#স্বপ্নলোকের_চাবি_৪৬
ফিজিক্স অব লাইট বা আলোক সংক্রান্ত পদার্থবিজ্ঞান ঘাঁটতে গিয়ে ‘জাস্ট নোটিশেবল ডিফারেন্স’ বা জেএনডি বলে একটা ব্যাপার জেনেছি। ব্যাপারটা হলো আলোর কারণে অনেক কিছুই বদলে যায়, কিন্তু সব পরিবর্তন আমাদের চোখে পড়ে না। পরিবর্তন চোখে পড়ার জন্য কিছু শর্ত মেনে চলে আমাদের চোখ, আমাদের স্নায়ু, আমাদের মস্তিষ্ক।
হঠাৎ পরিবর্তন যেভাবে আমাদের চোখে লাগে, চোখের সামনে প্রতিদিন একটু একটু করে ঘটতে থাকা পরিবর্তন আমরা সেভাবে টের পাই না। গত পাঁচ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে এই ক্যাম্পাসের যা আমরা আলাদাভাবে খেয়াল করিনি। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে আমাদের লাইব্রেরির। চমৎকার ঝকঝকে নতুন গ্রন্থাগারভবন তৈরি হয়েছে। আগের অপরিসর ভবন থেকে নতুন সুপরিসর ভবনে এসে হাজার হাজার বই যেন নতুন করে আলোর মুখ দেখছে। যদিও আমরা এখনো লাইব্রেরি থেকে বই ধার করে বাড়ি নিয়ে যেতে পারি না, তবে লাইব্রেরিতে বসে পড়তে পারি যে কোনো বই। বইয়ের তাকগুলি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এখন বইয়ের তাক থেকে টেনে নিয়ে পড়তে পারি যে কোনো বই – আগের মতো স্লিপ দিয়ে অপেক্ষা করতে হয় না। লাইব্রেরির রেফারেন্স সেকশানে অসংখ্য বই। এতদিন এই বইগুলিকে কেন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখা হয়েছিল জানি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হলো উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চা, জ্ঞানবৃদ্ধি আর নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি। মুক্তচিন্তার লালন ও অনুশীলনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হতে পারে না। এই নতুন লাইব্রেরি নিশ্চয় আমাদের নতুন জ্ঞান সৃষ্টির সহায়ক হবে। ইদানীং একটু সময় পেলেই লাইব্রেরিতে ঢুকে যাচ্ছি।
লাইব্রেরির ভেতরের হাজার হাজার বইয়ের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে লাইব্রেরির সামনের সিঁড়ি। মূল রাস্তা থেকে লাল ইটের সিঁড়ি ধাপে ধাপে উঠে গেছে পাহাড়ের উপর লাইব্রেরির প্রধান ফটকে। সেখানকার মোজায়েক করা প্রশস্ত সিঁড়িতে বসে আড্ডা দেয়া শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। লাইব্রেরির সিঁড়ি হয়ে উঠেছে অনেকের মিটিং-পয়েন্ট। এখানেই আজ অনামিকাদের সাথে দেখা হবার কথা।
বাস থেকে নেমে রাস্তার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। লাইব্রেরির সিঁড়ি আজ জনশূন্য। সিঁড়ির মাঝামাঝি একটুখানি জায়গা রেখে বাকিটাতে মোটা মোটা নাইলনের দড়ি আর বিশ্রি বাঁশ বেঁধে নোটিশ ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে – “এখানে বসা নিষেধ।“ এসব কাদের কাজ তা আর বলে দিতে হবে না। ক্যাম্পাসে কে কোথায় বসবে – তাও ঠিক করে দেবে ছাত্রশিবির?
অন্ধকারে থাকতে থাকতে অনেক পোকা অন্ধ হয়ে যায়। কয়েক প্রজন্ম পরে সেই প্রজাতির পোকা অন্ধ হয়েই জন্মায়। আমাদেরও অনেকটা সেই দশাই হয়েছে। ক্যাম্পাসের বাইরে রেলস্টেশনে গেলেই আমাদের বীরত্ব বেড়ে যায়। ট্রেনে সিটের জন্য আমরা মারামারি করি, বাসে হাফ-ভাড়া দেয়ার জন্য আমরা কন্ডাক্টরের উপর চড়াও হই – কিন্তু ক্যাম্পাসে আমরা শিবিরের ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকি। আসলে গত পাঁচ বছরে আমরা সবাই কেঁচো হয়ে গিয়েছি।
আশেপাশে তাকালাম। প্রদীপ নাথ আর সুশান্তের এখানে থাকার কথা। হলে থাকে বলে তারা আমার আগেই ক্যাম্পাসে আসে। লাইব্রেরির বারান্দায় উঠে এলাম। সেখানেও নেই তারা।
চলে এলাম ডিপার্টমেন্টে। ক্লাসরুমের সামনে প্রদীপ নাথের সাথে দাঁড়িয়ে আছে সুশান্ত আর তার বোন অনামিকা। প্রদীপ নাথের মাধ্যমে সুশান্তের সাথে আমাদের পরিচয় অনেকদিনের। আমাদের ব্যাচে অ্যাকাউন্টিং-এ পড়ে সুশান্ত, শাহজালালে থাকে। অনামিকা এবার ফিজিক্সে ভর্তি হয়েছে। অনামিকার আরো কয়েকজন বন্ধু - মুক্তি, প্রীতি, জিনাতের সাথেও পরিচয় হলো। তাদের ক্লাস এখনো নিউট্রন জেনারেটর বিল্ডিং-এ হচ্ছে। ফার্স্ট ইয়ারের পর আর যাওয়া হয়নি সেই বিল্ডিং-এ। আমাদের পর আরো চার ব্যাচ ভর্তি হয়ে গেছে ডিপার্টমেন্টে!
সোবহানস্যারকে আসতে দেখে তাদের বিদায় দিয়ে ক্লাসে ঢুকলাম। সোবহানস্যারের পাঞ্জাবীর দৈর্ঘ্য ক্রমশ বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে অচিরেই তা ভূমি স্পর্শ করবে। ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্সের লজিক গেইট পড়াচ্ছেন তিনি। বিদেশী বই থেকে পড়ালে যা হয় – উদাহরণগুলি থাকে বিদেশী। এক্সক্লুসিভ অর গেইটের একটা উদাহরণে আছে ব্লন্ড আর ব্রুনেটের কথা। এগুলি কী বস্তু কোন ধারণাই নেই আমার। সোবহানস্যার ব্লন্ডের বাংলা বললেন ফর্সা মেয়ে, আর ব্রুনেট – কালো মেয়ে। হতেই পারে – ফর্সা মেয়ে আর কালো মেয়ের পছন্দের ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু স্যারের ব্যাখ্যায় বাধ সাধলো ফারুক। সে বলে উঠলো – ব্লন্ড মানে স্যার সোনালী চুলের মেয়ে, আর ব্রুনেট মানে লিপির মতো।
আমার ধারণা ফারুকের জ্ঞানবোতলের ছিপি নেই। তাই তার জ্ঞান বিপজ্জনকভাবে বের হয়ে আসে স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে। নইলে সে সোবহানস্যারের ভুল ধরতে যায়! আর এক সপ্তাহ পরেই সোবহানস্যার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হবেন এটা জানার পরেও ফারুক ব্লন্ড আর ব্রুনেট নিয়ে তর্ক করে! সোবহানস্যার ফারুকের কথায় একটুখানি হাসলেন। তারপর লজিক গেইটের লজিক অন্যদিকে নিয়ে গেলেন। ফারুককে এর জন্য কী মুল্য দিতে হয় কে জানে।
সেকেন্ড পিরিয়ডের পর আজ আর কোন ক্লাস হবে না। নিচের তলায় এক নম্বর গ্যালারিতে এখলাসউদ্দিনস্যারের স্মরণে অনুষ্ঠান আছে। এবার তিনদিন ব্যাপী ‘এখলাসউদ্দিন স্মারক বক্তৃতামালা’র বক্তা হচ্ছেন প্রামাণিকস্যার। সেকেন্ড পিরিয়ড ছিল নুরুল ইসলামস্যারের নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। কিন্তু স্যার ক্লাস নিতে এলেন না।
মিজান আর প্রেমাঙ্কর আমাকে ডেকে নিয়ে গেল সেমিনার-লাইব্রেরিতে। আমাদের ডিপার্টমেন্টের সেমিনার-লাইব্রেরিরও স্থানান্তর ঘটেছে। দোতলা থেকে সেমিনার-লাইব্রেরি উঠে এসেছে তিন তলায়। মোবাশ্বেরস্যারের অফিসের পাশেই এখন সেমিনার-লাইব্রেরি। আয়তনে আগের রুমের চেয়ে অনেক বড়। সেমিনার-লাইব্রেরিয়ান সুশীলদাকে আমি এখনো ভয় পাই। সেই ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে একবার সেমিনারে ঢোকার পর তিনি শীতলকন্ঠে বলেছিলেন “ফার্স্ট ইয়ারেই সেমিনারে ঢুকে পড়েছেন? ফাইনাল ইয়ারে উঠেন, তারপর আসবেন।“ তাঁর সেই আদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছি। ফাইনাল ইয়ারে ওঠার পরও অনেক ভয়ে ভয়ে আমি সেমিনার-লাইব্রেরিতে ঢুকেছি। ক্রমে ক্রমে সেদিনের গাম্ভীর্যে ভরপুর সুশীল রুদ্র এখন আমাদের হাসিখুশি ‘সুশীলদা’ হয়ে গেছেন।
প্রেমাঙ্কর আর মিজান সেমিনারের দেয়াল থেকে এখলাসউদ্দিন স্যারের ছবিটা খুলে গ্যালারিতে নিয়ে গেলো অনুষ্ঠান উপলক্ষে। আমি প্রামাণিকস্যারের সেমিনারের পোস্টার লিখতে বসলাম – ফ্যাকাল্টির বিভিন্ন জায়গায় আর লাইব্রেরির সামনে লাগিয়ে দিয়ে আসতে হবে। ভাবছি – লাইব্রেরির সিঁড়িতে যেখানে ‘এখানে বসা নিষেধ’ নোটিশ টাঙানো হয়েছে – সেখানে গিয়ে লাগিয়ে দিয়ে আসবো।
“সুশীলদা, আপনি তো এখলাসস্যারের সাথে কাজ করেছেন। স্যারের কথা মনে আছে আপনার?”
“মনে আছে মানে? এখলাসস্যারের সাথে যার একবার পরিচয় হয়েছে সে কখনো স্যারকে ভুলবে না। স্যার খুবই ভালোমানুষ ছিলেন। আবার প্রচন্ড বদরাগী ছিলেন। একটুও অনিয়ম সহ্য করতেন না।“
সুশীলদার কাছ থেকে এখলাসস্যার সম্পর্কে অনেক কিছু শুনলাম। এখলাসস্যারের কথা আমি প্রথম শুনেছিলাম চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় ফিজিক্সের মোজাম্মেল হকস্যারের কাছে। এখলাসস্যার নাকি ভাইভা নিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে নিজে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে প্রশ্নটি আবার জিজ্ঞেস করতেন। শিক্ষার্থী উত্তর দেয়ার পর বলতেন, “ভেরি গুড। এই তো তুমি পারো।“ এসব শুনে কেমন যেন রূপকথার মতো মনে হতো – এমন শিক্ষকও আছেন! কিন্তু আমরা উচ্চমাধ্যমিকে থাকতেই এখলাসস্যারের জীবনাবসান হয় ১৯৮৪ সালের ২০ আগস্ট।
আমাদের ডিপার্টমেন্টকে নিজের হাতে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষাঙ্গন হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন এখলাসস্যার। শুধু আমাদের ডিপার্টমেন্ট নয়, সায়েন্স ফ্যাকাল্টির বর্তমান ভবন তৈরি হয়েছে তাঁর সার্বিক তত্ত্বাবধানে। ফরেস্ট্রি এবং মেরিন সায়েন্স ইন্সটিটিউট স্থাপিত হয়েছে তাঁর চেষ্টায়। ক্যাম্পাসের নান্দনিকতার অনেকটুকুই তাঁর অবদান। বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজ স্থাপিত হয়েছে তাঁর উদ্যোগে।
মাত্র ৪৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু আমাদের ডিপার্টমেন্ট শুধু নয়, পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই ছিল মারাত্মক শোকের। আমাদের হামিদাবানুম্যাডাম ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়েছিলেন এখলাসস্যারের জন্যই। আমাদের ডিপার্টমেন্টের বর্তমান শিক্ষকদের অনেকেই এখলাসস্যারের সরাসরি ছাত্র ছিলেন।
এখলাসস্যারের মৃত্যুদিবসে এখলাসস্যারের স্মরণে আলোচনাসভা এবং বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা হয় ডিপার্টমেন্টে। কিন্তু এবছর আগস্টে বিশ্ববিদ্যালয় অবরুদ্ধ থাকার কারণে এই অনুষ্ঠানটি সেসময় হতে পারেনি। তাই এবার সেপ্টেম্বরের নয় থেকে এগারো এই তিন দিনের বক্তৃতামালার আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিদিন সকাল এগারোটা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত প্রামাণিকস্যার বক্তৃতা দেবেন “রিলিজিয়াস অ্যান্ড সায়েন্টিফিক ভিউজ অব দ্য ইউনিভার্স” বিষয়ে।
এরকম সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে পরপর তিনদিন বক্তৃতা দেয়ার দুঃসাহস প্রামাণিকস্যারের আছে দেখে মুগ্ধ হবার পাশাপাশি এক ধরনের উত্তেজনাও অনুভব করছি।
দলবেঁধে পোস্টার লাগিয়ে এসে গ্যালারিতে ঢুকে মনে হলো পোস্টার লাগানোর কোন দরকার ছিল না। এমনিতেই গ্যালারি পূর্ণ হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে জামাল নজরুল ইসলামস্যার মহাবিশ্বের প্রসারণ বিষয়ে বক্তৃতা করেছেন এই গ্যালারিতে। এখনকার এক তৃতীয়াংশ মানুষও ছিল না সেদিন। তবে কি প্রামাণিকস্যার জামাল নজরুল ইসলামস্যারের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়? কিন্তু দর্শকদের চেহারা দেখে তা মনে হচ্ছে না। বেশিরভাগ দর্শকই অপরিচিত। মনে হচ্ছে সবাই এসেছে প্রামাণিকস্যারের বিজ্ঞানের হাত থেকে ধর্মকে রক্ষা করতে।
প্রামাণিকস্যার বক্তৃতার শুরুতেই বলে দিলেন – তিনি যা বলবেন তার কোনটাই তার নিজের মতামত নয়। বিজ্ঞানের যা কিছু সবই বিজ্ঞানের জার্নাল বা বইতে প্রকাশিত হয়েছে। ধর্মের যা বলবেন – সবই ধর্মের বইগুলিতে আছে। সবই তিনি সুনির্দিষ্ট রেফারেন্সসহ উল্লেখ করবেন। সুতরাং এখানে ব্যক্তিগত আক্রমণের কোন সুযোগ নেই।
কিন্তু বক্তৃতা শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল চিৎকার চেঁচামেচি। প্রামাণিকস্যারকে বক্তৃতার মাঝেই প্রশ্ন করতে শুরু করলেন উপস্থিত শিক্ষকদের অনেকে। বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে রশীদুন্নবীস্যার অনুষ্ঠানের সভাপতি। তিনি সভায় শৃঙ্খলা বজায় রাখার দিকে কোন আগ্রহ প্রকাশ করলেন না।
প্রামাণিকস্যার যখন ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন কেন ছয় দিনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে সম্ভব নয় – আমাদের নুরুল ইসলামস্যার বলে উঠলেন এখানে এক দিন মানে ২৪ ঘন্টা নয়, এখানে দিন মানে অনেক লম্বা সময় – যা এক হাজার বছরও হতে পারে। এরকম যুক্তিও দেয়া যায়! প্রচন্ড হট্টগোলের মধ্যে প্রথম দিনের বক্তৃতা শেষ হলো। আরো দুই দিন বাকি।
পরের দিন রশীদুন্নবীস্যার গ্যালারিতে এলেন না। শিক্ষকরা কয়েকভাগে ভাগ হয়ে গেলেন। বেশিরভাগই প্রামাণিকস্যারের বিপক্ষে। আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম – গ্যালারিতে একজন ছাত্রীও নেই। আগেরদিন বেশি না হলেও কয়েকজন ছাত্রী উপস্থিত ছিল। তারা কি ভয় পেয়ে এলো না, নাকি এসবের প্রতি কোন আগ্রহই নেই কারো? শিবিরের ক্যাডাররা গ্যালারির বিভিন্ন জায়গায় দলবদ্ধ হয়ে বসেছে। কয়েকটি চেনামুখের সাথে চোখাচোখি হলো আমার। তাদের মধ্যে একজন আমার মেসেই থাকে।
নির্দিষ্ট সময়ে বক্তৃতা শুরু করলেন প্রামাণিকস্যার। মিনিট দুয়েক পরেই শুরু হয়ে গেল হৈচৈ। গ্যালারির মাঝখান থেকে একজন প্রবীণ অধ্যাপক দাঁড়িয়ে উর্দূতে বক্তৃতা করতে শুরু করলেন। প্রামাণিকস্যারের স্নায়ু কী দিয়ে তৈরি জানি না। তিনি একটুও না রেগে, উত্তেজিত না হয়ে একটার পর একটা স্লাইড দেখিয়ে তাঁর যুক্তি দিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু গ্যালারিতে উপস্থিত জামায়াতে ইসলামের সমর্থক শিক্ষক ও তাদের সাথে আসা শিবিরের ক্যাডাররা কোন ধরনের শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে চিৎকার করতে লাগলো।
সময় শেষ হয়ে গেল। এটুকু জানা হলো যে এখলাসস্যারের গড়া আমাদের ডিপার্টমেন্টে বর্তমানে প্রগতিশীল শিক্ষকের সংখ্যা খুবই কম।
পরদিন ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে দেখি যে পোস্টারগুলি লাগিয়েছিলাম সেগুলি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। সায়েন্স ফ্যাকাল্টির গেটের কাছে, আমাদের ডিপার্টমেন্টের নোটিশবোর্ডে – কোথাও কোন চিহ্ন রাখেনি। সব তুলে ফেলেছে।
ফার্স্ট পিরিয়ডে প্রামাণিকস্যারের ক্লাস। তিনি ক্লাসে এসে বললেন, “কাল রাতে আমার বাসায় ফোন করে আমাকে প্রাণে মারার হুমকি দিয়েছে ছাত্রদের কেউ। আমার হাত কেটে নেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। টেলিফোনে হুমকি দেয়ার দরকার ছিল না। ইচ্ছে করলে আমি বোর্ডে লেখার সময়ও কেউ এসে আমার হাত কেটে ফেলতে পারো। যুক্তি খন্ডন করা – মানে যুক্তি কাটতে না পারলে আর কী করবে! আমার আজকের বক্তৃতা হচ্ছে না। আমি ভয় পেয়ে বন্ধ করে দিইনি। তোমাদের ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান নিজের ক্ষমতাবলে তা বন্ধ করে দিয়েছেন।“
এরপর যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়াতে শুরু করলেন প্রামাণিকস্যার।
সমরেশ মজুমদার কালবেলা উপন্যাসে লিখেছেন – আমাদের দেশে তিন শ্রেণির মানুষ খুব ভালোভাবে বেঁচে থাকে। এক – যাদের প্রচুর টাকা আছে, যা ইচ্ছে প্রয়োজনে কিনে নিতে পারে। দুই – যারা শিক্ষিত এবং শিক্ষাটাকে বুদ্ধিমানের মতো ব্যবহার করে সমাজে ঠাঁই করে নিতে পেরেছে। তিন – মাস্তানরা – যারা যেকোনো জায়গায় যেতে পারে, যাদেরকে অনেকেই পোষণ করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকাওয়ালাদের খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু আর দুই শ্রেণির মানুষকে খুব দেখা যায়। শিক্ষাকে ধূর্তের মতো কাজে লাগিয়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অধিকার করেছেন – তাদের কয়েকজনকে তো গত দু’দিনে চোখের সামনেই দেখলাম। আর তাদের পোষা মাস্তানদেরও দেখলাম। এই মাস্তানরা এখন জামায়াত-শিবিরের দখলে। ক্ষমতার পালাবদল হলে অন্য কোনো দলের দখলে যাবে। মাস্তানদের সবাই পোষণ করে, কাজে লাগায়।
কিন্তু এর বাইরেও প্রামাণিকস্যারের মতো একজন দু’জন থাকেন, যাঁরা প্রচন্ড বৈরি পরিবেশেও মাথা উঁচু করে থাকতে পারেন। এরা আরামে থাকেন না, কিন্তু আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকেন। মনস্থির করে ফেললাম - প্রামাণিকস্যারের কাছেই আমি থিসিস করবো।
No comments:
Post a Comment