২০১২ সালের জুন মাসে সুইজারল্যান্ডের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে হিগ্স বোসন আবিষ্কারের সময় সারা পৃথিবীর পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রচন্ড উত্তেজনা চলছিল। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল ১৯৬৪ সালে যে অনন্য বোসন কণার অস্তিত্বের কথা তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করেছিলেন ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী পিটার হিগ্স এবং আরো কয়েকজন বিজ্ঞানী – যা পরবর্তীতে ‘হিগ্স বোসন’ নামে পরিচিতি পেয়েছে – তা বাস্তবে পাওয়া যাবে কি না দেখার জন্য। কিন্তু সেই সময় এই উত্তেজনার পাশাপাশি অপবিজ্ঞানীরা আরো একটি উত্তেজনা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিল ফেসবুক ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য সব প্রচার মাধ্যমে – যা ছিল খুব মারাত্মক। প্রচার করা হচ্ছিল লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে কৃত্রিমভাবে বিগ-ব্যাং সংঘটনের কাজ চলছে, এবং তার ফলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এরকম পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার কাল্পনিক ঘটনাকে বিজ্ঞানের মোড়ক দিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে, সিনেমাও তৈরি হয়েছে অনেকগুলি। অনেক মানুষ বিজ্ঞান ও কল্পনার মাঝখানের সীমানা বুঝতে না পেরে এসব কাল্পনিক কাহিনি বিশ্বাস করে ফেলেন। ২০১২ সালে এরকম অনেকের ভেতর একটা ভয় ও উৎকন্ঠা তৈরি হয়ে গেল – পৃথিবী কি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে? বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও এই পৃথিবী-ধ্বংসের তত্ত্ব প্রচারিত হচ্ছিল। তখন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেই এগিয়ে এলেন মানুষকে আশ্বস্ত করার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যাঁর কথায় সবচেয়ে বেশি আশ্বস্ত হলেন – তিনি ছিলেন প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম। এর আগেও অনেকবার এরকম হয়েছে। ১৯৮৮ সালে হঠাৎ বাংলাদেশে গুজব ছড়িয়ে পড়লো ঢোল কলমি গাছের পাতা ছুঁলেই নাকি মানুষ মারা যাচ্ছে। গুজবের ডালপালা গজাতে শুরু করলো। অনেকে বলতে লাগলো পাতা নয়, পাতায় যেসব পোকা হয় সেসব পোকা মানুষের গায়ে বসলেই মানুষ মারা যাচ্ছে। তখনো বাংলাদেশে ডিজিটাল যুগ শুরু হয়নি। মানুষ খবরের কাগজ পড়ে এবং রেডিও-টেলিভিশন থেকে খবর সংগ্রহ করতো। অনেক সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হতে লাগলো দেশের কোথায় কতজন মারা গেছে ঢোলকলমীর সংক্রমণে। হুজুগে মানুষ এসব আরো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে। লোকে দূর থেকে কেরোসিন ছিটিয়ে, বাঁশের আগায় করে আগুন দিয়ে ঢোলকলমী গাছ পোড়াতে শুরু করলো। এর মধ্যেই একদিন টেলিভিশনে সরাসরি অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম নিজের হাতে ঢোলকলমী গাছের পাতা মেখে, পাতার পোকা নিজের হাতে ধরে দেখালেন এসবে মানুষের কোন ক্ষতি হয় না। গুজব থেমে গেলো। অপবিজ্ঞানের সামনে বিজ্ঞানের সরাসরি প্রয়োগ – সাধারণ মানুষের বোধগম্য আকারে প্রকাশ যে কত কার্যকরী তা প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম – আমাদের জামালস্যার অনেকবারই দেখিয়েছেন।
এব্যাপারে আরেকজন পৃথিবীবিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীর সাথে জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের খুব মিল আছে – তিনি ছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান। কাছাকাছি সময়েই রিচার্ড ফাইনম্যান আমেরিকান জনগণের সামনে উন্মোচন করেছিলেন ১৯৮৬ সালের নভোযান চ্যালেঞ্জার-এর বিস্ফোরণের প্রধান বৈজ্ঞানিক কারণ। ফাইনম্যান সরাসরি প্রচারিত টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে এক গ্লাস বরফের ভেতর এক টুকরা রাবার রেখে দেখিয়েছিলেন প্রচন্ড ঠান্ডায় কীভাবে রাবারের স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে যায় – এবং যার ফলে চ্যালেঞ্জারের ও-রিং এর রাবার ঠিকমতো কাজ করেনি। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে আমেরিকান প্রফেসর রিচার্ড ফাইনম্যান এবং বাংলাদেশের প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম পরস্পর সহকর্মী এবং বন্ধু ছিলেন। ক্যালটেকে তাঁরা একই ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন, থাকতেনও কাছাকাছি বাসায়। ফাইনম্যানের স্ত্রীর সাথে জামালস্যারের স্ত্রীর ঘনিষ্ঠতা ছিল। ফাইনম্যানের ছেলে কার্ল ও মেয়ে মিশেল ছোটবেলায় অনেকসময় জামালস্যারের বাসাতেই থাকতো। ফাইনম্যান জামালস্যারের বাসার বাঙালি রান্না খেয়ে খুব আনন্দ পেয়েছিলেন – বিশেষ করে বাঙালি পদ্ধতিতে রান্না করা মাছের তরকারি।
পৃথিবীর প্রথম সারির পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন আমাদের জামালস্যার। কেমব্রিজ, ক্যালট্যাকের মতো পৃথিবীবিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পরেও যিনি বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন মাটির টানে, বাংলার সংস্কৃতির টানে। ১৯৮৪ সাল থেকে ২০১৩ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের বিজ্ঞান, প্রকৌশল, অর্থনীতিসহ প্রায় সব বিষয়েই তাঁর গভীর বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রমাণ যেমন রেখেছেন, তেমনি সরাসরি জড়িয়ে ছিলেন সঙ্গীতসহ শিল্পকলার অন্যান্য অনেক শাখার সাথে। নিজে খুব ভালো পিয়ানো বাজাতেন, আইনস্টাইনের মতো বেহালা বাজাতেন, সত্যেন বসুর মতো এস্রাজ বাজাতেন। চমৎকার গান করতেন। চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে জামালস্যারের সংগীতানুষ্ঠানও হয়েছে। আর বিজ্ঞান – জামাল স্যারের হাতে গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট।
জামালস্যারের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ঝিনাইদহে। তাঁর বাবা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলাম ছিলেন তখনকার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সাব-জজ। বাবার কর্মসূত্রে তাঁর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা হয়েছে কলকাতায়। সেখান থেকে চট্টগ্রামে আসার পর কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেছেন ক্লাস নাইন পর্যন্ত। তারপর চলে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানের মারির লরেন্স কলেজে। সেখান থেকে পাস করলেন সিনিয়র কেম্ব্রিজ (যা এখন ও-লেভেল নামে পরিচিত) এবং হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ (এ-লেভেল) পরীক্ষা। তারপর চলে গেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে বিএসসি পাস করলেন। তারপর সোজা ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএসসি পাস করলেন, পরের বছর এমএসসি। কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে তিনি যোগ দিলেন সেখানকার ইন্সটিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। এইসময় তাঁর গবেষণা-বন্ধু ছিলেন স্টিফেন হকিং। এরপর যোগ দিলেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি – ক্যালটেকে। রিচার্ড ফাইনম্যানের সাথে বন্ধুত্ব তখন সেখানেই। ক্যালটেকের পর তিনি কাজ করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনে। ১৯৭৩ সালে ফিরে এলেন লন্ডনে। যোগ দিলেন কিংস কলেজে। নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম খুব ভালোবাসতেন জামালস্যারকে। আবদুল সালামের প্রতিষ্ঠিত ইতালির ইন্টারন্যাশনাল থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স সেন্টারের ফেলো ছিলেন জামালস্যার। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত জামালস্যার ছিলেন লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে এলেন একেবারে। যোগ দিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। ১৯৮৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তুললেন আন্তর্জাতিক গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র। প্রফেসর আবদুস সালাম এই গবেষণাকেন্দ্রের উদ্বোধনী সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। ২০০৪ পর্যন্ত এই গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন জামালস্যার। এরপর ২০০৬ পর্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পরেও তিনি ইমেরিটাস প্রফেসর হিসেবে সংযুক্ত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে।
বাংলাদেশে তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশের মানুষের অকুন্ঠ ভালোবাসা; পেয়েছেন বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের স্বর্ণপদক, রাষ্ট্রীয় একুশে পদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুরষ্কার ইত্যাদি। কিন্তু এসব পুরষ্কারের চেয়েও সত্যিকারের বিজ্ঞানীদের জন্য সবচেয়ে বড় পুরষ্কার হলো – তাঁদের আবিষ্কৃত জ্ঞানের প্রয়োগে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি। সে হিসেবে জামালস্যারের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত তাঁর তিনটি মৌলিক বই – ‘দি আলটিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’, ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’ এবং ‘এন ইন্ট্রোডাকশান টু ম্যাথম্যাটিক্যাল কসমোলজি’ - যেগুলি মহাবিশ্বের প্রতি বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সাহায্য করেছে। সারাবিশ্বের কসমোলজির সিরিয়াস শিক্ষার্থীদের জন্য এই বইগুলি অবশ্যপাঠ্য।
১৯৭৭ সালে রয়েল এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির কোয়ার্টারলি জার্নালে একটি ছোট্ট টেকনিক্যাল পেপার – ‘পসিবল আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’ প্রকাশ করেছিলেন জামালস্যার। এরপর নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েইনবার্গ, ফ্রিম্যান ডাইসন, স্টিফেন হকিং, জয়ন্ত নারলিকার প্রমুখ বিজ্ঞানীরা জামালস্যারকে অনুরোধ করলেন এই টেকনিক্যাল পেপারের একটি জনপ্রিয় ভার্সান রচনা করতে – যা সাধারণ পাঠকের বোধগম্য হবে। এর আগে এরকম বিষয়ে হাতেগোণা কয়েকটি মাত্র বই প্রকাশিত হয়েছে। স্টিভেন ওয়েইবার্গের ‘ফার্স্ট থ্রি মিনিটস’ প্রকাশিত হয়েছে মাত্র এক বছর আগে। জামালস্যার সবার অনুরোধে রচনা করলেন ‘দি আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’। ১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে এই বই প্রকাশিত হবার পর মহাবিশ্বের ভবিষ্যত পরিণতি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তো বটেই, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। পরে জামালস্যারকে অনুসরণ করে এরকম বই আরো অনেকেই লিখেছেন। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত স্টিফেন হকিং-এর আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’-এর আইডিয়া জামালস্যারের ‘দি আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’ থেকে উৎসৃত। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী পল ডেভিস ১৯৯৪ সালে প্রকাশ করলেন তাঁর জনপ্রিয় বই - ‘দি লাস্ট থ্রি মিনিটস’ – যা জামালস্যারের বইটির পরের অধ্যায় বলা চলে। পল ডেভিস তাঁর বইয়ের সাব-টাইটেলে উল্লেখ করেছেন ‘কনজেকসার্স অ্যাবাউট দি আলটিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’।
আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে রোটেটিং ফিল্ড বা ঘূর্ণায়মান ক্ষেত্রের গাণিতিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছেন জামালস্যার। তাঁর গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে তিনি রচনা করেছেন তাঁর আরেকটি মাইলফলক গবেষণা-বই ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’। ১৯৮৫ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এই বইটি মূলত গবেষক এবং শিক্ষার্থী-গবেষকদের জন্য লেখা। এই গাণিতিক ভিত্তি প্রয়োগ করেই পরবর্তীতে স্টিফেন হকিং ব্ল্যাকহোলের ‘হকিং রেডিয়েশান’-এর আলো দেখতে পেয়েছেন।
জনপ্রিয় বিজ্ঞান মানুষের কৌতূহল মিটায়, হয়তো বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহও কিছুটা তৈরি করে। কিন্তু সত্যিকারের বিজ্ঞান-শিক্ষার জন্য দরকার বিজ্ঞানের মৌলিক গ্রন্থ। জামালস্যারের ‘আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’-এ মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় ব্যাখ্যা করা হয়েছে গণিত ব্যাবহার না করে। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের মূল ভাষা হলো গণিত। মহাবিশ্বের উৎস, গঠন, বিবর্তন এবং পরিণতির গণিত বুঝতে হলে একটা নির্ভরযোগ্য বইয়ের দরকার ছিল। সেই দরকার মিটিয়েছেন জামালস্যার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে তিনি রচনা করেছেন ‘এন ইন্ট্রোডাকশান টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি’। ১৯৯২ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হবার পর থেকে পৃথিবীর সব সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কসমোলজির শিক্ষার্থীদের জন্য এই বইটি প্রধান বইতে পরিণত হয়েছে। ২০০১ সালে এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে এর অনলাইন সংস্করণ।
জামালস্যার বাংলা ভাষায় রচনা করেছেন ‘কৃষ্ণ বিবর’। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত এই বই ব্ল্যাকহোলের উপর বাংলায় লেখা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একটি বই। সেই বইয়ের শুরুর দিকে জামালস্যার লিখেছেন – অনাগত ভবিষ্যতে বিশ্বের কী অবস্থা হবে এবং কী ঘটনা ঘটবে এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ব্যাপারে কৃষ্ণ বিবরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এই ভূমিকার ব্যাপারটা তো আমরা সবাই দেখেছি। ব্ল্যাকহোল এখন আবিষ্কৃত হয়েছে, এর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এদের পেছনে যে বিজ্ঞানীদের অবদান – তাঁদের কেউ কেউ নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। শুরুর দিকে এই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি যাঁরা তৈরি করে দিয়েছেন – আমাদের জামালস্যার তাঁদেরই একজন।
আমাদের খুব কাছের – একেবারে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বলেই হয়তো – আমরা জামালস্যারের মেধাকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারিনি। যে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাকেন্দ্র তিনি নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন – সেই গবেষণাকেন্দ্রে আমরা সেরকম আন্তর্জাতিক মানের ফসল ফলাতে পারিনি। অবসর গ্রহণের পরেও জামালস্যার আমাদের মাঝে ছিলেন। তিনি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ব্যাপারে অনেক গবেষণা করেছেন অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিষয়েও। সম্ভবত জামালস্যারই বাংলাদেশের একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি সরাসরি দৃঢ়ভাবে বলেছেন – আমাদের দেশে বিদেশী সাহায্যের কোন দরকার নেই। বিদেশী সাহায্য বন্ধ হলেই আমরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে শিখবো, বাধ্য হয়েই শিখবো। জামালস্যারের এই কথায় নীতিনির্ধারকদের কেউই কোন গুরুত্ব দেননি সেই সময়।
২০১৩ সালের ১৬ মার্চ জামালস্যারের জীবনাবসান হয়। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন তাঁর সৃষ্ট জ্ঞানের মধ্যে, তাঁর গবেষণা ও গবেষণাকেন্দ্রের মধ্যে। তাঁর স্মরণে তাঁর প্রতিষ্ঠিত গবেষণাকেন্দ্রের নাম দেয়া হয়েছে – ‘জামাল নজরুল ইসলাম গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র’। জামালস্যারের বৈজ্ঞানিক উত্তরাধিকার বহন করতে হলে যথাযথ যোগ্যতা অর্জন করতে হবে আমাদের।
সূত্র:
কৃষ্ণবিবর, আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স, রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি,
ম্যাথম্যাথিক্যাল কসমোলজি – জামাল নজরুল ইসলাম। দি লাস্ট থ্রি মিনিটস – পল ডেভিস।
______________
বিজ্ঞানচিন্তা জুন ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment