স্বপ্নলোকের চাবি – ৪০
“অ-দা, গাট্টি-বোঁচ্কা বাইন্ধা হইয়ে নে?” – বলতে বলতে লোকটি
দোকানে ঢুকে গদীতে বসে গেলেন আমার বাবার মুখোমুখি। আমি লোকটিকে চেনার চেষ্টা করছি।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরিচিত মুখও অনেকসময় অপরিচিত ঠেকে। এই মুহূর্তে তাকে আমি চিনতে
পারছি না। ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি বাবার খুবই পরিচিত। বয়সে বাবার চেয়ে অনেক
ছোট হবেন। পরনের লুঙ্গিটা গুটিয়ে হাঁটুর কাছাকাছি তুলে এনেছেন বসার সময়। পাঞ্জাবির
উপর একটা চাদর ভাঁজ করে ঝুলিয়ে রেখেছেন গলার দু’দিকে। লম্বা দাড়ি, মাথায় টুপি। টুপি
তিনি সবসময় পরেন কি না জানি না। সাম্প্রতিক সংযোজনও হতে পারে। কারণ গত ক’দিন ধরে সারাদেশে
মন্দিরভাঙা শুরু হবার পর থেকে হঠাৎকরে টুপির ব্যবহার বেড়ে গেছে। এখন হিন্দুদেরও অনেকে
পকেটে টুপি রাখছে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে।
লোকটি কী ইংগিত করছে তা না বোঝার কথা নয় আমাদের কারোরই। কিন্তু
বাবা লোকটির প্রশ্নের কোন উত্তর দিলেন না। বরং আমাকে মৃদুস্বরে বললেন ভেতরে চলে যেতে।
আমি বুঝতে পারছি কোন অপ্রিয় ব্যাপার আমার সামনে ঘটুক তা তিনি চাচ্ছেন না। কিন্তু আমি
নড়লাম না। দোকানের বইয়ের আলমারির পাশে যেখানে বসেছিলাম – সেখানেই বসে রইলাম।
সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার মতো বাজে। সাধারণত এই সময়ে বাজারভর্তি
মানুষ থাকে। আমাদের দোকানেও ভীড় থাকে অনেক। কিন্তু এখন অন্যরকম পরিস্থিতি। আমাদের এলাকায়
সান্ধ্য-আইন জারি করা হয়েছে। রাত আটটার পর চলাচল নিষিদ্ধ। তাই আজ দোকানে আর কেউ নেই।
আমি বাবার কাছে বসে গল্প করছিলাম। দাদা গেছে কালীবাড়িতে জরুরি মিটিং-এ। বাবার সাহায্যকারী
ছেলেটা গেছে কোন একটা কাজে – সে এলেই দোকান বন্ধ করে ফেলবে।
লোকটি এবার একটু গলা নামিয়ে বাবাকে আবার প্রশ্ন করলেন, “অ-নে
কত্তে যাইবান গই?”
এধরনের প্রশ্ন আমার বাবাকে আগেও অনেকবার শুনতে হয়েছে। ১৯৭১
সালে শুনতে হয়েছে, ১৯৭৫ সালে শুনতে হয়েছে। এখন আবার ১৯৯০-তে এসে শুনতে হচ্ছে। বাবা
না বুঝার ভান করে বললেন, “আমি কোথায় যাবো?”
“কেন? ইন্ডিয়ায়? আপনাদের নিজের দেশে? অবস্থা দেখে বুঝতে পারছেন
না? এখানে হিন্দুরা থাকতে পারবে? আজ নয় কাল তো যেতেই হবে।“
আমার বাবা একটু পরপর আমার দিকে তাকাচ্ছেন। তিনি ভয় পাচ্ছেন
আমি হঠাৎ যদি কিছু বলে বসি বা করে ফেলি। বাবারা সব সময় সন্তানদের সামনে থেকে অপ্রিয়
বিষয় আড়াল করতে চান।
আমার মেজাজ খারাপ হলেও চুপ করে আছি। বাবার সামনে আমি কারো
সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না। আমি লোকটিকে চিনতে পেরেছি। কিছুদিন আগেও গরুর দালালি করতেন।
এখন জমির দালালি করে্ন।
লোকটি এবার আমার দিকে নজর দিলেন। “পোয়া গুরাউবা নে? কত্তে
আইস্যে? মাশাল্লা পোয়া ত ডঁঅর হই গেইয়ে।“
আমার কিছু বলা উচিত কি না বুঝতে পারছি না। অন্য সময় হলে হয়তো
সালাম দিতাম। কিন্তু এখন তিনি সে যোগ্যতা হারিয়েছেন।
“আপনি আমার বড় ভাইয়ের মতো। সেজন্য আপনাকে একটা পরামর্শ দিই।
সময় থাকতে চলে যান। জায়গা-জমির ভালো দাম পাইয়ে দেবো।“
হাসতে হাসতে সুন্দরভাবে যে কথাগুলি তিনি বললেন তা যে কত অপমানজনক
তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। সংখ্যালঘু নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষের
অপমান সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। এই লোকটার কথার পিঠে শক্ত কথার উত্তর দিয়ে
ঝগড়া করা যায়। কিন্তু তাতে কি অবস্থার পরিবর্তন হবে কোন কিছুই? এই লোকটা তো একা নয়।
যেকোনো দেশেই – বিশেষ করে যেসব দেশে ধর্মের দোহাই সবচেয়ে বড় দোহাই – ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা
বড়ই অসহায়। অনেক অপমান তাদের নিরবে সইতে হয়।
বাবার সাহায্যকারী ছেলেটা আসার সাথে সাথে বাবা তাকে দোকান
বন্ধ করার আদেশ দিয়ে আমাকে হাত ধরে নিয়ে এলেন ঘরের ভেতর। দোকানের পেছনেই আমাদের বাড়ি। আমি বুঝতে চেষ্টা করছিলাম
কী চলছে বাবার মনের ভেতর।
পরীক্ষা শেষ হবার দু’দিন পরেই বাড়ি চলে এসেছি। সেই সময় থেকেই
সারাদেশে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ক্রমশ বেগবান হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে
আটটি সমমনা দলের জোট, বিএনপির নেতৃত্বে সাতটি সমমনা দলের জোট, এবং কমিউনিস্ট পার্টির
নেতৃত্বে পাঁচটি বামপন্থী দলের জোট একসাথে প্রায় অভিন্ন কর্মসূচীতে এরশাদের বিরুদ্ধে
আন্দোলন চালাচ্ছে। ছাত্রসংগঠনগুলি সব একজোট হয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন করেছে। একটা
ব্যাপার খুবই ভালো লাগছে – তা হলো জামায়াতে ইসলামীকে কোন দলের জোটেই নেয়া হয়নি। একই
ভাবে সর্বদলীয় ঐক্যে ছাত্রশিবিরের ঠাঁই হয়নি। তাই এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এদের ভূমিকা
চোখে পড়ার মতো কিছু নেই। ছাত্রশিবির এখনো ক্যাম্পাস দখল করে রেখেছে – এতেই তাদের একমাত্র
সুখ।
অক্টোবরের দশ তারিখে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘটে পুলিশ
গুলি চালিয়ে পাঁচজনকে হত্যা করেছে। আহত করেছে পাঁচ শয়ের বেশি মানুষকে। তাতে আন্দোলন
আরো বেগবান হয়েছে। এর পর থেকে প্রতিদিন হরতাল, অবরোধ বিক্ষোভ হচ্ছে আর পুলিস সবখানে
গুলি করে মানুষ মারছে। দেশের প্রত্যেকটা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ হচ্ছে। সম্ভবত একমাত্র
ব্যতিক্রম আমাদের ক্যাম্পাস। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এখনো শিবিরের নিয়ন্ত্রণে। নির্বাচিত
চাকসুর সর্বদলীয় নেতাদের যা কিছু কার্যক্রম তা শহরকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।
অক্টোবরের মাঝামাঝি ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর – প্রত্যেকটি
বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে ছাত্রদের। অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আহত
হচ্ছে প্রতিদিন পুলিসের গুলিতে। এরশাদ সরকার বুঝতে পারছে এই আন্দোলন থামার নয়। শিক্ষার্থীদের
থামানোর জন্য দেশের সবগুলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ আদেশে বন্ধ করে দেয়ার ক্ষমতা সরকারের
আছে – এই মর্মে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (আইন ও শৃঙ্খলা) অধ্যাদেশ ১৯৯০ জারি করা হয়েছে। এর
আওতায় সরকার রাজশাহী ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয় ১৭ অক্টোবর। ২০ অক্টোবর ঢাকা
ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়ার আদেশ দেয়া হয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে
রিট জারি করা হয়। ২৪ অক্টোবর হাইকোর্ট সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চায় – কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
অধ্যাদেশ অসাংবিধানিক বা বে-আইনি ঘোষণা করা হবে না।
প্রতিদিনই বিক্ষোভ হচ্ছে এরশাদের বিরুদ্ধে। দেশের সবগুলি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এরশাদ সরকার বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যেই ছাত্রবিক্ষোভ
চলছে। ২৭ অক্টোবর সারাদেশে রাজপথ রেলপথ অবরোধ করা হলো। সারাদেশ ফুঁসে দাঁড়াচ্ছে এরশাদের
বিরুদ্ধে।
আমি বাড়িতে বসে পত্রিকায় খবরগুলি পড়ছি আর ছটফট করছি – কখন
শহরে যাবো, এই বিক্ষোভের অংশ হবো। বিক্ষোভ এখনো শহরকেন্দ্রিক, গ্রাম বা উপজেলায় সেভাবে
ছড়ায়নি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংবাদ দেখলে মনে হয় – বাংলাদেশের মতো শান্তিপূর্ণ দেশ
পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
যেকোনো স্বৈরাচারী সরকারই ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শেষ অস্ত্র
হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে। এরশাদও তাই করলেন। ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রাম শহর থেকে শুরু
হলো সাম্প্রদায়িক হামলা। হঠাৎ চট্টগ্রাম শহরের সবগুলি মন্দিরে একযোগে আগুন লাগানো হলো।
এরশাদের ভাড়াকরা গুন্ডারা পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দিলো সদরঘাট কালীবাড়ি, চট্টেশ্বরী কালীবাড়ি,
কৈবল্যধাম, তুলসীধাম -এরকম যত মন্দির আছে সবগুলি। চট্টগ্রামের হিন্দুদের মনে আতঙ্ক
ঢুকে গেলো এক নিমিষেই।
এতদিন ধরে এরশাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ চলছে, অথচ উপজেলা
পর্যায়ে সেই বিক্ষোভ ছড়ায়নি এতদিনেও। অথচ এরশাদের দেয়া মন্দির-পোড়ানোর মন্ত্র মুহূর্তেই
ছড়িয়ে পড়লো একেবারে গ্রামেগঞ্জে। শহরে শুধু মন্দির পুড়েছে। আর গ্রামে গ্রামে শুরু হয়ে
গেছে প্রচন্ড তান্ডব। মন্দিরে আগুন লাগানো, ঘরবাড়ী ভাঙচুর করা, লুটতরাজ, ডাকাতি, মেয়েদের
অপমান – কিছুই বাকি থাকলো না। যারা এসব করলো – তারা কি সবাই এরশাদের পার্টি? এরশাদের
এত সমর্থক যদি সারাদেশে থাকে – তাহলে তো এরশাদকে সরানো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু
আসল ব্যাপারটা অন্যখানে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা যেদেশে লালন করা হয়, সেদেশে মন্দির
পোড়ানোকে অবশ্য-কর্তব্য বলে ভাবার লোকের অভাব থাকে না।
আমাদের উপজেলায় হিন্দুদের গ্রামে, প্রতিষ্ঠানে, মন্দিরে,
বাড়িতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হলো। বাঁশখালীর ঋষিধাম – খুবই বিখ্যাত একটি ধর্মীয়
প্রতিষ্ঠান। পুড়িয়ে শেষ করে ফেলা হলো। মন্দির যখন পোড়ানো হচ্ছিলো – তখন চলন্ত বাসে
চেক করা হচ্ছিলো যদি কোন হিন্দু পাওয়া যায় – জবাই করার জন্য। এরপর থেকে আমাদের গ্রামের
অনেকেই যারা ধুতি পরতো – হঠাৎ লুঙ্গি পরতে শুরু করেছে। গোপনে টুপি কিনে পকেটে রাখতে
শুরু করেছে – কখন দরকার হয় কে বলতে পারে।
চট্টগ্রামের দেখাদেখি পরদিন ৩১ অক্টোবর ঢাকাতেও শুরু হয়ে
গেলো হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ। উভয় পক্ষ একে অপরের উপর আক্রমণ করলে তাকে সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গা বলা চলে। সে অর্থে এরশাদের এই পরিকল্পিত আক্রমণ – সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়। এটা
যে তার ক্ষমতায় থাকার চাল – সেটা বুঝতে পারলেও – সাম্প্রদায়িক মনের উপর তো গণতন্ত্রের
মুক্তির জন্য আন্দোলনকারীদের প্রভাব খুব একটা ছিল না। এই সুযোগে এরশাদ সারাদেশে ১৪৪
ধারা জারি করে দিয়েছে। নভেম্বরের ৪ তারিখ পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামে কারফিউ দিয়ে রেখেছে
– যাতে কেউ কোন আন্দোলন না করতে পারে।
আমাদের গ্রামের অবস্থা খুবই খারাপ। মন ভেঙে গেছে সবার। রাস-পূর্ণিমার
উৎসবের জন্য প্রস্তুতি চলছিলো ব্যাপকভাবে। সব অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা বাতিল করে দিতে
হয়েছে। তার বদলে সবাইকে পালা করে রাত জেগে গ্রাম পাহারা দিতে হচ্ছে – যাতে মেয়েরা,
শিশুরা নিরাপদে বাড়িতে ঘুমাতে পারে। রাত আটটার মধ্যে সারাগ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে।
যে লোকটা আজ এসে আমার বাবাকে ইন্ডিয়া চলে যাবার জন্য হুমকি
দিয়ে গেলো হাসিমুখে – সেই লোকটাই কালকে যদি পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে যায় – এসে
বলবে সে মশকরা করেছিল।
আমার বাবার দিকে তাকালে কেমন যেন মায়া হয়। আবার আশ্চর্যও
লাগে বিপদেও এই মানুষটার স্থির হয়ে থাকার শক্তি দেখে। ১৯৭১ সালে এই মানুষটা একেবারে
নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। পুরোপুরি ভিখারির দশা তখন। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল। আমরা
প্রায় পাঁচ বছর অন্যের বাড়ির বারান্দায় বাস করেছিলাম। মানুষের কাছ থেকে চড়াসুদে টাকা
ধার করে ছোট্ট একটা দোকান চালিয়েছেন আমার বাবা। অমানুষিক পরিশ্রম করে কোন রকমে ঘুরে
দাঁড়িয়েছেন। সেইখানে এসে আজ ১৯৯০ সালে তাঁকে আবার এরকম একটা মানসিক পরিস্থিতিতে দাঁড়
করিয়ে দিয়েছে এরশাদ সরকার। কিন্তু মূল সমস্যা কি এরশাদ? এরশাদের বদলে অন্য কোন সরকার
এলে কি মানুষের মন থেকে এই সাম্প্রদায়িকতা চলে যাবে? ধর্মের নামে অন্যকে ভয় দেখিয়ে
স্বার্থসিদ্ধির প্রবণতা কি কমে যাবে?
নভেম্বরের পাঁচ তারিখের মধ্যেই মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়ালো।
বিক্ষোভ মিছিলের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মিছিলও হলো। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
বন্ধ করে দিলেও সেই আদেশ অমান্য করে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হলো। ১১ নভেম্বর ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় খুলে গেল। আইন অমান্য করে অনুষ্ঠিত হলো সবগুলি ক্লাস। এ তো ক্লাস নয়,
প্রতিবাদ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনও
বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় খুলে যাবার খবর আজাদীতে পাবার পর আমার শহরে
আসার পথ খুলে গেল। বাবাকে অনেক বুঝিয়ে, মাস্টার্সে ভর্তি হতে হবে, ক্লাস শুরু হয়ে যাবে
ইত্যাদি বলে বাড়ি থেকে চলে এলাম।
১৮ নভেম্বর ৮, ৭, ও ৫ দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা
ঘোষণা করলো। এরশাদের পতন এবার হবেই। অনেকদিন পর শহরে এসে বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য
ছটফট করছিলাম। মেসে অজিত ব্যাপকভাবে পড়াশোনা করছে। তাদের মাস্টার্সের পরীক্ষার ডেট
দেয়নি – কিন্তু শীঘ্র হয়ে যাবে। আমাদের রেজাল্টের আগে ক্লাস শুরু হবে না।
১৯ নভেম্বর একটি ঘটনা ঘটলো। সকালে যীশুর বাসায় গেলাম। সে
বেড়ানোর মুডে আছে। শাকপুরা যাচ্ছে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে। প্রদীপ নাথের বাসায় গেলাম।
চকবাজার অলিয়ঁস ফ্রসেজের পাশের গলিতে তারা বাসা নিয়েছে। কিন্তু সে নেই বাসায়। শুনলাম
বাড়িতে গেছে। সবাই ব্যস্ত। আমি পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছি সারা শহর।
ষোলশহর স্টেশনে দেখা হয়ে গেল মাসুদের সাথে। মাসুদ খান আমার
অনেকদিনের বন্ধু। চট্টগ্রাম কলেজে আমরা একসাথে উচ্চমাধ্যমিক পড়েছি। তারপর একসাথেই ফিজিক্সে
ভর্তি হয়েছি। কিন্তু সেকেন্ড ইয়ারে এসে সে সাবসিডিয়ারি ক্লিয়ার করতে পারেনি বলে এক
বছর পিছিয়ে পড়েছে। অনার্স পরীক্ষা সে দিতে পারেনি আমার সাথে। কিন্তু আমার সাথে দেখা
হবার সাথে সাথেই সে বললো, “হ্যাই প্রদীপ, তোমাকেই খুঁজছিলাম আজ ফ্যাকাল্টিতে। মিষ্টি
খাওয়াও।“
কী কারণে মিষ্টি খাওয়াতে হবে আমার সামান্যতম ধারণাও নেই।
আমার হতবিহ্বল অবস্থা দেখে মাসুদ বললো, “তোমাদের রেজাল্ট দিয়েছে তো আজকে।“
“তাই নাকি?”
“তাই নাকি মানে কী? পাঁচজন ফার্স্ট ক্লাস। তুমি ফার্স্ট হয়েছো।“
খবরটা লোভনীয়, তবে অবিশ্বাস্য। কিন্তু মাসুদ সিরিয়াস টাইপের
মানুষ – এরকম কথা সে বানিয়ে বলবে না। তার কাছ থেকে জেনে নিলাম অন্যান্য খবর। হারুন
সেকেন্ড হয়েছে, আনন্দ থার্ড, মইনুল ফোর্থ, আর দীলিপ ফিফ্থ।
মাসুদকে মিষ্টি খাওয়াতে চাইলাম। কিন্তু সে মিষ্টি খেতে রাজি
হলো না।
আমি আগামীকাল সংবাদপত্রে রেজাল্ট রেজাল্ট দেখার আগে খবরটা
কাউকে বলবো না সিদ্ধান্ত নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। শহরের ফুটপাত ধরে হাঁটতে অনেক
আনন্দ। দেশে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। আগামীকাল সারাদেশে হরতাল। হরতালের পক্ষে
মিছিল বের হয়েছে। মুরাদপুরের মোড়ে একটি মিছিলে ঢুকে পড়লাম। হেলাল হাফিজের কবিতার কথা
মনে পড়ছিলো – “মিছিলের সব হাত কন্ঠ পা এক নয়। সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে।
কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার, কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার।“ এই মিছিলে কে সংসারী,
কে সংসার-বিরাগী বোঝার উপায় নেই। কিন্তু সবাই যে স্বৈরাচারের পতন চায় তাতে কোন সন্দেহ
নেই।
মিছিল মুরাদপুর থেকে পাঁচলাইশের মোড়ে এসে সোনালী ব্যাংকের
সামনে ডানদিকে মোড় নিয়ে পাঁচলাইশ থানার সামনে দিয়ে প্রবর্তকের মোড়ে এসে মেডিকেল কলেজের
সামনে চলে এলো। পাঁচলাইশ থানার সামনে অনেকগুলি পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে লাঠিসোটা নিয়ে। ভেবেছিলাম
কাঁদানে গ্যাস বা লাঠিচার্জ করবে। কিন্তু কিছুই করলো না। মনে হচ্ছে প্রশাসনের মধ্যেও
এরশাদবিরোধী মনোভাব দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এটা ভালো লক্ষণ।
মেডিকেল কলেজের সামনে গিয়ে মিছিল একটা মিটিং-এ রূপান্তরিত
হলো। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম এই মিছিলটি ছিল ডাক্তারদের মিছিল। এরশাদ সরকারের স্বাস্থ্যনীতি
– যেখানে সরকারি ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে – বাতিল করার
দাবিতে ডাক্তাররা একজোট হয়ে আন্দোলনে নেমেছেন অনেকদিন থেকে। পেশাজীবীদের মধ্যে ডাক্তাররাই
সবচেয়ে আগে এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছেন।
মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অলিখাঁ মসজিদের
সামনে এলাম। চকবাজার আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে। বইয়ের দোকান হচ্ছে এদিকে একটার পর একটা।
এটা ভালো লক্ষণ। লালচাঁদ রোডের মুখে একটা চকলেট ও আইসক্রিমের দোকান আছে। প্রত্যয়ের
জন্য এক প্যাকেট মিমি কিনে চললাম দিদির বাসার দিকে।
দিদি দরজা খোলার সাথে সাথেই বললো, “তুই এতক্ষণ কোথায় গিয়েছিলি?”
“মুরাদপুরের ওদিকে হাঁটছিলাম।“ – মিছিলের কথা একবারও উচ্চারণ
করলাম না। আন্দোলন, রাজনীতি, মিছিল এসবের ব্যাপারে আমাদের একটা মধ্যবিত্ত-ইফেক্ট আছে।
সেটা হলো আমাদের মা-বাবা দাদা-দিদিরা আমাদেরকে মিছিলে বা আন্দোলনে যেতে দেবে না, কিন্তু
আন্দোলনের ফল ঠিকই ভোগ করবে।
প্রত্যয় ছুটে এসে কোলে উঠার পায়তারা করার আগেই তাকে মিমিটা
দিয়ে দিলাম। মিমি পেয়েই সে মামার কথা সাময়িকভাবে ভুলে গেল। আমার গায়ে পায়ে কয়েক মিলিমিটার
ধুলাবালি জমেছে। বাথরুমে ঢুকলাম।
টেবিলে খাবার দিয়ে দিদি বললো, “প্রদীপ আর তৌহিদ এসেছিল।“
“তাই নাকি? আমি তো প্রদীপের বাসায় গিয়ে তাকে পাইনি।“
“তোদের নাকি রেজাল্ট দিয়েছে। তুই নাকি ফার্স্ট হয়েছিস। ওরা
খবর দিতে এসেছিল।“
দিদি খুব নিরুত্তাপ গলায় বললো। আমিও চুপচাপ শুনলাম। বললাম,
“কালকে পেপার দেখলে বোঝা যাবে।“
রাতে এ প্রসঙ্গে আর কোন কথা হলো না।
পরদিন সকালে পেপার এলো। সংবাদ সঠিক।
হরতালের কারণে আমি ফতেয়াবাদে যেতে পারলাম না। যীশুর বাসায়
গিয়ে শুনলাম সে শাকপুরা থেকে আসেনি।
পরদিন সকালে ফতেয়াবাদ গেলাম। মুকিতভাই বাড়িতে চলে গেছেন।
কখন ফিরবেন কেউ জানে না। অজিতকে পেলাম।
অজিত কোন ভূমিকা ছাড়াই বললো, “আমার সিকো-ফাইভ ঘড়ি কখন দিবি
বল।“
“কিসের সিকো-ফাইভ ঘড়ি?”
সে তার ডেস্ক থেকে একটা কাগজ বের করে আমার হাতে দিয়ে বললো
– “এখানে কী লেখা আছে?”
কাগজটার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার পরীক্ষা চলাকালীন
আমার মনোবল চাঙ্গা করার জন্য অজিত একটা অদ্ভুত বাজি ধরেছিল আমার সাথে। আমি যদি ফার্স্ট
ক্লাস পাই তাহলে আমি তাকে একটি সিকো-ফাইভ ঘড়ি দেবো। আর যদি ফার্স্ট ক্লাস না পাই, তাহলে
সে আমাকে একটি সিকো-ফাইভ ঘড়ি দেবে। স্পেশালি এই ঘড়িটা কেন দিতে হবে তা মনে নেই। দেখলাম
কাগজে আমরা দুজনই দস্তখত করেছিলাম।
হাহাহা করে হাসলাম দুজনে।
এরপর কয়েকদিন সময় খুব দ্রুত গেল। ক্যাম্পাসে প্রতিবাদী ক্লাস
চলছে। এরশাদের আইন অমান্য করে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হয়েছে। আমাদের মাস্টার্সের ক্লাস
শুরু হয়ে গেছে। তিন দিন ক্লাসও করে ফেললাম। প্রামাণিকস্যার কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ক্লাস নিলেন।
মাস্টার্সের কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনার্সের চেয়ে দুর্বোধ্য।
এরশাদ সরকারের বারোটা বাজতে আর দেরি নেই বুঝতে পারছি। কিন্তু
তিনি যে সাম্প্রদায়িকতার সম্প্রসারণ করেছেন – তা যে কীভাবে বেড়েছে তার প্রমাণ পেলাম
একদিন পরেই।
শুক্রবার সকাল দশটার দিকে মসজিদের পুকুরে গোসল করতে গিয়েছি
অন্যান্য দিনের মতো। দেখলাম পাকা ঘাটে বসে আছেন ইমাম সাহেব। আমি জামা-কাপড় রেখে পুকুরে নামার জন্য তৈরি হচ্ছি – তিনি বললেন, “আপনি আমানত
খান বিল্ডিং-এ থাকেন, তাই না?”
“জ্বি”
“কতদিন ধরে থাকেন?”
“চার বছর”
“এই চার বছরে আপনাকে একদিনও মসজিদে দেখলাম না। আপনি কি নামাজ
পড়েন না?”
“জ্বি না।“
“আপনি কি হিন্দু?”
“জ্বি।“
“কিছু মনে করবেন না, এই পুকুরে তো আমরা নামাজিরা অজু করি।
সেখানে আপনি নামাজ-কালাম পড়েন না, পেসাব করে পানি ব্যবহার করেন না, এখানে আপনার গোসল
করাটা কি ঠিক হবে? উচিত হবে? আপনাদের হিন্দুদের পুকুরে কিন্তু আমাদের গোসল করতে দেয়
না।“
“জ্বি, এখানে গোসল করা আমার উচিত হবে না। আমি দুঃখিত। এই
ভুল আর হবে না।“
মাথা নিচু করে চলে এলাম। মনে হলো – কার কৃতকর্মের ফল কে ভোগ
করছে। একসময় হিন্দুদের জাত-প্রথার কারণে মুসলমান তো বটেই, হিন্দুদের অনেকেও পুকুরে
নামা তো দূরের কথা – পুকুরঘাটের কাছ দিয়েও হাঁটতে পারতো না। সেই সবের দায় কেন আমাকে
নিতে হবে জানি না, কিন্তু হলো। যুক্তির বিচারে আমার কষ্ট পাবার কিছু নেই। কিন্তু কেমন
যেন একটু কষ্ট হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment