#স্বপ্নলোকের_চাবি_৫০
“অন্যায়ের ছুরির কোন বাঁট থাকে না; যে মারে সেও রক্তাক্ত হয়।“ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই দার্শনিক উক্তির পক্ষে অনেক ঘোরানো-প্যাঁচানো শৈল্পিক যুক্তি দেখানো যায়। কিন্তু বাস্তবে সেরকম প্রমাণ আমি খুব একটা দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত-শিবির গত পাঁচ বছর ধরে যেসব অন্যায় অনবরত করে চলেছে – তাতে আমরাই শরীরে-মনে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি, কিন্তু তাদের ভেতরে-বাইরে কোথাও রক্তক্ষরণের চিহ্ন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তারা এমনভাবে সবকিছু করছে – অনেকে বুঝতেই পারছে না কোন্টা ন্যায়, কোন্টা অন্যায়। আমার সাথে সরাসরি যে অন্যায়টা তারা করেছে, আলাওল হলের ব্যাপারটা – আমি বন্ধুদের কাউকে বলিনি। শিবিরের হাতে মার খাওয়াটা এখন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার বলে ধরে নেয় সবাই। অন্যায় সহ্য করতে করতে অন্যায়টাই স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়। ছিয়াশির নভেম্বরের আগে এরশাদের বলে বলীয়ান হয়ে এরকম যখন যাকে খুশি ধরে মারতো ছাত্রসমাজের ক্যাডাররা। এখন শিবিরের ক্যাডাররা একই ঘটনা ঘটাচ্ছে। শিবিরের রাজত্ব যদি কখনো শেষ হয় – তখন অন্য কোন দলের ক্যাডাররা ঘটাবে। আমাদের মতো নিরীহ সাতে-পাঁচে না থাকতে চাওয়া শিক্ষার্থীরা মার খেতেই থাকবে।
যীশু সেদিন আমার সাথে ছিল, সে কাউকে বলেছে কি না জানি না। কিন্তু ক্লাসের অনেকেই জেনে গেছে ব্যাপারটা। হলের বারান্দায় সেই সময় যারা ছিল তারা দেখেছে। তাদের মধ্যে আমাদের ক্লাসেরও কেউ কেউ হয়তো ছিল। ঘটনার পরেরদিন হাফিজ জানতে চাইলো, “কী করবি ভাবছিস?”
“কী আর করবো, কিছু করার উপায় কি আছে?”
“সেটাই বলতে চাচ্ছিলাম। এবার তো অল্পের উপর দিয়ে গেছে। এরপর হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়ে রেললাইনে ফেলে রাখবে।“
আমি বুঝতে পারছি হাফিজ কী বলতে চাচ্ছে। যীশু আর প্রদীপ নাথের সাথে এব্যাপারে সব সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছি। হলে যেসব ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে তার তুলনায় আমার ঘটনাটা নিতান্তই তুচ্ছ। আমাকে যদি এখন হলে সিট একটা দেয়াও হয়, আমি কি হলে থাকতে পারবো? কুমিরের সাথে ঝগড়া করে পানিতে বাস করতে হলে সারাক্ষণ যে পরিমাণ উৎকন্ঠার ভেতর থাকতে হবে তাতে পড়াশোনা হবে?
কিন্তু অন্যায় একেবারে চুপচাপ সহ্য করাও কি সম্ভব? আবার সহ্য না করেও উপায় কী? ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে’ জাতীয় আপ্তবাক্য নিরাপদ দূরত্বে বসে বলা অনেক সহজ। কিন্তু মনের বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে অন্যায়কে মেনে নেয়ার যে কী কষ্ট – তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে, এবং তাদের সংখ্যা অনেক। সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে স্বয়ং ভিসি পর্যন্ত আজ তাদের কাছে অসহায়।
১৮ নভেম্বর থেকে ভাইস-চ্যান্সেলরের অফিস-বাসা অবরোধ করে রেখেছে শিবিরের ক্যাডাররা। বাসার বাইরে মাইক লাগিয়ে অনবরত হুমকি দেয়া হচ্ছে তাঁকে পদত্যাগ করার জন্য। ক্যাম্পাসে পুলিশ-ক্যাম্প আছে, সেখানে গায়ে-হাওয়া-লাগানো পুলিশ আছে অনেক। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখা ছাড়া আর কিছুই করছে না। কারণ আর কিছু করার হুকুম তাদের দেয়া হচ্ছে না উপরের মহল থেকে। উপরের মহল অর্থাৎ সরকার এখন জামায়াত-শিবিরের পক্ষে।
শিবিরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সর্বদলীয় ছাত্র-ঐক্য গঠিত হয়েছিল। চাকসু নির্বাচনে জেতার পর এই ঐক্য শিবির-প্রতিরোধের চেয়েও ক্ষমতা এবং সুযোগ-সুবিধা ভাগাভাগির দিকেই বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েছে বলে আমার ধারণা। নইলে শিবিরের বিরুদ্ধে তাদের অবরোধ কয়েকদিনের মধ্যেই একটা হাস্যকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতো না।
সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য নামে সর্বদলীয় হলেও এখন রাজনৈতিক বোঝাপড়ার কারণে ছাত্রদল ছাত্রশিবিরের বিপক্ষে একটা শব্দও উচ্চারণ করছে না। চাকসুর ভিপি অচিরেই বিএনপিতে যোগ দিচ্ছেন বলে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে। তারপরও ছাত্রঐক্যের ডাকে একদিন আধাবেলা হরতাল পালিত হয়েছে, আর অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ডাকা হয়েছে শিবিরের অবরোধের বিরুদ্ধে। ছাত্রঐক্য শহর থেকে শাটল ট্রেন আসতে দিচ্ছে না। আর ক্যাম্পাসে যেসব বাস চলতো সেগুলি বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু টিচার্স-বাস, স্টাফ-বাস ঠিকই চলছে এবং ক্লাসও চলছে।
আমার ধারণা শিক্ষকরা আন্তরিকভাবে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বাধাহীনভাবে চলতো। শিক্ষকরা যদি রাজনৈতিক সুবিধা না নিতেন, ছাত্ররাজনীতিকে নিজেদের ব্যক্তিগত সুবিধালাভের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার না করতেন, তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির এই অবস্থা হতো না। ছাত্রদের রাজনীতি থেকে তাঁরা নিজেদের লাভ ঠিকই খুঁজে বের করে নেন। নইলে গতবছরের ডিসেম্বরে ছাত্র-শিক্ষকদের উপর শিবিরের আক্রমণের পর, একজন ছাত্র নিহত এবং অসংখ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হবার পর আবার শিবিরই যখন বিশ্ববিদ্যালয় অবরোধ করে রেখেছিল মাসের পর মাস, তখন কোন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ক্লাস নেননি। এমইএস কলেজে বিকল্প প্রতীকী ক্লাস চালু হবার পর প্রামাণিকস্যার ছাড়া আমাদের ডিপার্টমেন্টের আর কোন শিক্ষক ক্লাস নিতে যাননি। অথচ এখন যখন প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলি ভিসিস্যারকে হেনস্তা করার প্রতিবাদে শিবিরের বিরুদ্ধে অবরোধ ডেকেছে, আমাদের ডিপার্টমেন্টের স্যাররা ক্লাস নিচ্ছেন। ক্লাস নেয়া শিক্ষকদের দায়িত্ব। এজন্য অবশ্যই তাঁদের সাধুবাদ দেয়া উচিত। কিন্তু সেই দায়িত্ব শিবিরের অবরোধের সময় দেখা যায় না কেন? অবশ্য প্রামাণিকস্যার এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম। তিনি তখনো ক্লাস নিয়েছেন, এখনো ক্লাস নিচ্ছেন। দায়িত্বে অবহেলা তাঁর নীতিবিরুদ্ধ। তিনি তো সরাসরি বলেন, “ক্লাস বন্ধ করলে তোমাদেরই ক্ষতি, তোমরাই পিছিয়ে যাবে, তোমাদেরই শিক্ষাবর্ষ নষ্ট হবে। বিশ্ববিদ্যালয় বছরের পর বছর বন্ধ থাকলেও শিক্ষকদের কোন অসুবিধা হবে না।“
অবরোধের সমর্থনে শুরুতে আমরা কয়েকজন কিছুদিন ক্লাস করিনি। কিন্তু তাতে আমাদেরই ক্ষতি হয়েছে। সোবহানস্যার একটা টিউটোরিয়েল পরীক্ষা নিয়ে ফেলেছেন। অর্ধেক শিক্ষার্থী টিউটোরিয়েল পরীক্ষার কথা না জানলেও পরীক্ষা নিতে স্যারের কোন অসুবিধা হয়নি। শিবিরের অবরোধের সময় প্রামাণিকস্যার যে ক্লাস নিয়েছিলেন সেটাকে অবৈধ বলেছিল যারা, তারা এখন চুপ করে আছে। আমরা যারা পরীক্ষা দিতে পারিনি, সোবহানস্যারের কাছে গিয়েছিলাম। স্যার খুবই বিরক্তভাবে বলেছিলেন, “তোমরা ক্লাসে না এলে তোমাদেরকে কি বাসায় বাসায় গিয়ে ডেকে নিয়ে আসবো?”
বেশিরভাগ ডিপার্টমেন্টেই আমাদের মতো অবস্থা। প্রগতিশীলদের অবরোধ অচিরেই একটা হাস্যকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। অথচ ভিসিস্যারের বাসা আর অফিসের সামনে শিবিরের ননস্টপ অবরোধ চলছে।
ভিসিস্যার অবরুদ্ধ অবস্থায় কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন জানি না, কিন্তু কোনকিছুই থেমে নেই। অজিতদের মাস্টার্সের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা হয়ে গেলো। আমাদের অনার্সের রেজাল্টের ভিত্তিতে স্কলারশিপ দেয়া হয়েছে। সেই স্কলারশিপের টাকা তোলার জন্য নোটিশ দেয়া হয়েছে। নোটিশ মোতাবেক গেলাম প্রশাসনিক ভবনে।
লাল-ফিতার দৌরাত্ম্য সম্পর্কে আগে কিছুটা শুনেছিলাম, এবার দেখলাম। নতুন গ্রন্থাগার ভবন হবার আগে যেখানে লাইব্রেরি ছিল – এখন সেই বিল্ডিংটার পুরোটাই প্রশাসনিক ভবন। নিচের তলায় একটা রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম বৃত্তির টাকা তুলতে কোথায় যেতে হবে। যাঁকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি আকারে ছোটখাট হলে কী হবে – আশ্চর্য রকমের বজ্রকন্ঠ। খুবই বিরক্ত হয়ে তর্জনী উঁচিয়ে গমগমে গলায় বললেন, “দোতলায় গিয়ে দ্যাখেন।“
দোতলায় উঠলাম। সারি সারি রুম, লোকজনের ভীড় নেই কোথাও। এতগুলি রুমে এতজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর কী কাজ তা জানি না। বারান্দা থেকে রুমের ভেতর যতটুকু দেখা যায় – দেখতে পাচ্ছি প্রত্যেক রুমেই তিন-চারজন মানুষ মিলে গল্পগুজব করছেন। সকাল এগারোটা সম্ভবত গল্পগুজব করার সময়। রুমের সামনে কাঠের নাম-ফলকে লেখা আছে সেকশান অফিসার-১, সেকশান অফিসার-২, সেকশান অফিসার-৩, … কতজন সেকশান অফিসার আছেন এখানে? এদিকে কয়েকটা রুমে আবার পর্দা ঝুলছে। আমি পর্দাবিরোধী মানুষ। পর্দা ঠেলে ঢোকার সাহস হলো না, পর্দাহীন একটা রুমে গলা বাড়ালাম।
“কী চান এখানে?” ধমকে উঠলেন একজন সোয়েটার-মাফলার পরা ভদ্রলোক। তাঁর টেবিলে অনেকগুলি ফাইলপত্র স্তূপ করা আছে। কিন্তু তিনি ফাইলের উপর পত্রিকা বিছিয়ে পাশের টেবিলের টাইপিস্টের সাথে কথা বলছিলেন এতক্ষণ।
এই বিল্ডিং-এর সবারই সম্ভবত মেজাজ গরম। প্রশাসনিক দপ্তরে যারা কাজ করেন তারা সবাই কোন না কোনভাবে নিজেকে শাসনকর্তা ভাবেন; সে রাষ্ট্রই হোক, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ আমাদের কাজ করার জন্যই তাঁদেরকে রাখা হয়েছে। কিন্তু সেটা আমরা জানলেও কিছুই করার নেই। ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ বলে বন্দুকের নল যখন জনগণের দিকে তাক করা হয়, তখন জনগণের জানতে বাকি থাকে না কার ক্ষমতা কতটুকু।
ধমক খেয়ে আমার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। মিনমিন করে বললাম, ‘বৃত্তির টাকা তোলার জন্য কোথায় যেতে হবে?’
“টাকা তোলার জন্য কোথায় যায় মানুষ? ব্যাংকে যেতে হবে।“
“না, মানে বৃত্তির টাকা –“
“বৃত্তির টাকা ব্যাংকে জমা হবে। ব্যাংক থেকে তুলতে পারবেন।“
টুকটাক বৃত্তি আগে যেগুলি পেয়েছিলাম সেগুলির কোনটাই ব্যাংক থেকে তুলতে হয়নি। স্কুল-কলেজ থেকে নগদ দিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি কি তবে ব্যাংকে যায়? কীভাবে কী হয় এই তথ্যগুলি আমাদের সরাসরি জানিয়ে দিলে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের কী অসুবিধা হয় আমি জানি না।
“কীভাবে জমা হবে কিছুই তো জানি না।“
এবার টাইপিস্ট মহোদয়ের দয়া হলো। তিনি কিছুটা মোলায়েমভাবে বললেন, “আপনি তিন তলায় অ্যাকাউন্টস সেকশানে গিয়ে খবর নেন।“
তিন তলায় অনেক ভীড়। টাকা-পয়সার ব্যাপার যেখানে, ভীড় সেখানে বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন স্যারকেও দেখলাম এখানে হাঁটাহাঁটি করছেন। খুবই হাই-পাওয়ার সেকশান বুঝতে পারছি। কিন্তু এখানে কাকে জিজ্ঞেস করবো বুঝতে পারছি না। এক কোণায় একটা কাউন্টারের মতো দেখা যাচ্ছে। গেলাম সেখানে।
“কী দরকারে আইছেন?” বিশাল একটা খাতায় দ্রুত কলম চালাতে চালাতে প্রশ্ন করলেন টুপি-পরা বৃদ্ধ ভদ্রলোক। লম্বা দাড়ি ধবধবে সাদা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেয়ার বয়স সম্ভবত সরকারি চাকরির অবসরের বয়স থেকে বেশি। নইলে এই ভদ্রলোকের বয়স অনুযায়ী এতদিনে অবসরে চলে যাওয়ার কথা।
“স্কলারশিপের টাকার ব্যাপারে।“
“ফরম ফিল আপ করছেন?”
“জি না।“
“পাঁচ টাকা দেন” বলে পেছনের টেবিলে রাখা ফাইলের স্তূপ থেকে টেনে একটা হলদেটে কাগজ কাউন্টারের লোহার শিকের ভেতর দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন “ফরমের দাম।“
আমি পকেট থেকে টাকা বের করে দেখলাম পাঁচ টাকার কোন নোট নেই। দশ টাকার একটি নোট এগিয়ে দিলাম। তিনি টাকাটা টেনে নিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিলেন। আমি ফরমটার দিকে তাকালাম। সাইক্লোস্টাইল করা ঝাপসা একটি ফরম।
“ওইটা পূরণ কইরা চেয়ারম্যানের সাইন লইয়া আইসা এইখানে জমা দিবেন।“
“জি।“
আমি দাঁড়িয়ে আছি পাঁচ টাকা ফেরত নেয়ার জন্য। তিনি সম্ভবত ভুলে গেছেন। মনে করিয়ে দেবো কি না ভাবতে ভাবতে ফরমে চোখ বুলাচ্ছি।
“আর কিছু কইবেন?”
“পাঁচ টাকা বললেন, দশ টাকা দিয়েছি তো।“
“পাঁচ টাকা ভাঙতি নাই। আরেকটা ফরম নিয়া যান।“ – বলে আরেকটা ফরম এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।
“দুটো ফরম নিয়ে আমি কী করবো?”
“সেইটা আমি কী জানি। পাঁচ টাকার লাইগা যেইভাবে খারাই আছেন!” – তাঁর কন্ঠে শ্লেষ। মনে হচ্ছে পাঁচ টাকা ফেরত চেয়ে আমি ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছি।
ফরমের জন্য যে পাঁচ টাকা করে নিচ্ছেন সেটার কোন রশিদ দিচ্ছেন না। আমি রশিদ চাইলে কী করবেন কে জানে! এগুলি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা হবে না তা যে আমি বুঝতে পেরেছি তা তিনিও বুঝতে পেরেছেন। সে কারণেই হয়তো এবার আরেকটু তথ্য দিলেন। বললেন, “ব্যাংকে একাউন্ট খুলছেন? অগ্রণী ব্যাংকের বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় একটা একাউন্ট খোলেন। সেই একাউন্ট নম্বর এই ফরমে লিখে জমা দিবেন। আপনার বিত্তির টাকা অই একাউন্টেই জমা হইব।“
ব্যাংকের একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে যে এত ঝামেলা করতে হয় তা জানা ছিল না। চারপাতার একটা ছাপানো ফরম পূরণ করতে হলো। আমি যে বাংলাদেশের নাগরিক তা প্রমাণের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে জাতীয়তা সনদপত্র এনে জমা দিতে হলো ফরমের সাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সময় দুনিয়ার সব কাগজপত্র জমা দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে একটা পরিচয়পত্র দিয়েছে। সেটা দেখালেই তো বোঝা উচিত যে আমার সব কাগজপত্র ঠিক আছে। না, তা হবে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই আমাদেরকে প্রতিবছর একবার করে ভর্তি হতে হবে, ভর্তির সময় সমস্ত কাগজপত্র জমা দিতে হবে। আবার পরীক্ষার আগে ফরম পূরণ করতে হবে। এগুলি করার জন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে হল, হল থেকে ব্যাংক সব জায়গায় কয়েকবার করে দৌড়াতে হবে। একজন ছাত্রকে এতবার করে কেন একই জিনিস প্রমাণ করতে হবে? এই গোলমেলে সিস্টেম চলছে বছরের পর বছর ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন যে শিক্ষকরা তাঁরাও হয়তো ছাত্রাবস্থায় এই সিস্টেমের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু নিজেরা যখন শিক্ষক হয়েছেন – এই সিস্টেম বদলানোর কথা ভুলে গেছেন।
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার পর বৃত্তির ফরম পূরণ করে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের সাইন-টাইন যা লাগে সব নিয়ে আবার গেলাম প্রশাসনিক ভবনের সেই কাউন্টারে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক ফরমটা টেনে নিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, বিশ টাকা দেন।
আমি কিছু বলার আগেই তিনি আবার বললেন, “রেভিনিউ লাগবে। সরকারি ট্যাক্স।“
আমি দশ টাকার দুটো নোট এগিয়ে দিলাম। তিনি টাকা টেনে নিতে নিতে বললেন, “এইখানে সাইন করেন।“
বিশাল একটা খাতার যেখানে আমাকে সাইন করতে বললেন সেখানে পৌঁছানোর জন্য কাউন্টারের শিক দিয়ে হাত ঢুকাতে হলো। তিনি আরেকটি মোটা খাতার ভেতর থেকে ডাকটিকেটের মতো একটা টিকেট বের করে বিশাল খাতায় আমার দস্তখতের পাশে লাগিয়ে দিলেন। দেখলাম চার টাকার রাজস্ব টিকেট লাগানো হয়েছে। চার টাকার বদলে আমার কাছ থেকে বিশ টাকা নিলেন!
“দুই সপ্তাহ পরে ব্যাংকে খবর নিবেন। আপনার একাউন্টে চব্বিশ শ টাকা জমা হয়ে যাবে। এক মাসে দুইশ টাকা করে এক বছরের বিত্তি।“
“কত টাকার রেভিনিউ লাগলো?”
আমার প্রশ্ন শুনে তিনি গম্ভীরভাবে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “মনটারে বড় কইরেন বুইঝলেন। দুই-চাইর টাকার হিসাব কইরতে থাকলে বড় হইতে পাইরবেন না। আল্লার ইচ্ছায় বিত্তি পাইছেন, শোকর কইরেন।“
আমি ভদ্রলোকের কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। তিনি মিথ্যা বলে আমার কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন, আমি সেটা জিজ্ঞেস করতেই ছোটমনের মানুষ হয়ে গেলাম! তিনি অন্যায় করার পরেও মাথা উঁচু করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আর আমি মাথা নিচু করে চলে এলাম।
এরকমই জগতের নিয়ম কিনা আমি জানি না, তবে আমাদের চারপাশে এটাই নিয়ম। এখানে অন্যায়কারীই শক্তিমান। সেই শক্তিমত্তার পরিচয় পাওয়া গেল ২৯ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধান শত্রুদের একজন – গোলাম আযম জামায়াতের আমীর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। সেই ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি পাকিস্তান থেকে এসে এদেশে বহাল তবিয়তে আছেন। এতবছর গোপনে জামায়াতের প্রধান হিসেবে কাজ চালালেও আমীর হিসেবে প্রকাশ্যে আসেননি। এখন খালেদা জিয়ার আমলে তিনি প্রকাশ্যে এলেন। ডিসেম্বর মাস – আমাদের স্বাধীনতার মাস। আমাদের স্বাধীনতার ঠিক বিশ বছর পর এরকম একটা অপমান আমাদের সইতে হচ্ছে।
শুধু সেখানেই শেষ নয়। এই একই দিনে খালেদা জিয়া সরকার আমাদের ভিসি আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনকে মেয়াদ শেষ হবার আগেই ভাইস-চ্যান্সেলরের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এতদিন ধরে জামায়াত-শিবিরের অনবরত চাপের কাছে একটুর জন্যও মাথা নোয়াননি যে প্রফেসর আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন, তাঁকে রাষ্ট্রের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরিয়ে দেয়া হলো। ৩০ ডিসেম্বর থেকে ভিসির দায়িত্ব নিয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর রফিকুল ইসলাম চৌধুরি।
No comments:
Post a Comment