#স্বপ্নলোকের_চাবি_৪১
বলা হয়ে থাকে ক্ষমতার লোভ মানুষকে পশু বানিয়ে ফেলে। কিন্তু
পশুরা কি আসলে ক্ষমতার তোয়াক্কা করে? তারা তো যা কিছু করে সবই করে পেটের তাগিদে আর
বংশবৃদ্ধির জৈবিক তাড়নায়। সিংহকে পশুদের রাজা বানিয়েছে মানুষ, পশুরা বানায়নি। কোন্
পশু সিংহকে ভয় করলো কি করলো না, সালাম দিল কি দিল না, রাজা মানলো কি মানলো না, তাতে
সিংহের কিংবা অন্য পশুর কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু একমাত্র মানুষই জোর করে অন্য মানুষের
আনুগত্য আদায় করতে চায়। বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করার পর সেই ক্ষমতা গণবিক্ষোভের মুখে
হাতছাড়া হয়ে যাবার উপক্রম হতেই আহত সিংহের মতো তড়পাতে শুরু করেছেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ,
তাঁর ভাইস-প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমেদ, প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফরসহ অন্যান্য সব সুবিধাভোগী।
ক্ষমতার স্বাদ একবার পেলে তা হারাতে চায় না কেউ। বাংলাদেশে
সরকারের উঁচু পদের কথা বাদই দিলাম একেবারে নিচুপদের কর্মচারিরাও দায়িত্বকে দায়িত্ব
মনে করে না, মনে করে ক্ষমতা। সরকারের কেউ ভুল করেও বলে না যে তারা দায়িত্বে আছে, বলে
ক্ষমতায় আছে। এই ক্ষমতার মধুর হাঁড়ি যেকোনো প্রকারেই তারা নিজেদের আয়ত্বে রাখতে মরিয়া
হয়ে উঠেছে। দেশের ভেতর হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি করার জন্য
এরশাদের ভাড়াটে গুন্ডারা মন্দিরে আগুন দিয়েছে সারাদেশে, হিন্দুদের বাড়িঘর লুটপাট করেছে।
কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি
জাতীয় পার্টি আর জামায়াত ছাড়া দেশের বাকি সবগুলি রাজনৈতিক দল একজোট হয়ে এরশাদ হটাও
– এই এক দাবিতে সংগ্রাম করছে।
কিন্তু এরশাদের মন্ত্রণাদাতারা বসে নেই। তারা আওয়ামী লীগের
জোট আর বিএনপি জোটের মধ্যে পরস্পরের অবিশ্বাস তৈরি করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রঐক্য
ও ছাত্রদলের মধ্যে বন্দুকযূদ্ধ লাগিয়ে দিলো। ২৫ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
রণক্ষেত্রে পরিণত হলো। সাতজন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হলো। পরদিন আবার আক্রমণ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ক্যাম্পাসে। একজন ছাত্র প্রাণ দিলো বন্দুকের গুলিতে, গুলিবিদ্ধ হলো আরো অনেকে।
সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে।
এরশাদ সরকার নির্বাহী আদেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলো। আমাদের ইউনিভার্সিটিও
বন্ধ হয়ে গেল পুরো ডিসেম্বর মাসের জন্য।
সারাদেশে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় মিলিটারি
টহল দিচ্ছে। ক্ষমতায় থাকার জন্য নিজের দেশের মানুষের উপর গুলি চালানোর আদেশ দিয়েছে
এরশাদ সরকার।
জরুরি আইন চলছে। মেস থেকে শহরে যাওয়াও এখন জটিল হয়ে যাচ্ছে।
খুব দরকার ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। জরুরি আইনে পুলিশ যাকে খুশি তাকে রাস্তা
থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শুনেছি এরকম অবস্থা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়। ১৯৭১-এর
পর ১৯৯০-এ আরেকটি যুদ্ধ শুরু হয়েছে – স্বৈরাচার-মুক্তির যুদ্ধ।
৩০শে নভেম্বরের মধ্যে সকল মন্ত্রী ও এমপিদের পদত্যাগ করতে
হবে – এই দাবি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এসব দাবিদাওয়ার কোনকিছুই সরকার-নিয়ন্ত্রিত রেডিও-টেলিভিশনে
প্রকাশ করা হয় না। টিভিতে এখনো নির্লজ্জভাবে নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে এরশাদের গান – নতুন
বাংলাদেশ গড়বো মোরা …। সংবাদপত্রগুলি নিয়মিত প্রচার করছে সারাদেশে এরশাদবিরোধী বিক্ষোভের
খবর। এবার সেগুলিও যেন প্রকাশিত না হয়, সে ব্যবস্থা করলো সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়।
আদেশ জারি হলো সংবাদপত্রে যে কোন খবর প্রকাশের আগে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়ে
যুগ্মসচিবের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে আসতে হবে।
এর প্রতিবাদে সাংবাদিকরা ধর্মঘটে নামলেন। সংবাদপত্র বন্ধ
হয়ে গেল। মানুষ রাজপথে নেমে এলো। মানুষকে দমানোর জন্য আধা-সামরিক বাহিনী বিডিআর লেলিয়ে
দেয়া হলো। সামরিক বাহিনিকে রেডি রাখা হলো – আদেশ পাওয়ামাত্র ট্যাংক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে
মানুষের উপর।
২৭ নভেম্বর ঢাকায় এরশাদের ভাড়াটে খুনিরা গুলি করে খুন করে
বিএমএ-র যুগ্মসম্পাদক ডাক্তার শামসুল আলম খান মিলনকে। এরশাদের স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে
ডাক্তারদের আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন ডাক্তার মিলন। ডাক্তার মিলনের হত্যাকান্ড বিক্ষোভের
আগুনে পেট্রোল ঢেলে দিলো। মুহূর্তে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লো সারাদেশে।
এর পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশে রচিত হলো আরেকটি
স্বৈরাচার-মুক্তির ইতিহাস। ২৭ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশ ও বিডিআরের গুলিতে
প্রাণ হারিয়েছেন পঞ্চাশেরও বেশি মানুষ – যার মধ্যে ঢাকায় ত্রিশ জন, চট্টগ্রামে ছয় জন,
রাজশাহীতে তিন জন, খুলনায় তিন জন, নারায়ণগঞ্জে ২ জন, ময়মনসিংহে ৪ জন। সংবাদপত্র বন্ধ।
এসব খবরের জন্য ভারতীয় আকাশবাণী, বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকার খবর শুনছি নিয়মিত। একাত্তরে
মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনতে হতো গোপনে। এখন সবাই খবর শুনছে প্রকাশ্যে। এরমধ্যেই টেলিভিশনে
মওদুদ আহমেদ প্রতিদিন ব্যাখ্যা করে চলেছেন এরশাদ সাহেব যে কত ভালোমানুষ, দেশের জন্য
কত ভালো ভালো কাজ করেছেন ইত্যাদি।
২৮ নভেম্বর সকাল থেকে ঢাকা অবরুদ্ধ হয়ে গেল। ছাত্র-শিক্ষক
পেশাজীবী সবাই রাজপথে নেমে এসেছেন। রেললাইনে ট্রেন রেখে ড্রাইভাররা চলে গেছেন। ট্রেন-চলাচল
বন্ধ হয়ে গেল। জেলা শহরগুলিতে কারফিউ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কেউ মানছে না কারফিউ।
২৯ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ সকল শিক্ষক একযোগে
পদত্যাগ করার ঘোষণা দিলেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সকল শিক্ষক একযোগে পদত্যাগপত্র
জমা দিলেন।
৩০ নভেম্বর জুমার নামাজের পর গায়েবানা জানাজার কর্মসূচীতে
বাধা দেয়ার জন্য মিলিটারিরা বায়তুল মোকারম মসজিদ ঘিরে ফেলে। এতে মুসল্লীরা ক্ষেপে যায়।
মিলিটারির বাধা উপেক্ষা করে গায়েবানা জানাজার শেষে বের হয় বিশাল মিছিল। কাকরাইলের মোড়ে
সেই মিছিলে গুলি করতে শুরু করে এরশাদের পুলিশ। পুলিশের এলোপাথাড়ি গুলিতে রামপুরা ওয়াপদা
রোডের এক বাসায় নিহত হন একজন তরুণী মা। তার কোলে তখন দুধের শিশু, সেই শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন
তিনি।
সারাদেশে বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে কল-কারখানায়।
কালুরঘাটে শ্রমিকদের মিছিলে মিলিটারি গুলি করে মেরেছে কয়েকজন শ্রমিককে।
ডিসেম্বরের শুরু থেকে চট্টগ্রামে বিজয়মেলা শুরু হয় সার্কিট
হাউজের মাঠে। কিন্তু এবার সেই মাঠ এবং আউটার স্টেডিয়াম দখল করে ফেলেছে মিলিটারিরা।
বিজয়মেলা যেন হতে না পারে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে এরশাদ। স্বাধীন বাংলাদেশে বিজয়
উদ্যাপন করতে দেবে না!
ডিসেম্বরের তিন তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন বিক্ষোভ হয়েছে – আর
প্রতিদিনই বিক্ষোভে মিছিলের মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি করা হয়েছে। ক্যান্টনমেন্টের
মিলিটারিরা রাস্তায় টহল দিচ্ছে। ঘরভাড়া নিতে এসে খান সাহেব অনুরোধ করলেন বাড়িতে চলে
যেতে। তিনি নাকি নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর পেয়েছেন মিলিটারিরা রাতের অন্ধকারে দেশের সব
ছাত্রাবাস ও মেসে মেসে গিয়ে ছাত্রদের ধরে নিয়ে যাবে যেন কোন মিছিল না হতে পারে। তিন
তারিখের মধ্যে আমাদের মেস খালি হয়ে গেল। সবাই যে যার বাড়িতে চলে গেছে।
কারফিউ চলছে। দূরপাল্লার বাস-ট্রেন সব বন্ধ। চার তারিখ সকালে
বের হয়ে অনেকবার গাড়ি বদলে বাড়ি পৌঁছতে পোঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাতে ভয়েস অব আমেরিকার
খবরে জানতে পারলাম এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। চার তারিখ সকালেই ঢাকায় গণ-অভ্যুত্থান
ঘটে গেছে। সচিবালয়সহ প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী আর এরশাদের অধীনে কাজ করবেন
না ঘোষণা দেয়ার পর এরশাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার আর কোন পথ রইলো না। তিনজোট মনোনীত তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের প্রধানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার ঘোষণা দিতে বাধ্য হলেন এরশাদ।
একাত্তরে যখন পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমপর্ণ করে, বাংলাদেশের
বিজয় ঘোষিত হয় তখন মানুষের কী রকম লেগেছিল তা বোঝার বয়স আমার হয়নি। কিন্তু এবার বুঝতে
পারলাম বিজয়ের আনন্দ কী।
সাংবিধানিক কত বাধ্যবাধকতা দেশে। অথচ জরুরি আইন প্রয়োগ করে
সংবিধান অচল করে দেয়া যায়। প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান
মনোনীত করা হলো। সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলে ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্টের
দায়িত্ব পান। সে হিসেবে এরশাদ পদত্যাগ করলে মওদুদ আহমেদ প্রেসিডেন্ট হবেন। কিন্তু সে
গুড়ে বালি। প্রেসিডেন্ট এরশাদের আগে পদত্যাগ করতে হলো ভাইস-প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমেদকে।
নতুন ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন
আহমেদ। এবার এরশাদ পদত্যাগ করলেন। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন
আহমেদ। দায়িত্ব নিয়েই তিনি এরশাদ এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গকে গ্রেফতারের আদেশ দিলেন। স্বাস্থ্যনীতি
ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অধ্যাদেশ বাতিল করা হলো।
এরশাদ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কন্ঠরোধ করেছিলেন। সেই প্রতিবাদে
সংবাদপত্র বন্ধ ছিল এতদিন। এরশাদের পতনের খবর প্রকাশের মাধ্যমে দেশের সব সংবাদপত্র
আবার প্রকাশিত হলো। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হচ্ছে। ডিসেম্বরের নয় তারিখ
আমাদের ইউনিভার্সিটিও খুলে গেল।
বিপুল আনন্দ আর উৎসাহ নিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরলাম। সবার ভেতর
আনন্দ। চারদিকে উৎসবের আয়োজন চলছে, বিজয়মেলা শুরু হয়েছে নতুনভাবে, নতুন উৎসাহে। এবারের
বিজয়দিবসে স্বৈরাচারমুক্তির বিজয়মিছিল করা হবে।
তার আগে ১২ ডিসেম্বর আমাদের ক্যাম্পাসে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের
বিজয়মিছিল হলো। মিছিলে মিছিলে মুখরিত ক্যাম্পাসের ফ্যাকাল্টি থেকে ফ্যাকাল্টিতে ঘুরতে
কী যে আনন্দ লাগছিলো। দেখলাম ছাত্রশিবির আলাদা একটা বিজয়মিছিল বের করেছে। বিজয়ের কৃতিত্বের
ভাগ সবাই নিতে চায়। কিন্তু সারাদেশ জানে এরশাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জামায়াতশিবিরের
তেমন কোন ভূমিকা ছিল না। বিজয়ের আনন্দে আমরা ভুলে যেতে বসেছিলাম যে মাত্র কিছুদিন আগেই
ছাত্রশিবিরের ভরাডুবি হয়েছে চাকসু নির্বাচনে। সেই পরাজয়ের ক্ষোভ এখনো তাদের যায়নি।
এরশাদের ছাত্রসংগঠনকে হটিয়ে ছাত্রশিবির আমাদের ক্যাম্পাস দখল করেছে ১৯৮৬তে। এরপর এরশাদপন্থীদের
বেশিরভাগই শিবিরে যোগ দিয়েছে। সে হিসেবে এরশাদপন্থীরা এখন আর শিবিরের শত্রু নয়। শিবিরের
শত্রু হলো তারা যারা প্রগতির কথা বলে, গণতন্ত্রের কথা বলে। কারণ শিবিরের সংবিধানে গণতন্ত্রের
কোন বিধান নেই, নির্বাচনের কোন বিধান নেই। তবুও তারা নির্বাচনে কী কারণে অংশ নেয় জানি
না।
ছাত্রঐক্যের বিশাল বিজয়মিছিলের পর আর্টস ফ্যাকাল্টির সামনের
চত্বরে সভা হলো। বিজয়ের আনন্দে ভাসছে আমাদের ক্যাম্পাস। গত চার বছরে এমন স্বতস্ফূর্ত
ক্যাম্পাস আর দেখিনি।
মেয়েদের প্রায় সবাই আজ রঙিন শাড়ী পরে এসেছে। সবাইকে কেমন
যেন অন্যরকম লাগছে। আমার সহপাঠীদেরকেই আমি চিনতে পারছিলাম না। রিনা রাখী লিপি লীনা
পারুল ইলা রেহানা বিউটি দিলারা ইলোরা শীলা রুমা সবাই সেজেগুজে এসেছে। সাধারণত বসন্তেই
এরকম সাজে জানতাম। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে বসন্ত আগেই চলে এসেছে। আমি আইরিনকে খুঁজছিলাম
তার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য। আইরিন মিলিটারি অফিসারের বউ। কয়েকদিন আগেও ভীষণ ক্ষমতাশালী
ছিলেন মিলিটারি অফিসাররা। এখন কি সেই ক্ষমতার কোন পরিবর্তন হয়েছে? খুব জানতে ইচ্ছে
করছিল। কিন্তু আইরিন আসেনি।
শীতের দুপুরের তেরছা রোদে জারুল গাছের নিচে ছায়া নেই। ওখানেই
দাঁড়িয়েছিলাম সবাই। হাফিজ, ইকবাল, প্রেমাঙ্কর, শরীফ, ফারুক, অশোক, রাহুল, ঝিনুক, শফিক।
মাস্টার্সে এখন আমাদের ক্লাসমেটের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। চট্টগ্রাম কলেজ, কুমিল্লা
ভিক্টোরিয়া কলেজ, আর সিলেটের এমসি কলেজ থেকে যারা অনার্স পাস করেছে তারা এসেছে। আবার
প্রিলিমিনারি থেকেও এসেছে অনেকে।
মাইকে ভেসে আসছে মিটিং-এর বক্তাদের কথাবার্তা। মন দিয়ে শোনার
ইচ্ছে নেই কারো। আমরা যে যার মতো গল্প করছি। যীশু শীলার সাথে কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া লাগিয়েছে।
রিনার সাথে কথা বলতে গেলাম। সে একটা ধমক দিলো, “আমার সাথে কথা বলবি না তুই।“ সে কী
কারণে আমার উপর রেগে আছে আমি এখনো জানি না। ফারুক গলা খুলে আবৃত্তি করছে, “ব্যর্থ হয়ে
থাকে যদি প্রণয়ের এত আয়োজন, আগামী মিছিলে এসো, স্লোগানে স্লোগানে হবে কথোপকথন।“
হঠাৎ আমাদের ভিসিস্যারের নাম কানে এলো। প্রফেসর আলমগীর মোহাম্মদ
সিরাজুদ্দিনের ভাষণটা শোনা দরকার। তিনি এরশাদের স্বৈরাচার থেকে মুক্ত হবার পর ক্যাম্পাসকে
রাজাকার-আলবদর থেকে মুক্তির প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। তিনি বলছেন একাত্তরের দালালেরা
আজ নব্বইতে এসে বিপ্লবী সেজেছে। মুক্তির আনন্দ কয়েকশ গুণ বেড়ে গেলো। এবার কি তবে সত্যিই
শিবিরমুক্ত হতে চলেছে আমাদের ক্যাম্পাস?
কিন্তু তখনো জানতাম না কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। ভিসিস্যারও
সম্ভবত জানতেন না একাত্তরের দালালেরা নব্বইতে এসে আরো কী পরিমাণ শক্তিশালী হয়েছে। প্রফেসর
আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনের কথায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হলো ছাত্রশিবির এবং তাদের হাইকমান্ড
জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে।
পরদিন ক্যাম্পাসে গিয়ে খবর পেলাম ছাত্রশিবির ভিসিস্যারের
বাসভবন অবরোধ করে রেখেছে গতরাত থেকে। স্যারকে বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছে না। ছাত্রশিবিরের
দাবি – ভিসিস্যারকে তাঁর -একাত্তরের দালালরা নব্বইতে বিপ্লবী সেজেছে- কথার জন্য ক্ষমা
চাইতে হবে, নইলে পদত্যাগ করতে হবে।
স্বৈরাচারমুক্তির আনন্দের বেলুন চুপসে যেতে সময় লাগলো না।
সারাদেশে কী পরিবর্তন হবে জানি না, কিন্তু আমাদের ক্যাম্পাসে তার কোন প্রভাব পড়বে বলে
মনে হচ্ছে না। ভিসিস্যারের বাসা এখন অবরুদ্ধ, ক্রমেই হয়তো তারা ক্যাম্পাস অবরুদ্ধ করে
ফেলবে। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়েছে ঢিমেতালে। আমাদের ব্যাচ থেকে
মাস্টার্সের সিলেবাসে পরিবর্তন এসেছে। আগের ব্যাচ পর্যন্ত সাবজেক্ট নিতে হতো তিনটি।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স সবার জন্য বাধ্যতামূলক। বাকি দুইটা সাবজেক্ট বেছে নেয়ার সুযোগ
ছিল। প্রতি সাবজেক্ট ১০০ মার্কের। এখন আমাদের চারটি সাবজেক্ট নিতে হবে। প্রতি সাবজেক্টের
মার্ক ৭৫। কোয়ান্টাম মেকানিক্স আর ইলেকট্রনিক্স বাধ্যতামূলক। বাকি দুইটা সাবজেক্ট নিতে
হবে। ইলেকট্রনিক্স আমার প্রিয় সাবজেক্ট নয়। কিন্তু বাধ্যতামূলক বলে তা নিতেই হচ্ছে।
নিউক্লিয়ার ফিজিক্স আর সলিড স্টেট ফিজিক্স নিলাম।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রথম ক্লাসটা নিতে এলেন অরুনস্যার।
অরুনস্যারের কোন ক্লাস অনার্সের কোন ইয়ারে পাইনি। অরুনস্যার আমাদের ডিপার্টমেন্টের
সবচেয়ে লম্বাস্যার। অনার্সে প্রামাণিকস্যারের কোয়ান্টাম কিছুই বুঝিনি। পরীক্ষা পাস
করেছি জোড়াতালি দিয়ে – মানে ঠিকমতো না বুঝেই। মাস্টার্সে কি সেই অবস্থার কিছু পরিবর্তন
হবে? অরুনস্যার কেমন পড়াবেন জানি না। প্রথমদিনই তিনি যেভাবে বকাবকি শুরু করেছেন – তাতে
কেমন যেন প্রাইমারি স্কুলের কোন ক্লাসে বসে আছি বলে মনে হচ্ছে।
“তোদের অনার্স পরীক্ষার খাতার যা নমুনা আমি দেখলাম, কাকের
ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং হাবিজাবি লিখে খাতা ভরিয়েছিস। মাস্টার্সে সেরকম করলে পাসের মুখ দেখতে
হবে না। প্রামাণিকস্যার অনেক চমৎকার পড়ান। কিন্তু সেগুলি বোঝা তোদের মতো গাধাদের কাজ
নয়।“
স্যার কি আমাদের চেহারা দেখেই বুঝে গেলেন যে আমরা সবাই গর্দভের
ভাই-বোন? কিন্তু স্যার সেখানে থামলেন না।
“তোরা হলে কে কে থাকিস? অনেকেই থাকিস। হেহেহে।“ – স্যারের
হাসিটা ঠিক কিসের মতো বোঝানো যাবে না। এটা ঠিক হাসি নয়, এটা হচ্ছে বিদ্রুপ আর তাচ্ছিল্যের
সংকর।
“তোরা হলে কী কী করিস আমি জানি তো। সকালে ট্রেন আসার সময়
হলে হলের সামনের চায়ের দোকানে বসে নাস্তা করার নামে হা করে মেয়ে দেখিস। আর বিকেল হতে
না হতেই স্নো-পাউডার মেখে মেয়েদের হলের সামনে গিয়ে হাজির হোস।“
স্যার কি প্রথমদিনই বকাবকি করে নিচ্ছেন, নাকি সব ক্লাসেই
এরকম বকাবকি করবেন বুঝতে পারছি না। শুধু কি বকাবকিই করবেন, নাকি কিছু পড়াবেনও?
“আমি তোদের যা পড়াবো সেগুলি কোন বইতে পাবি না। সুতরাং আমার
ক্লাস না করলে মারাত্মক ভুল করবি। যদি ভেবে থাকিস ইন্ডিয়ান বই পড়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্স
পাস করবি, তাহলে পাস করার কথা ভুলে যা।“
স্যারের হাতের লেখা বেশ পরিচ্ছন্ন। বোর্ডে সবকিছু পরিষ্কার
করে লিখতে শুরু করেছেন। প্রামাণিকস্যারের হাতের লেখা বুঝতে কষ্ট হতো। অরুণস্যারের হাতের
লেখা বোঝা যাচ্ছে। শুধু এটুকুই উন্নতি হয়েছে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এখনো মাথায় ঢুকছে
না। গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি শক্ত না হলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্বটা হয়তো
বোঝা যাবে, কিন্তু মূল মেকানিক্স – যেটা আসলে গণিত – সেটা বোঝা যাবে না। গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান
বুঝতে হলে গণিত বুঝতে হবে। সেই গণিতের ভিত্তি শক্ত হতে হবে উচ্চমাধ্যমিক থেকে। এই উপলব্ধিটা
যখন হওয়ার দরকার ছিল তখন হয়নি। এখন হা-হুতাশ করে কী হবে।
ক্যাম্পাসে শিবিরের মিছিল বের হচ্ছে প্রতিদিন। তারা ভিসিস্যারের
নামে আজেবাজে শ্লোগান দিয়ে মিছিল করছে। ছাত্রঐক্য তার প্রতিবাদে মিছিল বের করার প্রস্তুতি
নিতেই সময় খেয়ে ফেলছে। চাকসুর নির্বাচিত নেতাদের কর্মকান্ড যেভাবে চোখে পড়ার কথা সেভাবে
পড়ছে না।
এরশাদ অনির্ধারিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখেছিলেন অনেকদিন।
সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবারের শীতকালীন ছুটি বাতিল করা হয়েছিল। তাই এখনো ক্লাস চলছে।
ডিসেম্বরের ২০ তারিখ থেকে তিন-চারদিনের জন্য রাঙ্গুনিয়া বেড়াতে
যাবার একটা সুযোগ এলো। আমার বৌদির গ্রামের বাড়ি। নতুন জায়গা, আগে কোনদিন যাইনি। ভ্রমণ
আমার প্রিয় বিষয়। ভ্রমণের সুযোগ পেলেই কাজে লাগাতে হয়। কিন্তু অরুনস্যারের ক্লাস মিস
দেয়া ঠিক হবে কি না সে ব্যাপারে একটু দ্বিধান্বিত ছিলাম। কিন্তু সেই দ্বিধা কেটে গেলো।
অরুনস্যার বলেছিলেন তিনি যেগুলি পড়াবেন সেগুলি কোন বইতে পাওয়া যাবে না, ইন্ডিয়ান বইতে
তো নয়ই। তাঁর দুইটা ক্লাসের পরেই লাইব্রেরিতে গিয়ে সিলেবাসে যে কয়টা বইয়ের নাম দেয়া
আছে সেগুলি একটা একটা করে খুঁজে দেখেছি – স্যার বোর্ডে যেগুলি লিখে দিয়েছেন সেগুলি
কোন বইতেই সেভাবে নেই। ইন্ডিয়ান বই তো স্যার বলেই দিয়েছেন না ধরতে। কিন্তু অজিতের টেবিল
থেকে গুপ্ত-কুমারের কোয়ান্টাম মেকানিক্স খুলে বেশ অবাক হয়ে দেখলাম, সেখানে স্যারের
লাইনগুলি হুবহু বর্তমান। অরুনস্যারের ক্লাস করার বাধ্যবাধকতা আর রইলো না। চলে গেলাম
রাঙ্গুনিয়া।
গ্রামীন সৌন্দর্য আর আতিথেয়তায় দ্রুত কেটে গেলো তিন দিন।
পার্বত্য অঞ্চলের গ্রাম। বিদ্যুৎ নেই। শহরের খবর সেখানে নিয়মিত পৌঁছায় না। নিয়মিত পত্রিকাও
যায় না সেখানে। কেউ শহর থেকে গেলে পত্রিকা নিয়ে যায়। শহরের খবর তেইশ তারিখ সন্ধ্যায় এক বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়ে
সেদিনের পেপারে চোখ গেল। বাইশ তারিখ আমাদের ক্যাম্পাসে ছাত্রঐক্যের মিছিলে হামলা করেছে
জামায়াত-শিবির। ছাত্র-শিক্ষকসহ অনেকেই আহত হয়েছে। শিক্ষকপরিষদের সভাপতি প্রফেসর হামিদা
বানুকে টার্গেট করে আক্রমণ করেছে শিবিরের ক্যাডাররা। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন।
ছাত্রনেতা ফারুকুজ্জামান ফারুক নিহত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ
ঘোষণা করা হয়েছে।
আমার মন কু গাইছে। ফারুকুজ্জামান ফারুক কে? আমাদের ফারুক
নয় তো! ওরা কি নাম ভুল করতে পারে না? আমার বন্ধুরা সব ভালো আছে তো?
পরদিন সকালে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে এলাম শহরে। যীশুর বাসায়
গেলাম। যীশু ক্ষোভে ফুঁসছে। সে আর প্রদীপ নাথ ছিল সেই মিছিলে। অল্পের জন্য বেঁচে গেছে।
ওরা আক্রমণ করেছে রেল-গেইটের কাছে। হামিদা বানু ম্যাডামকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল ওরা।
ছাত্রছাত্রীরা কোন রকমে রক্ষা করেছে। ফারুকুজ্জামান ফারুক আমাদের ক্লাসের ফারুক নয়।
কিন্তু আমাদেরই তো মানুষ। আমাদের ক্লাসের শরীফের পেটের মধ্যে লোহার রড ঢুকিয়ে দিয়েছে।
শরীফ – আমাদের বন্ধু শরীফ, ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী শরীফ, হাসিখুশি শরীফ – এখন হাসপাতালের
বেডে শুয়ে আছে জীবন-মরণের মাঝামাঝি।
No comments:
Post a Comment