পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান কাজ হলো প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি কীভাবে ঘটে তার সঠিক কারণ খুঁজে বের করা। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবন বেড়েছে – এবং তার সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক তত্ত্ব। বিংশ শতাব্দীতে এসে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক পুরনো ধারণার যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে। নিউটনের চিরায়ত গতিবিদ্যার একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব করেছে কোয়ান্টাম গতিবিদ্যার নতুন জগত। ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সের অনেক সূক্ষ্ম পরিমাপ – কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্যে করলে দেখা যাচ্ছে অনেক অনিশ্চয়তা এসে ভর করছে সেসব পরিমাপে। নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র থেকে আমরা বস্তুর ভরের যে হিসেব পাচ্ছি – সেই একই ভরের হিসেব আমরা পেতে পারছি আইনস্টাইনের ভর ও শক্তির সমীকরণ থেকে। এই দুই ভরের মধ্যে সূক্ষ্ম তারতম্য দেখা যাচ্ছে – যেটার ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে। কোন তত্ত্বের প্রয়োগ করে তত্ত্বীয়ভাবে যে ফলাফল পাওয়া যায় – তার অনিশ্চয়তা যত কম হয়, অর্থাৎ পরীক্ষার মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যায় তার সাথে তত্ত্বীয় ফলাফলের পার্থক্য যত কম হয়, সেই তত্ত্বটি ততই সঠিক বলে ধরে নেয়া হয়। পদার্থের সাথে পদার্থের মিথস্ক্রিয়া কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হবার পর পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এবং উলফ্গং পাউলি - তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্রের উপর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রয়োগ করার জন্য আবিষ্কার করলেন – কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স। এপর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানের যত তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে কম অনিশ্চয়তাসম্পন্ন তত্ত্ব হলো কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স। আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী জুলিয়ান সুইংগার এবং জাপানি পদার্থবিজ্ঞানী শিনিতিরো তোমোনাগা আলাদা আলাদা ভাবে কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের সমস্যার সমাধানের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু সেই একই সময়ে কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের জটিল সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন যে বিজ্ঞানী তাঁর নাম রিচার্ড ফাইনম্যান। এই আবিষ্কারের জন্য ফাইনম্যান, সুইংগার এবং তোমোনাগা – তিনজনই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৬৫ সালে।
বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং ব্যতিক্রমী পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান। আইনস্টাইন যতই বলুন তাঁর নিজের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পেছনে প্রতিভার অবদান মাত্র ১০%, বাকি ৯০%-ই তাঁর অধ্যবসায় এবং অনুশীলন, আমরা সবাই জানি যে বিজ্ঞানীরা ভীষণ প্রতিভাবান। প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদেরকে দুইটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় – এক শ্রেণি হলেন স্বাভাবিক প্রতিভাবান, অন্য শ্রেণির বিজ্ঞানীরা হলেন জাদুকরী প্রতিভাবান। ঠিকমতো চেষ্টা, উদ্যম, অধ্যবসায় এবং সুযোগ থাকলে অনেকেরই প্রতিভার স্ফুরণ ঘটতে পারে। তাঁরা কী করছেন, কীভাবে করছেন তা জানা খুব সহজ বলে তাঁদের চিন্তা ও কাজের মধ্যে তেমন কোন রহস্য থাকে না। তাঁদের কাজ দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে যে এই কাজ তাদের পক্ষেও করা সম্ভব। কিন্তু জাদুকরী প্রতিভাবানদের কাজের ধরন সম্পূর্ন আলাদা। তাঁদের কাজের ফলাফল দেখা যায়। কিন্তু কাজটা কীভাবে হলো তা দেখার পরেও, সমস্ত সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়েও সাধারণের পক্ষে সম্ভব হয় না সেই কাজটা করা। রিচার্ড ফাইনম্যান ছিলেন বিজ্ঞানের উচ্চতম পর্যায়ের জাদুকরী প্রতিভাবান – বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিস্ময়কর পদার্থবিজ্ঞানী।
১৯১৮ সালের ১১ মে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরের ফার রকএওয়ে সাবার্বে জন্ম রিচার্ড ফাইনম্যানের। তাঁর বাবা মেলভিল ফাইনম্যান ও মা লুসিল ফিলিপ্স ইওরোপ থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন অভিবাসী হয়ে। তিনি কাজ করতেন একটি পোশাক তৈরির কারখানায় সেল্স ম্যানেজার হিসেবে। তাঁদের প্রথম সন্তান রিচার্ডের জন্মের পাঁচ বছর পর দ্বিতীয় সন্তান হেনরির জন্ম হয়। কিন্তু বেশিদিন বাঁচেনি হেনরি। রিচার্ডের যখন নয় বছর বয়স, তখন তাঁদের কন্যা জোয়ানের জন্ম হয়। সীমিত আয়ের সংসার হলেও মেলভিল ছিলেন জ্ঞানপিপাসী মানুষ। তিনি তাঁর ছেলে-মেয়ে রিচার্ড ও জোয়ানের ভেতর বিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসার বীজ রোপন করে দিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা নিয়ে বড় হয়েছেন রিচার্ড। তাঁর স্কুল, বাড়ি সবখানেই নানারকম পর্যবেক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে শিখতে শিখতে মুক্ত চিন্তার স্বাধীন পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন রিচার্ড ফাইনম্যান। স্কুলের নিচের ক্লাসে থাকতেই লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে এসে নিজে নিজে শিখে ফেলেছেন বীজগণিত, ক্যালকুলাস, ত্রিকোণমিতি। ফার রকএওয়ে স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি বাড়িতে বসেই নানারকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। যে কোন বিষয়ই তিনি বুঝতে চেষ্টা করতেন প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে। ক্যালকুলাস, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতির একই সমস্যার সমাধান করতেন বিভিন্ন পদ্ধতিতে। যদি দেখতেন প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে তাঁর নিজের পদ্ধতি বেশি কার্যকর, তিনি সেটাই গ্রহণ করতেন। কিন্তু যদি দেখা যেতো তাঁর নিজের পদ্ধতির চেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি ভালো, তখন নির্দ্বিধায় নিজের পদ্ধতি বর্জন করতেন। বিজ্ঞান শিখতে হলে যে কোন ধরণের আত্ম-অহংকার থাকতে নেই – তা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন একেবারে ছোটবেলা থেকেই।
একুশ বছর বয়সে ১৯৩৯ সালে ম্যাচাচুসেস্ট ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এম-আই-টি) থেকে গণিতে বিএসসি পাস করার পর ফাইনম্যান প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে গেলেন পিএইচডি করার জন্য। সেখানে তরুণ প্রফেসর জন হুইলারের গবেষণা-সহকারী হিসেবে গবেষণা শুরু করলেন। পল ডিরাক ইলেকট্রনের মিথস্ক্রিয়ায় কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রয়োগ করে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। ফাইনম্যান এধরনের মিথস্ক্রিয়ায় নতুন কোন পদ্ধতিতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রয়োগ করা যায় কি না সে ব্যাপারে গবেষণা শুরু করলেন। অন্যান্য প্রচলিত জটিল দীর্ঘ গাণিতিক পদ্ধতির পরিবর্তে সহজে প্রয়োগযোগ্য কার্যকরী বিকল্প পদ্ধতির উদ্ভাবন করলেন ফাইনম্যান। তাঁর পিএইচডি থিসিস ‘দ্য প্রিন্সিপাল অব লিস্ট অ্যাকশান ইন কোয়ান্টাম মেকানিক্স’-এর মাধ্যমে কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের এক নতুন মাইলফলক স্থাপিত হলো। ফাইনম্যানের বয়স তখন মাত্র ২৩ বছর। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি পিএইচডি সম্পন্ন করেন ১৯৪২ সালে।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আমেরিকা পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। অত্যন্ত গোপনীয় মিশন – ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’-এর কাজ চলছে আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যের গোপন ল্যাবরেটরিতে। বোমা তৈরির মিশনের বৈজ্ঞানিক ইউনিটের প্রধান রবার্ট ওপেনহেইমার জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য আমেরিকার সবচেয়ে মেধাবী বিজ্ঞানীদের খুঁজে বের করে টিম গঠন করছেন। তরুণ ফাইনম্যানের ডাক পড়লো সেখানে। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ফাইনম্যান কাজ করেছেন পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক প্রকল্প ম্যানহাটান প্রজেক্টে হিউম্যান কম্পিউটার হিসেবে। সেই সময় তিনি কাজ করেছেন বিজ্ঞানী নিল্স বোর, এনরিকো ফার্মির সাথে। ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই আমেরিকা আরিজোনার মরুভূমিতে পারমাণবিক বোমার প্রথম পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায়। বিজ্ঞানীরা সেই বিস্ফোরণ পর্যবেক্ষণ করেন পুরু কালোচশমায় চোখ ঢেকে। ফাইনম্যান বসেছিলেন বিস্ফোরণস্থলের কাছেই একটি মিলিটারি ট্রাকে। তিনি হিসেব করে দেখেছিলেন ট্রাকের সামনের কাচের ভেতর দিয়ে পারমাণবিক বিস্ফোরণের যে আলো আসবে – তাতে তার চোখ অন্ধ হয়ে যাবে না। তিনি তাই চোখের কালো চশমা খুলে সরাসরিই প্রত্যক্ষ করেছিলেন প্রথম পারমাণবিক বোমার প্রলয়ংকরী বিস্ফোরণ। তিনিই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি খালিচোখে সেই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর ফাইনম্যান প্রথম কাজ নিলেন নিউইয়র্কের জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানিতে। বেল ল্যাবোরেটরিতে কাজ করেছেন তিনি সেই সময়। এই বিখ্যাত বেল ল্যাবরেটরি থেকেই উদ্ভাবিত হয়েছে ট্রানজিস্টার – যা পরবর্তীতে সারা পৃথিবীকেই বদলে দিয়েছে ডিজিটাল পৃথিবীতে। এখানে কয়েক মাস কাজ করার পরেই তিনি কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে ছিলেন ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত। এখানেই তিনি কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের সমস্যার সমাধান করার জন্য উদ্ভাবন করলেন কিছু সহজ রেখাচিত্র – যা পরবর্তীতে ‘ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম’ নামে খ্যাতিলাভ করে। তিনি দেখিয়েছেন কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের যেকোনো মিথস্ক্রিয়ার প্রধান ক্রিয়া মাত্র তিন ধরনের – (১) একটি ইলেকট্রন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়, (২) একটি ফোটন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়, এবং (৩) একটি ইলেকট্রন একটি ফোটনকে হয় শোষণ করে কিংবা বর্জন করে। এই তিন ধরনের ঘটনার মাধ্যমে চার্জ ও তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের সমস্ত রকমের ঘটনার নিখুঁত হিসেব করা যায়। ফাইনম্যান এই তিন ধরনের কাজের জন্য তিনটা সহজ চিত্র ব্যবহার করলেন। ইলেকট্রনের জন্য ব্যবহার করলেন সরলরেখা। সরলরেখার মধ্যে তীরচিহ্ন দিয়ে দেখানো হয় ইলেকট্রনের দিক। ফোটনের জন্য ব্যবহার করলেন তরঙ্গের মতো বক্ররেখা। সেই রেখায় তীরচিহ্নের দিক নির্দেশ করে ফোটন শোষিত হচ্ছে – কিংবা বর্জিত হচ্ছে। এভাবে মাত্র তিনটি চিহ্নের সমন্বয়ে পুরো ইলেকট্রোডায়নামিক্সের সঠিক ব্যাখ্যা দেয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেললেন ফাইনম্যান।
ফাইনম্যান ডায়াগ্রামের প্রধান চিহ্ন |
১৯৪৯ সালে ফাইনম্যান তাঁর ডায়াগ্রাম প্রকাশ করেন ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালে। ১৯৬৫ সালে এই কাজের জন্যই তিনি বিজ্ঞানী সুইঙ্গার ও তোমোনাগার সাথে যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান।
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময়েই তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (ক্যালটেক) থেকে অফার পান সেখানে যোগ দেয়ার জন্য। ক্যালটেকে যোগ দেয়ার আগে ফাইনম্যান প্রায় এক বছর ব্রাজিলে কাটান। সেখানে গিয়ে তিনি নিজের চোখে দেখেন তৃতীয় বিশ্বের বিজ্ঞানচর্চার স্বরূপ। তিনি দেখেছেন তৃতীয় বিশ্বের লক্ষ-লক্ষ ছেলেমেয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়ছে। কিন্তু তেমন কিছু না বুঝেই শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাস করার জন্য পদার্থবিজ্ঞান মুখস্থ করছে। তাই তৃতীয় বিশ্বে পদার্থবিজ্ঞানের ডিগ্রিধারী এত ছাত্র এবং শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও সেখান থেকে ধরতে গেলে কোনো পদার্থবিজ্ঞানীই তৈরি হচ্ছে না।
ব্রাজিল থেকে ফিরে এসে তিনি ক্যালটেকে যোগ দেন। ১৯৫১ থেকে জীবনের শেষ দিন (১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত তিনি অধ্যাপনা ও গবেষণা করেছেন ক্যালটেক-এ। যে ন্যানো-টেকনোলজির প্রয়োগ এখন ওষুধ থেকে শুরু করে জীবনের হাজারো ক্ষেত্রে সেই ন্যানো-টেকনোলজির প্রাথমিক ধারণার উৎপত্তি ফাইনম্যানের হাতে। তরল হিলিয়ামের ক্ল্যাসিক্যাল থিওরি দিয়েছিলেন রাশিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী লেভ ল্যানডাউ। ফাইনম্যান তার কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান ছাড়া পদার্থবিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যেখানে ফাইনম্যান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেননি। কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক যে ফাইনম্যান জ্যোতির্বিজ্ঞানে কোন গবেষণা করেননি কেন? নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর ফাইনম্যান যখন বিখ্যাত ব্যক্তি হয়ে গেছেন তখন একবার আলাস্কায় গিয়েছিলেন একটা কনফারেন্সে অতিথি হয়ে। আলাস্কা থেকে সূর্যের অরোরা খুব ভালো দেখা যায়। সেখানে একটা অরোরা অবজারভেটরি আছে। অবজারভেটরির পরিচালক ফাইনম্যানকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখানোর সময় ফাইনম্যান স্বাভাবিকভাবেই খুব আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন অরোরার বৈজ্ঞানিক উপাত্তের ব্যাপারে। পরিচালক তখন ফাইনম্যানকে অনুরোধ করলেন, “আপনি অরোরা নিয়ে কিছু গবেষণা করুন।“
ফাইনম্যান উত্তর দিলেন, “আমি তো করতে চাই, কিন্তু করতে পারবো না। কারণ অরোরা নিয়ে গবেষণা করতে হলে আমাকে আমার ছোটবোনের অনুমতি নিতে হবে।“
পরিচালক ভাবলেন ফাইনম্যান মজা করছেন। কিন্তু ফাইনম্যান মজা করেননি। ফাইনম্যান তাঁর নয় বছরের ছোট বোন জোয়ানাকে পদার্থবিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেই ছোটবেলা থেকে। ছোটবেলায় এক গভীর রাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে জোয়ানাকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন খোলা মাঠে অরোরা দেখাতে। জোয়ানার বয়স তখন মাত্র চার, আর ফাইনম্যান তেরো। ক্রমাগত ভাইয়ের সাথে পদার্থবিজ্ঞানের খেলা খেলতে খেলতে পদার্থবিজ্ঞানকে গভীরভাবে ভালোবেসেছেন জোয়ানাও। সলিড স্টেট ফিজিক্সে পিএইচডি শেষ করার পর জোয়ানা অরোরা সংক্রান্ত গবেষণায় উৎসাহী হয়েছেন। তিনি জানেন তার ভাই যেখানেই হাত দেবে সেখানেই সোনা ফলবে। কিন্তু তিনি নিজে এমন একটা ক্ষেত্রে কাজ করতে চান – যেখানে তার ভাই হাত দেবেন না। একদিন তিনি ফাইনম্যানকে বললেন, “তুমি পদার্থবিজ্ঞানের সবকিছু নিয়ে নাও, কেবল মহাকাশটা আমার জন্য ছেড়ে দাও।“ ফাইনম্যান রাজি হয়ে গেলেন।
ফাইনম্যান মহাকাশ গবেষণা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেও মৃত্যুর দু’বছর আগে তাঁকে আমেরিকার মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে স্মার্ট বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় মহাকাশ সংক্রান্ত একটি ঘটনা। ১৯৮৬ সালের ২৮ জানুয়ারি আমেরিকান মহাকাশযান চ্যালেঞ্জার উৎক্ষেপণের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিস্ফোরিত হয়ে সাতজন মহাকাশচারীর সবাই মারা যান। প্রেসিডেন্ট রিগান তেরো সদস্যের এক বৈজ্ঞানিক কমিশন গঠন করেন এই ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য। ফাইনম্যান সেই কমিটির মেম্বার ছিলেন। তিনি ঘটনাস্থল, গবেষণাগার সবকিছু খুঁটিনাটি নিজের চোখে দেখে, সেখানকার সংশ্লিষ্ট সবার সাথে নিজে কথা বলে ঘটনার মূল কারণ শনাক্ত করেন। চ্যালেঞ্জার উৎক্ষেপণের আগের রাতে প্রচন্ড তুষারপাত হয়েছিল। রকেটের ও-রিং-এর রাবার প্রচন্ড ঠান্ডায় কার্যকারিতা হারিয়েছিল। উৎক্ষেপণের আগে সবকিছু পরীক্ষা করা হলেও বিজ্ঞানীরা এই আপাত ছোট্ট ব্যাপারটার দিকে নজর দেননি। ফাইনম্যান টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে ছোট্ট একটা পরীক্ষার সাহায্যে দেখালেন কী সমস্যা হয়েছিল চ্যালেঞ্জারের রকেটে। তিনি বরফভর্তি কাচের গ্লাসে এক টুকরা রাবার রেখে দেখালেন কীভাবে রাবারের ইলাস্টিসিটি নষ্ট হয়ে যায়। বিজ্ঞানের জগতে আগে থেকেই বিখ্যাত ছিলেন ফাইনম্যান। কিন্তু এই ঘটনার পর রাতারাতি সবার চোখে বিখ্যাত হয়ে যান ফাইনম্যান।
পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ফাইনম্যানের মত এমন ভালো শিক্ষক আর কখনো পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে ক্লাসিক টেক্সট বইয়ের নাম ‘ফাইনম্যান লেকচার অন ফিজিক্স’ যা রচিত হয়েছে তাঁর ক্যালটেকের ক্লাসরুমে দেয়া লেকচারগুলো থেকে। আইনস্টাইনের পরে ফাইনম্যানই ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে সৃষ্টিশীল বহুমাত্রিক পদার্থবিজ্ঞানী।
অনেকদিন থেকেই ক্যান্সারে ভুগছিলেন ফাইনম্যান। দুইবার অপারেশনের পর সেরেও উঠেছিলেন। কিন্তু তৃতীয়বার অপারেশানের পর ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মারা যান ফাইনম্যান।
তথ্যসূত্র
১) প্রদীপ দেব – কোয়ান্টাম ভালোবাসা।
২) ক্রিস্টোফার সাইকিস – নো অর্ডিনারি জিনিয়াস।
৩) জেমস গ্লেইক – জিনিয়াস।
_______________
বিজ্ঞানচিন্তা মে ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment