মহাবিশ্বের দশ হাজার কোটি নক্ষত্রের লক্ষ কোটি গ্রহের মধ্যে পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও এখনো প্রাণের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু মহাকাশবিজ্ঞানীদের অনেকেই ভিনগ্রহে প্রাণ থাকার ব্যাপারে আশাবাদী। মহাকাশে প্রাণের সন্ধানে এপর্যন্ত অনেকগুলি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে, পাঠানো হয়েছে অনেকগুলি বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট। কল্পবিজ্ঞানে ভিনগ্রহের প্রাণিদের যেরকম বুদ্ধিমান পূর্ণাঙ্গ প্রাণী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে – সেরকম প্রাণী খুঁজে পাবার আশা বিজ্ঞানীরা করেন না। কিন্তু কমপক্ষে কোন এককোষী আদি প্রাণীর সন্ধানও যদি পাওয়া যায় তাও অনেক। তাই প্রাণের উদ্ভব ঘটতে পারে এরকম কোন প্রাণরাসায়নিক উপাদান খুঁজে পেলেই বিজ্ঞানীরা আনন্দিত হয়ে উঠেন। আর সারাপৃথিবীর প্রচারমাধ্যম অনেক গুরুত্বসহকারে সেই সংবাদ প্রচার করে। সম্প্রতি শুক্র গ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা আছে এরকম প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
বৃটেনের কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী জেইন গ্রিভ্স এর নেতৃত্বে শুক্রগ্রহের বায়ুমন্ডলের উপাদানের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা হচ্ছে অনেক বছর থেকে। ২০১৭ সালে হাওয়াই-এ অবস্থিত জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল টেলিস্কোপের (JCMT) সাহায্যে শুক্রগ্রহের বায়ুমন্ডলের মেঘের বর্ণালী বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখেছেন সেখানে প্রচুর ফসফিন গ্যাস আছে (প্রায় ২০ পার্টস পার বিলিয়ন)। নিশ্চিত হবার জন্য বিজ্ঞানীরা আরো শক্তিশালী টেলিস্কোপ (চিলির অ্যাটাকামা লার্জ মিলিমিটার/সাবমিলিমিটার অ্যারে – ALAMA) ব্যবহার করেও একই ফল পেয়েছেন। তাঁদের গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নেচার অ্যাস্ট্রোনমি জার্নালে।
পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ফসফিন আছে এর চেয়ে হাজারগুণ কম। এখন প্রশ্ন হলো ফসফিনের সাথে প্রাণের সম্পর্ক কী? এমন তো না যে ফসফিন এর আগে পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায়নি। বৃহস্পতির মত বিশালাকৃতির গ্রহের অভ্যন্তরে প্রচন্ড গ্যাসীয় চাপ এবং উচ্চ তাপমাত্রায় প্রচুর ফসফিন গ্যাস নিত্য তৈরি হচ্ছে। শনিগ্রহেও পাওয়া গেছে এই গ্যাস। তাহলে শুক্রগ্রহে ফসফিন দেখতে পেয়ে বিজ্ঞানীরা এত লাফাচ্ছেন কেন? কারণ শুক্রগ্রহের যেখানে এত বেশি পরিমাণ ফসফিন পাওয়া গেছে – সেই বিষাক্ত সালফিউরিক এসিড সমৃদ্ধ মেঘের আস্তরণের উপরে এত বেশি ফসফিন এক সাথে থাকার একটিমাত্র কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না বিজ্ঞানীরা। সেই কারণটি হলো – জৈবপ্রাণের উপস্থিতি।
ফসফিন একটি খুব সরল সাধারণ দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস যাতে ফসফরাসের একটি পরমাণু তিনটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে যুক্ত থাকে। বৃহস্পতি বা শনির মত বড় বড় গ্রহে প্রচন্ড তাপ ও চাপে প্রাকৃতিকভাবে ফসফিন তৈরি হতে পারে। কিন্তু পৃথিবী বা শুক্রের মত আয়তনে ছোট গ্রহের তাপ ও চাপ আপনাআপনি ফসফিন তৈরির উপযুক্ত নয়। পৃথিবীতে কলকারখানায় এই বিষাক্ত গ্যাস অনেক উৎপন্ন হয়। তাছাড়া কিছু সামুদ্রিক অণুজীব এবং কিছু অ্যানেরোবিক মাইক্রো অর্গানিজম – যেগুলি অক্সিজেন ছাড়াই বাঁচে, জৈবপদ্ধতিতে ফসফিন তৈরি করে। ফসফিন গ্যাস খুব সহজেই বাতাসের অন্যান্য গ্যাসের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় অন্য অণুতে পরিণত হয়। শুক্রগ্রহে যে পরিমাণ ফসফিন পাওয়া গেছে – সেই পরিমাণ ফসফিন সেখানে থাকতে হলে সেই ফসফিনের নিয়মিত জোগানদাতাদেরও থাকতে হবে সেখানে। ফসফিনের নিয়মিত জোগানদাতা হতে পারে অণুজীব।
এখন প্রশ্ন হলো শুক্রগ্রহে কি প্রাণের খোঁজ করা হয়নি এর আগে? ষাটের দশকে যখন মহাকাশে অভিযান শুরু হয়েছে তখন থেকে অনেকবার অভিযান চালানো হয়েছে শুক্রগ্রহে। বুধ, শুক্র ও মঙ্গল - পৃথিবীর কাছাকাছি এই গ্রহ তিনটিতে স্বয়ংক্রিয় নভোযান পাঠানো শুরু হয় ১৯৬১ সালে স্পুটনিক প্রোগ্রামের মাধ্যমে। এপর্যন্ত শুক্র অভিযানের ৪৫টি মিশন পরিচালনা করা হয়েছে। এই ৪৫টি মিশনের মধ্যে ৩২টি মিশন পরিচালনা করেছে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এই মিশনগুলো পরিচালিত হয়। চাঁদে অভিযানে যেমন আমেরিকানদের সাফল্য তুলনামূলকভাবে বেশি, তেমনি শুক্র অভিযানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাফল্য বেশি ছিল। বাকি ১৩টি মিশনের মধ্যে এপর্যন্ত ১০টি মিশন পরিচালনা করেছে আমেরিকা, ১টি জাপান, এবং দুটো মিশন চালায় ইওরোপীয় ইউনিয়ন। আমেরিকান পাইওনিয়ার ভেনাস প্রোগ্রাম, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেনেরা প্রোগ্রাম চলাকালীন সময়ে চালানো হয়েছিল। তারপর ম্যাগেলান পাঠানো হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের ভেনাস এক্সপ্রেস স্যাটেলাইট পাঠানো হয়েছে ২০০৫ সালে। আর জাপানের আকাৎসুকি পাঠানো হয়েছে ২০১০ সালে; ২০১৫ সালে তা শুক্রের কক্ষপথে প্রবেশ করে। শুক্রগ্রহের অনেক অজানা তথ্য পাওয়া গেছে এই স্যাটেলাইটগুলি থেকে।
পৃথিবী ও শুক্র গ্রহের আয়তন প্রায় সমান। শুক্রকে পৃথিবী গ্রহের twin sister বা জমজ বোন মনে করা হয়। কিন্তু শান্ত সবুজ প্রাণসমৃদ্ধ পৃথিবীর সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের গ্রহ শুক্র। শুক্র আক্ষরিক অর্থেই আগুনসুন্দরী। জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির তপ্ত লাভায় আচ্ছাদিত তার শরীর। শুক্রের গড় তাপমাত্রা 464 ডিগ্রি সেলসিয়াস - যা গ্রহগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরতে শুক্রের সময় লাগে 225 দিন। অর্থাৎ শুক্র গ্রহে 225 দিনে এক বছর হয়। কিন্তু শুক্র নিজের অক্ষের ওপর একবার ঘুরতে সময় নেয় পৃথিবীর 243 গুণ। অর্থাৎ পৃথিবী যেখানে এক দিনে নিজের অক্ষের ওপর একবার ঘুরে, সেখানে শুক্র 243 দিনে একবার ঘুরে। তার মানে শুক্রের এক দিন হলো পৃথিবীর 243 দিনের সমান। সবগুলো গ্রহ ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে অর্থাৎ পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে ঘুরে। কিন্তু শুক্র ঘুরে ঘড়ির কাঁটা যেদিকে ঘুরে সেদিকে - অর্থাৎ পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে। তাই শুক্র গ্রহে সূর্য উঠে পশ্চিম দিক থেকে আর অস্ত যায় পূর্ব দিকে।
শুক্র আমাদের পৃথিবীর নিকটতম গ্রহ হলেও, শুক্রের আয়তন ও ভর পৃথিবীর কাছাকাছি হলেও শুক্রের বায়ুমন্ডলের সাথে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কোন মিল নেই। সাড়ে চার শ কোটি বছর আগে জন্মের সময় শুক্র ও পৃথিবীর পরিবেশ হয়তো একই রকম ছিল। কিন্তু তারপর দুই গ্রহের বিবর্তন হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে।
শুক্র গ্রহের বায়ুমন্ডল এতটাই পুরু এবং ভারী যে এর বায়ুমন্ডলের চাপ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের চাপের 90 গুণ। সূর্যের কাছের গ্রহ হওয়ার কারণে শুক্র পৃথিবীর চেয়েও অনেক বেশি সূর্যালোক পায়। কিন্তু শুক্রের ঘন বায়ুমন্ডলের কারণে সেই সূর্যালোকের শতকরা মাত্র তিন ভাগ শক্তি শুক্রের মাটিতে এসে পৌঁছায়। বেশির ভাগ সূর্যালোক বায়ুমন্ডলের বাইরের স্তরে প্রতিফলিত হয়ে যায় - ফলে দূর থেকে এই গ্রহটিকে খুবই উজ্জ্বল দেখায়। শুক্রের ভূমির উপরে প্রায় এক শ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুমন্ডল। শুক্র গ্রহের ভূমি থেকে 20-25 কিলোমিটার পর্যন্ত বাতাস স্বচ্ছ। শুক্রে ভূমির সমতলে বাতাস প্রায় স্থির বলা চলে। বাতাসের বেগ ঘন্টায় 10 কিলোমিটারের বেশি নয় সেখানে। কিন্তু তাপমাত্রা প্রায় 500 ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। বাতাসের চাপ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের চাপের 90 গুণ। শুক্রের বায়ুমন্ডলের মোট ভরের শতকরা 90 ভাগ এই নিচের ভূমি-সংলগ্ন স্তরের ভর। এখানে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ শতকরা 96 ভাগেরও বেশি। শুক্রের বায়ুমন্ডলের অন্যান্য গ্যাসের মধ্যে আছে নাইট্রোজেন (৩.৫%), এবং খুব কম পরিমাণে হাইড্রোক্লোরিক এসিড, হাইড্রোফ্লোরাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, পানি, আর্গন, কার্বন মনোক্সাইড, অক্সিজেন, নিয়ন ও ক্রিপ্টন। শুক্রে পাঠানো বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইটগুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে শুক্রের বায়ুমন্ডলে ফসফিনের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
শুক্রের বায়ুমন্ডলের উপরে সালফিউরিক এসিডের মেঘের স্তরের বাইরে ফসফিনের উপস্থিতি প্রাণের অস্তিত্বের প্রমাণ বলে দাবি করা হলেও নিশ্চিত করে বলার মতো সময় এখনো আসেনি। এমনও হতে পারে যে শুক্রগ্রহে প্রাণ নয়, ফসফিন তৈরি হবার প্রাকৃতিক রাসায়নিক ব্যাপারটাই এখনো অজানা রয়ে গেছে। যাই হোক, শুক্র গ্রহে আবার নতুন করে স্যাটেলাইট পাঠানো শুরু হবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
তথ্যসূত্র:
১। প্রদীপ দেব, শুক্র: যে গ্রহে সূর্য উঠে পশ্চিম দিকে, মীরা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৯।
২। Jonathan O'Callaghan, Life on Venus? Scientists hunt for the truth, Nature, Vol 586, 8 October 2020.
ধন্যবাদ স্যার।
ReplyDeleteপড়ার জন্য ধন্যবাদ।
Delete