#স্বপ্নলোকের_চাবি_৪৭
অনুসন্ধিৎসার ব্যাপারটা প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের সবার ভেতর কম-বেশি আছে। বিষয়ের ভিন্নতা থাকতে পারে, তবে ব্যাপারটা আছে। যেমন ক্যাম্পাস এবং হলের কোন্ কোন্ কোণে গেলে সিগারেট কেনা যাবে কিংবা খাওয়া যাবে তা প্রদীপ নাথ খুঁজে বের করে ফেলেছে অনেক আগেই। ব্রিটিশ ফটোগ্রাফিক জার্নালের কোন্ সংখ্যায় ‘গরম’ ছবি প্রকাশিত হয়েছে, এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের কোন্ তাকে সেই ম্যাগাজিন আছে সে খবরও সে কীভাবে যেন নিয়মিত পেয়ে যায়। ক্যাম্পাসের প্রায় সব সুদর্শনার নাম-পরিচয় হাফিজ-স্বপন-মামুন-ইকবাল জানে। অর্পণ ‘দেশ’ পত্রিকা পড়ে নিয়মিত। নতুন বই আর গানের খবর তাকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়। এখলাস রিডার্স ডাইজেস্টের নিয়মিত পাঠক, লাইব্রেরিতে গিয়ে টাইম ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টায়। তাকে ওয়ার্ল্ড নিউজ চ্যানেল বলা চলে। হুমায়ূন আহমেদ আর তসলিমা নাসরিনের সব খবর রাখেন মুকিতভাই। বিপ্লব খুঁজে ফেরে নতুন নতুন ক্যাকটাস।
সবচেয়ে বিচিত্র ধরনের কৌতূহল দেখেছি যীশুর মধ্যে। শাক-সব্জি থেকে শুরু করে পোকা-মাকড় সবকিছুতেই তার সমান কৌতূহল। বাসায় সে কাচের বাক্সে মাছ পোষে, কাঠের বাক্সে খরগোশ। শহীদ মিনারের সামনের নার্শারিতে নিয়মিত যায় নতুন ধরনের ফুলের চারার সন্ধানে। তার বাসার বারান্দা ভর্তি হয়ে গেছে বিচিত্র ধরনের ফুলের গাছে। নতুন ওঠা শাক-সব্জিকে হাতে ধরে দেখার জন্য সে বাস থেকে নেমে যায় মাঝে-মধ্যে। ক্যাম্পাসেও সে প্রায়ই তার অনুসন্ধানী কার্যকলাপ চালায়।
চাকসুর ক্যাফেটরিয়া থেকে সায়েন্স ফ্যাকাল্টির সামনে দিয়ে যে রাস্তাটি চলে গেছে ফরেস্ট্রি ও মেরিন সায়েন্সের দিকে – সেই রাস্তার বাম পাশে নিচু জলাভূমি। অনেকটা লম্বা ডোবার মতো। বর্ষাকালে পানিতে টইটুম্বুর থাকে। এখন সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি। ডোবার পানি অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। যীশু হাঁটতে হাঁটতে আজ হঠাৎ ডোবার পাড়ে থমকে দাঁড়ালো দেখে আমি মোটেও অবাক হলাম না।
হাতে সময় থাকলে যীশু ঘোলা পানির কাছে গিয়ে মৎস্য-অনুসন্ধান করে। একদিন একটা ছোট্ট কাঁকড়াকে সেখানে কাদার উপর হাঁটতে দেখে জুতা-মোজা খুলে সে কাদায় নেমে গিয়েছিল কাঁকড়া ধরার জন্য। এখনো হয়তো সেরকম কিছু একটা দেখেছে।
যীশু কীসের অনুসন্ধান করছে সে ব্যাপারে আমি খুব একটা কৌতূহলী হলাম না। মাছ কিংবা কাঁকড়া দেখলেই তার ধরতে ইচ্ছে করে। আরো কী কী ধরতে ইচ্ছে করে কে জানে। আমার কোনকিছুই ধরতে ইচ্ছে করে না – মাছ, কাঁকড়া, পাখি, পোকা – কিছুই না। ধরে ফেলার মধ্যে কেমন যেন একটা বল-প্রয়োগের ব্যাপার থাকে, বীরত্ব দেখানোর ব্যাপার থাকে।
ক্যাম্পাসের গাছগুলিতে আবার পাতা গজিয়ে গেছে। এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে বেশিরভাগ গাছই আধমরা হয়ে গিয়েছিল। চার মাসের মধ্যেই তারা নতুন উদ্যমে বেঁচে উঠছে। প্রকৃতি ঘুরে দাঁড়াতে সময় নেয় না, মানুষেরই সময় লাগে।
একটা টিচার্স-বাস এসে থামলো আমাদের কাছেই। আমাদের ফরায়জি কামালস্যার, বিকিরণস্যার, গণিতের নীলরতনস্যার, গনেশস্যার, কেমিস্ট্রির বেনুগোপালস্যারসহ আরো দু-তিনজন স্যার নেমে রাস্তা পার হয়ে ফ্যাকাল্টির দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন। বাসটি তখনো দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পর নামলেন সোবহানস্যার। লম্বা ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবীর কারণেই কি এতক্ষণ লাগলো নামতে?
স্যার নামতেই বাস চলে গেল সামনের দিকে। হাত তুলে সালাম দিলাম স্যারকে। স্যার সম্ভবত আমাদের খেয়াল করেননি। রাস্তা পার হয়ে খুব আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলেন ফ্যাকাল্টির দিকে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবীর সাথে খয়েরি রঙের ব্রিফকেস – কেমন যেন বিসাদৃশ্য লাগছে। ব্রিফকেসের বদলে কাপড়ের থলি নিলেই কি সাদৃশ্য লাগতো?
“চল্ চল্ তাড়াতাড়ি চল্” বলে যীশু হঠাৎ জোরে হাঁটতে শুরু করলো। তাল মিলিয়ে হাঁটার সময় শুনতে পেলাম কিছুটা উচ্চ ডেসিবেলের কয়েকটা শব্দ নির্গত হলো তার শরীরের মধ্যাঞ্চল থেকে। ব্যাপারটা সুবিধাজনক ঠেকছে না। তার পাকস্থলিতে নিম্নচাপের লক্ষণ। কিন্তু সে যেদিকে দৌড়াচ্ছে – সেদিকে না গিয়ে তার উচিত ছিল ক্যাফেটরিয়ার দিকে যাওয়া। আমাদের ফ্যাকাল্টির টয়লেটগুলির যে কী জঘন্য অবস্থা তা তো তার অজানা নয়। কিন্তু তাকে কিছু বলার আগেই সে আরো কিছুটা বায়ুদূষণ ঘটিয়ে দৌড়ে উঠে গেল ফ্যাকাল্টির সিঁড়িতে।
সায়েন্স ফ্যাকাল্টির স্থাপত্যের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো দুই পাশের সিঁড়িগুলি। মাঝখানে প্রশস্ত র্যাম্প আছে। কিন্তু দুই পাশের এই সিঁড়িগুলির প্রস্থ এত কম যে পাশাপাশি একজনের বেশি উঠতে বা নামতে হলে অন্যজনের গায়ে লাগবেই। যীশু এতক্ষণ দৌড়ে সিঁড়ির গোড়ায় এসে আটকে পড়লো। সোবহানস্যার সিঁড়ি ধরে উপরে উঠছেন আস্তে আস্তে। প্রকৃতির বড় ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য নেই যীশুর। স্যারকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কোন উপায় নেই। আমি দূর থেকে দেখলাম সে সিঁড়িতে স্যারকে কোন রকমে পাশ কাটিয়ে চলে গেল উপরে। কিন্তু এজন্য যে তাকে পরে মূল্য দিতে হবে তা তখন একবারও মনে আসেনি।
ক’দিন আগেই ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হয়েছেন সোবহানস্যার। ডিপার্টমেন্টে অনেক নতুন নিয়ম তিনি চালু করতে চলেছেন – এ ব্যাপারে কানাঘুষা চলছে। ক’দিন আগে ক্লাসে তিনি বলেছেন – প্রক্টরের পদটা নাকি সৃষ্টি করা হয়েছিল ক্যাম্পাসে ছেলেদের সাথে মেয়েদের মেলামেশা বন্ধ করার জন্য। স্যারের কথা শুনে ফারুকের দিকে তাকিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম সে এই তথ্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করবে। কিন্তু ফারুক কোন কথা বলেনি। তবে কি ইতোমধ্যেই তাকে সাবধান করে দেয়া হয়েছে? তবে কি আমাদের ডিপার্টমেন্টে সেরকম কোন বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে “প্রক্টর” নিয়োগ করা হবে?
সেকেন্ড পিরিয়ডে সোবহানস্যার ক্লাস নিতে এসে যীশুকে খুঁজে বের করলেন।
“তোমার নাম কী?”
“যীশুখৃস্ট চোধুরি, স্যার।“
“তুমি কি খ্রিস্টান?”
“না স্যার, হিন্দু।“
“যীশুখৃষ্ট নাম – তাই জিজ্ঞেস করলাম। আচ্ছা, তখন কি তোমার খুব বেশি তাড়া ছিল?”
যীশুর মুখ অপমানে বেদনায় কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আমতা আমতা করে সে বললো, “জি স্যার, একটু তাড়া ছিল স্যার।“
“না, এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম। তোমার ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। স্টুডেন্ট তো টিচারদের পাশ কাটিয়ে যেতেই পারে।“ – স্যার হাসিহাসি মুখ করে কথাগুলি বললেও আমাদের কারোরই বুঝতে বাকি থাকলো না যে স্যার ব্যাপারটাকে সহজভাবে নেননি। যীশুর ভয়ের অনেক কারণ আছে।
মাস্টার্স পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। সেকেন্ড পিরিয়ডের পর আর কোন ক্লাস হলো না। যীশুর শরীর-মন কিছুই ভালো নেই। সে চলে গেল বাসায়। নাথ গেলো তার সঙ্গে। আমি একটু বেশি সময় ধরে ক্যাম্পাসে থাকার চেষ্টা করছি। সেমিনারে বা লাইব্রেরিতে যাবার অভ্যাস করছি। অনার্সের সময়টাতে মনের উপর আলাদা কোন চাপ ছিল না। কিন্তু এখন কেমন যেন একটা টেনশান তৈরি হয়েছে।
তিন তলায় উঠে সেমিনারে ঢুকলাম। সেমিনাররুমের ভেতরে আরেকটি ছোট রুম আছে। সেখানে দেয়ালঘেঁষে ফ্লোরের উপর রাখা হয়েছে শত শত ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নাল। এই জার্নালটি যে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বনেদি জার্নাল তা জেনেছি মাত্র কয়েকদিন আগে। আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির এই দামী জার্নাল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে বিনামূল্যে। উন্নয়নশীল দেশের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এই জার্নাল আমরা ফ্রি-তে পাচ্ছি আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির কাছ থেকে। ফ্রি জিনিসের কোন মূল্য নেই বলেই এত দামী জার্নালটিকে রাখা হয়েছে সবচেয়ে অবহেলায়। জার্নালের ভলিউম এবং নাম্বার অনুযায়ী সাজিয়ে রাখার কথা। কিন্তু আমাদের সেমিনার-লাইব্রেরিয়ানের সেরকম কোন ইচ্ছে আছে বলে মনে হয় না।
সেমিনার রুমের ভেতরের রুমের সাথে লাগানো মোবাশ্বেরস্যারের অফিস। আমি ভেতরের রুম থেকেই শুনতে পেলাম মোবাশ্বেরস্যারের গলা, অঞ্জন আর রিনার গলা। অঞ্জন আর রিনা মোবাশ্বেরস্যারের কাছে থিসিস করছে।
অনেকদিন রিনার সাথে কথা হয় না আমার। ইদানীং সবাই কেমন যেন অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছে। আমি নিজেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আজ কথা বলতে হবে তাদের সাথে। তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে সেমিনারের মেইন রুমে ঢুকতেই শায়লাআপার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল।
“প্রদীপ, প্রামাণিকস্যারের কিটেলের বইটা তুমি নিয়ে গেছ না?”
শায়লাআপা প্রামাণিকস্যারকে খালু না বলে স্যার কেন বলেন কে জানে। অবশ্য খালু তো ব্যক্তিগত সম্পর্ক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রয়োগ প্রামাণিকস্যার নিশ্চয় পছন্দ করবেন না। বললাম, “জি আপা।”
“তুমি কি বইটা এনে দিতে পারবে?”
“কালকে নিয়ে আসবো।“
“আজকে পারবে না? আজকে নিয়ে এসো। বাসায় দিয়ে যাও আজকে কোন এক সময়।“
শায়লাআপার উচ্চারণ এত সুন্দর, কথাগুলি কেমন যেন কবিতার মতো শোনায়।
সেমিনার থেকে বের হয়ে মোবাশ্বেরস্যারের অফিসে উঁকি দিয়ে দেখলাম। অঞ্জন ও রিনা এখনো স্যারের সামনে বসে আছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি তাদের জন্য।
মাস্টার্স পরীক্ষার্থীরা আসতে শুরু করেছে। অবশেষে আমাদের আগের ব্যাচের মাস্টার্স পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। এদের সার্টিফিকেটে লেখা থাকবে ১৯৮৮ সালের মাস্টার্স পরীক্ষা। অথচ হচ্ছে ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। আমাদেরটা যে আগামীবছর এসময় হবে – তার কোন গ্যারান্টি নেই। এতগুলি বছর যে শিক্ষাজীবন থেকে নিষ্ফলা ঝরে যাচ্ছে তার জন্য ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারো কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় যাঁরা চালান – তারা সুযোগ-সুবিধা সব ভোগ করেন, কিন্তু কোন দায়িত্ব নেন না। বিশ্ববিদ্যালয় মাসের পর মাস বন্ধ থাকে, খোলা থাকলেও ঠিকমতো ক্লাস হয় না, যথাসময়ে পরীক্ষা হয় না, পরীক্ষার রেজাল্ট দিতে মাসের পর মাস লেগে যায়। অথচ সব দোষ দেয়া হয় সরকারকে। এতদিন এরশাদ সরকারের দোষ ছিল, এবার খালেদা জিয়ার সরকারের দোষ।
রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে দেশের স্কুল-কলেজের পড়াশোনাও তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা তো একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হয়ে যাচ্ছে। স্কুল-কলেজে তো কোন সেশান-জট নেই। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কেন এই অবস্থা? বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্তরিকভাবে চাইলেই বিশ্ববিদ্যালয়কে সেশান-জট থেকে মুক্ত করা সম্ভব। কিন্তু আমার ধারণা সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া – বেশিরভাগই সে ব্যাপারে আন্তরিক নন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় বছরের পর বছর অচল হয়ে থাকলেও শিক্ষকদের কোথাও কোন অসুবিধা হয় না, কারো কাছেই কোন জবাবদিহি করতে হয় না তাঁদের। আমার ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার মতো এমন সুখের চাকরি আর হয় না।
কিন্তু এতসব স্বাধীনতার পরেও আমাদের স্যারদের দেখলে খুব একটা সুখি মানুষ বলে মনে হয় না। সুখি মানুষ ছোট-খাট ব্যাপারে খিটমিট করেন না। কিন্তু আমাদের স্যারদের কেউ কেউ করেন। যেমন আজ সোবহানস্যার করলেন। একজন ছাত্র শিক্ষককে পাশ কাটিয়ে গেলেই চরম বেয়াদবি হয়ে গেল? ছাত্ররা শিক্ষক-বাসে উঠলেই শিক্ষকদের অপমান হয়ে গেল? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক কি প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক?
“কী রে, তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস?” রিনার গলার স্বর কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে শোনাচ্ছে।
“তোদের জন্য।“
অঞ্জন জানতে চাইলো, “যীশুর সাথে সোবহানস্যারের কী হয়েছে?”
পুরো ঘটনাটি শোনার পর তারা আতঙ্কিত হয়ে গেল। স্যারদের পাশ দিয়ে যাবার সময় সর্বনিম্ন কতটুকু দূরত্ব বজায় রাখলে বেয়াদবি হবে না তা জানা থাকলে ভালো হতো।
রুমে ফিরে আবার বের হতে হলো। প্রামাণিকস্যারের বইটা শায়লাআপাকে দিয়ে আসতে হবে। আদম শফিউল্লাহস্যার কিটেলের বই থেকে সলিড স্টেট ফিজিক্স পড়াচ্ছেন। আমি কিটেলের বই কিনেছি। আন্দরকিল্লায় যে ইন্ডিয়ান প্রিন্ট পাওয়া গেছে সেটা সিক্সথ এডিশান। কিন্তু স্যার পড়াচ্ছেন ফিফ্থ এডিশান থেকে। প্রামাণিকস্যারের কাছ থেকে ফিফ্থ এডিশানের বইটা এনেছিলাম। স্যারের কাছে যেসব বই আছে সেগুলি তো বটেই, লাইব্রেরি থেকেও যদি কোন বই লাগে – স্যার নিজে সেগুলি লাইব্রেরি থেকে ইস্যু করে দিচ্ছেন।
প্রামাণিকস্যারের বাসায় যাবার সময় ইউনিভার্সিটির দুই নম্বর গেটে নামলে কাছে হয়। আমাদের ইউনিভার্সিটির এলাকাটা যে কত বড় তা পুরো ক্যাম্পাস না ঘুরলে বোঝা যাবে না। স্যারের বাসা খেলার মাঠের ঐপাশে পাহাড়ের উপর। একতলা সুন্দর বাসা। বাসার সামনে বিশাল সাইজের একটা গোলাপ ফুটে আছে। যীশু এই ফুল দেখলে খুশি হয়ে যেতো।
“বই এনেছো?”
আমাকে ভেতর থেকে দেখতে পেয়ে বের হয়ে এসেছেন শায়লা আপা।
“জি। আপনার পরীক্ষা কেমন হলো?”
“পরীক্ষার কথা জিজ্ঞেস করবে না। কোনদিন জিজ্ঞেস করবে না।“
“ঠিক আছে। আপনিও জিজ্ঞেস করবেন না। এই নেন আপনার বই।“
“থ্যাংক ইউ। এবার বিদায় হও।“
“স্যারের সাথে দেখা করবো না?”
“না, স্যার বাসায় নেই।“
ফিরে আসার সময় আলাওল হলের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম। থিসিসের কাজ শুরু করার পর প্রামাণিকস্যারের কাছ থেকে অনেক কিছুই জানতে পারছি। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সমস্যার চেয়েও স্যারের কাছ থেকে জীবন-দর্শন ও নিয়মনিষ্ঠতার পাঠ অনেক বেশি আনন্দময় বলে মনে হচ্ছে।
স্যার বলেন, “নিয়মনিষ্ঠতা আর নীতিবোধ কিন্তু এক জিনিস নয়। যে সব নিয়ম মেনে চলে তাকে নিয়মনিষ্ঠ বলতে পার। কিন্তু সে যে খুব নীতিবান হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন কোন কমিটিতে থাকেন, তখন মিটিং-এ উপস্থিত থাকার জন্য অনেক টাকা সম্মানী পান। প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টে অনেকগুলি কমিটি থাকে। প্রত্যেক টিচারই একাধিক কমিটির মেম্বার। প্রতি মাসে অনেকগুলি কমিটির অনেকগুলি মিটিং হয়। শুধুমাত্র মিটিং-এর সিটিং-মানিও কিন্তু অনেক। এগুলি সব বেতনের বাইরে। পরীক্ষার প্রশ্ন করার জন্য, খাতা কাটার জন্য, পরীক্ষায় ডিউটি করার জন্য, ভাইভা নেয়ার জন্য – আলাদা আলাদা সম্মানী আছে। এর সবকিছুই কিন্তু নিয়মের মধ্যে আছে। এখন প্রশ্ন হলো সব কাজের জন্য যদি আলাদা আলাদা সম্মানী দেয়া হয় – তাহলে নিয়মিত বেতন-ভাতা কী কারণে দেয়া হয়? এখানে অনিয়ম কেউ করছে না। কিন্তু নীতির প্রশ্ন যদি তোল, তাহলে অন্য কথা।”
নীতির প্রশ্ন কোথায় তুলবো, কার কাছে তুলব? গতকাল অঞ্জনদার সাথে দেখা হয়েছিল ফ্যাকাল্টিতে। অঞ্জন কুমার চৌধুরি – আমাদের দু’ব্যাচ সিনিয়র। প্রামাণিকস্যারের কাছে থিসিস করেছেন। অনার্স মাস্টার্স দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছেন। বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে নিয়োগ দেয়া হয়নি দুইটি কারণে - হিন্দু হওয়ার কারণে, এবং প্রামাণিকস্যারের কাছে থিসিস করার কারণে।
পনেরো দিন ক্লাস হবার পর সায়েন্স ফ্যাকাল্টির গেটে আবার তালা পড়লো। সকালে ক্লাস করতে গিয়ে দেখলাম ফ্যাকাল্টির কলাপসিবল গেটে তালা লাগিয়ে গেট আগলে দাঁড়িয়ে আছেন – না, কোন ছাত্রসংগঠন নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াত সমর্থক শিক্ষকদের নেতারা। ডীন নির্বাচন প্রতিহত করার জন্যই এই ব্যবস্থা। আমাদের পরিচিত শিক্ষকদের এই ভূমিকায় দেখে একটা প্রশ্নই মনে আসে - বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা কী সুনীতির শিক্ষা পাচ্ছি?
No comments:
Post a Comment