স্বপ্নলোকের চাবি – ৩৬
আরেকটি বিজয় দিবস চলে গেলো। ১৯৭১ থকে ১৯৮৯ – বিজয়ের ১৮ বছর। যুদ্ধজয়ী বাংলাদেশের বয়স ১৮ হলো আজ। সুকান্ত ভট্টাচার্য আঠারো হবার আগেই লিখে গেছেন,
“আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।“
এই দুঃসাহসেরা উঁকি দিতে শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে আজ। সার্কিট হাউজের মাঠে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা শুরু হয়েছে। সারাসন্ধ্যা মুক্তিযুদ্ধের গান, কবিতা, নাটক আর মুক্তিযোদ্ধাদের মুখ থেকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি শুনতে শুনতে মনে হয়েছে – এই মাঠভর্তি মানুষের মনে যদি বাঁধভাঙা সাহসের জোয়ার জাগে – তাহলে তো জামায়াত-শিবির-রাজাকার আর এরশাদ স্বৈরাচারের বিদায়ঘন্টা বেজে যাবে।
কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলেই সেরকম? আমরা উৎসবপ্রবণ জাতি। আমরা ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে – রক্তলাল, রক্তলাল, রক্তলাল’ গাইতে গাইতে মেলায় ঘুরি, চটপটি খাই, মনোহারি জিনিস কিনি, আর খুব বেশি হলে স্বপ্ন দেখি – একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
সবকিছু ঠিক হয়ে যাবার এই স্বপ্নটুকুর গুরুত্বও অনেক। অবিরত সংগ্রামের মধ্য দিয়েই মানুষ স্বপ্ন দেখে। একাত্তরে স্বাধীনতার স্বপ্ন না দেখে শুধুমাত্র বাস্তববাদী হলে পাকিস্তানী মিলিটারির ট্যাংকের সামনে ঘরে বানানো সামান্য হাতবোমা নিয়ে দাঁড়ানোর সাহস পেতো না কোন মুক্তিযোদ্ধা। এই বিজয়মেলা নতুন করে সেই সাহসের আগুন উসকে দিয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে শুরু হলো এই বিজয়মেলা। আগামীতে এটা সারাদেশে ছড়িয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু বলা যায় না, এরশাদ বিজয়মেলাবিরোধী আইনও সংসদে পাস করে ফেলতে পারেন।
বিশু, নুপুর, যীশু, ফারুক, আতিক ওরা যে যার বাসার দিকে চলে গেছে। আমি স্টেডিয়াম পেরিয়ে চিটাগং ক্লাবের সামনে দিয়ে লালখান বাজারে এসে বাসে উঠে গেলাম। মুরাদপুরে এসে রাত এগারোটাতেও ফতেয়াবাদের বাস পেতে সমস্যা হলো না। বিজয়মেলা উপলক্ষে অনেক মানুষ আজ এসেছে এখানে। সবার ভেতর মেলা-ফেরত উচ্ছ্বাস। বাসের ভেতর অনেক জিনিসপত্র অনেকের কোলে। প্রথম বিজয়মেলার কিছু না কিছু স্মারক কিনে নিয়ে যাচ্ছে বাড়িতে। একদিন এগুলি স্মৃতি হবে। হবে ইতিহাসের অংশ।
স্মৃতি আর ইতিহাসের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। স্মৃতি ব্যাপারটা খুবই নিজস্ব। একই ঘটনার সাক্ষী হলেও একেক জনের কাছে একেক ধরনের স্মৃতি থাকে সেই ঘটনা সম্পর্কে। সময়ের সাথে সাথে কোন কোন স্মৃতি মুছে যায়, বদলে যায়। কিন্তু ইতিহাস? ইতিহাসের ব্যাপারটা গোলমেলে। যে গ্রিক শব্দ ‘হিস্টোরিয়া’ থেকে হিস্ট্রি শব্দের উৎপত্তি – তার আক্ষরিক অর্থ হলো – অতীত সম্পর্কে জানা। কিন্তু অতীত সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা কি সহজ?
মানুষ যার যার ক্ষমতা অনুসারে নিজেদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ইতিহাস লেখে, বিকৃত করে, মুছে দেয়। যেমন পরাজিত পাকিস্তানীরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখলে তা কীভাবে লিখবে? আর আমাদের বিজয়ের ইতিহাস, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও দফায় দফায় বিকৃত করে চলেছে যখন যে ক্ষমতা দখল করেছে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলা হয়েছে। স্কুলে আমি যে ইতিহাসের বই পড়েছি সেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অধ্যায়টা ছিল খুবই ছোট। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর এই শব্দগুলি সেখানে নেই। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি সেখানে নেই। বাংলাদেশের রেডিও, টেলিভিশন – কোথাও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারিত হওয়া তো দূরের কথা, তাঁর নামও উচ্চারিত হয় না। ১৯৭৫ সালের আগে যেসব সিনেমা তৈরি হয়েছে – সেই পুরনো সিনেমাগুলি এখন হলে বা টেলিভিশনে দেখানো হলে – সেখানে যদি বঙ্গবন্ধুর কোন ছবি থাকে – সেই ছবির উপর অনেকগুলি দাগ দিয়ে ঝাপসা করে দেয়া হয়। সেদিন ‘আলোর মিছিল’ দেখানো হলো। সেখানেও একই অবস্থা।
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে স্কুল-কলেজে তেমন কিছু না জেনেই আমি বড় হয়েছি। হয়তো আমার সমসাময়িক সবারই এই অবস্থা। নিজের আগ্রহে যতটুকু জেনেছি তা যথেষ্ট নয়। এত বড় একটা মুক্তিযুদ্ধের ফসল আমাদের বাংলাদেশ। অথচ এখানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখনো তেমন কোন সাহিত্য রচিত হয়নি, সিনেমাও নয়। আজ বিজয় দিবস উপলক্ষে টিভিতে কী বিশেষ নাটক প্রচারিত হয়েছে জানি না।
এপর্যন্ত স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস উপলক্ষে টিভিতে যতগুলি নাটক প্রচারিত হয়েছে, সবগুলিতেই মুক্তিযুদ্ধ দেখানো হয়েছে অত্যন্ত হাস্যকরভাবে। সেখানে ‘রাজাকার’ শব্দ উচ্চারণ করা যায় না, সেখানে বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের অন্য কোন নেতার নামও উচ্চারিত হয় না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল, রাজনৈতিক নেতারা তা পরিচালনা করেছেন। কিন্তু আমাদের নাটকে সেই রাজনীতির কিছুই দেখানো মানা। হুমায়ূন আহমেদ বহুব্রীহি নাটকে পাখির গলা দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছেন ‘তুই রাজাকার’। এতেই আমরা কী যে খুশি হয়ে গেছি!
ফতেয়াবাদ আসতে আসতে বাস প্রায় খালি হয়ে গেল। অন্যদিন তিন নম্বর বাস ঘুরানোর জন্য গার্লস স্কুল পার হয়ে তালগাছ পর্যন্ত আসে। আমি সেখানে এসেই নামি – তাতে আমার হাঁটার দূরত্ব অর্ধেক হয়ে যায়। কিন্তু আজ ফতেয়াবাদ হাইস্কুলের সামনেই ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি ঘুরিয়ে ফেললো। নামতে হলো।
দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। বিজয়মেলায় বন্ধুদের সাথে শিককাবাব খেয়েছিলাম। সেগুলি কত আগেই হজম হয়ে গেছে। রুমে অবশ্য দুপুরের বাসী খিঁচুড়ির কিছুটা আছে। ওটার কথা মনে হতেই ক্ষুধাটা পেটে শোলমাছের মতো ঘাই মারতে শুরু করেছে।
ছুটতে ছুটতে বিল্ডিং-এ এসে ঝামেলায় পড়ে গেলাম। নিচের তলার লোহার গেটে তালা দেয়া। উপরের তলায় মূল দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বারোটা না বাজতেই এ অবস্থা কেন আজ বুঝতে পারছি না। মাহমুদমিয়া বারান্দায় তাঁর চৌকিতে কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। চৌকির নিচে একটা ‘আইল্যা’ অর্থাৎ মাটির পাতিলে কাঠকয়লার আগুন জ্বলছে। রাতের বেলা তাঁর কাজটা নাইটগার্ডের। কিন্তু যেভাবে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছেন! আজ কী হলো সবার!
মাহমুদমিয়াকে না ডেকে বারান্দার ডানদিকে বেলকনিতে যাবার দরজা সশব্দে খুললাম। আশা করেছিলাম এই শব্দে মাহমুদমিয়া জেগে যাবেন। কিন্তু মাহমুদমিয়ার নাসিকাগর্জন অব্যাহত ধ্বনিতে চলতে লাগলো। বেলকনি দিয়ে হেঁটে দেখলাম দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের রুমের বন্ধ জানালায় আলোর আভাস দেখা যায় কি না। কাজ হলো না। দক্ষিণ পশ্চিমের এই রুমে এখলাস থাকতো। সে চলে যাবার পর আজমভাই এসেছেন। আজমভাই সম্ভবত বাড়ি গেছেন। নইলে তো ভিসিআর-এ সিনেমা দেখতেন। বেলকনির শেষ প্রান্ত থেকে মাহমুদভাইয়ের রুমের জানালা দেখা যায়। অন্ধকার। মাহমুদভাইয়ের ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। তাঁর তো লেখাপড়া করার কথা। তিনি সম্ভবত রুমে নেই। সাইফুদ্দিন আর ফজলুও সম্ভবত বাড়ি গেছে।
ঘুমন্ত কাউকে জাগাতে ইচ্ছে করছে না। যার জেগে থাকার কথা সেই মাহমুদমিয়া যেভাবে গভীর ঘুমে মগ্ন – তাঁকেও জাগাতে ইচ্ছে করছে না। আরেকটু দেখি বিকল্প কোন পথ পাওয়া যায় কি না। না হলে তো মাহমুদমিয়াকেই জাগাতে হবে সবার আগে।
দোতলার বারান্দার কোণায় মূল দরজা। অনেক ঠেলাঠেলিতেও কাঠের ভারী দরজা খুললো না। মুকিতভাই বাড়িতে গেছেন। তৌহিদভাই আছেন জানি। কিন্তু তাঁর রুম একেবারে পূর্বদিকের দোতলায়। এদিক থেকে যাবার কোন সুযোগ নেই। এক কাজ করা যেতে পারে। ছাদে উঠে দেখা যেতে পারে ছাদের দরজা খোলা আছে কি না। যদি থাকে ভালো, না থাকলে ছাদ থেকে তৌহিদভাইকে ডাকতে সুবিধা হবে। তৌহিদভাইয়ের রুমের উপরে গিয়ে ছাদে লাফালাফি করলে ভয় পেয়ে জেগে যাবেন। তৌহিদভাই জ্বিনে বিশ্বাস করেন।
এদিকের বেলকনি ঘেঁষে বড় আমগাছ – উঠে গেছে ছাদ পর্যন্ত। কুয়াশায় গাছের ডাল একটু পিচ্ছিল হয়ে আছে। ডাল বেয়ে ছাদে উঠতে খুব একটা অসুবিধা হলো না। গাছ থেকে ছাদে নামার সময় মনে হলো মাহমুদমিয়ার গলা শুনতে পেলাম – হেই হেই হেই হেই। সম্ভবত ঘুমের মধ্যে কথা বলছেন।
যা ভেবেছিলাম তাই – ছাদের দরজা খোলা আছে। আহ্, কী শান্তি। মনে পড়লো দুপুরে গোসল করে জামাকাপড় শুকাতে দিয়েছিলাম ছাদে। পুবদিকের তারে সেগুলি ঠান্ডা হয়ে ঝুলছে। জামাকাপড় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দু’ধাপ নামার পর হঠাৎ চোখের উপর টর্চের তীব্র আলোয় আঁৎকে উঠলাম।
“হিবা কন্?” – এদিক দিয়ে দোতলায় ঢোকার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাহমুদমিয়া।
“অ-নে উডি গেইয়ন গই?”
আমার মুখের উপর টর্চের আলো ফেলেই টর্চ নিভিয়ে ফেলেছেন মাহমুদমিয়া। বললাম, “আমি তো আপনাকে না জাগানোর জন্যই এদিক দিয়ে এলাম।“
“দরজা খোলা ছিল তো।“
“কী বলেন? দরজা বন্ধ ছিল। আমি তো অনেকক্ষণ ঠেলাঠেলি করলাম।“
“দরজা খোলা ছিল।“ – মাহমুদমিয়া নিচুস্বরে বিড়বিড় করে আবারো বললেন। মাহমুদমিয়া নিশ্চয় মিথ্যা কথা বলবেন না আমার সাথে। গাছ বেয়ে কাউকে উঠতে দেখে তিনি জেগে উঠে – হেই হেই করে উঠেছিলেন। তারপর এদিকে এসেছেন ছাদে উঠে দেখার জন্য। নাইটগার্ডের দায়িত্ব তিনি ঠিকমতোই পালন করছেন। কিন্তু দরজা খোলা ছিল বলছেন কেন?
মাহমুদমিয়ার পেছন পেছন দোতলার করিডোর দিয়ে এলাম মেইন দরজায়। এসেই বুঝতে পারলাম কী বোকামিটাই আমি করেছি। যে দরজা ভেতর থেকে টেনে বন্ধ করতে হয়, সেটা তো বাইরে থেকে টেনেই খুলতে হবে। আমি ঠেলাঠেলি করেই ভেবেছি দরজা বন্ধ! মাহমুদমিয়াকে কিছু না বলে চুপচাপ রুমে চলে এলাম। মাহমুদমিয়া নিশ্চয় বুঝে গেছেন আমার বুদ্ধির দৌড় কতটুকু।
***
আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবন এখনোপর্যন্ত রাজাকারদের দখলে। সেখানে স্বাধীনতার কোন উৎসব তো দূরের কথা – কোন আনুষ্ঠানিক আলোচনাও হয় না। প্রফেসর আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন উপাচার্য হবার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ছাত্রশিবির ক্রমশ বুঝতে পারছে প্রফেসর মোহাম্মদ আলীর কাছ থেকে তারা যতটুকু সুবিধা পেয়েছিল এখন তা পাবে না, তারা ক্রমশই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। বিজয় দিবস উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একটি আলোচনাসভা করার কথা ছিল ১৭ ডিসেম্বর। ছাত্রশিবির তা বাঞ্চাল করার জন্য অবরোধ ডেকেছে।
ক্যাম্পাসে এখনো শিবিরের কথাই শেষ কথা। তবে একটা পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। চাকসু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। আর দেড় মাস পরেই ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চাকসু নির্বাচন হবে। শিবিরের বিরুদ্ধে সব প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন এক জোট হবার প্রক্রিয়া চলছে। আর শিবির ক্রমশ আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। হল থেকে প্রতি রাতেই কাউকে না কাউকে মেরে বের করে দিচ্ছে।
ইতোমধ্যে আমাদের ডিপার্টমেন্টে পিকনিকের আয়োজন করে ফেলা হয়েছে। ডিসেম্বরের ২২ তারিখ শুক্রবার সকাল সাতটায় ফ্যাকাল্টি থেকে বাস ছাড়ার কথা। পিকনিক কমিটির নেতারা – আমান, মিজান, দৌলতুজ্জামান দুলাল, শাহাবুদ্দিন – সবাই জোর দিয়ে বলেছে – ক্যাম্পাস থেকে সকাল সাতটাতেই বাস ছেড়ে দেবে। তার মানে সকাল সাতটার মধ্যেই ক্যাম্পাসে থাকতে হবে। যারা শহর থেকে যাবে – তাদের জন্য মুরাদপুরে বাস থামবে। সকাল আটটায় তাদের মুরাদপুরে থাকতে হবে।
সময়ের ব্যাপারে আমার খুতখুতানি আছে। শুক্রবার সকাল সাতটার মধ্যে ক্যাম্পাসে পৌঁছানোর জন্য ছড়ারকুল থেকে হন্টন ছাড়া উপায় নেই। দুই পায়ে সোজা হেঁটে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে যীশু নাম দিয়েছে ‘নাম্বার ইলেভেন বাস’। প্রদীপনাথ বৃহস্পতিবারে আমার রুমে চলে এসেছিল। শুক্রবার সকাল সাড়ে ছ’টায় আমাদের নাম্বার ইলেভেন বাস চালিয়ে দিলাম রেললাইন ধরে।
রুম থেকে বের হয়ে রেললাইন ধরে আধঘন্টা স্বাভাবিক গতিতে হেঁটেই আমরা ইউনিভার্সিটির রেলগেইটে পৌঁছে গেলাম। এই কাজটা তো চাইলে প্রতিদিনই করতে পারি। কিন্তু প্রতিদিন করার কথা শুনে নাথ দুর্বাশা মুনির দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। সে পৈতাধারী ব্রাহ্মণ মানুষ। পৌরাণিক যুগ হলে তার এই দৃষ্টিতে আমি ভস্ম হয়ে যেতাম। ঘোর কলিযুগে জন্মানোর অনেক সুফল আছে।
রেলগেইটে পৌঁছেই দেখলাম কক্সবাজার লাইনের একটি বাস যাচ্ছে ফ্যাকাল্টির দিকে। বোঝাই যাচ্ছে পিকনিকের জন্য ভাড়া করা হয়েছে। হোয়াট এ টাইমিং! দৌড়ে উঠে গেলাম বাসে।
সোহরাওয়ার্দীর সামনে চৌরাস্তায় গিয়ে বাস ঘুরিয়ে থামলো সোহরাওয়ার্দীর গেটের সামনে। আমরা দু’জন ছাড়া পিকনিকের আর কারো দেখা নেই। সকাল সোয়া সাতটা বেজে গেছে। প্রদীপ নাথ আমার দিকে আবার অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করার জন্য তাকাতেই আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। সে অনেকবার বলেছে – আটটার আগে বাস কিছুতেই ক্যাম্পাস ছাড়বে না। কিন্তু আমিই তাকে ঠেলেঠুলে অত সকালে রুম থেকে বের করে নিয়ে এসেছি।
হাতে সময় থাকলেই সেই সময়টা সিগারেট টেনে ধ্বংস করতে হয় – এটা প্রদীপনাথের থিওরি। বাস থেকে নেমে সে সেই কাজ করতে দেরি করলো না। হলের সামনের ঝুপড়ি দোকানের ঝাঁপ সবেমাত্র খুলেছে। নাথ সেখান থেকে সিগারেট কিনে মুখে জ্বালিয়ে আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বাসের দিকে আসতে গিয়ে হঠাৎ সিগারেট লুকিয়ে সোহরাওয়ার্দীর গেটের দিকে হাঁটা দিলো। দেখলাম রশীদুন্নবী স্যার আসছেন বাসের দিকে। আর কোন স্যার-ম্যাডাম যাবেন কি না জানি না। ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হিসেবে স্যার যাচ্ছেন আমাদের সাথে।
ডিপার্টমেন্টের পিকনিকের আয়োজন যারা করে তারা জানে – ঝামেলা কাহাকে বলে, কতপ্রকার ও কী কী। বাসে জিনিসপত্র উঠাতে উঠাতে, এটা ওটা করতে করতে, একে ওকে ডাকতে ডাকতে অবশেষে সোয়া আটটায় বাস রওনা দিলো। শামসুন্নাহার হলের সামনে গেলো আরো বিশ মিনিট। আমাদের ক্লাসের মেয়েদের চেনা যাচ্ছে না। এত সকালেই এত সেজেছে!
পিকনিকের বাসে মাইক থাকবে না তা তো হয় না। মাইক লাগানো হয়েছে। কিন্তু মাইকের ব্যাটারিতে গন্ডগোল, তাই ওটা বাজছে না। মুরাদপুর এসে মাইকের ব্যাটারি জোগাড় করার জন্য গেলো আরো অনেকক্ষণ। যীশু, অর্পণ, ফারুক, মানস – মুরাদপুর থেকে উঠলো। অবশেষে এগারোটায় শহর থেকে কক্সবাজারের দিকে রওনা দেয়া গেল।
পিকনিকের গন্তব্য হিসেবে খুবই কমন জায়গা হলো কক্সবাজার। পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিদের বেড়ানোর কমন জায়গা নাকি দীপুদা অর্থাৎ দীঘা, পুরী, দার্জিলিং। সেভাবে আমাদেরও বেড়ানোর কমন জায়গা হলো বারাক – বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার।
সাড়ে তিনটা বেজে গেলো কক্সবাজার পৌঁছতে। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে মোটেল পান্থনিবাসে। স্যার আর মেয়েরা থাকছে অন্য জায়গায়- হোটেল তাজসেবায়।
আমাদের ক্লাসের মধ্যে অনেকেই এই প্রথমবার এলো কক্সবাজার। আমিও যে আগে অনেকবার এসেছি তা নয়। এই নিয়ে চারবার এলাম। চট্টগ্রামের ছেলে হিসেবে আমার আরো অনেকবার আসা উচিত ছিল।
খাবার খেতে খেতে সূর্যাস্ত হয়ে গেলো। অনেকে সূর্যাস্ত দেখার জন্য তাড়াহুড়ো করে সৈকতে চলে গেছে। আমরা খেয়েদেয়ে রুমে ব্যাগট্যাগ রেখে আস্তেধীরে বের হলাম। সন্ধ্যা সাতটার দিকে সমুদ্রসৈকতে।
সমুদ্রের আলাদা একটা ব্যাপার আছে। বিশালত্ব ছাড়াও আরো একটা অদৃশ্য অনুভবের ব্যাপার ঘটে সমুদ্রের কাছে গেলে।
যীশু বিশাল এক ক্যামেরা নিয়ে এসেছে। আমাদের মধ্যে সে হচ্ছে সবচেয়ে সৌখিন এবং আধুনিক-প্রযুক্তি-ব্যবহার-সক্ষম মানুষ। মাঝে মধ্যেই ঝলসে উঠছে তার ক্যামেরার ফ্লাশ। সমুদ্রের পানি অন্ধকারে খুব বেশিদূর দেখা যাচ্ছে না। বাতাস আর পানির ঢেউয়ের মিশ্রণে একটা অদ্ভুদ শব্দ হচ্ছে। দীলিপ আর প্রদীপনাথ মুখ থেকে চিমনির মতো ধোঁয়া ছাড়ছে। শফিক ইতোমধ্যে কয়েকটা ঝিনুকের মালা কিনে গলায় ঝুলিয়ে ফেলেছে। আগ্রহ ভরে মালা কিনে নিজে পরতে আর কোন ছেলেকে দেখিনি আগে।
সমুদ্রের অন্ধকার আরো ঘন হয়ে গেছে। সৈকতের ঝিনুক-মার্কেটে গিজগিজ করছে মানুষ। এই মার্কেটে ঢোকার ইচ্ছে আমাদের গ্রুপের কারোরই নেই। আমরা হাঁটতে লাগলাম সিটি সেন্টারের দিকে।
কক্সবাজার ছোট্ট একটা শহর। ট্যুরিস্টদের জন্যই সবকিছু সাজানো। আমরা যারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি – আমাদেরকে এরা ট্যুরিস্ট বলে মনে করে না। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে বার্মিজ মার্কেটের সামনে এসেই দেখা গেলো আমাদের ক্লাসের মেয়েরা এবং ছেলেদের অনেকেই এখানে কেনাকাটা করছে। বেড়াতে গেলে সম্ভবত মানুষের জিনিসপত্র কেনার ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। জায়গা দেখার চেয়েও জিনিসপত্র দেখার আগ্রহ বেশি দেখা যায় অনেকের মধ্যে।
বার্মিজ মার্কেটে বিক্রেতাদের প্রায় সবাই বার্মিজ মেয়ে। সবাই দু’গালে সাদা সাদা ক্রিমজাতীয় কিছু একটা লাগিয়ে রেখেছে। জিনিসটা কী – বোঝার চেষ্টা করছি – এমনসময় কানের কাছে কেউ একজন বলে উঠলো – “ঐ মেয়ের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”
চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি রিনা। তার হাতে বেশ কয়েকটি শপিং-ব্যাগ।
“তোরা কি বাস থেকে নেমেই এখানে ঢুকে গিয়েছিলি নাকি? এর মধ্যেই এত বাজার করে ফেলেছিস?”
“এত আর কোথায়? একটা বার্মিজ শাল কিনতে চাচ্ছি। এইটা দেখতো – কেমন?” দোকানে ঝোলানো একটা ফুটফুটে রঙিন শাল টেনে ধরে বললো।
“আমাকে জিজ্ঞেস করে কোন লাভ নেই। আমি যে কালার-ব্লাইন্ড সেটা তো তুই জানিস। আর আমি জামা-কাপড়ের কিছুই জানি না।“
“তা জানবি কেন? সিগারেট টানতে তো জানিস।“
এ তো মহাবিপদে পড়লাম। সবাই আমাকে সিগারেটখোর মনে করছে কেন?
“আচ্ছা, তুই কি আমাকে সিগারেট টানতে দেখেছিস কখনো?”
“দেখি নাই। কিন্তু তুই নিশ্চয় টানিস। তোর জন্যই তো ঐ প্রদীপ সিগারেট ছাড়তে পারছে না। তুই তাকে সিগারেট ধরিয়েছিস।“
আমার তো এখন ধরণী-দ্বিধা-হও অবস্থা। আমি নাথকে সিগারেট ধরিয়েছি! নাথ সিগারেট টানছে মনে হয় প্রাইমারি স্কুল থেকে। জিজ্ঞেস করলাম, “তোকে এসব কে বলেছে?”
“ঐ প্রদীপ বলেছে।“
দেখলাম মার্কেটে ঢোকার মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে হিহি করে হাসছে প্রদীপনাথ। তার হাতে এখনো সিগারেট জ্বলছে।
রাতে স্যারসহ সব মেয়েরা আমাদের হোটেলে এসে খাওয়া-দাওয়া করার পর আবার স্যারের সাথেই চলে গেলো। স্যার যাবার আগে বলে গেলেন, “কাল খুব ভোরে আমি চলে যাবো। ডিপার্টমেন্টে আমার একটা জরুরি মিটিং আছে। তোমরা টেকনাফ থেকে ফিরে দুপুরের পরেই রওনা দিও যেন সন্ধ্যার আগেই ক্যাম্পাসে ফিরে আসতে পারো।“
আমাদের রুমগুলিকে গণরুম বলা চলে। একেক রুমে আটটি করে সিঙ্গেল বেড। মিলিটারি ব্যারাকের মতো ব্যবস্থা। ভোর পর্যন্ত কাটলো তাস খেলে। মানস, যীশু, ফারুক, দীলিপ খেলার সময় এত উত্তেজিত হয়ে যায়, এত চিৎকার-চেঁচামেচি করে – অবিশ্বাস্য।
শনিবার ভোর হবার অনেক আগেই সৈকতে চলে গেলাম। কক্সবাজারের সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখা যায়। কিন্তু সূর্যোদয় দেখা যায় না। কিন্তু সূর্য ওঠার সময়ের আলোটা সমুদ্রে এসে পড়ে – অদ্ভুত সুন্দর লাগে তখন। এসব প্রাকৃতিক কারণেই সমুদ্র কখনো পুরনো হয় না। এখানে প্রতিদিন এলেও একঘেয়ে লাগার কথা নয়।
হোটেলে ফিরে সাতটার মধ্যে বের হয়ে গেলাম সবাই। হোটেলের রুম ছেড়ে দিয়ে বাসে গিয়ে উঠলাম। সাতটার দিকে বাস ছাড়লো টেকনাফের উদ্দেশ্যে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফের দূরত্ব প্রায় আশি কিলোমিটার। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্বের চেয়ে মাত্র বিশ কিলোমিটার কম। এদিকের বাসের রাস্তা এখনো তেমন ভালো নয়। কিন্তু দুপাশের দৃশ্য খুবই সুন্দর। মাঝখানে এক জায়গায় বাসের চাকা বদলাতে হলো। সেখানে সবাই নেমে কিছু ছবি তোলা হলো। তিন ঘন্টা লেগে গেলো টেকনাফ পৌঁছাতে।
নাফ নদীর পাড়ের প্রকৃতি কী যে সুন্দর। নদীর ওপারে বার্মা। এত সুন্দর জায়গা, অথচ কিছু সংঘবদ্ধ চোরাচালানির কারণে পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে। এখানে তেমন কোন মার্কেট নেই, কিন্তু অনেকেই হাতে করে জিনিসপত্র বিক্রি করছে। বার্মিজ আচার, কাপড় এরকম আরো অনেককিছু।
ফারুক হঠাৎ বমি করতে শুরু করলো। সম্ভবত সারারাত না ঘুমানোর ফল। তাকে ডাবের পানি খাইয়ে কিছুটা সুস্থ করা হলো। এক ঘন্টার মধ্যেই অ্যাবাউট টার্ন। এবার বাসে উঠে দেখা গেলো প্রায় প্রত্যেকেরই হাতে কিছু না কিছু সামগ্রী। বার্মিজ আচার কেন এত প্রিয় সবার জানি না। আর থামি টাইপের কিছু কাপড়ও কিনেছে মেয়েদের কেউ কেউ। পথে নাকি বিডিআর চেকপোস্ট আছে। শুনে সবাই বার্মিজ জিনিসপত্র লুকোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি কিছুই কেনাকাটা করিনি। আইরিন এসে এক প্যাকেট কাপড় দিয়ে গেল আমার ব্যাগে রাখার জন্য।
পথে কোন চেক হলো না। কক্সবাজার ফিরে এসে খেয়েই আমরা রওনা দিলাম। বাসে উঠেই যে যেভাবে পারে চিৎকার চেঁচামেচি করে শুরু করলো গান ও নাচ। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সবার গলা গেল বসে। তারও ঘন্টাখানেক পর ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো সবাই।
ক্যাম্পাসে যাবার পথে ছড়ারকুলে নেমে গেলাম আমি আর প্রদীপনাথ। রুমে ঢুকেই মনে পড়লো আইরিনের কাপড় রয়ে গেছে আমার ব্যাগে।
পরদিন ক্লাসে গিয়ে আইরিনের কাপড়ের প্যাকেটটা দিয়ে দিলাম। ক্লাস হলো না কিছুই। শিবির আবার ধর্মঘট ডেকেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শীতকালীন ছুটি হয়ে গেল জানুয়ারির ১৫ তারিখ পর্যন্ত।
ফ্যাকাল্টির সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রিনা বললো, “খুব যে বলছিলি জামা-কাপড়ের কিছুই চিনিস না। আইরিনের জন্য কাপড় কীভাবে কিনলি?”
No comments:
Post a Comment