নক্ষত্রের আলোকে আলোকিত আমাদের মহাবিশ্ব। আমরা জানি আলোর গতি সর্বত্র। কত লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ পার হয়ে সুদূর অতীতের আলো এসে ঝিকমিক করে আমাদের রাতের আকাশে। কিন্তু আমরা এটাও এখন জানি যে এই মহাবিশ্বের মহাকাশে এমন কিছু জায়গা আছে যেখান থেকে আলোও ফিরে আসতে পারে না। গভীর নিকষ অন্ধকার সেখানে। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং যাকে তুলনা করেছেন ইতালিয় কবি দান্তে আলিগিয়েরির ডিভাইন কমেডিতে বর্ণিত দোজখের সাথে – যেখানে প্রবেশ করার সময় সমস্ত আশা চিরতরে পরিত্যাগ করতে হয়। সেখানে মাধ্যাকর্ষণের টান এতটাই তীব্র যে সেই টানে আয়তন এত কমে যায় যে সেটা স্থান-কাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেখান থেকে আলো, কিংবা তড়িৎ-চৌম্বক তরঙ্গ কিংবা কোন কিছুই আর বের হয়ে আসতে পারে না। এই অদৃশ্য বস্তু মূলত মৃত নক্ষত্র। আগে এর নাম ছিলো ডার্ক স্টার। ১৯৬৭ সালে বিজ্ঞানী জন হুইলার তাদের নাম দিয়েছেন ব্ল্যাক হোল। জন হুইলারের ছাত্র ছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান, কিপ থর্ন প্রমুখ খ্যাতনামা বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী কিপ থর্ন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ২০১৭ সালে মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করার জন্য। তাদের শনাক্তকরা মহাকর্ষ তরঙ্গের ঢেউ এসেছিল শত কোটি বছর আগে ঘটে যাওয়া দুটো ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষ থেকে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের সাহায্যে গ্যালাক্সি M87 এর কেন্দ্রে থাকা ব্ল্যাকহোলের ছায়া থেকে বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাকহোলের ছবি তৈরি করতে সমর্থ হন। পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক উৎসাহের জন্ম দিয়েছিল সেই ব্ল্যাকহোলের ছবি। তারই হাত ধরে ২০২০ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কারের মূল বিষয় – ব্ল্যাকহোল।
M87 গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত ব্ল্যাকহোলের ছবি |
২০২০ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার যৌথভাবে পেয়েছেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রজার পেনরোজ, জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাংক ইন্সটিটিউট অব এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ফিজিক্স, ও ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলির অধ্যাপক রাইনহার্ড গেনজেল, এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস এঞ্জেলেসের অধ্যাপক এনড্রিয়া গেজ।
ব্ল্যাকহোলের আধুনিক গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের মূল উৎস আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব। যদিও আইনস্টাইন নিজে ব্ল্যাকহোলের ফ্যান ছিলেন না, কিন্তু আইনস্টাইনের মৃত্যুর দশ বছর পর ১৯৬৫ সালে ব্ল্যাকহোল সংক্রান্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং সবচেয়ে ক্ল্যাসিক গাণিতিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী রজার পেনরোজ। ১৯৩১ সালের ৮ আগস্ট ইংল্যান্ডের কোলচেস্টারে জন্ম রজার পেনরোজের। তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত মনোচিকিৎসক লিওনেল পেনরোজ। ১৯৫৮ সালে তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির সেন্ট জন’স কলেজ থেকে গণিতে পিএইচডি করেন। মূল গণিত থেকে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের গণিতে আকৃষ্ট হন ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডেনিস স্কিয়ামার উৎসাহে। ডেনিস স্কিয়ামা ছিলেন স্টিফেন হকিং-এর পিএইচডি সুপারভাইজার। রজার পেনরোজের সাথে যৌথভাবে অনেক গবেষণা করেছেন স্টিফেন হকিং। ব্ল্যাকহোলের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজের অসংখ্য গবেষণা রয়েছে। পেনরোজ জ্যোতির্বিজ্ঞানের গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব নিয়ে এসেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্ল্যাকহোলকে শক্ত বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দেয়ার পাশাপাশি পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিত করেছেন এবং জনপ্রিয়তা দিয়েছেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। এবছরের পুরষ্কারের অন্যতম একজন হতেন স্টিফেন হকিং। কিন্তু তিনি ব্ল্যাকহোলের ছবি পাওয়ার আগেই তিনি মারা যান ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ। রজার পেনরোজসহ অনেকেই ব্ল্যাকহোল সংক্রান্ত গবেষণায় স্টিফেন হকিং-এর অবদানের কথা স্মরণ করছেন। নোবেল কমিটিও এই কথা বলেছেন। নোবেল পুরষ্কারের প্রধান শর্ত হলো – বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ থাকতে হবে, এবং পুরষ্কার ঘোষণার সময় বিজ্ঞানীকে বেঁচে থাকতে হবে। সেই কারণেই ১৯৬৫ সালে উদ্ভাবিত তত্ত্বের জন্য রজার পেনরোজ নোবেল পুরষ্কার পেলেন আবিষ্কারের ৫৫ বছর পর।
বিস্ময়কর রহস্যে ভরা আমাদের মহাবিশ্ব। সেই প্রাচীন কাল থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে কাজ করে চলেছেন। পৃথিবীর প্রাচীনতম বিজ্ঞান হলো জ্যোতির্বিজ্ঞান। মানুষের হাতে যখন কোন যন্ত্রপাতি ছিল না, ছিল না কোন পূর্ব-ধারণা, তখন থেকেই শুধুমাত্র কৌতূহল আর নিরন্তর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানুষ আবিষ্কার করেছে মহাবিশ্বের অনেক রহস্য। গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথ, সৌরজগতের গ্রহ ও উপগ্রহগুলির অনেক বৈশিষ্ট্য মানুষের জানা হয়ে গেছে দূরবীণ আবিষ্কারের আগেই। দূরবীণ আবিষ্কারের পর মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনের গতি বেড়ে যায় বহুগুণ। কাছের নক্ষত্র পেরিয়ে মানুষের দৃষ্টিসীমা প্রসারিত হয় গ্যালাক্সি থেকে গ্যালাক্সিতে। শত কোটি বছর আগের নক্ষত্র থেকে উৎসারিত আলোর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে মহাবিশ্বের উৎপত্তির নাক্ষত্রিক ইতিহাস। সপ্তদশ শতাব্দীতে নিউটনের হাত ধরে আমরা জানলাম মহাবিশ্বের সর্বত্র নিরবিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে আছে মহাকর্ষ বল। উনবিংশ শতাব্দীতে পেলাম তড়িৎচৌম্বক বল। এবং বিংশ শতাব্দীতে পেলাম সবল নিউক্লিয়ার বল ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। এই চার ধরনের মৌলিক বলের মধ্যে মহাকর্ষ বল হলো সবচেয়ে দুর্বল। বাকি তিনটি বলই মহাকর্ষ বলের চেয়ে কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি (১০^৩৮) গুণ শক্তিশালী হলেও শুধুমাত্র মহাকর্ষ বলই সব জায়গায় সমস্ত ধরনের পদার্থের উপর কাজ করে। নিউটনের মহাকর্ষের সূত্র থেকে আমরা দেখি দুটো বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষ বলের পরিমাণ বস্তু দুটোর ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের বিপরীতানুপাতিক। অর্থাৎ বস্তুর ভর বাড়লে মহাকর্ষ বলের পরিমাণ বাড়বে, দূরত্ব বাড়লে মহাকর্ষ বলের পরিমাণ কমে যাবে। এই সহজ গাণিতিক হিসেব থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশিত হবার আগপর্যন্ত ধারণা ছিল যে যদি বস্তুর ভর শূন্য হয়, তাহলে তার উপর মহাকর্ষ বল কাজ করবে না। আলোর ভর নেই, এবং তার উপর মহাকর্ষ বল কাজ করে না – এরকম ধারণা ছিল। কিন্তু আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানের সেই ধারণা বদলে দিয়েছেন তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্ব দিয়ে। তিনি দেখিয়েছেন ভরের যে ধারণা আমাদের এতদিন ধরে ছিল – সেই ধারণা ভুল। মহাবিশ্বের সবকিছুর উপরই কাজ করে মহাকর্ষ বল। এই বলের প্রভাবেই স্পেস-টাইম বা স্থান-কালের পরিবর্তন হয়। আইনস্টাইনের তত্ত্ব এত শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানের অনেক ধারণা আমূল বদলে দেয়। শুরু হয় মহাবিশ্বকে নিউটনীয় মেকানিক্সের বদলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রয়োগে দেখার যুগ। বিংশ শতাব্দী থেকে – আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে বলা যায় – আইনস্টাইনের যুগ থেকে মহাজাগতিক পদার্থগুলির গতিপ্রকৃতির সূক্ষ্ম হিসেবে আপেক্ষিকতার প্রয়োগ অনিবার্য হয়ে পড়ে। আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এতটাই যুগান্তকারী যে আইনস্টাইন নিজেও ভাবতে পারেননি যে তাঁর তত্ত্ব থেকে পাওয়া যেতে পারে মহাবিশ্বের গভীর গোপন রহস্য – ব্ল্যাকহোল সৃষ্টির তত্ত্ব।
ব্ল্যাকহোল কী? বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম ব্ল্যাকহোলকে বলেছেন – কৃষ্ণ বিবর। অনেকে কৃষ্ণ গহ্বরও বলে থাকেন। কিন্তু বিবর বা গহ্বর বললে যেরকম গর্তের ধারণা আমরা পাই – ব্ল্যাকহোল কিন্ত সেরকম কোন গর্ত নয়। কিন্তু বোঝার সুবিধার্থে আমরা ব্ল্যাকহোলকে একটা অসীম গভীরতার গর্ত ধরে নিতে পারি যেখানে মাধ্যাকর্ষণ বলের টান এত বেশি যে সেখান থেকে কোন কিছুই আর বের হয়ে আসতে পারে না, এমনকি আলোও নয়। কেন এমন হয়? মহাবিশ্বের কোথায় আছে কিংবা সৃষ্টি হয় এই ব্ল্যাকহোল? চৌদ্দ শ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের উদ্ভবের পর থেকেই নানারকম মহাজাগতিক ঘটনা ঘটে চলেছে মহাবিশ্বে। মানুষ সেগুলি ভালোভাবে জানতে শুরু করেছে মাত্র কয়েক শ বছর আগে থেকে। নিউটনের মহাকর্ষ বলের সূত্র থেকে হিসেব করা গেছে বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের ভর, তাদের মুক্তিবেগ। পৃথিবীর মুক্তিবেগ সেকেন্ডে প্রায় ১১.২৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে কোন বস্তু যদি এই বেগে ছুড়ে দেয়া হয়, তাহলে সেটা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ভেদ করে চলে যাবে, আর কখনো পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। ১৭৮৩ সালে ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জন মিশেল এবং ১৭৯৬ থেকে ১৭৯৯ সালের মধ্যে ফরাসি গণিতবিদ পিয়েরে-সাইমন ল্যাপলাস নিউটনের সূত্র কাজে লাগিয়ে বড় আকারের নক্ষত্রের মুক্তিবেগ হিসেব করে দেখালেন যে যদি নক্ষত্রের মুক্তিবেগ আলোর বেগের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আলোও সেই নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ বল অতিক্রম করে যেতে পারবে না। তার মানে সেই নক্ষত্রটিকে কখনোই দেখা যাবে না। তাঁরা সেধরনের কল্পিত নক্ষত্রের নাম দিয়েছিলেন ডার্ক স্টার বা কৃষ্ণ নক্ষত্র বা কালো তারা।
জন মিশেল যে নক্ষত্রটিকে কল্পনা করেছিলেন সেই নক্ষত্রটির ব্যাসার্ধ ছিল আমাদের সূর্যের ব্যাসার্ধের ৫০০ গুণ। আর ল্যাপলাসের নক্ষত্রটি ছিল আমাদের সূর্যের ২৫০ গুণ, আর ঘনত্ব ছিল পৃথিবীর সমান, অর্থাৎ আমাদের সূর্যের চার গুণ। তাঁদের হিসেব থেকে একটি নতুন ধারণা পাওয়া গিয়েছিল – তা হলো কৃষ্ণ নক্ষত্রের ধারণা। এখন প্রশ্ন হলো কোন্ নক্ষত্র কৃষ্ণ নক্ষত্রের বৈশিষ্ট্য অর্জন করবে তার হিসেব করার কোন উপায় কি আছে? প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই নক্ষত্র থেকে কোন কিছুই বের হতে পারবে না। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র এবং গতি-শক্তির সূত্র কাজে লাগিয়ে সহজেই একটা বৈশিষ্ট্য বের করা গেল। দেখা গেল নক্ষত্রের ব্যাসার্ধ যদি একটা নির্দিষ্ট পরিমাপের চেয়ে কম হয় তাহলে সেখান থেকে কোন কিছু বের হতে পারবে না। এই ব্যাসার্ধ হলো 2GM/c^2, যেখানে G হলো মহাকর্ষ ধ্রুবক, M হচ্ছে নক্ষত্রের ভর, আর c হচ্ছে আলোর বেগ। (টেক্সট বক্স – ১)
১৯১৫ সালের নভেম্বর মাসে আইনস্টাইন পর পর তিনটি পেপারে তাঁর জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি গ্রাভিটেশনাল ফিল্ড বা অভিকর্ষজ ক্ষেত্রতত্ত্বের সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করেন। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বে স্থান-কাল জ্যামিতিকভাবে সমতল। কিন্তু সার্বিক তত্ত্বে স্থান-কাল অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে বেঁকে যায়। এদিকে ইওরোপে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জার্মান বিজ্ঞানীদের অনেকেই যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সোয়ার্তশিল্ড তখন আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু যুদ্ধাবস্থাতেও বাংকারে বসে সময় পেলে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করছেন। আইনস্টাইনের পেপারগুলি তাঁর কাছে পৌঁছেছে। তিনি সেখানে বসেই আইনস্টাইনের ফিল্ড ইকুয়েশান বা ক্ষেত্রসমীকরণের একটি সমাধান বের করে ফেললেন। স্ফেরিক্যালি সিমেট্রিক ঘূর্ণায়মান নয় – এমন কোন বস্তুর চারপাশের স্থান-কালের বক্রতার মেট্রিক্স সমীকরণ তিনি প্রকাশ করলেন আইনস্টাইনের পেপার প্রকাশিত হবার দু’মাসের মধ্যেই – ১৯১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি। এর দুমাস পরেই যুদ্ধাবস্থায় অসুস্থ হয়ে মারা যান সোয়ার্তশিল্ড। তাঁর সমীকরণ থেকে পাওয়া যায় ব্ল্যাকহোলের সর্বোচ্চ ব্যাসার্ধ বা ইভেন্ট হরাইজন। (বক্স -২)
সোয়ার্তশিল্ড সমীকরণ থেকেও ব্ল্যাকহোলের যে ব্যাসার্ধ পাওয়া যায় তা ১৭৮৩ সালের জন মিশেলের দেয়া সমীকরণের সাথে মিলে যায়। এই ব্যাসার্ধের কম হলেই তা হয়ে পড়ে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন। যাকে বলা হয় ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা-দিগন্ত। এই সূত্র থেকে আমরা যে কোন গ্রহ-নক্ষত্রের জন্য ঘটনা-দিগন্তের দূরত্ব হিসেব করতে পারি। যেমন আমাদের সূর্যের ভর যদি হয় 2 x 10^30 কিলোগ্রাম, তাহলে তার সোয়ার্তশিল্ড ব্যাসার্ধ হবে 2.95 কিলোমিটার। অর্থাৎ আমাদের সূর্য যদি নিজের মাধ্যাকর্ষণের টানে সংকুচিত হতে হতে তার বর্তমান ব্যাসার্ধ প্রায় সাত লক্ষ কিলোমিটার থেকে কমে মাত্র তিন কিলোমিটারে চলে আসে তাহলে এই সূর্য ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। আমাদের পৃথিবীর ক্ষেত্রেও এই হিসেব করা যায়। পৃথিবীর ভর 6 x 10^24 কিলোগ্রাম। পৃথিবীর বর্তমান ব্যাসার্ধ ৬,৩০০ কিলোমিটার থেকে সংকুচিত হতে হতে যদি মাত্র এক সেন্টিমিটারে চলে আসে তাহলে আমাদের পৃথিবী ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। এই বিরাট ভরকে যদি মাত্র এত ছোট আকারের ভেতর রেখে দেয়া হয় তাহলে তার ঘনত্ব হবে সাংঘাতিকভাবে বেশি। পৃথিবী ও আমাদের সূর্যের ব্ল্যাকহোল হবার যে শর্ত হিসেব করলাম, বাস্তবে তা হওয়া অসম্ভব। সব নক্ষত্রের শেষ পরিণতি কিন্তু ব্ল্যাকহোল নয়।
পেনরোজ এবং স্টিফেন হকিং ব্ল্যাকহোলের বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। হকিং দেখিয়েছেন বিশেষ অবস্থায় ব্ল্যাকহোল থেকে বিকিরণ নির্গত হতে পারে – যাকে আমরা হকিং রেডিয়েশান হিসেবে জানি। আর পেনরোজ তাঁর গাণিতিক মডেলে ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হরাইজন ব্যাখ্যা করেছেন কার্যকরভাবে। নক্ষত্র নিজের মাধ্যাকর্ষণের টানে চুপসে যায়। তারপর সেটা ঘটনা-দিগন্তে প্রবেশ করে ব্ল্যাকহোলে বিলীন হয়ে যায়। সেখান থেকে কিছুই আর ফিরে আসতে পারে না। চুপসে যাওয়া নক্ষত্রের আয়তন কমতে কমতে এমন একটা বিন্দুতে পৌঁছায় যেখানে আয়তন হয়ে পড়ে শূন্য, ঘনত্ব হয়ে পড়ে অসীম। সেক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানের কোন নীতিই আর কাজ করে না। এই বিন্দুকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি।
বিজ্ঞানীরা মহাকাশে ব্ল্যাকহোলের সন্ধান করতে শুরু করেছেন অনেক বছর আগে থেকে। জন মিশেল সেই ১৭৮৩ সালে ধারণা দিয়েছিলেন যে কালো তারা বা কৃষ্ণ নক্ষত্র থেকে কোন আলো বের হবে না। আমরা তাদের দেখতে পাবো না। কিন্তু অন্যান্য নক্ষত্র সেই কালো নক্ষত্রের অভিকর্ষন বলের টানে তার চারপাশে ঘুরতে থাকবে। প্রায় দুই শতাধিক বছর পর আমাদের গ্যালাক্সিতে এরকম একটি ব্যাপার আবিষ্কার করেছেন আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এনড্রিয়া গেজ এবং জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাইনহার্ড গেনজেল। সমস্ত তথ্যপ্রমাণ থেকে এটাই ধারণা করা হচ্ছে যে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে রয়েছে একটি ব্ল্যাকহোল। এই আবিষ্কারের জন্য ২০২০ সালে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন এনড্রিয়া গেজ এবং রাইনহার্ড গেনজেল।
রাইনহার্ড গেনজেলের জন্ম ১৯৫২ সালের ২৪ মার্চ জার্মানিতে। তাঁর বাবা লুডভিগ গেনজেল ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক। রাইনহার্ড রেডিও-অ্যাস্ট্রোনমিতে পিএইচডি করেন ম্যাক্স প্ল্যাংক ইন্সটিটিউট অব রেডিও-অ্যাস্ট্রোনমি থেকে ১৯৭৮ সালে। তারপর তিনি কাজ করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলিতে। সেখানে তিনি প্রফেসর। একই সাথে তিনি জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাংক ইন্সটিটিউট ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ফিজিক্সের ডিরেক্টর। কর্মজীবনের শুরু থেকেই তিনি মহাকাশ গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর দল চিলির ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরির টেলিস্কোপের মাধ্যমে গত তিরিশ বছর ধরে চোখ রেখেছেন আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের দিকে।
এদিকে ১৯৯০ এর শুরুতে আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপ্পুঞ্জের কেক পর্বতের উপর তৈরি হয়েছে অবজারভেটরি। সেখানে স্থাপিত হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যাসের টেলিস্কোপ। সেখান থেকে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে চোখ রাখলেন ২৫ বছর বয়সী মার্কিন তরুণী এনড্রিয়া মিয়া গেজ। তারপর ত্রিশ বছর ধরে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণের পর আবিষ্কার করতে পেরেছেন মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে প্রচন্ড ঘনত্বের সুপার-ম্যাসিভ পদার্থ যার ব্ল্যাকহোল হবার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা প্রায় নিশ্চিত। এই আবিষ্কারের জন্য এবছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন এনড্রিয়া গেজ। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের ইতিহাসে এপর্যন্ত তিনিই চতুর্থ নারী। ২১৬ জন নোবেল বিজয়ীর মধ্যে মাত্র চার জন নারী – মেরি কুরি (১৯০৩), মারিয়া গোয়েপার্ট-মেয়ার (১৯৬৩), ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড (২০১৮) এবং এবছর এনড্রিয়া গেজ।
এনড্রিয়া গেজের জন্ম ১৯৬৫ সালের ১৬ জুন নিউইয়র্ক সিটিতে। ছোটবেলা থেকেই মহাকাশের দিকে তাঁর প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। বড় হয়েছেন শিকাগোতে। শিকাগো ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এম আই টি থেকে ফিজিক্সে স্নাতক এবং ক্যালটেক থেকে পিএইচডি করেছেন ১৯৯২ সালে। তারপর গবেষণা ও অধ্যাপনা করেছেন আরিজোনা ইউনিভার্সিটিতে, কেমব্রিজে এবং ১৯৯৪ থেকে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস এঞ্জেলেসে। পদার্থবিজ্ঞানে মেয়েদের সংখ্যা এমনিতেই খুব কম। তার মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানে আরো কম। এমন একটি ফিল্ডে কাজ করতে গিয়ে এনড্রিয়াকে হতে হয়েছে অনেক বেশি শক্ত প্রকৃতির মানুষ। কৈশোরে স্বপ্ন ছিল চাঁদে যাওয়ার। প্রথম নারী হিসেবে চাঁদে যাওয়ার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন তিনি তাঁর মাকে। চাঁদে যাওয়ার কোন মিশন ছিল না সেই সময়। তাই ওই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিন্তু তিনি হয়েছেন বিশ্বের প্রথম নোবেলবিজয়ী নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী। মেয়েদেরকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে উৎসাহ দেয়ার জন্য ১৯৯৫ সালে তিনি একটি বইও লিখেছেন – ইউ ক্যান বি আ ওম্যান অ্যাস্ট্রোনমার।
আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে আছে অনেকগুলি নক্ষত্র আর প্রচুর উত্তপ্ত গ্যাস। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের অভিকর্ষজ ক্ষেত্রের পরিমাপ হিসেব করার জন্য এই নক্ষত্রপুঞ্জ ও গ্যাসের চলাচলের দিকে অনবরত দৃষ্টি রেখেছেন পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা। চিলির অবজারভেটরি থেকে রাইনগার্ড গেনজেলের দল, আর হাওয়াইর কেক অবজারভেটরি থেকে এনড্রিয়া গেজের দল স্বতন্ত্রভাবে নজর রাখছিলেন আর ডাটা সংগ্রহ করছিলেন মিল্কি-ওয়ে থেকে। প্রচন্ড মহাজাগতিক ধুলির ভেতর দিয়ে পৃথিবী থেকে কিছু দেখা প্রায় অসম্ভব। প্রতি একশ কোটি আলোর কণা থেকে মাত্র একটি আলোর কণা ফোটন এসে পৌঁছাতে পারে টেলিস্কোপের দৃষ্টিপথে। দুই দলই আলোর অবলোহিত তরঙ্গে দেখার চেষ্টা করেছেন। তাতে খুব সামান্য বেশি ফোটন ধরা পড়েছে লেন্সে। কিন্তু অনেক বেশি সময় লাগে ডাটা সংগ্রহ করতে। তাছাড়া পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের পরিবেশ বদলে যায় অনেক দ্রুত। তাতে সমস্যা হয় আরো বেশি। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠার জন্য তাঁদের নতুন বৈজ্ঞানিক কৌশল আবিষ্কার করতে হয়েছে। অনেক বেশি মাত্রার সংবেদী ডিজিটাল লাইট সেন্সর ব্যবহার করে তাঁরা কিছুটা ভালো ইমেজ পেলেন। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের প্রায় তিরিশটি উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের দিকে নজর রেখেছেন তাঁরা। তিরিশ বছর ধরে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করে এবং সংগৃহীত ডাটা থেকে উভয় দলই প্রমাণ পেয়েছেন যে সেখানে একটি নক্ষত্র S-02 গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরে আসছে মাত্র ষোল বছরে। নক্ষত্রের ক্ষেত্রে এটা খুবই কম সময়। আমাদের সূর্যের প্রায় বিশ কোটি বছর লাগে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে। ভিন্ন ভিন্ন দুটি জায়গা থেকে পর্যবেক্ষণ করে দুটি স্বতন্ত্র দল একই ফলাফল পেলো। তাতে এটাই প্রমাণিত হয় যে আমাদের গ্যলাক্সির কেন্দ্রে একটা ব্ল্যাক হোল আছে যার প্রচন্ড টানে S-02 নক্ষত্র এত প্রচন্ড বেগে ঘুরছে। হিসেব করে দেখা গেছে এই ব্ল্যাকহোলের ভর আমাদের সূর্যের ভরের চল্লিশ লক্ষ গুণ। আর এই চল্লিশ লক্ষ সূর্যকে টেনে আনা হয়েছে আমাদের সৌরজগতের যতটুকু জায়গা ততটুকুতে। এর নাম দেয়া হয়েছে স্যাজিটেরিয়াস এ স্টার ( Sgr A*)। যদিও এটাকে এখনো পুরোপুরিভাবে ব্ল্যাক হোল বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি, কিন্তু বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে অচিরেই গ্যালাক্সি M87 এর কেন্দ্রের ব্ল্যাকহোলের মতোই আমাদের Sgr A* ব্ল্যাকহোলেরও ছবি পাওয়া যাবে।
তথ্যসূত্র:
1. www.nobelprize.org
2. রজার পেনরোজ - সায়েন্টিফিক আমেরিকান, মে ১৯৭২
3. রজার পেনরোজ - জার্নাল অব ফিজিক্স (০১২০০১, ২০০৯)
4. স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজ - দ্য নেচার অব স্পেস এন্ড টাইম (১৯৯৬)
5. জামাল নজরুল ইসলাম – কৃষ্ণ বিবর (২০১৮)
_________________
বিজ্ঞানচিন্তা অক্টোবর ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment