১৬ তারিখ। হাতে আঠারো দিন সময় আছে। এই সময়টা কাজে লাগাতে হবে। ফার্স্ট পেপার পরীক্ষা ঠিকমতো দেয়ার পর কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু শরীর আবার ঝামেলা শুরু করেছে। আবার জ্বর এসেছে। আমি সাধারণত ডাক্তারদের এড়িয়ে চলতে পছন্দ করি। পারতপক্ষে তাদের চেম্বারের ধারে কাছেও যাই না। কিন্তু অজিত নিজেই অনেকটা স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ টাইপের মানুষ। বললো, “তোর টিটেনাস দেয়া দরকার। মনে হচ্ছে তোর মাথার ব্যথা থেকেই জ্বর আসছে।“
আমার অ্যান্টিবায়োটিক চলছে এখনো। ডাক্তারের কাছে এখন যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু অজিত কোন কথা শুনলো না, জোর করে ধরে নিয়ে গেল ডাক্তারের কাছে। তার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে ডাক্তারদের প্রতি তার তীব্র একটা আকর্ষণ আছে। তার ইচ্ছে ছিল আমাকে শহরে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখায়। কিন্তু আমি পরীক্ষার দোহাই দেয়াতে চৌধুরী হাটের ডাক্তার শাহাদাত হোসেনে রাজি হয়েছে। রিকশা করে চৌধুরিহাট যাওয়ার সময় সে ক্রমাগত বলে চলেছে, “অসুখ না হলেও ডাক্তারের কাছে রেগুলার যাওয়া দরকার। একটা যন্ত্র যেরকম পরীক্ষা করে দেখা দরকার ঠিক আছে কি না, সেরকম আমাদের শরীরও তো একটা যন্ত্র।“
কানের কাছে উপদেশের যে যন্ত্রণা চলছে – যন্ত্র না বলার সাহস হলো না। তার কথাগুলি পরপর লিখে ফেললে শরীরের যত্ন বিষয়ক প্রবন্ধ হয়ে যেতো।
ডাক্তার শাহাদাত হোসেন বললেন আমার আর কোন নতুন চিকিৎসার দরকার আপাতত নেই। ফিরে আসার সময় অজিতকে বললাম, “কোন দরকার ছিল না। শুধু শুধু নিয়ে এলি।“
“অবশ্যই দরকার ছিল। শরীরের ব্যাপারে সবসময় ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।“
কোরবানের ছুটি শুরু হয়েছে। অজিত বাড়িতে গেছে। মুকিতভাইও বাড়িতে চলে গেছেন। আমি নিজের মতো করে পরবর্তী সাতটি পেপারের অত্যন্ত সিলেকটিভ কিছু অংশ রেডি করছি আস্তে আস্তে পরীক্ষার জন্য। যীশু আর প্রদীপ নাথ আসে প্রত্যেক পেপারের আগে কী কী পড়ছি তা ঠিক করে নিতে।
জুলাইর শুরুতেই পশ্চিম জার্মানি আর পূর্ব জার্মানি এক হয়ে গেছে। জুলাইয়ের দুই তারিখ মক্কায় হজ্ব করার সময় একটি টানেলের মধ্যে ভীড়ে হুড়োহুড়িতে পদদলিত হয়ে মর্মান্তিকভাবে মারা গেছেন প্রায় চৌদ্দ শ হাজী। কেমিস্ট্রির হারুনভাইর খুব মন খারাপ করে আছেন। তাঁর কোন আত্মীয় এবার হজ্বে গেছেন। এখনো তাঁর খবর পাওয়া যায়নি।
আট তারিখ রাতে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল খেলা দেখলাম রাত আড়াইটা পর্যন্ত। বিশ্বকাপ ১৯৯০ গেলো পশ্চিম জার্মানির ঘরে। একটু টেকনিক্যাল সমস্যাও হয়ে গেল। বিশ্বকাপ শুরুর সময় দেশটি ছিল পশ্চিম জার্মানি। অথচ এই জুলাইয়ের এক তারিখ থেকে পূর্ব-পশ্চিম এক হয়ে দেশটি এখন শুধু জার্মানি। সে যাই হোক, আর্জেন্টিনার সাথে পেনাল্টি শটে গোল করেছে তারা। বিশ্বকাপ ফাইনাল হিসেবে খুব একটা ভালো খেলা হয়নি। আর্জেন্টিনার সেকেন্ড রাউন্ডে উঠা অনিশ্চিত ছিলো। সেখানে তারা রানার্স আপ হয়ে গেল। কিন্তু রেফারির আচরণ নিরপেক্ষ ছিল বলে মনে হলো না। পৃথিবীব্যাপী যেকোনো ব্যাপারেই রেফারীদের এই সমালোচনা সইতে হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন কী যে হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে এখন আট, সাত, আর পাঁচ দলীয় জোট একসাথে আন্দোলন করছে। কিন্তু সরকারের তেমন কোন হেলদোল হচ্ছে না। ১৫ জুলাই জনতা মুক্তি পার্টি নামে আরেকটি নতুন রাজনৈতিক দল জন্ম নিয়েছে। মীর্জা সুলতান রাজা এই দলের আহ্বায়ক, আর মাহমুদুর রহমান মান্না যুগ্ম আহ্বায়ক। মান্না সাহেব ডাকসুর ভিপি ছিলেন এক সময় – সে হিসেবে কিছুটা পরিচিত। কিন্তু মীর্জা সুলতান রাজার নাম আগে কখনো শুনিনি।
এই সময় আমার এসব রাজনীতির খবরাখবর না পড়ে পরীক্ষার পড়া পড়া উচিত জানি। কিন্তু কী করবো – চোখের সামনে রিলেটিভিটির বই আর বিচিত্রা এক সাথে থাকলে কোন এক বিচিত্র কারণে বিচিত্রার দিকে চোখ যায়।
১৬ জুলাই সেকেন্ড পেপার রিলেটিভিটি পরীক্ষা হয়ে গেল। এবার আর বেশি গ্যাপ নেই। ২২ তারিখ থার্ড পেপার – ইলেকট্রোডায়নামিক্স, আর ২৮ তারিখ ইলেকট্রনিক্স পরীক্ষা হয়ে গেল। পরীক্ষা কেমন হচ্ছে চিন্তাও করছি না। যেরকম সিরিয়াস হয়ে পরীক্ষা দেয়া দরকার সেরকম কিছু হচ্ছে না। অজিত বাড়ি থেকে আসার পর থেকে আমার পেছনে লেগে আছে। রুমের বাইরে ঘুরঘুর করছি দেখলেই কথা আছে বলে রুমে ডেকে নিয়ে আসে। সে অনার্সের সিলেবাসের কোন কিছুই বাদ দেয়নি। সবকিছুই সে পড়েছে এবং ভালো করেই মনে আছে সব। কলেজে অনার্স না পড়ে সে যদি ইউনিভার্সিটিতে অনার্স পড়তো – তার রেজাল্ট আরো অনেক ভালো হতো। সে আমার সাথে পড়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। আমি বুঝতে পারি সে আমার মগজে ফিজিক্স ঢুকিয়ে দিচ্ছে – কিন্তু ভালোই লাগে। সে খুব ভালো বোঝাতে পারে। ইলেকট্রনিক্স পরীক্ষার আগের সন্ধ্যায় তার রুমে বসে বসেই পড়াশোনা করলাম।
ইলেকট্রনিক্স, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স আর সলিড স্টেট ফিজিক্স মাস্টার্সেও আছে। এই পরীক্ষাগুলির প্রস্তুতি নেয়ার সময় অজিত যে আমাকে কীভাবে সাহায্য করেছে তা বলে বোঝানো যাবে না। সে টপিকগুলি আমার কাছে এমনভাবে ব্যাখ্যা করছিলো যেন সে নিজের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অথচ সেগুলি আমারই পরীক্ষার টপিক।
অবশেষে আগস্টের ২১ তারিখ আমার তত্ত্বীয় পরীক্ষা শেষ হলো। দুই মাস লাগলো থিওরি পরীক্ষা শেষ হতে। প্র্যাকটিক্যাল আর ভাইভা হতে আরো দুই মাস।
প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার জন্য প্র্যাকটিস শুরু হলো সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। প্রদীপ নাথ আলাওলের ১০৪ নম্বর রুমে থাকে। আমি আর যীশুও গিয়ে উঠলাম সেখানে। ছোট্ট দু’জনের রুমে তারা আগে থেকেই তিনজন থাকতো। আমরা দু’জনসহ হলাম পাঁচজন। সুজন হলে নাকি তেঁতুল পাতাতেও নয়জনের জায়গা হয়ে যায়। আমাদেরও জায়গা হয়ে গেল। পুরো এক সপ্তাহ ধরে প্র্যাকটিক্যাল প্র্যাকটিস করলাম। আর হলে ইচ্ছামতো গল্পগুজব করলাম সবাই মিলে। হাফিজ তো আলাওলেই থাকে। ফারুক থাকে এফ রহমানে। সেও চলে আসে আড্ডা মারার জন্য। আড্ডায় যে কী সুখ তা যারা আড্ডা মারে না – তারা বুঝবে না।
অবশেষে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা ও ভাইভার ডেট দেয়া হয়েছে। আমার ভাইভা ১১ তারিখ, আর প্র্যাকটিক্যাল তেরো-চৌদ্দ। কিন্তু এগারো তারিখ সারাদেশে হরতাল ডেকেছে আট, সাত ও পাঁচ দল। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। ডাক্তাররা সবাই আন্দোলন করছেন প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যনীতি বাতিলের দাবিতে। এরশাদ আইন করে সরকারি ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করতে চাচ্ছেন।
এগারো তারিখ হরতালের কারণে বাস-ট্রেন সব বন্ধ। পরীক্ষা হবে কি হবে না কিছু জানি না। সকালে রেললাইন ধরে হেঁটে ক্যাম্পাসে গেলাম। যাদের প্র্যাকটিক্যাল ছিল – তাদের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা হয়ে গেল। কিন্তু হরতালের কারণে এক্সটার্নাল এক্সামিনার আসতে পারেননি বলে ভাইভা হলো না। পরে কখন হবে এখনো জানি না।
থার্ড ইয়ারের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা বিশাল লম্বা। মোট ১০০ নম্বরের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা হয় দুই দিনে। প্রতিদিন ছয় ঘন্টা করে বারো ঘন্টা সময়। এক দিনে একটা করে এক্সপেরিমেন্ট করতে হয়। প্রথমদিন ইলেকট্রনিক্সে আমার লটারিতে উঠলো ‘স্টাডি অব অ্যা পাওয়ার সাপ্লাই’। মূলত ট্রান্সফর্মার। এই বস্তু কীভাবে কাজ করে তা জানি। কিন্তু পরীক্ষার সময় যে যন্ত্রপাতি দেয়া হয়েছে তা আমার সাথে এমন ব্যবহার শুরু করলো যেন আমি তার চিরশত্রু। একটা পাঠও ঠিকমতো নিতে পারলাম না। এর মধ্যে প্রামাণিকস্যার ভাইভা নিতে এসে এমন উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, যেটুকু থিওরি জানা ছিল সেটুকুও এলোমেলো হয়ে গেলো। প্রামাণিকস্যারের সাথে সাথে আমি নিজেও বুঝতে পারলাম যে ইলেকট্রনিক্সের অ-আ-ক-খ কিছুই আমার জানা নেই।
পরের দিন ১৪ অক্টোবর প্র্যাকটিক্যালের সেকেন্ড পার্ট – অপটিক্স। পোলারিমিটারের সাহায্যে সুগার সলিউশানের স্পেসিফিক রোটেশান বের করতে হবে। পানির মধ্যে চিনি মেশাতে হবে একটা পর্যায়ে। পরে কতটুকু চিনি মেশানো হলো তার ভর বের করতে হবে। পোলারিমিটারের খুবই প্রাগৈতিহাসিক পরীক্ষণ। এই পদ্ধতিতে কাজ করা হতো সম্ভবত উনবিংশ শতাব্দীতে। মনে হলো সবকিছু ঠিকমতোই করলাম যা যা করতে হয়। ভাইভা নিতে এলেন সোবহানস্যার। তিনি আমার খাতার রিডিং দেখে ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়েন পেন্ডুলামের মতো। “সুগারের কোয়ান্টিটি কি ওরা বলে দিয়েছে তোমাকে?”
কারা বলে দেবে? ল্যাব-সহকারী যারা যন্ত্রপাতি সাপ্লাই করেছেন, তাঁরা? আমি তাঁদের সাহায্য কেন নেবো? স্যার কি আমার সততার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করছেন?
“না স্যার, কেউ কিছু বলেনি। আমি পরীক্ষার ডাটা থেকে হিসেব করে বের করেছি।“
“তোমার উত্তর তো সঠিক হয়নি। কীভাবে নম্বর দিই তোমাকে?”
“আপনি ডাটা দেখুন স্যার। এই পোলারিমিটারের রিডিং দেখেন।“
পোলারিমিটারের রিডিং-এর প্রতি স্যারের কোন আগ্রহ দেখা গেল না। তিনি কাগজে কিছু একটা লিখে নিয়ে এসেছেন। সম্ভবত কতটুকু চিনি দেয়া হয়েছে তা লেখা আছে সেখানে। স্যার আমাকে আর কোন প্রশ্ন না করে চলে গেলেন। আমি বুঝতে পারলাম না পাস করলাম, না ফেল করলাম। অনার্সের সবগুলি পরীক্ষা পরীক্ষা দিয়ে ফেললাম কোন ধরনের টেনশান ছাড়া। আর আজ প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার শেষে আমার সেই টেনশানটা ফিরে এলো। প্র্যাকটিক্যালে ফেল করিয়ে দিলেই কিন্তু আমি একেবারে ফেল। আমাকে আবার সবগুলি পরীক্ষা আগামীবছর দিতে হবে। স্যাররা কী কারণে শিক্ষার্থীদের টেনশান দিতে পছন্দ করেন আমি জানি না।
যাই হোক, জেনারেল ভাইভাটা হয়ে গেলেই অনার্স পরীক্ষা শেষ। আমার জেনারেল ভাইভা প্রথমদিন হওয়ার কথা ছিল। হরতালের কারণে হয়নি। এক্সটার্নাল কিন্তু এর পরেও আসতে পারেননি। জেনারেল ভাইভা আমাদের স্যাররাই নিয়ে নিচ্ছেন।
পরদিন ডিপার্টমেন্টে গেলাম ভাইভা কখন হবে জানতে। আমাদের পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান নুরুল মোস্তফাস্যার। তিন তলায় স্যারের রুমের সামনে দাঁড়াতেই স্যার রুম থেকে বের হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “অ্যাই ছেলে, ভাইভা দিয়েছো?”
“না স্যার”
“আসো, ভাইভা দিয়ে যাও।“
স্যারের রুমে ঢুকলাম। আহমদ হোসেনস্যার বসে আছেন সেখানে। মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম ইলেকট্রনিক্স থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই তো আমি শেষ। আহমদ হোসেনস্যারের প্রিয় বিষয় ইলেকট্রনিক্স। কিন্তু তিনি সব প্রশ্ন করলেন অ্যাটমিক ফিজিক্স থেকে। আর নুরুল মোস্তফাস্যার প্রশ্ন করলেন নিউক্লিয়ার ফিজিক্স থেকে। উৎরে গেলাম।
জুনের ২৭ তারিখ থেকে শুরু হয়ে অক্টোবরের ১৫ তারিখ শেষ হলো। প্রায় চার মাস লাগলো অনার্সের থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা সম্পন্ন করতে। শুনেছি বিদেশে নাকি এই সময়ের মধ্যে একটা সেমিস্টারের পড়াশোনা, পরীক্ষা, রেজাল্ট সব হয়ে যায়।
No comments:
Post a Comment