“বৌদি, এই রুমে এসি নেই – না?”
“না, আমরা অত বড়লোক না।“
“কী যে বলো! ফ্ল্যাট কিনেছো,
গাড়ি কিনেছো। আর কত বড়লোক হবে?”
মুখভর্তি ফেনা নিয়ে দাঁত ব্রাশ
করতে করতে কথা বলছে কৃষ্ণগোপাল। কথার সাথে তার মুখ থেকে থুতু ছিটকে পড়ছে বেডরুমের মেঝেতে।
সঙ্গীতা মশারি টানাতে টানাতে
একবার তাকিয়ে দেখলো মেঝের উপর ছিটকে পড়া সাদা সাদা ফেনার দিকে।
কৃষ্ণগোপাল এলোমেলো ময়লা লুঙ্গি
আর খালি গায়ে বাথরুমের স্যান্ডেল পরে ঘরের ভেতর হেঁটে বেড়াচ্ছে। স্যান্ডেল দিয়ে থুতু
মাড়িয়ে সারাঘর করছে।
রাগে গা রি রি করছে সঙ্গীতার।
কিন্তু কিছু বলার উপায় নেই। কিছু বললেই তা দশগুণ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আত্মীয়স্বজন সবাইকে
বলে বেড়াবে- যে তার বৌদি তাকে সহ্য করতে পারে না।
কৃষ্ণগোপালকে সে সহ্য করতে
পারে না – কথাটা অবশ্য মিথ্যা নয়। ঘরের ভেতর হেঁটে বেড়ানো তেলাপোকাকেও তবু সহ্য করা
যায়, কিন্তু কৃষ্ণগোপালের যে আচরণ সেটা সহ্য করা কোন রুচিশীল মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
“অর্কদের রুমে এসি আছে না?”
“হ্যাঁ, আছে। মুনমুনের গরমে
এলার্জি হয়। সেজন্য অর্ক এসি লাগিয়ে নিয়েছে।“
“আমাকে ঐ রুমে দিতে পারতে।
আমি তো এসি ছাড়া ঘুমাতে পারি না।“
কৃষ্ণগোপালের কথায় সঙ্গীতা
কী বলবে বুঝতে পারে না। মানুষের নির্লজ্জতার স্বার্থপরতার একটা সীমা থাকে। কিন্তু তার
শ্বশুরের এই ছেলেটি চূড়ান্ত নির্লজ্জ, নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই চেনে না সে।
“আমি ছেলে আর ছেলের বৌকে তাদের
রুম থেকে বের করে তোমাকে সেখানে থাকতে দেবো?” – সঙ্গীতা রাগ সামলাতে পারছে না।
“না, সেটা বলছি না। আমি এসি
ছাড়া ঘুমাতে পারি না জানলে অর্ক নিজেই আমাকে সেই রুমে থাকতে বলতো। অর্ক আমাকে খুব পছন্দ
করে তো। আমার মতোই উদার স্বভাবের হয়েছে ছেলেটা।“
আর কিছু বলার রুচি হলো না সঙ্গীতার।
স্বামীর হুকুমে নিজেদের রুম ছেড়ে দিয়েছে সে তার জন্য। এখন এসি ছাড়া তিনি ঘুমাতে পারবেন
না! নিজের বিছানার চাদর আর বালিশ নিয়ে বের হয়ে এলো সঙ্গীতা।
অর্কদের রুমে এখনো বাতি জ্বলছে।
তার মানে কৃষ্ণগোপালের কথাগুলি নিশ্চয় কানে গেছে তাদের। এতক্ষণে মুনমুন হয়তো ক্ষ্যাপাতে
শুরু করেছে অর্ককে।
রাত সাড়ে বারোটা বাজে। এতক্ষণে
একটু বসার সময় পেলো সঙ্গীতা। টিভির সামনে বড় সোফাটা দখল করে হা করে ঘুমাচ্ছে তার স্বামী
ননীগোপাল। টিভিতে টকশো চলছে। বাংলাদেশের নতুন শিক্ষানীতি নিয়ে জোরে জোরে কথা বলছে দুইতিনজন
একসাথে। বক্তাদের কেউই মনে হয় সরাসরি স্কুল-কলেজের শিক্ষার সাথে যুক্ত নয়। সঙ্গীতা
নিজে একটা বেসরকারি কলেজে পড়ায়। কয়েক লাইন শুনেই সে বুঝতে পারলো শিক্ষা সম্পর্কে তার
ধারণা এদের চেয়ে বেশি। টিভিটা বন্ধ করে দিলো।
টিভির শব্দ অফ হতেই তাদের বাথরুম
থেকে ভেসে হলো খা-খা- করে গলা পরিষ্কার করার শব্দ। এসব কাজ যে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে
করতে হয় সেই বোধটুকুও নেই কৃষ্ণগোপালের। অথচ বিদেশে থাকে বলে তার কী বাহাদুরি! মালয়শিয়ার
বদলে আমেরিকা বা কানাডায় থাকলে কী করতো কে জানে।
মাথার উপর ফুলস্পিডে ফ্যান
ঘুরছে। ফ্যানের শব্দ ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে নাক ডাকার শব্দ। বিশ্রী শব্দ করে নাক ডাকছে
ননীগোপাল। তারও খালি গা, লুঙ্গি উঠে গেছে হাঁটুর উপর। সঙ্গীতা একশোবার বলেছে – বাসায়
নতুন বউ, খালি গায়ে থেকো না। কার কথা কে শোনে! ননীগোপালের গায়ে একটা চাদর টেনে দিতে
দিতে তার বোয়াল মাছের মতো হা-করা মুখের দিকে তাকিয়ে সঙ্গীতা ভাবতে চেষ্টা করে - কী
দেখে এই লোকটার প্রেমে পড়েছিল সে?
ভুল মানুষের প্রেমে পড়াই সম্ভবত
প্রেমের অলিখিত নিয়ম। এই ভুলটা যত দেরিতে ধরা পড়ে ততই ভালো। কিন্তু সঙ্গীতা বিয়ের কিছুদিন
পরেই বুঝতে পেরেছিল – তার ভালোবাসার মানুষটিকে আর খুঁজে পাচ্ছে না তার বিয়ে-করা স্বামীর
ভেতর। তাহলে কি এটাই ঠিক যে বিয়ের সাথে সাথে ভালোবাসার মৃত্যু হয়! আর সেই মৃত ভালোবাসার
শব বহন করে চলেছে গত ত্রিশ বছর ধরে!
একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো
সঙ্গীতার ভেতর থেকে। ত্রিশ বছর কেটে গেছে – এরকম ছোটবড় দীর্ঘশ্বাসের ভেতর দিয়েই। এর
মধ্যেই তাদের ঘরসংসার, চাকরি-বাকরি। কয়েক বছর পরেই অবসরে যাবে তারা দুজনই। প্রভিডেন্ড
ফান্ড এটাসেটা করে কোন রকমে বারো শ স্কয়ার ফুটের এই ফ্ল্যাটটা কিনেছে। একমাত্র ছেলে
অর্ক বিসিএস পাস করে চাকরিতে যোগ দিয়েছে। অর্ককে বিয়ে করিয়েছে মাস তিনেক আগে। ব্যাংক
থেকে লোন নিয়ে অর্ক একটা সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি কিনেছে। সেই গাড়িতে সঙ্গীতাও চড়ার সুযোগ
পায় মাঝে মাঝে। অনেকেই সঙ্গীতার সংসারকে সুখী সংসার বলে। কিন্তু সুখ ব্যাপারটা কি অন্যে
কী বলে তার উপর নির্ভর করে?
ফোনটা বেজে উঠতেই এতক্ষণের
বিরক্তিটা উধাও হয়ে গেলো সঙ্গীতার। একটা রিং বাজতে না বাজতেই রিসিভ করলো, – “সংযুক্তা,
কেমন আছিস?”
কথা বলতে বলতে দেয়ালের ঘড়ির
দিকে চোখ গেল সঙ্গীতার। রাত একটা। নিউইয়র্কে এখন রোববার বিকেল। প্রতি সপ্তাহে এই সময়েই
ফোন করে সংযুক্তা।
“কোথায় যাচ্ছিস? অফিসের পার্টি?
তোদের কি সবকিছু ওপেন করে দিয়েছে? মাস্ক এখনো পরতে হয়? ঠিক আছে, সাবধানে থাকিস।“
মনটা অনেক ভালো হয়ে গেল সঙ্গীতার।
ননীগোপালকে ঠেলে জাগিয়ে পাঠিয়ে দিলো ছোট্ট রুমটাতে। ননীগোপাল পরনের লুঙ্গিটা কোন রকমে
সামলে টলতে টলতে যাবার সময় ঘুম জড়ানো গলায় প্রশ্ন করলো, “কৃষ্ণর রুম ঠিক করে দিয়েছো?”
আবার মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছিলো
সঙ্গীতার। কোন রকমে সামলে নিলো।
বিয়ের পর থেকেই সঙ্গীতা দেখছে
ননীগোপালের কাছে তার চেয়েও তার ভাই-বোনদের গুরুত্ব বেশি। নতুন বউ হিসেবে বাসায় এসেই
দেখেছে দেবর ছাড়াও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের কেউ না কেউ থাকে সেখানে। দুই রুমের একটা বাসা।
কোন প্রাইভেসি নেই। এতগুলি বছর কীভাবে যে সব ম্যানেজ করেছে সে নিজেই ভেবে পায় না।
সঙ্গীতার বিয়ের সময় কৃষ্ণগোপালের
বয়স ছিল একুশ-বাইশ বছর। বছরের পর বছর ধরে পড়াশোনার নামে পড়াশোনা ছাড়া আর সবকিছুই করেছে
ইচ্ছেমতো। তিন-চার বার বিএ ফেল করার পর ব্যবসা করার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা নষ্ট করেছে।
কৃষ্ণগোপালের ধারণা তার মতো সুদর্শন ছেলে ত্রিভুবনে নেই, বাংলাদেশের সব মেয়ে তাকিয়ে
আছে তার দিকে। বোম্বেতে থাকলে সে আমির খান কিংবা শাহরুখ খান হয়ে যেতে পারতো। দুই হাতে
টাকা উড়ায় – সেই টাকা জোগান দেয় তার ভাই।
ননীগোপাল বেসরকারি ব্যাংকে
চাকরি করে – বেতন ভালোই পায়। কিন্তু সেই বেতনের টাকা কোথায় যায় সঙ্গীতা জানে না। সঙ্গীতার
বেতনের টাকায় সংসার চলে।
স্বামীর এত আদরের ভাইকে নিজেও
আদর-স্নেহ দিয়ে আগলে রাখতে চেয়েছিল সঙ্গীতা। কিন্তু কৃষ্ণগোপাল যে সেসবের যোগ্য ছিল
না – তা সঙ্গীতা বুঝতে পেরেছিল অল্পদিনের মধ্যেই।
সঙ্গীতার ছোটবোন সংযুক্তা এসএসসি
পরীক্ষা দিয়ে তার বাসায় এসেছিল – সরকারি কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য। কিন্তু যেদিন
সংযুক্তা এলো, সেদিন সন্ধ্যায় ননীগোপাল অফিস থেকে ফিরে বেশ গম্ভীরভাবে সঙ্গীতাকে বললো,
“তুমি তোমার বোনকে রাখবে বলে আমার ভাইকে বাসা থেকে বের করে দেবে?”
“মানে কী?”
“কী আবার? তুমি কৃষ্ণকে বাসা
থেকে বের হয়ে যেতে বলোনি?”
সঙ্গীতা বুঝতে পারে কৃষ্ণগোপাল
তার দাদাকে কী বলেছে। দুই রুমের বাসায় একটা রুমে সঙ্গীতারা থাকে। অন্যরুম দখল করে রেখেছে
কৃষ্ণগোপাল। আলাদা কোন রুম নেই সংযুক্তাকে থাকতে দেয়ার জন্য। ড্রয়িংরুমে একটা খাট আছে।
কৃষ্ণগোপাল সেই খাটে থাকলে সংযুক্তাকে রুমটা দেয়া যায়। সঙ্গীতা কৃষ্ণগোপালকে অনুরোধ
করেছে – রাতের বেলা সে যেন ড্রয়িং রুমে শোয়। তাতেই এত কথা?
“দ্যাখো, তোমাকে আমি পরিষ্কার
বলে দিচ্ছি। আমার ভাইকে তুমি যদি কোনভাবেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করো – আমি সহ্য করবো না।“
ননীগোপাল অফিসের প্যান্ট-শার্ট খুলে লুঙ্গি পরতে পরতে হুসিয়ারি দেয় সঙ্গীতাকে।
সঙ্গীতার নিজেকে খুবই ছোট মনে
হতে থাকে। ননীগোপালের ভাই ভাই, আর তার নিজের বোন কিছুই না? রাগে ফুঁসে উঠে সঙ্গীতা।
“তোমার ভাইকে বাসা থেকে বের
হয়ে যেতে বলিনি। ড্রয়িং রুমে ঘুমাতে বলেছি – যাতে সংযুক্তা রুমের ভেতর থাকতে পারে।
ড্রয়িং-রুমে সারাক্ষণ হৈচৈ চলে – সংযুক্তা সেখানে পড়বে কীভাবে?”
“আমি ওসব জানি না। আমি কোনধরনের
অশান্তি চাই না। সারাদিন চাকরি করে এসব ভালো লাগে না।“
“চাকরি তুমি একা করো না। চাকরি
আমিও করি।“
“তোমাকে চাকরি করতে তো আমি
বলিনি। চাকরি ছেড়ে দাও না।“ – বলেই দরজা খুলে গজগজ করতে করতে আবার বের হয়ে গেল ননীগোপাল।
রুম থেকে বের হয়েই সংযুক্তার
সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় সঙ্গীতার। বুঝতে পারে ড্রইং-রুমে বসে সব কথা শুনেছে সংযুক্তা।
তার চেয়ে বয়সে দশ বছরের ছোট হলেও অনেক কিছুই বুঝতে পারে সদ্য পনেরো পার করা সংযুক্তা।
তাদের বাবা অনেক কষ্ট করে তাদের
দুই বোনকে লেখাপড়া করিয়েছে। গ্রামের মাতব্বররা সবাই বলেছিল সঙ্গীতাকে এতদূর না পড়িয়ে
বিয়ে দিয়ে দিতে। বাবা তাদের কারো কথা শোনেনি। তাদের দুই বোনের মাঝে এক ভাই ছিল - শংকর।
দশ বছর বয়সে শংকর মারা যায় ডাকাতের গুলিতে। পুত্রহারানোর শোক সহ্য করে বাবা-মা দুই
মেয়েকে আকড়ে রেখেছে। সঙ্গীতা নিজের খুশিতে পড়াশোনা করেছে। নিজের পছন্দের ছেলের সাথে
বিয়ের ব্যাপারেও কোন আপত্তি করেনি তার বাবা-মা।
এতদিন শুধু নিজের দিকটাই দেখেছে
সঙ্গীতা, মা-বাবার বড়সন্তান হিসেবে কোন দায়িত্বই পালন করেনি সে। এখন ছোটবোনটার লেখাপড়ার
দায়িত্ব তো সঙ্গীতার নেয়া উচিত। কিন্তু সেটার শুরুতেই এত কথা শুনতে হচ্ছে। সঙ্গীতা
জানে – এসব কথা বাবার কানে গেলে বাবা সংযুক্তাকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। হয়তো গ্রামের কলেজেই
পড়াবে। সংযুক্তা লেখাপড়ায় এত ভালো – অথচ ভালো একটা কলেজে পড়তে পারবে না শুধুমাত্র থাকার
জায়গার অভাবে? না, সঙ্গীতা তা কিছুতেই হতে দেবে না।
“তুই বাবাকে এসব কিছু বলিস
না। তোর কোন অসুবিধা হবে না এখানে।“ – সংযুক্তাকে আশ্বস্ত করে সঙ্গীতা।
“আমি এখানেই ঘুমাতে পারবো দিদি।
ফ্লোরেই ঘুমাতে পারবো।“
সংযুক্তার কথায় বুক ঠেলে কান্না
বেরিয়ে আসতে চায় সঙ্গীতার। তার ছোট্ট এই বোনটা কোনদিন কোন কিছু নিয়ে আবদার করেনি। কারো
কাছে কোনকিছু চায়নি। শংকরের সাথেই ছিল তার সব আবদার। শংকর ছোট্ট সংযুক্তাকে কাঁধে নিয়ে
ঘুম পাড়াতো, পাড়াময় ঘুরে বেড়াতো। সংযুক্তা যখন ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়, ক্লাস ফাইভে পড়তো তখন শংকর। বোনকে কোলে করে স্কুলে
নিয়ে যেতো। সঙ্গীতার এসএসসি পরীক্ষা চলছিল তখন। বাবার ছোট্ট একটা দোকান ছিল বাজারে।
শংকর বাড়ির জন্য বাজার আনতে গিয়েছিল। বাড়িতে আসার সময় হঠাৎ ডাকাতের এলোপাথাড়ি গুলি
শংকরের মাথায় লাগে। গুলি খেয়ে রাস্তার উপর পড়েছিল শংকর। বাবা-মা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল।
সংযুক্তা সেদিন থেকে কেমন যেন পাথরের মতো হয়ে গেছে। সেদিনের পরে আর কোনদিন কাঁদেনি
সে। আবার একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে সঙ্গীতার।
সংযুক্তা ড্রয়িং রুমে বসেই
পড়াশোনা করছিল। সঙ্গীতা তাকে বাসার কাছে একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। দুপুরে
ক্লাস থাকে তার। নিজে নিজেই যাওয়া-আসা করতে পারে। ঘরে সংযুক্তা চুপচাপ থাকে। দরকার
না হলে কোন কথাবার্তাও বলে না তেমন একটা।
সংযুক্তার দিকে তাকিয়ে সঙ্গীতার
মন খারাপ হয়ে যায়। কৈশোর হবে দুরন্ত, অথচ সংযুক্তা রোবটের মতো ধীরস্থির। এসএসসি পরীক্ষা
দিয়েছে, অথচ তাকে দেখতে এখনো ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ে বলে মনে হয়।
কয়েকদিন পরেই একটা ঘটনা ঘটলো।
বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে সঙ্গীতা দেখে তার বাসায় তার স্বামীর বড়বোন বেনুবালা খুব রাগী
রাগী মুখে বসে আছে। তার সামনে মুখ কালো করে বসে আছে ননীগোপাল। বোঝাই যাচ্ছে অনেকক্ষণ
থেকে ভাইবোনে মিলে কোন শলাপরামর্শ চলছিলো। যে ননীগোপাল রাত ন’টার আগে বাসায় আসে না,
সে আজ পাঁচটার আগেই চলে এসেছে!
সঙ্গীতা বাসায় ঢোকার সাথে সাথে
বেনুবালা চিৎকার করে বলে উঠে, “সঙ্গীতা, তুমি কি তোমার বোনকে এনেছ আমার ভাইয়ের পেছনে
লেলিয়ে দেয়ার জন্য?”
সঙ্গীতা বুঝতে পারে না ঘটনা
কী। সে পারতপক্ষে বেনুবালার সাথে কোন কিছু নিয়ে তর্ক করে না। বেনুবালা লেখাপড়া তেমন
কিছু জানে না। তার স্বামীর ওষুধের দোকান আছে, অনেক টাকা রোজগার হয় – সেই অহংকারে তার
মাটিতে পা পড়ে না। যখন তখন সঙ্গীতার বাসায় এসে সঙ্গীতার উপর মাস্টারি করাটা বেনুবালা
খুব আগ্রহ নিয়েই করে। আজ কী হয়েছে এখনো বুঝতে পারছে না সঙ্গীতা। সে ননীগোপালকে জিজ্ঞেস
করে, “তুমি আজ এত তাড়াতাড়ি চলে এসেছো?”
“না এসে কী করবো! তোমার বোন
তো আমার ভাইকে মেরে শুইয়ে দিয়েছে।“
“কী হয়েছে!” – সঙ্গীতার বিশ্বাস
হচ্ছে না ওরা কী বলছে। একরত্তি মেয়ে সংযুক্তা মেরে শুইয়ে দিয়েছে ষণ্ডা জোয়ান কৃষ্ণগোপালকে?
সঙ্গীতা নিজের রুমে ঢুকে দেখে
ঘরের এক কোণায় ফ্লোরে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে সংযুক্তা। সঙ্গীতাকে ঢুকতে দেখে
একবার চোখ তুলে তাকালো।
“কী হয়েছে রে? কী বলছে ওরা
এসব? তুই নাকি কৃষ্ণকে মেরেছিস?”
“ঠিকমতো মারতে পারিনি তো, পালিয়ে
গেছে।“
“কী বলছিস! কী হয়েছে?“
“আমি পড়ছিলাম। পেছন থেকে এসে
আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার জামার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল। মুখে কামড় দিতে চেয়েছিল। আমি
মশারির স্ট্যান্ড খুলে মেরেছি।“ – নিচুস্বরে বললেও সংযুক্তার তেজ দেখে অবাক হয় সঙ্গীতা।
নিজের বোনকে সে নতুন করে চিনছে আজ।
কৃষ্ণগোপালের স্বভাব যে ভালো
না তা অনেক আগেই বুঝেছিল সঙ্গীতা। এরকম অনেক ঘটনার কথা তার কানে আগেও এসেছে। কিন্তু
সংযুক্তার সাথেও যে সে এরকম কিছু করতে পারে ভাবেনি। সংযুক্তার জন্য ভয় লাগছে এখন সঙ্গীতার।
আরো ভয়ংকর কিছুও তো হয়ে যেতে পারতো।
আবার ড্রয়িং-রুমে এলো সঙ্গীতা।
বেনুবালার সামনেই ননীগোপালকে বললো, “তোমার ভাই কী করেছে শুনেছো নিশ্চয়ই।“
ননীগোপাল কিছু বলার আগেই বেনুবালা
খেঁকিয়ে উঠলো, “আমার ভাই কিছু করেনি। আমার ভাই সুন্দর বলে তোমার বোন আমার ভাইকে খারাপ
করতে চেয়েছিল। ছি ছি ছি, কী লজ্জার কথা। কিন্তু উপরে ভগবান আছে। ছি ছি ছি! কেমন বোন
তোমার! মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে আমার ভাইয়ের।“
বেনুবালার কথায় খুব বেশি গুরুত্ব
দেয় না সঙ্গীতা। কৃষ্ণগোপাল বাসায় নেই। সম্ভবত মার খেয়ে পালিয়ে বেনুবালার বাসায় গিয়ে
লাগিয়েছে। মালতীর মা আছে বাসায়, তাকে জিজ্ঞেস করলেই বোঝা যাবে। মালতীর মা সকালে সঙ্গীতা
কলেজে যাবার আগে আসে, সন্ধ্যায় চলে যায়। সারাদিনের রান্নাবান্না, ঘরমোছা, কাপড়ধোয়া
এসব কাজ করে।
“মালতীর মা, কী হয়েছিল তুমি
জানো?”
মালতীর মা রান্নাঘরে বসে কান
খাড়া করে শুনছিল ড্রয়িংরুমের কথাবার্তা। সঙ্গীতার প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য রান্নাঘর
থেকে বের হয়ে এলো।
“আমি রান্নাঘরে ছিলাম। আপনার
বোন এখানে খাটে বসে পড়ছিল। আর ছোটবাবু ঘরে হাঁটাহাঁটি করছিলো। হঠাৎ আপনার বোন চিৎকার
দিয়ে উঠে। আমি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দেখি আপনার বোন মশারির ডান্ডা নিয়ে ছোটবাবুকে
মারছে।“
বেনুবালা চিৎকার দিয়ে উঠে,
“শুনলে তো, কে মেরেছে শুনলে তো।“
“এর আগে আপনার ভাই কী করেছে
সেটা শোনেননি? আপনার ভাই আমার বোনকে অপমান করেছে।“
“সব মিথ্যা কথা। বানানো কথা।
আমার ভাইয়ের চারপাশে কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কি পাগল হয়েছে যে তোমার
বোনের মতো একটা কালো মেয়ের দিকে চোখ দেবে?”
বেনুবালা চিৎকার করেই চলেছে।
“খবরদার বলে দিলাম সঙ্গীতা।
তোমার বোনকে তুমি বিদায় কর।“
“আমার বোনকে বিদায় করবো কেন?
আপনার ভাইতো এখন আপনার বাসায় গেছে। আপনি তাকে আপনার বাসায় রেখে দেন।“
সঙ্গীতার গলার ঝাঁজ উপেক্ষা
করে আরো গলা চড়ায় বেনুবালা, “কেন? আমার ভাই কেন যাবে? এটা আমার ভাইয়ের বাসা। ভাইয়ের
বাসায় ভাইয়ের থাকার অধিকার।“
“বোনের বাসায় বোনের অধিকার
নেই?”
“কিসের বোনের বাসা? এটা তোমার
স্বামীর বাসা, যেখানে তুমি থাকো।“
বেনুবালা অশিক্ষিত হলেও – কী
নির্মম সত্য কথাটা বলে ফেললো। স্বামীদেরই তো বাসা। স্ত্রীর বেতনের টাকায় বাসাভাড়া দেয়া
হলেও বাসাটা কিন্তু স্বামীর। সেখানে স্বামীরই অধিকার। নারীর কোন অধিকার নেই বলেই তো
এতো নারী-অধিকার নারী-অধিকার বলে চিৎকার করতে হচ্ছে।
না, সেদিন সঙ্গীতাও পারেনি
তার কোন অধিকার ফলাতে। কেবল অপমানিত চোখে তাকিয়ে দেখেছে তার একদা প্রেমিক, বর্তমান
স্বামী ননীগোপাল নাড়ুগোপালের মতো মুখ করে নিরবে সমর্থন করেছে তার দিদির কথা।
বেনুবালা চলে যাবার পরে সঙ্গীতা
ননীগোপালকে বলেছিল, “কৃষ্ণগোপাল এমন একটা কাজ কেমনে করলো? বাচ্চা একটা মেয়ের সাথে!
কেমনে পারলো সে?”
“শুধু এক পক্ষের কথা শুনলে
তো হবে না। তোমার বোন যে তাকে কোনভাবে প্রভোক করেনি তার গ্যারান্টি কী?”
ননীগোপালের কথায় নিজেকে খুবই
অপমানিত মনে হয় সঙ্গীতার। এই কি সেই ননীগোপাল যে একদিন সাম্যবাদের কথা বলতো! নারী-পুরুষের
সমান অধিকারের কথা বলতো! আর এখন সে তার ভাইয়ের পক্ষে সাফাই গাইছে!
পরদিন সকালেই সংযুক্তাকে নিয়ে
বাবার বাড়িতে যায় সঙ্গীতা। সংযুক্তার আর শহরে কোচিং করা হয়নি। কিন্তু তাতে কী হয়েছে।
সংযুক্তা অনেকগুলি লেটার নিয়ে এসএসসি পাস করেছে। শহরের সরকারি কলেজেই পড়েছে। হোস্টেলে
থেকেছে। সেখান থেকে ইউনিভার্সিটি। ঝকঝকে রেজাল্ট করেছে। নিজে নিজে আমেরিকার স্কলারশিপ
জোগাড় করে আমেরিকায় চলে গেছে। পিএইচডি করে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে কাজ পেয়েছে। পৃথিবীর
অনেক দেশে ঘুরে বেড়িয়েছে।
ইতোমধ্যে বাবা মারা গেছে। সংযুক্তা
মা-কে আমেরিকায় নিয়ে গিয়েছে। কাজের সূত্রেই মাইকেলের সাথে পরিচয় সংযুক্তার। মাইকেল
আফ্রিকান ছেলে। আফ্রিকান ছেলে বিয়ে করতে চায় শুনে মা খুব আপত্তি করেছিল। সাদা ছেলে
হলে আপত্তি করতো না, কালো বলেই আপত্তি! কিন্তু শেষে মেনে নিয়েছে। খুব সুখে আছে মাইকেল
আর সংযুক্তা। তাদের একটাই মেয়ে। নাম রেখেছে ইমানি। সোয়াহিলি ভাষায় ইমানি শব্দের অর্থ
বিশ্বাস। সঙ্গীতা মা-কে জিজ্ঞেস করেছিল – দেখতে কেমন হয়েছে ইমানি? মা – টেলিফোনে হাসতে
হাসতে বলেছিল, কুচকুচে কালো হয়েছে।
ইমানিকে চোখের আড়াল করতে চাইতো
না মা। মা মারা গেছে দু’বছর হয়ে গেল। নিউইয়র্কেই দাহ করা হয়েছে মা-কে। ইমানির বয়স এখন
দশ। মাঝে মাঝে ভিডিও-কলে কথা হয় ইমানির সাথেও।
একটাও মিথ্যা কথা না বলে, কোন
রকমের ভনিতা না করে যে জীবন চালানো যায় – তা সংযুক্তাকে না দেখলে কিছুতেই বিশ্বাস করতে
পারতো না সঙ্গীতা। এখন এই বয়সে এসে সে ভাবে – যদি সংযুক্তার মতো হতে পারতো! মুখের উপর
অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারতো!
ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে একটা পাতলা
কাঁথা বিছিয়ে শুয়ে পড়লো সঙ্গীতা। তার নিজের বেডরুমে ঘুমাচ্ছে কৃষ্ণগোপাল – যে কি না
এখন মালয়েশিয়া প্রবাসী। কত ধরনের অন্যায়ের সাথে যে আপোষ করে চলতে হয় সঙ্গীতাকে। এই
যে কৃষ্ণগোপাল – সংযুক্তার হাতে মার খাওয়ার পরেও তার স্বভাবের কোন পরিবর্তন হয়নি। একের
পর এক ঘটনা ঘটিয়েছে। আর তার ভাই-বোন, মা-বাবা সবাই তাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। সে সুন্দর
বলেই নাকি মেয়েরা তার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। চামড়া ফর্সা হলেই কি মানুষ সুন্দর হয়ে গেলো?
চরিত্র গোপন করে বিয়ে করানো
হয়েছিল কৃষ্ণগোপালকে। এক বছরের মধ্যে সেই বিয়ে ভেঙে যায়। কোন রুচিশীল মেয়ের পক্ষেই
কৃষ্ণগোপালের সঙ্গে ঘর করা সম্ভব নয়। নারী-নির্যাতনের মামলায় হাজতও খেটেছে সে। অনেক
টাকাপয়সা খরচ করে সেই মামলা আপোষ করা হয়েছে। তারপর তাকে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
সেখানে সে কী করে ঠিক জানে না সঙ্গীতা। জানার আগ্রহও নেই। শুনেছে ওখানে নাকি এক ইন্ডিয়ান
মেয়েকে বিয়ে করেছে। কৃষ্ণগোপালের মতো দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্যও পাত্রীর অভাব হয় না,
এটাই আশ্চর্যের।
কৃষ্ণগোপাল এবার কী কারণে দেশে
এসেছে ঠিক জানে না সঙ্গীতা। সম্ভবত টাকার জন্য এসেছে। অর্কর বিয়ের সময় আসবে বলেছিল।
কোভিডের কারণে আসতে পারেনি। ফ্লাইট চালু হতেই চলে এসেছে। ভাইকে আনতে ঢাকায় গিয়েছিল
ননীগোপাল। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছে। পারলে ভাইকে মাথায় তুলে রাখে
ননীগোপাল। সঙ্গীতা স্বামীর ইচ্ছের বিরোধিতা করেনি। নিজের বেডরুম ছেড়ে দিয়ে এখন ফ্লোরে
ঘুমাচ্ছে সে। আর কৃষ্ণগোপালের তাতেও মন ভরেনি – তার নাকি এসি ছাড়া ঘুম আসে না। কিন্তু
এখন যে এসি ছাড়াই নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে!
কোভিডের কারণে স্কুল-কলেজ এখনো
বন্ধ। সকালে কলেজে যাওয়ার তাড়া নেই। একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠলো সঙ্গীতা। ন’টার দিকে
অর্ক আর তার বাপ এক সাথেই বের হয়ে যায়। মুনমুন আরো ঘন্টাখানেক ঘুমায়। সঙ্গীতা ডাকে
না তাকে। যতদিন পারে একটু আরাম করে নিক। অর্কও তার বউকে খুব একটা ডিস্টার্ব করে না।
নিজের মতো উঠে রেডি হয়ে রুমের দরজা ভেজিয়ে রেখে বের হয়ে যায়।
সঙ্গীতা বাথরুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। বিদেশী
অতিথির জন্য ভালো নাস্তা বানানোর হুকুম দিয়ে গেছে ননীগোপাল। ইচ্ছের বিরুদ্ধেও ভাবছে
কী বানানো যায়। এসব ব্যাপার মুনমুন ভালো জানে। সে উঠলে কিছু একটা বানাতে বলবে।
এমন সময় হঠাৎ মুনমুনের চিৎকার
– “মা মা মা …”
সঙ্গীতা দৌড়ে অর্কদের বেডরুমের
দিকে যাবার সময় দেখলো লুঙ্গিপরা খালি-গা কৃষ্ণগোপাল দ্রুতবেগে বের হচ্ছে সেই রুম থেকে।
সঙ্গীতা রুমে ঢুকে দেখলো মুনমুন মশারির ভেতর বিছানায় বসে ঠকঠক করে কাঁপছে।
“আমার গায়ে হাত দিয়েছে লোকটা”
– কাঁপছে আর কাঁদছে মুনমুন।
মাথায় রক্ত উঠে গেল সঙ্গীতার।
দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে নিজের বেডরুমে এলো। দেখলো কৃষ্ণগোপাল এর মধ্যেই আবার বিছানায়
লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে, ঘুমের ভান করে চোখ বন্ধ করে আছে। সঙ্গীতা খাটের সাথে লাগানো
হাতের কাছের কাঠের স্ট্যান্ডটা খুলে হাতে নিলো। অনেক বছর আগে সংযুক্তা কীভাবে এই জানোয়ারটাকে
পিটিয়েছিল সে দেখেনি। কিন্তু আজ সে বুঝতে পারছে তার কী করা উচিত। শুধু মন্ত্রপাঠ করে
তো অসুরনিধন করা সম্ভব নয়।
গল্পের শেষটা অনেক সুন্দর হয়েছে। এটা পুরোটাই কি বাস্তব ঘটনা?
ReplyDeleteধন্যবাদ। এটা একটি গল্প।
Delete