কোন পরমাণুর নিউক্লিয়াস বিভক্ত হয়ে দুটো আলাদা পরমাণুতে পরিণত
হবার ‘নিউক্লিয়ার ফিশান’ পদ্ধতি সম্পর্কে এখন অনেকেই জানেন। নিউক্লিয়ার ফিশান পদ্ধতি
আবিষ্কারের জন্য ১৯৪৪ সালের রসায়নে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে জার্মান রসায়নবিদ অটো
হানকে। অথচ ফিশান প্রক্রিয়ার নামকরণ থেকে শুরু করে এসংক্রান্ত পদার্থবিজ্ঞানের মূল
তত্ত্বীয় ভিত্তি যিনি আবিষ্কার করেছিলেন তিনি ছিলেন অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানী লিজা মেইটনার।
শুধুমাত্র ইহুদি বংশোদ্ভূত হবার কারণে লিজাকে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়নি। লিজাকে নোবেল
পুরষ্কার দেয়া হবে কি হবে না – এই সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে ১৯৪৪ সালের রসায়নে নোবেল
পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়নি ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৫ সালে লিজা মেইটনারকে বাদ
দিয়ে ফিশান পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ১৯৪৪ সালের রসায়নে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় অটো হানকে।
১৯২৪ সাল থেকে শুরু করে ১৯৬৫ সালের মধ্যে মোট ৪৮টি মনোনয়ন দেয়া হয় লিজা মেইটনারকে নোবেল
পুরষ্কার দেয়ার জন্য।[1] নোবেল
কমিটি লিজা মেইটনারের কৃতিত্ব অস্বীকার করলেও এখন সবাই জানেন যে নিউক্লিয়ার ফিশান আবিষ্কারের
প্রধান কৃতিত্ব লিজা মেইটনারের।
লিজা মেইটনারের জন্ম ১৮৭৮ সালের ৭ নভেম্বর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়।
তাঁর বাবা ফিলিপ মেইটনার ছিলেন আইনজীবী। আট ভাইবোনের মধ্যে লিজা ছিলেন তৃতীয়।
সেই সময় মেয়েদের উচ্চশিক্ষার পথ সুগম ছিল না। ১৪ বছর বয়স
পর্যন্ত স্কুলে পড়াশোনা করার পর লিজা বাড়িতে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
১৯০১ সালে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের ভর্তি করানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলে
লিজা ভর্তি হলেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়ার জন্য। ১৯০৬ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে
পিএইচডি ড্রিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় নারী-পিএইচডি।
পরের বছর তিনি বার্লিনে গিয়ে ম্যাক্স প্ল্যাংকের অধীনে গবেষণা শুরু করলেন ইন্সটিটিউট
অব এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সে। বার্লিনে রসায়নের গবেষক অটো হানের সাথে লিজার পরিচয় হয়
এবং অচিরেই তাদের মধ্যে গবেষণা-সহযোগিতা শুরু হয়। পরবর্তী তিরিশ বছর ধরে তাঁরা গবেষণা
করেছেন নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া সম্পর্কে।
অটো হান কাজ করতেন কেমিক্যাল ইন্সটিটিউটে – যার পরিচালক ছিলেন
১৯০২ সালের রসায়নে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী এমিল ফিশার। লিজা মেইটনার কেমিক্যাল ইন্সটিটিউটে
যোগ দিতে চাইলেন। কিন্তু ফিশার তাঁর ইন্সটিটিউটে কোন নারীকে ঢুকতে দিতে রাজি নন। অনেক
বোঝানোর পর ফিশার কিছুটা নমনীয় হয়ে বিল্ডিং-এর বেসমেন্টে একটা ল্যাবরেটরি স্থাপনের
অনুমতি দিলেন – যেখানে অটো হান আর লিজা মেইটনার কাজ করতে পারবেন। কিন্তু ইন্সটিটিউটের
মূল গবেষণাগারে লিজার প্রবেশ কঠোরভাবে নিষেধ – শুধু তাই নয় বিল্ডিং-এর অন্য কোন ফ্লোরেও
লিজার যাওয়া নিষেধ। পরবর্তীতে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার জন্য এবং বিজ্ঞান গবেষণায় মেয়েদের
সুযোগ দেয়ার জন্য অনেক সংগ্রাম করেছেন লিজা।
১৯১২ সালে অটো হান যোগ দিলেন বার্লিনের কাইজার-বিলহেল্ম
ইন্সটিটিউট অব কেমিস্ট্রিতে। লিজা যোগ দিলেন ম্যাক্স প্ল্যাংকের সহকারি হিসেবে বার্লিনের
ইন্সটিটিউট অব থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সে। দুজন দুই প্রতিষ্ঠানে হলেও তাঁদের গবেষণা-সহযোগিতা
অব্যাহত রইলো।
১৯১৪ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লিজা অস্ট্রিয়ান
সেনাবাহিনীকে এক্স-রে সেবা প্রদানকারী দলে যোগ দিয়ে অনেক সহযোগিতা করেন। এরকম এক্স-রে
সহযোগিতা ফ্রান্সে শুরু করেছিলেন মেরি কুরি।
যুদ্ধশেষে আবার ল্যাবে ফিরলেন লিজা। অটো হান ও লিজা সেই সময়
আবিষ্কার করলেন তেজষ্ক্রিয় মৌল প্রোট্যাক্টিনিয়াম (পারমাণবিক সংখ্যা ৯১)। এই আবিষ্কারের
জন্য লিজা মেইটনার বার্লিন একাডেমি অব সায়েন্সের লিবনিজ মেডেল পান ১৯২৪ সালে এবং অস্ট্রিয়ান
একাডেমি অব সায়েন্সের লাইবেন প্রাইজ পান ১৯২৫ সালে। কাইজার-বিলহেলম ইন্সটিটিউটে তখন
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়েছে। লিজা মেইটনার সেই বিভাগের প্রথম প্রধান পদে নিযুক্ত
হলেন।
১৯২৬ সালে লিজা মেইটনার যোগ দেন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ
অধ্যাপক হিসেবে। তিনি ছিলেন জার্মানির পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম নারী-অধ্যাপক। পরবর্তী
বছরগুলোতে লিজা মেইটনার নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের গবেষণায় অনেকগুলি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
পান।
১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় এলে – সব প্রতিষ্ঠান
থেকে ইহুদি-বিতাড়ন শুরু হয়। আইনস্টাইনসহ জার্মানির বেশিরভাগ ইহুদি অধ্যাপক-বিজ্ঞানীকে
জার্মানি থেকে পালিয়ে যেতে হয়। লিজা মেইটনার ইহুদি পরিবারে জন্ম নিলেন তাঁর বাবা ফিলিপ
উদারনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ছেলেমেয়েদের স্বাধীনভাবে মানুষ করেছেন। ছেলেমেয়েরা
পরে নিজেদের ইচ্ছেমতো ধর্ম বেছে নিয়েছে। লিজার দুই বোন ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসী হয়েছে।
লিজা নিজে বেছে নিয়েছেন প্রোটেস্ট্যান্ট বিশ্বাস। প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান হবার পরেও
লিজার বাবা ইহুদি হওয়ার কারণে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ থেকে লিজাকে বরখাস্ত
করা হয়। তবে কাইজার-বিলহেল্ম ইন্সটিটিউটের চাকরিটি তখনো বলবৎ থাকে।
এই টালমাটাল সময়েও লিজা এবং অটো হান তাঁদের গবেষণা অব্যাহত
রাখেন। তাঁদের সঙ্গে আরেকজন জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রিৎজ স্ট্রাসমান-ও যোগ দিয়েছেন। নিউক্লিয়ার
ফিজিক্সের তখন স্বর্ণযূগ চলছে। ১৯৩২ সালে আবিষ্কৃত হয়েছে নিউট্রন, ১৯৩৩ সালে পজিট্রন,
১৯৩৪ সালে কৃত্রিম তেজষ্ক্রিয়তা। সেই সময় ইতালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি একটি
গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন ‘ট্রান্স-ইউরেনিক’ মৌলের ধর্মাবলি। ইউরেনিয়াম মৌলের সাথে নিউট্রনের
বিক্রিয়ায় নতুন ধরনের তেজষ্ক্রিয় মৌল পাওয়া যাচ্ছে। লিজা মেইটনার, অটো হান এবং ফ্রিৎজ
স্ট্রাসমান ইউরেনিয়ামের সাথে নিউট্রনের বিক্রিয়ার গবেষণায় ব্যাপক সাফল্য লাভ করলেন।
জার্মানির রাজনৈতিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছিলো।
১৯৩৮ সালে লিজা মেইটনারকে জার্মানি থেকে পালিয়ে যেতে হলো। তিনি জার্মানি থেকে নেদারল্যান্ড
হয়ে কোপেনহেগেনে গেলেন, সেখান থেকে সুইডেন। স্টকহোমে তখন আলফ্রেড নোবেলের ইন্সটিটিউট
ফর এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সে যোগ দিলেন তিনি।
এদিকে জার্মানিতে অটো হান ও ফ্রিৎজ স্ট্রাসমান ইউরেনিয়ামের
সাথে নিউট্রনের বিক্রিয়ায় বেরিয়ামের মতো হালকা মৌলের সন্ধান পেলেন। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন
না ইউরেনিয়ামের মতো ভারী মৌল থেকে কীভাবে বেরিয়ামের মতো হালকা মৌলের জন্ম হবে। অটো
হান মিজা মেইটনারের সাথে যোগাযোগ করলেন। লিজার বোনের ছেলে পদার্থবিজ্ঞানী অটো ফ্রিশ
কাজ করছিলো কোপেনহেগেনে নিলস বোরের সাথে। লিজা অটোর সাথে আলোচনা করলেন এ ব্যাপারে।
অটোর ধারণা জার্মানির বিজ্ঞানীরা কিছু একটা ভুল করছেন। ইউরেনিয়াম থেকে বেরিয়াম পাওয়া
অসম্ভব। কিন্তু লিজা হিসেব করে দেখলেন – না, সম্ভাবনা আছে। আইনস্টাইনের ভর-শক্তির সমীকরণ
প্রয়োগ করে দেখা গেল – এভাবে নিউক্লিয়ার বিভাজনে প্রচুর শক্তির উৎপাদন ঘটবে। এই নতুন
ধরনের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার সম্ভাবনার পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র
তিনি প্রকাশ করলেন নেচার পত্রিকায়। বিশ্বব্যাপী সাড়া পড়ে গেল। জার্মানিতে তাঁর সহযোগী
বিজ্ঞানী অটো হানের সাথে যৌথ গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য পাঠানো হলো জার্মানির জার্নালে।
কিন্তু হিটলারের রোষানলে পড়ার ভয়ে সব গবেষণাপত্র থেকে লিজা মেইটনারের নাম বাদ দেয়া
হলো।
এদিকে আমেরিকায় পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের কাজ চলছে গোপনে।
লিজাকে অনুরোধ জানানো হলে সেই বৈজ্ঞানিকদলে যোগ দেয়ার জন্য। কিন্তু লিজা পারমাণবিক
বোমার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি সেখানে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানালেন।[2]
১৯৪৫ সালে ১৯৪৪ সালের রসায়নে নোবেল পুরষ্কারে লিজা মেইটনারকে
বঞ্চিত করা হলো। ফিশান বিক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয়া হলো অটো হানকে।
অথচ অটো হান তাঁর কোন পেপারে – ফিশান শব্দটিও উল্লেখ করেননি। ফিশান শব্দটি প্রথম ব্যবহার
করেছিলেন লিজা মেইটনার তাঁর নেচারে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে।
নোবেল পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত হলেও ১৯৪৯ সালে তাঁকে ম্যাক্স
প্লাংক মেডেল দেয়া হয়। নোবেল ইন্সটিটিউট থেকে পদত্যাগ করার পর তাঁর জন্য সুইডেনে একটি
আলাদা ইন্সটিটিউট স্থাপন করা হয় – রয়েল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি।
লিজা মেইটনার ১৯৪৭ সালে সুইডেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। সুইডেনে
তিনি তাঁর গবেষণা অব্যাহত রেখেছিলেন ১৯৬০ সাল পর্যন্ত – তখন তাঁর বয়স ৮২ বছর।
১৯৬০ সালে তিনি ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে চলে যান তাঁর অবসর
সময় কাটানোর জন্য। ১৯৬৬ সালে লিজা মেইটনার, অটো হান এবং ফ্রিৎজ স্ট্রাসমানকে আমেরিকান
অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের এনরিকো ফার্মি পুরষ্কার দেয়া হয়।
১৯৬৮ সালের ২৭ অক্টোবর ৯০ বছর বয়সে মারা যান লিজা মেইটনার।
[1] Nobelprize.org,
https://www.nobelprize.org/nomination/archive/show_people.php?id=6097
(cited 7/11/2021)
[2] Biographical
encyclopedia of scientists, vol 5, p142, World Books, Chicago, 2003
আপনার লেখা বিজ্ঞানীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রত্যেকটি পর্ব পড়ার চেস্টা করি। এই পর্বটা ছিল একই সাথে ইন্টারেস্টিং এবং হৃদয়গ্রাহী।
ReplyDeleteধন্যবাদ লেখক কে।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
Delete