#স্বপ্নলোকের_চাবি_৪৮
আবদুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ দায়িত্বমুক্ত হলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন এভাবে, “একজন জ্যন্ত মানুষকে কবর দেয়ার পর তাকে কবর থেকে তুললে যে অবস্থা হয়, আমারও সে অবস্থা হয়েছে।“
বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদকে খুবই ন্যায়নিষ্ঠ নীতিবান মানুষ বলে মনে হয়েছে আমার। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পুরো সাত মাস বন্ধ ছিল শিবিরের কারণে। তিনি সেদিকে নজর দেয়ার সময় পাননি। তবুও একটা বিশ্বাস ছিল যে তাঁর শাসনামলে শিবির লাগামহীন বেপরোয়া হতে পারবে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করা কঠিন। নীতিবানদের জন্য তো আরো কঠিন। হয়তো সে কারণেই তিনি দায়িত্ব পালনের সময়টাকে জ্যন্ত কবরে থাকার সাথে তুলনা করেছেন। এখন তিনি তো দায়িত্বপালন শেষে নিজের আগের পদে ফিরে গেছেন। তিনি ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রপতি। নতুন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস দলীয় ভোটে নির্বাচিত হয়ে কতটুকু সর্বদলীয় হয়ে উঠতে পারেন সেটাই দেখার।
কাগজে-কলমে নিয়ম মানার জন্য কতকিছু যে করতে হলো। রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসার জন্য সংসদে সংবিধান সংশোধনের বিল পাস হবার পরেও একটা গণভোট করতে হলো। সেপ্টেম্বরের সেই গণভোটে ভোট পড়েছে মাত্র ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ দুই তৃতীয়াংশ ভোটার ভোটই দেননি। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ফেরার পর সংসদ-সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটের শরিকদের সব মিলিয়ে এক শ ভোটও নেই। তারপরও তারা বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরিকে জাতীয় ঐকমত্যের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেন। গণতান্ত্রিক পন্থায় সেটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু সেই প্রার্থী কী কারণে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের কাছে গিয়ে দোয়া ভিক্ষা করেন আমার বোধগম্য নয়। আমার পরিচিত ছাত্রলীগের অনেক নেতাকে আমি এই প্রশ্ন করেছি। তারাও খুব বিব্রত এই ব্যাপারে। আমি মনে করি এই কাজের ফলে আওয়ামী লীগের কোন লাভ তো হয়নি – বরং এই কাজের খেসারত তাদের দিতে হবে দীর্ঘদিন। যে গোলাম আযম এতদিন অনেকটাই আড়ালে থাকতে বাধ্য ছিলেন, হঠাৎ করে তিনি অনেক বেশি প্রকাশ্যে চলে এলেন। তার প্রভাব সাংঘাতিকভাবে পড়লো আমাদের ক্যাম্পাসে।
আমাদের আগের ব্যাচের মাস্টার্স পরীক্ষা প্রায় শেষের পথে। তারা পরীক্ষা দিয়ে চলে গেলে সব হলে বেশ কিছু সিট খালি হবে। মাস্টার্সের ছাত্রদের জন্য প্রায় সব হলেই কিছু সিংগেল রুম আছে। মেধাভিত্তিক সিটবন্টন করা হবে বলে সব হলেই বলা হয়ে থাকে। অনার্সের রেজাল্টের ভিত্তিতে সিট দিলে একটা সিট তো আমি পেতেই পারি। আলাওল হলে সিটের জন্য দরখাস্ত জমা দিলাম।
মাস্টার্সে ভর্তি হবার সময় আমি হল পরিবর্তন করে সোহরাওয়ার্দী থেকে আলাওলে নাম লিখিয়েছি। এর পেছনে একটাই কারণ কাজ করেছে – সেটা হলো আগে পরীক্ষা শেষ করার ইচ্ছা। আমি খেয়াল করে দেখেছি – পরীক্ষার রোল নম্বর শুরু হয় আলাওল হল থেকে। ভাইভা হয় রোল নম্বর অনুসারে। আলাওল হলের ছাত্রদের ভাইভা আগে হয়। ভাইভার মানসিক চাপ আমার সহ্য হতে চায় না। মৌখিক পরীক্ষা যত তাড়াতাড়ি হয়ে যায় ততই ভাল।
নভেম্বরের ১৩ তারিখ দুপুরে হলে সিট বন্টনের তালিকা প্রকাশিত হবার কথা। প্রদীপ নাথ গতবছর সিট পেয়েছে। সে এখন নিয়মিত হলেই থাকে। হাফিজও থাকে আলাওলে। যীশু শাহজালালে দরখাস্ত করেছিল – তাকে সিট দেয়া হয়নি। আমি নিশ্চিত – সায়েন্স ফ্যাকাল্টির কাউকে একটা সিটও যদি দেয়া হয় – নিয়ম অনুযায়ী সেই সিট আমাকে দিতে হবে।
ক্লাস শেষ করে গেলাম আলাওলে। অনেকটা নিশ্চিন্তমনে কবে থেকে হলে উঠবো এসব আলোচনা করতে করতে আলাওল হলের অফিসে গেলাম। বারান্দায় নোটিশ টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে ইতোমধ্যে। অনেকগুলি সিট বন্টন করা হয়েছে। কিন্তু তালিকার কোথাও আমার নাম নেই। এরকম তো হবার কথা নয়। যীশুরা সবাই কয়েকবার করে দেখলো। না, আমাকে কোন সিট দেয়া হয়নি।
সেকশান অফিসারের রুমে ঢুকলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “হলের সিট বন্টন কীসের ভিত্তিতে হয়েছে?”
“মেধার ভিত্তিতে হয়েছে। যাদের রেজাল্ট ভালো তাদেরকে সিট দেয়া হয়েছে।“
“অনার্সে যারা ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে তারা কি সিট পেয়েছে?”
“অবশ্যই, সেকেন্ড ক্লাস পেয়েও অনেকে পেয়েছে। ফার্স্ট ক্লাস তো বেশি পায় না।“ – সেকশান অফিসারকে খুব অমায়িক মানুষ বলে মনে হলো।
“তাহলে আমার তো একটা সিট পাবার কথা। আমাকে তো সিট দেয়া হয়নি।“
যীশু এসব ব্যাপারে অল্পতেই রেগে যায়। সে হড়বড় করে অনেক কিছু বলে ফেললো। সেকশান অফিসার দরখাস্তের ফাইল বের করলেন। ফাইলে বিশ-পঁচিশটা দরখাস্তের মধ্যে আমার দরখাস্ত নেই।
“আপনি কি দরখাস্ত জমা দিয়েছিলেন?”
“অবশ্যই জমা দিয়েছি। আমার জমা-রশিদ দেখেন।“
দরখাস্তের ফরম কেনার রশিদ, জমা দেয়ার রশিদ আমার সাথে ছিল। দেখালাম। সেকশান অফিসারের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, কপালের ভাঁজগুলি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছিলো।
প্রদীপনাথ এই হলের আবাসিক ছাত্র। তার নিজের হলে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে – এটাতে তার সম্ভবত খুব অপমান লাগছিল। সে বিচক্ষণ হেডমাস্টারের মতো ঠান্ডা মাথায় নির্দেশ দিলো, “ফরম এখানে আপনার অফিসেই জমা দিয়েছি আমরা সবাই একসাথে এসে। আপনি খুঁজে বের করেন। নইলে আমরা প্রভোস্টের কাছে যাচ্ছি। দরকার হলে ভিসির কাছে যাবো।“
দেখলাম ছোট্ট অফিসঘরে ভীড় জমে গেছে। অফিসার এবং সহকারীছাড়া বাকি যারা কান্ড দেখার জন্য ভীড় করেছে তাদের সবাইকে শিবিরের কর্মী বলে মনে হচ্ছে।
“আপনাদের এক ঘন্টা সময় দিলাম। ফরম খুঁজে বের করেন। আমরা ১০৪ নম্বর রুমে আছি। এক ঘন্টার মধ্যে খবর না পেলে সমস্যায় পড়বেন আপনারা।“
ঠান্ডা গলায় বললেও অনেকটা ধমকের মতো শোনালো কথাগুলো। সিটের দরখাস্তই ফেলে দিয়েছে আমার! মেজাজ ঠিক থাকে এরকম অন্যায় ঘটলে!
১০৪ নম্বর রুমে – প্রদীপ নাথ, সুকুমার আর ননী থাকে। তাদের রুমে এসে বসলাম। এরকম ঘটনা যে ঘটতে পারে তা কখনো চিন্তাও করিনি। আমার হলে ওঠা বন্ধ করতে আমার দরখাস্ত গায়েব করে ফেললো ওরা? এটা যে শিবিরের কাজ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না – আমার উপর তাদের ক্ষোভ কিসের? আমি তো ক্যাম্পাসে সরাসরি শিবিরের বিরুদ্ধে কিছু করিনি। অবশ্য তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু বলার সাহসও নেই আমার।
“সম্ভবত অন্য কোন ফাইলে রেখেছে ওরা। খুঁজে বের করে ফেলবে। নইলে প্রভোস্টের কাছে যাবো।“ – প্রদীপ নাথ আমাকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে।
মিনিট বিশেক পরেই দরজার সামনে লম্বা হ্যান্ডসাম কোঁকড়া চুলের এক সুঠাম তরুণ এসে প্রমিত বাংলায় জিজ্ঞেস করলো, “এখানে প্রদীপ দেব কে?”
বাহ্, একঘন্টা সময় দিয়েছিলাম, বিশ মিনিটেই খুঁজে বের করে ফেললো! খুব করিৎকর্মা অফিস বলে মনে হচ্ছে। খুশি হয়ে বললাম, “আমি।“
“আপনি প্রদীপ দেব?” ছেলেটা নিজের বাম হাতের তালুর দিকে তাকাচ্ছে। সেখানে বলপয়েন্টে আমার নাম লিখে এনেছে।
“আপনি আসুন আমার সঙ্গে।“
যীশুও উঠে দাঁড়ালো আমার সাথে।
“খবরদার, আপনারা কেউ বের হবেন না। আপনি আসেন আমার সঙ্গে।“
আমার গা দিয়ে একটা ঠান্ডাস্রোত বয়ে গেল। বুঝতে পারলাম – বড় বিপদ উপস্থিত। শিবির তাদের ক্যাডার পাঠিয়েছে। শিবিরের নিয়ম হলো সিনিয়র স্টুডেন্টদেরকে জুনিয়রদের দিয়ে পেটায়। দিনে-দুপুরে জবাই করে ফেলবে নাকি?
বেশিক্ষণ চিন্তা করারও সুযোগ পেলাম না। সুঠাম তরুণ তার লম্বা হাত বাড়িয়ে আমার ঘাড় ধরলো। তারপর শেয়াল যেভাবে মুরগি ধরে টেনে নিয়ে যায় – সেভাবে টেনে নিয়ে চললো আলাওল হলের বারান্দা দিয়ে। স্বাভাবিক রিফ্লেক্সে বাধা দিতে গিয়েছিলো আমার হাত। সেই হাত মুচড়ে পিছমোড়া করে ফেললো। মনে হচ্ছে এসব কাজে তার বিশেষ প্রশিক্ষণ আছে। একটূ আগে সবগুলি রুমের দরজা খোলা দেখেছিলাম। এখন সব দরজা বন্ধ। একটু পরপর দাঁড়িয়ে আছে শিবিরের ক্যাডার। তাদের হাতে কিছু না কিছু আছে। একজন এসে আমার পেছনে একটা লাথি মারলো। তার কী ক্ষতি আমি করেছিলাম জানি না। হাত-পায়ের রগ কেটে দেবে, না জবাই করবে বুঝতে পারছি না। কয়েক শ ফুট বারান্দা – মনে হচ্ছে কয়েক হাজার কিলোমিটার।
ঘাড়ের পেছনে কানের নিচে একটা ঘুষি খেয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবার মুহূর্তে শুনলাম, “এই হলে আর জীবনে যদি আসিস, আল্লাহর কসম – জবাই করে দেবো। আর কাউকে যদি এসব ঘটনা বলিস, তোর লাশও খুঁজে পাবে না কেউ।“ – হুবহু বাংলা সিনেমার ডায়লগ। ভিলেন জসিম এভাবেই শাসিয়েছে অসংখ্য সিনেমায়। কিন্তু এখন যা ঘটছে তা সিনেমার কোন দৃশ্য নয়।
একটু পরপর ঘাড়ের দু’পাশে কানের গোড়ায় ঘুষি মারছে, আর পশ্চাৎদেশে লাথি। এমন জায়গায় মারছে – রক্ত বের হবে না, কিন্তু ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে যাবে। অবশেষে বারান্দা শেষ হয়ে অফিসের কাছাকাছি গেটের কাছে পৌঁছলাম। এখানে শিবিরের ক্যাডারে ভর্তি হয়ে গেছে বারান্দা। শুধুমাত্র আমাকে মারার জন্য এতগুলি ক্যাডার জড়ো হয়েছে এখানে?
এখানে দোতলায় উঠার সিঁড়ির মুখে একটি পরিচিত মুখের দিকে চোখ পড়তেই সে চোখ সরিয়ে নিলো। আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এই লোক – আমার মেসে ছিল। কতদিন হাই-হ্যালো করেছি। আরো একজন পরিচিত মুখ ভীড়ের মধ্যে সরে গেল। সেই যে আযমভাইকে ভিসি-আর বন্ধ করার জন্য বলতে এসেছিল অনেকদিন আগে।
হলের গেটে এনে আক্ষরিক অর্থেই পশ্চাৎদেশে লাথি মেরে বের করে দিলো আমাকে। আমি পিচঢালা রাস্তায় পড়ে গেলাম। চারপাশে অনেক মানুষ দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কিচ্ছু বলছে না। মিনিটখানেক পর যীশু দৌড়ে এসে আমাকে টেনে তুললো। সে কীভাবে আসতে পারলো জানি না। আমার ঘাড় ফেরানোর শক্তি নেই। ঘাড়ের দুপাশের পেশিগুলি মনে হচ্ছে তরল হয়ে গেছে ঘুষির পর ঘুষি খেয়ে।
হলের সামনের বাগানে শীতকালীন ফুল ফুটতে শুরু করেছে। প্রচুর গাঁদা ফুটে হলুদ হয়ে আছে এদিকটা। কিন্তু আমি চোখে অন্যরকম হলুদফুল দেখছি। আমি হাঁটতে পারছি না, কিন্তু আমাকে দ্রুত গেট পেরিয়ে চলে যেতে হবে রাস্তায়। এটা আমার বিশ্ববিদ্যালয়, আমি এই হলের ছাত্র। কিন্তু শিবিরের হুকুম - আমি এই হলে আর আসতে পারবো না। আমার হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়নি সেজন্য আমার খুশি হওয়া উচিত। তীক্ষ্ম তলোয়ারে ক্ষত-বিক্ষত করেনি আমার শরীর, সেজন্য আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে পানিতে। শারীরিক যন্ত্রণার চেয়েও অপমানের যন্ত্রণা বেশি।
No comments:
Post a Comment