#স্বপ্নলোকের_চাবি_৪৩
দুপুরের পরেই কারেন্ট চলে গেছে। রুমের ভেতর কেমন যেন গুমোট
ভ্যাপসা গরম। দরজা-জানালা খুলে দেবার পরেও একফোঁটা বাতাস ঢুকছে না রুমে। বাইরে গাছপালাগুলি
কেমন যেন স্থির হয়ে আছে। বৃষ্টির পানি ঝরে পড়ছে তাদের গা থেকে, পাতাভর্তি মাথা থেকে।
কিন্তু কেমন যেন নিষ্প্রাণ।
রেডিওতে অনবরত ঘোষণা দিচ্ছে – চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বঙ্গোপসাগরের
নিকটবর্তী জায়গায় দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। সমুদ্রে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি
হয়েছে। তা আজ রাতে উপকূলবর্তী এলাকায় আঘাত হানতে পারে।
আমাদের বিল্ডিং এখন অনেকটা সুনশান। ২৪ এপ্রিল ইউনিভার্সিটি
খোলার কথা ছিল। কিন্তু সেটা পিছিয়ে গেছে দশ দিনের জন্য। তাই মেসের অনেকেই এখনো আসেনি।
হল খুলে দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু খোলেনি। এখলাস হলে উঠতে না পেরে এখন এখানে আছে। মুকিতভাই
বাড়ি গেছেন অনেকদিন। অজিত আছে – তার রুমে। ভীষণ পড়ছে। ইউনিভার্সিটি খুললেই তাদের মাস্টার্স
পরীক্ষার ডেট দিয়ে দেবে।
বিল্ডিং-এর সামনে করাত-কলে কোলাহল চলছে। কারেন্ট না থাকাতে
করাত চলছে না। শ্রমিকরা কাঠের উপর গোল হয়ে বসে তাস খেলছে। দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের
কথা না শোনার কথা নয়। স্থানীয় প্রশাসন বিকেল থেকে রিকশা করে মাইকিং করে জনগণকে সতর্ক
করছে ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপারে। কিন্তু জনগণ এসব সতর্কসংকেতকে মোটেও পাত্তা দিচ্ছে বলে মনে
হচ্ছে না।
রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে এলাম। আকাশের রঙ কেমন যেন অদ্ভুত ফ্যাকাসে
হয়ে যেতে শুরু করেছে। বৈশাখের মাঝামাঝি, কালবৈশাখীর সিজন। কিন্তু কালবৈশাখীর আগে আকাশের
মুখ যেমন গোমড়া হতে হতে থমথমে কালো হয়ে যায়, এখনকার আকাশের সাথে তার কোন মিল নেই। এখনকার
আকাশ কেমন যেন রহস্যময়ী রঙে রাঙা।
পশ্চিমদিকের বড় আমগাছে থোকা থোকা আম ঝুলছে। এবার প্রচুর আম
হয়েছে এই গাছটিতে। ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেই আমের নাগাল পাওয়া যায়। ছোটবেলায়
কাঁচা-আম খাওয়ার জন্য গাছে উঠে যেতাম। এখন হাতের নাগালে এত আম – অথচ খাওয়ার ইচ্ছেটা
হারিয়ে গেছে।
ছাদেও বাতাস নেই। সকাল থেকে গুটি গুটি বৃষ্টি হচ্ছিলো। দুপুরে
বৃষ্টির ফোঁটার আকার সামান্য বড় হয়ে একটু জোরে ঝরেই আবার হালকা হয়ে গেছে। এই বাদলা
হাওয়াকে বিকেল পর্যন্ত খুব একটা পাত্তা দিইনি। দুপুরে ছাতা নিয়ে দেড় কিলোমিটার হেঁটে
চৌধুরিহাটে গিয়েছিলাম ভাত খেতে। হোটেলের নাম শ্মশানেশ্বরী। শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়ায়
বলে দেবী কালীর আরেক নাম শ্মশানেশ্বরী। আয়তনে এত ছোট হোটেল আর কোথাও আছে কি না জানি
না। ছোট্ট একটা টুলে চেপেচুপে খুব বেশি হলে এক সাথে তিন জন বসতে পারে। প্রধান সড়কের
উপর এরকম শনের ছাউনি, বেড়ার ঘর এখনো কীভাবে টিকে আছে সেটাই আশ্চর্যের। দুপুরে যখন খেতে
গিয়েছিলাম তখন সাত নম্বর সিগনাল চলছিলো। সাত নম্বরেও খুব একটা বিচলিত হননি হোটেলের
মালিক কাম কুক কাম ওয়েটার। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি উপরের দিকে হাত তুলে বলেছেন,
“ঈশ্বর যা করবেন, মঙ্গলের জন্য করবেন।“ কিন্তু সমস্যা হলো মানুষ এরকম বিশ্বাসে স্থির থাকতে পারে না। বিশেষ
করে তাদের নিজেদের ইচ্ছার সাথে তাদের ঈশ্বরের ইচ্ছার গরমিল হলে।
মাগরিবের আজানের সাথে সাথেই ঝপ করে সন্ধ্যা নামলো। ছাদের
পুবদিকে সুপারিগাছের সারি। তাদের মাঝখানে একটা নারকেল গাছের মাথা ছাদ ছুয়েছে। সেখানে
কাকের বাসা। সম্ভবত ডিম পেড়েছে বা বাচ্চা হয়েছে। ওদিকে গেলেই কাক কর্কশস্বরে ডাকতে
ডাকতে উড়ে এসে মাথায় ঠোক্কর দিতে চায়। ছোটবেলায় পড়েছিলাম কাক কোকিলের বাসায় ডিম পাড়ে।
তাই যদি হবে – তাহলে কাকের বাসায় কী? তাদের বাসার কাছে যেতে চাইলে তেড়ে আসে কেন? অনেকে
বলেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপারে পশুপাখিরা অনেককিছু আগে থেকেই টের পায়। এই পাখিরা
কি পায়? কাক কি জানে যে এখন দশ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত চলছে! ঘূর্ণিঝড় এলে গাছের কী হবে,
তাদের বাসার কী হবে?
অন্ধকারে ছাদে একা একা হাঁটতে ভালো লাগছে। গতকাল পূর্ণিমা
ছিল। আকাশে এখন মেঘের পাতলা একটি আবরণ। তারা দেখা যাচ্ছে না। চাঁদও না। প্রকৃতি স্থির
হয়ে আছে। সজলকে পড়াতে যাবার কথা ছিল, কিন্তু ইচ্ছে করছে না।
ছড়ারকুলের দোকানগুলিতে হারিকেনের আলো জ্বলছে। আজ রাতে আর
কারেন্ট আসবে না। আশা করছি কাল সকালের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। হারিকেন আমাকেও জ্বালাতে
হবে। রুমে এসে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে হারিকেন জ্বালালাম। কেরোসিন কমে গেছে। দোকানে যাওয়া
দরকার।
দোতলায় উঠে দেখলাম – সব দরজাই বন্ধ। সবাই কি বাড়ি চলে গেল
না কি? অজিতের রুমেও তালা – সম্ভবত টিউশনিতে গেছে। দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের সময়ও পড়াতে
হবে? এখলাসকেও পেলাম না। দোকান থেকে কেরোসিন আর পাউরুটি কিনে নিয়ে এলাম। দোকানের প্রাত্যহিক
ভীড়ে কারো মধ্যেই দশ নম্বর সিগনালের ব্যাপারে কোন উদ্বেগ দেখলাম না। সমুদ্র থেকে অনেক
দূরে বলেই হয়তো।
কিন্তু আমাদের বাড়ি তো ধরতে গেলে সমুদ্র থেকে মাত্র পাঁচ-কিলোমিটারের
মধ্যে। জলোচ্ছ্বাস হলে কি পাঁচ-কিলোমিটার প্লাবিত হবে? মানুষ যে কী পরিমাণ স্বার্থপর
তা বিপদে না পড়লে বোঝা যায় না। সমুদ্রের আশেপাশে যাদের বাস তাদের জন্য আমার চিন্তা
হচ্ছে না। চিন্তা হচ্ছে আমার বাড়ির মানুষগুলির জন্য।
রাত দশটার দিকে বাতাসের বেগ বাড়তে শুরু করলো। জানালা দিয়ে
দেখতে পাচ্ছি চাঁদের আলোয় থৈ থৈ করছে চারপাশ। কিন্তু এতক্ষণ স্থির হয়ে থাকা গাছপালাগুলি
আস্তে আস্তে গা-ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে, বাতাসের সাথে প্রচন্ড-বেগে দুলতে শুরু করেছে।
বাতাস আসছে দক্ষিণ দিক থেকে। আমার রুমটা বিল্ডিং-এর উত্তর-পূর্ব কোণায় হওয়াতে বাতাস
সরাসরি এসে লাগছে না আমার দরজা কিংবা জানালায়। কিন্তু বাতাসের বেগে সব দরজা-জানালা
ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করেছে।
একবার মনে হলো – এই ঝড়ের রাতে আমার তো করার কিছু নেই। ঘুমিয়ে
পড়ি। সকালে ঘুম ভাঙলে দেখবো সব ঠিক হয়ে গেছে। অজিতও এই কথাই বলে গেছে ঘন্টা-দুয়েক আগে
টিউশনি থেকে ফিরে। কিন্তু বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলেই যদি ঘুমানো যেতো – তাহলে তো
আর কথা ছিল না।
প্রকৃতির কাছে মানুষ যে কত অসহায় তা বোঝা যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের
সময়। প্রকৃতির রহস্যসন্ধানই বিজ্ঞানের কাজ। হাজার বছর ধরে ক্রমাগত গবেষণার ফলে প্রকৃতির
কিছু কিছু রহস্য জানা গেছে। আজ আমরা জানি ঘূর্ণিঝড় কেন হয়। এই ঘূর্ণিঝড়েরই আবার ভিন্ন
ভিন্ন নাম – সাইক্লোন, টাইফুন, হারিক্যান। আটলান্টিক ও উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে
সৃষ্টি হলে সেই ঘূর্ণিঝড়ের নাম হয় হারিক্যান। উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে (এশিয়ার
দিকে) তার নাম টাইফুন, আর আমাদের দেশসহ ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে
সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের নাম সাইক্লোন। তবে সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ঘন্টায় ১১৯ কিলোমিটার
বা ৭৪ মাইলের বেশি হলেই তাকে সাইক্লোন বা টাইফুন বা হারিক্যান বলা হয়। কেন এই পরিমাপ
১১৯ কিলোমিটার তা আমি জানি না। এখন বাতাসের বেগ মনে হচ্ছে ঘন্টায় দেড়শ কিলোমিটার ছাড়িয়ে
গেছে।
হঠাৎ ঝনঝন শব্দে আমার পূর্বদিকের জানালার কাচ ভেঙে গেলো।
বাতাসের সাথে বৃষ্টির পানি ঢুকছে সেদিক দিয়ে। বিছানা গুটিয়ে চেয়ারে তুলে রাখলাম যেন
না ভিজে যায়। আমার রুমের দরজা বরাবর রুমের বাইরে দক্ষিণ দিকে একটা জানালা ছিল। ওটা
বন্ধই ছিল। কিন্তু বাতাসের ধাক্কায় প্রচন্ড শব্দে ওটা ভেঙে গেল। এখন বাতাস সরাসরি দক্ষিণ
দিক থেকে আমার জানালায় এসে ধাক্কা দিচ্ছে। একটি মাত্র হুক আছে দরজায়। একটু পরেই হুকটা
পেরেকশুদ্ধ উঠে আসবে কাঠের ভেতর থেকে। খাটটা ঠেলে দরজায় লাগিয়ে দিলাম। তারপর খাটের
মাঝখানে উঠে বসলাম। দরজা-জানালায় যত ফাঁক-ফোকর আছে সবগুলি দিয়ে বাতাস ঢুকছে। নানারকম
বাঁশির মতো শব্দ হচ্ছে।
রেডিওতে শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। সম্ভবত
সম্প্রচার-টাওয়ার ভেঙে গেছে। রুমের জানালা দিয়ে বাইরের তান্ডবের কিছু কিছু আবছা দেখা
যাচ্ছে। একটু পর পরই সুপারিগাছগুলি একটার পর একটা ভেঙে যাচ্ছে মাঝবরাবর। মাঝে মাঝে
প্রচন্ড শব্দে বিল্ডিং কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে দক্ষিণ দিকের জানালা দরজা কিছুই অবশিষ্ট
থাকবে না। এখানেই যদি এরকম অবস্থা হয়, জানি না উপকুলীয় অঞ্চলগুলিতে কী হচ্ছে। চিন্তা
হচ্ছে আমাদের বাড়ির কী অবস্থা হচ্ছে।
দুঃসময়ের গতি সম্ভবত সময়ের চেয়ে কম। নইলে সুসময় কত দ্রুত
চলে যায়, অথচ দুঃসময় কাটতে এত সময় লাগছে কেন!
ভোরের দিকে আস্তে আস্তে বাতাসের বেগ কমে এলো। পুবাকাশ ফর্সা
হয়ে উঠেছে। জানালা খুললাম। জানালার অনেকগুলি কাচ ভেঙে গেছে। বাইরের গাছগুলির বেশিরভাগই
ডালপালা ভেঙে ন্যাড়া হয়ে গেছে।
ছাদে উঠলাম। ছাদের রেলিং-এর দেয়াল ধ্বসে পড়েছে। সন্ধ্যাবেলা
যে গাছগুলি দেখেছিলাম তার কোনটাই অক্ষত নেই। ফলবতী আমগাছটির সবচেয়ে বড় শাখাটি ভেঙে
মাটিতে পড়ে গেছে। একটা গাছেরও মুন্ডু নেই। ডালপালা যা অবশিষ্ট আছে তাতে চেনার উপায়
নেই কোন্টা কী গাছ। নারকেল গাছের সবগুলি ডাল দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। যে কাকটি কাল সন্ধ্যায় রুক্ষস্বরে ডেকে ডেকে বাসা পাহারা দিয়েছিল - আজ মরে পড়ে আছে রেলিং-এর ভাঙা দেয়ালের ইটের নিচে।
এদিকের কয়েকটি পাকাবাড়ি ছাড়া আর কোন ঘরবাড়িই অক্ষত নেই। আমার
বাড়ি যাওয়া দরকার। আমি জানি না - গিয়ে কী দেখবো। কিন্তু যাবার কোন সুযোগ পেলাম না সারাদিন।
রাস্তায় এত বেশি গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়েছে যে সারাদিন গাড়ি চলাচল করতে পারেনি।
চট্টগ্রামের সাথে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম থেকে কোন সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে পারেনি। চট্টগ্রামের কোথাও বিদ্যুৎ-সংযোগ
অক্ষত নেই। টেলিযোগাযোগব্যবস্থা অচল হয়ে গেছে। দুপুরের পর রেডিওতে সিগনাল পাওয়া গেল।
প্রাথমিক খবরেই বলা হচ্ছে মৃতের সংখ্যা হাজারের উপরে। বেশিরভাগই বাঁশখালী এবং সন্দ্বীপের।
মাথার ভেতর কেমন যেন খালি খালি লাগছে।
এখলাসও খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছে তার বাড়ির জন্য। আনোয়ারাও সমুদ্রের
খুব কাছে।
৩০ তারিখ শহরে যেতে পারলাম না। ফতেয়াবাদে খানসাহেবদের বাড়ির
তেমন ক্ষতি হয়নি। পাকা দালান ঝড়ঝাপটা সইতে পারে। ফতেয়াবাদ স্কুলের টিনের ছাউনি উড়ে
গেছে। হেডমাস্টারের কোয়ার্টারের চাল উড়ে গেছে। দেয়ালগুলি দাঁড়িয়ে আছে কোনরকমে।
চৌধুরিহাটেরও বিধ্বস্ত অবস্থা। শ্মশানেশ্বরী হোটেল শ্মশান
হয়ে গেছে। বেড়া ভেঙে মিশে গেছে মাটির সাথে, শনের ছাউনির চিহ্নও নেই। বিপ্লবদের বাড়িতে
গেলাম। তাদের বারান্দার ছাউনি উড়ে গেছে, মূল বাড়ির অনেকগুলি টিন উড়ে চলে গেছে এদিক
সেদিক। মাদার্শায় প্রদীপনাথের বাড়ির কী অবস্থা জানি না। ওদিকের রাস্তার দুপাশে বড় বড়
গাছ ছিল। এখন সেই গাছগুলি রাস্তা আটকে শুয়ে আছে রাস্তায়।
১ মে ভোরবেলা বের হলাম এখলাসসহ। একটা-দুটো বাস চলছে। প্রচন্ড
ভীড়। ঠেলাঠেলি করে উঠে গেলাম। মুদারপুরে নেমে বহদ্দারহাটগামী বাসে উঠলাম। চট্টগ্রাম
শহর ভীষণ অচেনা ঠেকছে। সবকিছু কেমন যেন বিধ্বস্ত অবস্থা। বহদ্দারহাট থেকে বাঁশখালীর
বাস ছাড়ে। সরাসরি বাসে আমাদের বাড়ি যাওয়া যায়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। সরাসরি
যাবার ব্যবস্থা নেই। কর্ণফুলির উপর এরশাদ সরকার যে স্টিলের ব্রিজটি বানিয়েছিলো – একটা
জাহাজ নোঙর ছিঁড়ে এসে ধাক্কা খেয়েছে এই ব্রিজে। ব্রিজ ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম
শহরের সাথে আনোয়ারা, বাঁশখালী, পটিয়া যাবার সহজ রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। এবার আবার যেতে
হবে সেই কালুরঘাটের ব্রিজ পার হয়ে।
হাজার হাজার মানুষ স্টেশনে। কিন্তু পর্যাপ্ত গাড়ি নেই। যে
দুঃসময়ে মানুষের সবচেয়ে বেশি মানবিক হওয়ার কথা, আমাদের দেশে দেখা যায় সেই দুঃসময়েই
মানুষ অমানবিক ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে। ত্রিশ-টাকার বাসভাড়ার জায়গায় দাবি করে এক শ টাকা।
রাস্তার দুপাশে ধ্বংসস্তুপ দেখতে দেখতে যাচ্ছি। যতই দক্ষিণে
যাচ্ছি ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। বাঁশখালীর প্রধান সড়কের পশ্চিমদিকের পুরোটাই সমুদ্রের
সাথে মিশে গেছে। অথচ সমুদ্র রাস্তা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। বিভিন্ন জায়গায় পানিতে
ভাসছে মানুষের ব্যবহার্য জিনিস, গবাদিপশুর মৃতদেহ। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে লক্ষাধিক
প্রাণ।
বাড়ি পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমাদের বাড়ির মূল অংশটি কোন
রকমে দাঁড়িয়ে আছে। টিন উড়ে গিয়েছিল। সেগুলি জোগাড় করে আবার লাগানো হয়েছে। রান্নাঘর
আর বারান্দার পুরোটাই মাটিতে শুয়ে গেছে।
বাড়িতে এখন অনেক মানুষ। পাশের গ্রামের আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই
আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। আমাদের স্কুলের মাঠে আশ্রয়শিবির খোলা হয়েছে। দু’দিনের
মধ্যেই মানুষ বদলে গেছে বিভিন্নভাবে।
পুরো দুটো দিন কেটে যাবার পরেও সরকারি কোন ত্রাণ তৎপরতা শুরু
হয়নি। মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে মিলেমিশে কাজ শুরু করেছে। মানুষের জন্য মানুষ কাজ করছে
দেখে ভালো লাগছে।
পরদিন অনেক বেশি ব্যস্ত সময় কাটলো। আমাদের ক্লাবের ছেলেদের
নিয়ে যতটুকু কাজে লাগা যায়। সরকারি এবং বেসরকারি সাহায্য আসতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে।
আমাদের গ্রামে ঘরবাড়ির ক্ষতি হলেও প্রাণহানি ঘটেনি। কিন্তু পাশের গ্রামে জলোচ্ছ্বাসে
ভেসে গেছে শত শত প্রাণ। বিশেষ করে নারী ও শিশু। অনেকেই শত বার তাগাদা দেবার পরেও জলোচ্ছ্বাসের
আগে ঘর থেকে বের হয়নি।
একজন মানুষ তাঁর পরিবারের সবাইকে হারিয়ে পাগলের মতো ছটফট
করছেন। কয়েকমাস আগেও এই মানুষটি ঈর্ষার পাত্র ছিলেন অনেকের কাছে। কুয়েতে চাকরি করতেন।
প্রচুর টাকা পাঠাতেন বাড়িতে। কিন্তু গতবছরের শেষের দিকে হঠাৎ সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখল
করে নেয়ার পর যুদ্ধ শুরু হলে প্রায় একবস্ত্রে সব হারিয়ে তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন। তবুও
আপনজনরা ছিল। এই জলোচ্ছ্বাসে তারাও গেল। কিছু কিছু মানুষকে কেন এত কষ্ট পেতে হয়?
কিছুদিনের মধ্যেই আন্তর্জাতিক সাহায্যের হাত বাংলাদেশের দিকে
প্রসারিত হলো। বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানরা বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশের মানুষের সাথে
সহমর্মিতা প্রকাশ করলেন।
ত্রাণ তৎপরতা ও পুনর্বাসনে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো হলো।
সেনাবাহিনীর জওয়ানরা অনেক কাজ করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে কাজ করলো
যত, ভয় দেখালো তার চেয়েও বেশি। ক্ষুধার্ত মানুষ মিলিটারি-কায়দায় অর্ডার মানতে জানে
না, পারে না। সেজন্য তাদেরকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে পেটানোতে যে কোন বাহাদুরি নেই তা
তাদের কে বোঝাবে!
প্রচন্ড খারাপ অবস্থা থেকেও ঘুরে দাঁড়ানোর আশ্চর্য ক্ষমতা
আছে মানুষের। এই সর্বস্বহারানো মানুষগুলোও আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ালো।
অবশেষে দীর্ঘ পাঁচ মাস পর ১৪ মে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় খুললো। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই শিবিরের
অত্যাচারে আবার বন্ধ হয়ে গেল।
No comments:
Post a Comment