চিত্র ১: সূর্যের বলয়গ্রাস |
পৃথিবীর আকাশে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অথচ বিস্ময়কর ঘটনা সূর্যগ্রহণ। আমরা জানি সূর্যগ্রহণ কেন ঘটে। পৃথিবীর আকাশে আমরা প্রতিদিন সূর্যকে দেখতে পাই। সূর্যের মতোই আরো লক্ষ কোটি তারা দেখা যায় পৃথিবীর আকাশে। কিন্তু তারা এত দূরে যে তাদের আলো দিয়ে আমরা পৃথিবীর তেমন কিছু করতে পারি না। আমাদের পৃথিবী সূর্য নামক তারার গ্রহ। আমাদের সূর্য পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ কোটি ২০ লক্ষ কিলোমিটার দূরে। এত দূরে বলেই পৃথিবী থেকে এত বড় (ব্যাস ১৩ লক্ষ ৯২ হাজার কিলোমিটার) সূর্যকে একটা বড় গোল থালার মতো দেখায়।
পৃথিবী সূর্যের চারপাশে প্রতি সেকেন্ডে ৩০ কিলোমিটার অর্থাৎ ঘন্টায় প্রায় ১ লক্ষ ৮ হাজার কিলোমিটার বেগে ঘুরছে। এই প্রচন্ড গতিশীল গ্রহের বাসিন্দা আমরা – পৃথিবী থেকে সূর্যকে দেখতে পাই। কিন্তু পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর ২৪ ঘন্টায় একবার ঘুরে। তাই সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান বদলে যায়। সেজন্য আমরা সূর্যকে কিছুক্ষণ দেখি – কিছুক্ষণ দেখি না। যতক্ষণ দেখি – ততক্ষণ দিন, আর যতক্ষণ দেখি না, ততক্ষণ রাত।
আবার পৃথিবীর আছে একটি উপগ্রহ – আমাদের একমাত্র চাঁদ। এই চাঁদ সূর্যের আকারের তুলনায় অনেক অনেক ছোট (ব্যাস ৩,৪৭৪ কিলোমিটার)। কিন্তু পৃথিবী থেকে দূরত্বের তুলনায় চাঁদ সূর্যের চেয়ে অনেক কাছে। পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব তিন লক্ষ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। সূর্য ও চাঁদের আকারের অনুপাত ৪০০:১। আবার পৃথিবী থেকে সূর্য ও চাঁদের দূরত্বের অনুপাতও প্রায় ৪০০:১। এই কারণে পৃথিবী থেকে দেখলে চাঁদ ও সূর্যকে প্রায় সমান আকারের বলে মনে হয়। তাই চাঁদের ছায়া যদি সূর্যের উপর পড়ে - সূর্য পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যেতে পারে সেই ছায়ার নিচে।
চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চারপাশে। কেউ কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও থেমে নেই। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর চাঁদ পৃথিবী এবং সুর্যের মাঝখানে এসে পড়ে। তখন চাঁদের ছায়া পৃথিবীর উপর পড়ে। ফলে পৃথিবীর যেদিকে এই ঘটনা ঘটে সেই অঞ্চল থেকে সূর্যকে দেখা যায় না। সূর্যের এভাবে ছায়াচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনাই হলো সূর্যগ্রহণ।
চাঁদের ছায়া পৃথিবীর উপর পড়তে হলে সূর্য, চাঁদ ও পৃথিবীকে একই সরলরেখায় আসতে হবে এবং চাঁদ ও পৃথিবীকে একই তলে থাকতে হবে। মাসে দুইবার চাঁদ পৃথিবীর কক্ষতল অতিক্রম করে। এই দুই দিনের কিছুটা সময় চাঁদ, পৃথিবী ও সূর্য একই সমতলে আসে।
প্রতি অমাবস্যায় চাঁদ পৃথিবী ও সূর্য একই সরলরেখায় আসে। সেই সময় চাঁদ পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে আসে। কিন্তু সব অমাবস্যায় সূর্যগ্রহণ হয় না। কারণ সূর্যগ্রহণ হতে হলে চাঁদের ছায়া পৃথিবী পর্যন্ত এসে পৌঁছাতে হবে। চাঁদের ছায়ার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ লক্ষ ৭৪ হাজার কিলোমিটার। কিন্তু পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। এই গড় দূরত্বে চাঁদের ছায়া পৃথিবীতে এসে পৌঁছায় না।
কিন্তু চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে যে পথে ঘুরে সেই পথটা অনেকটা উপবৃত্তাকার। ফলে চাঁদ এক সময় পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসে, আবার অনেক দূরে চলে যায়। চাঁদ যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে চলে আসে তখন পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব হয় ৩ লক্ষ ৬৩ হাজার ৩০০ কিলোমিটার। সেই সময় চাঁদের ছায়া সহজেই পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে সূর্যগ্রহণ হওয়ার শর্ত অনেকগুলি। চাঁদ, পৃথিবী ও সূর্য একই তলে থাকতে হবে, একই সরলরেখায় থাকতে হবে এবং চাঁদ ও পৃথিবীর দূরত্ব হতে হবে গড় চাঁদের ছায়ার দৈর্ঘ্যের চেয়ে কম।
চিত্র ২: সূর্যগ্রহণের প্রক্রিয়া |
চাঁদের যেদিকে সূর্য থাকে তার বিপরীত দিকে চাঁদের দু’রকম ছায়া উৎপন্ন হয় – প্রচ্ছায়া এবং উপচ্ছায়া। চাঁদের তুলনায় সূর্য অনেক বড়। ফলে অনেক বড় আলোক-উৎস থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট চাঁদের উপর আলো পড়লে চাঁদের অন্যদিকে ছায়া তৈরি হয়। সেই ছায়ার মাঝখানের একটি অংশে সূর্য থেকে কোন আলো পৌঁছায় না। সেটা প্রচ্ছায়া। এই প্রচ্ছায়া ত্রিমাত্রিক কোণ বা শঙ্কুর আকারে ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে একটি বিন্দুতে গিয়ে শেষ হয়। এই বিন্দুটি ছায়াশংকুর শীর্ষবিন্দু বা এপেক্স। প্রচ্ছায়ার চারপাশে সূর্যের আলো-পড়ে সামান্য। সেই সামান্য আলোকিত অংশকে বলা হয় উপচ্ছায়া।
চাঁদের প্রচ্ছায়া পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে পোঁছায় সেই সব অঞ্চল থেকে সেই সময় সূর্যকে দেখা যায় না। সূর্যের কতটুকু অংশ দেখা যায় না – তার ভিত্তিতে সূর্যগ্রহণের নামকরণ হয় – পূর্ণগ্রহণ (total eclipse), আংশিক গ্রহণ (partial eclipse), কিংবা বলয় গ্রহণ (annular eclipse) ।
চিত্র ৩: পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ |
যখন পুরো চাঁদের ছায়ার কারণে সূর্যকে একেবারেই দেখা যায় না তখন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়েছে বলা হয়। প্রায় ছয় সাত মিনিট থাকতে পারে এই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ।
চিত্র ৪: আংশিক সূর্যগ্রহণ |
আর যদি সূর্যকে আংশিক দেখা যায় তখন হয় আংশিক সূর্যগ্রহণ। বেশিরভাগ সূর্যগ্রহণই হয় আংশিক।
চিত্র ৫: সূর্যের বলয়গ্রাস |
বিশেষ অবস্থায় যখন চাঁদের প্রচ্ছায়ার শীর্ষবিন্দু যখন পৃথিবীর আকাশের বেশ কিছুটা উপরে শেষ হয়ে যায়, তখন ঐ প্রচ্ছায়ার একটা বিপরীত ছায়া পৃথিবীতে পড়ে। তখন পৃথিবী থেকে সূর্যের মাঝখানের কিছু অংশ দেখা যায় না। সূর্যকে তখন থালার বদলে কেমন যেন রিং বা বলয়ের মত দেখা যায়। এই অবস্থাকে সূর্যের বলয়-গ্রহণ বলা হয়। এটাকে রিং অব ফায়ার বা অগ্নিবলয়ও বলা চলে।
সরাসরি সূর্যের দিকে না তাকিয়ে পরোক্ষভাবে বিভিন্ন ফিল্টার ও পোলারয়েড চশমা দিয়ে সূর্যগ্রহণ দেখা যায়। অনলাইনেও সরাসরি সূর্যগ্রহণ দেখা যায় অনেকগুলি ওয়েবসাইট থেকে।
সূর্যগ্রহণ চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে অনেকের ভেতরই কিছু কুসংস্কার কাজ করে। এই সময় অনেকেই খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়, বা বাসার সব খাবার ফেলে দেয়। সূর্যগ্রহণ চন্দ্রগ্রহণ সূর্যাস্ত সূর্যোদয়ের মতই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা। পৃথিবীর মানুষের উপর এর আলাদা কোন প্রভাব নেই। আমাদের দৈনন্দিন কাজের উপরও আলাদা কোন প্রভাব নেই। তাই এই সময় খাবার খাওয়া-না খাওয়া নিছক কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়।
তথ্যসূত্র:
১। প্রদীপ দেব, অর্ক ও সূর্যমামা, মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫।
২। প্রদীপ দেব, পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় গ্রহ, মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৬।
৩। প্রদীপ দেব, চাঁদের নাম লুনা, মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭।
চিত্রের উৎস:
চিত্র ১। https://www.maxpixel.net/Solar-Eclipse-Solar-Flare-Halo-Solar-Sun-Eclipse-5326698 (under creative common licence)
চিত্র ২। প্রদীপ দেব, পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় গ্রহ বই থেকে।
চিত্র ৩। https://commons.wikimedia.org/wiki/File:Total_solar_eclipse_2019_at_La_Silla_Observatory.jpg (under creative common licences)
চিত্র ৪। https://commons.wikimedia.org/wiki/File:Partial_Solar_Eclipse_(29096453620).jpg (under creative common licences)
চিত্র ৫। https://commons.wikimedia.org/wiki/File:Annular_solar_eclipse_2012.jpg (under creative common licences)
No comments:
Post a Comment