সূত্র: Nature Vol. 474, 16 June 2011 |
গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীর মানুষ যুদ্ধ করছে করোনা ভাইরাসের সাথে। এই ভাইরাস এত ছোট যে খালি চোখে তো দূরের কথা সাধারণ লাইট মাইক্রোস্কোপ বা আলোক-অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও এদের দেখা যায় না। কিন্তু সুযোগ পেলেই এরা আমাদের শরীরে ঢুকে যাচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে। ঢুকেই অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, আক্রমণ করছে আমাদের ফুসফুসসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। শরীরের প্রতিটি কোষের কার্যক্রম এমনভাবে ব্যহত করছে যে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করতে পারলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হচ্ছে। কীভাবে কাজ করছে এরা? আমাদের নাক-মুখ-চোখ দিয়ে ঢোকার সময় আমরা কোন ব্যথা পাচ্ছি না। বাতাসের উপাদানের সাথে এরা কীভাবে মিশছে? এই যে মিশে যাওয়া – বা ফিউশান ঘটা, আবার শরীরের কোষের ভেতর ঢুকে যাওয়া – এরজন্য যে শক্তির দরকার হয়, তা তারা কোথায় পায়? এই ভাইরাসগুলি শরীরে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এত দ্রুত কীভাবে বাড়ে এবং বিবর্তন ঘটায়? এত ক্ষুদ্র প্রাণসত্ত্বায় একইসাথে এত জটিল কাজ কীভাবে হয়? এসব রহস্য বের করতে বিজ্ঞানীরা হিমসিম খাচ্ছেন। আমরা প্রাণীকোষের গঠন এবং কার্যপ্রণালী সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। কিন্তু এখনো অনেক কিছুই অজানা। আমাদের ধ্রুপদী বলবিজ্ঞান বা ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্স দিয়ে জীবকোষের কার্য-প্রণালী পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। তাই বিজ্ঞানীদের এখন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আশ্রয় নিতে হচ্ছে – জীবনের মৌলিক উপাদান জীবকোষের মূল রহস্য বোঝার জন্য। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের আকার ও গতিপ্রকৃতি দেখার জন্য আমরা ইতোমধ্যেই ব্যবহার করছি যেসব যন্ত্র – যেমন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ, কিংবা পদ্ধতি – যেমন এক্স-রে ডিফ্রাকশান, এসবের মূল বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগত – এক অত্যাশ্চর্য জগত। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এসে এর আগের কয়েক শ বছরের চিরায়ত বিজ্ঞানের অনেক প্রচলিত ধারণা বদলে দেয়। এরপর থেকে বিজ্ঞানীরা অনেক আবিষ্কৃত ব্যাপারও নতুন ভাবে আবিষ্কার করেন, নতুন ভাবে বুঝতে শুরু করেন। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কিছু কিছু ব্যাপার এখনো এতটাই আশ্চর্যের যে – কোয়ান্টাম মেকানিক্স কীভাবে কাজ করে তা সম্পূর্ণরূপে বুঝতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো গলদঘর্ম হচ্ছেন। যেমন আলো – কণা রূপেও থাকতে পারে, আবার তরঙ্গ রূপেও থাকতে পারে।
কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের বয়স এখন ১২০ বছর। এপর্যন্ত কোয়ান্টাম জগতের যতটুকু পরীক্ষাগারে সরাসরি প্রমাণ করা গেছে, সেটুকু খুবই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে, খুবই ছোট ন্যানোমিটার স্কেলে এবং অন্ত্যন্ত কম তাপমাত্রায়। কিন্তু জীবন্ত জীবকোষের পরিবেশ মোটেও সেরকম নয়। জীবন্ত জীবকোষের নির্দিষ্ট তাপমাত্রা আছে এবং পরীক্ষাগারের আরোপিত শৃঙ্খলা সেখানে নেই। সেকারণে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্স পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব, জীববিজ্ঞানে সেভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। কিন্তু বিজ্ঞানের যতই উন্নতি ঘটছে, বিজ্ঞানীদের সেই ধারণা বদলে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা দেখতে পাচ্ছেন প্রকৃতিতে জীবকোষের ভেতর যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলিকে কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়েই সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে।
একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে আমরা সূর্যের শক্তি নিয়ে বেঁচে আছি। পৃথিবী টিকে আছে সূর্যের শক্তির উপর। সূর্যের ভেতর এই শক্তি কীভাবে উৎপন্ন হচ্ছে? সূর্যে আছে প্রচুর হাইড্রোজেন। যা নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় হিলিয়ামে পরিণত হচ্ছে এবং এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটির পুরোটাই কোয়ান্টাম প্রক্রিয়া। কীভাবে? একটি হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে একটি প্রোটন আছে। তার সাথে নিউক্লিয়ার ফিউশান হতে হলে আরেকটি হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস এসে মিশে যেতে হবে। এখন আরেকটি হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসও তো একটি ধনাত্মক প্রোটন। একটি প্রোটন তো অন্য আরেকটি প্রোটনকে আকর্ষণ করবে না। ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স অনুযায়ী একটি ধনাত্মক চার্জ অন্য একটি ধনাত্মক চার্জকে বিকর্ষণ করবে। ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স মেনে চললে তো সূর্য থেকে কোন শক্তিই উৎপন্ন হতো না, সৌরজগতও হতো না, মহাবিশ্বও হতো না। তাহলে এখানে একটি নিউক্লিয়াস আরেকটি নিউক্লিয়াসের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে কীভাবে? কোয়ান্টাম টানেলিং-এর মাধ্যমে, যা শুধু কোয়ান্টাম মেকানিক্সই ব্যাখ্যা করতে পারে। অনবরত কোয়ান্টাম টানেলিং-এর ফলে যে শক্তি বিকির্ণ হয়, সেই শক্তিই আমাদের পৃথিবীসহ সৌরজগতের সব গ্রহকে শক্তি জোগায়।
এই কোয়ান্টাম টানেলিং আমাদের শরীরের কোষে কোষে অনবরত চলছে। আমরা এনজাইম বা উৎসেচকের কথা জানি। এগুলো মূলত প্রোটিন। জীবকোষের ভেতর যত রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে সেগুলোকে ত্বরাণ্বিত করতে সাহায্য করে এনজাইম। কিন্তু কীভাবে এই কাজ করে এরা? কোষের মেমব্রেন বা কোষের আবরণ ভেদ করে কীভাবে এরা ইলেকট্রনের আদান-প্রদান ঘটায়? 'কোয়ান্টাম টানেলিং' এর মাধ্যমে। ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সের সূত্র মেনে কোন একটি বাধা পার হয়ে যেখানে ইলেকট্রনের যাওয়ার কোন উপায় নেই, সেখানেও দেখা যায় কিছু ইলেকট্রন সেই বাধা অতিক্রম করে ফেলেছে। জীবকোষের কোটি কোটি কোষের ভেতর অনবরত চলছে কোয়ান্টাম টানেলিং।
পৃথিবীতে যে প্রাণের উৎপত্তি এবং প্রাণ-বিকাশের পরিবেশ তৈরি হয়েছে – তা কীভাবে হয়েছে? ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স তার পুরোটা ব্যাখ্যা করতে পারে না। আমাদের পৃথিবীর খাদ্যভাণ্ডার তৈরি হয় প্রধানত জৈব-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ব্যাকটেরিয়া, গাছপালা ইত্যাদি কীভাবে সূর্যালোক, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, পানি থেকে জৈব-খাদ্য তৈরি করে – তা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে।
পৃথিবীর সবচেয়ে দরকারি এবং জটিল জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়া সালোক সংশ্লেষণ। এর ভেতর মূল কাজ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের। উদ্ভিদের পাতায় যে ক্লোরোফিল আছে তার সাথে সূর্যালোকের বিক্রিয়ার কয়েকটি ধাপ আছে। আমাদের পরিবেশে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প বা পানির কণা ভেসে বেড়াচ্ছে। গাছের পাতার ক্লোরোফিল সূর্যের আলোর সাথে বিক্রিয়া করে অর্থাৎ সূর্যের আলোর ফোটন কণার শক্তি কাজে লাগিয়ে পানি থেকে ইলেকট্রন বের করে নিয়ে আসে। সেই ইলেকট্রন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সাথে যুক্ত হয়। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় কার্বোহাইড্রেড বা গ্লুকোজ। ইলেকট্রনের আদান-প্রদানের ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমতে থাকে এবং অক্সিজেন তৈরি হতে থাকে। উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন ও গ্লুকোজ তৈরির রাসায়নিক সমীকরণ: 6CO2 + 12H2O + ফোটন (সূর্যের আলো) = C6H12O6 + 6O2 + 6H2O. সব সালোকসংশ্লেষণেই যে অক্সিজেন উৎপন্ন হবে এমন কোন কথা নেই। সাধারণত উদ্ভিদ, শৈবাল এবং কিছু ব্যাকটেরিয়া (সায়ানোব্যাকটেরিয়া) সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপন্ন করে। আবার কিছু বেগুনি ও সবুজ ব্যাকটেরিয়া সালোকসংশ্লেষণ ঘটিয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমায় ঠিকই, কিন্তু অক্সিজেন তৈরি করে না। সেখানে পানির বদলে অন্য পদার্থ ব্যবহৃত হয়। সেধরনের সালোকসংশ্লেষণের রাসায়নিক সমীকরণ লেখা যায় এভাবে: CO2 + 2H2A + ফোটন (আলো) = [CH2O] + 2A + 2H2O. এখানে A হলো এমন একটি যৌগ যেটা থেকে ফোটনের বিক্রিয়ায় ইলেকট্রন বের হয়ে আসবে। আলোর ফোটন কী প্রক্রিয়ায় পদার্থ থেকে ইলেকট্রন বের হয়ে আসতে সাহায্য করে সেই ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে হলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ছাড়া চলবে না। বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণ ঘটিয়ে প্রত্যেকটি ধাপ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্যে এই ধাপগুলো ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন ফোটনগুলো শোষিত হবার পর কোষের ভেতর একটি কেন্দ্রে গিয়ে মিলিত হচ্ছে - যাকে রিঅ্যাকশান সেন্টার বলা হয়। এই কেন্দ্রেই সালোক সংশ্লেষণ ঘটে। ফোটনগুলো এই কেন্দ্রে সরাসরি যায় না। একই সাথে অনেকগুলো পথে এই ফোটনগুলো রিঅ্যাকশান সেন্টারে যায় - যা কোয়ান্টাম সুপারপজিশান, অর্থাৎ একই সাথে একাধিক অবস্থায় থাকা।
শীতপ্রধান দেশের যেসব অঞ্চলে খুব বেশি শীত পড়ে সেখান থেকে শীতকালে হাজার হাজার পাখি হাজার হাজার কিলোমিটার পথ উড়ে উড়ে চলে যায় অপেক্ষাকৃত উষ্ণ কোন অঞ্চলে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর নিজের দেশে শীত কমে গিয়ে বসন্ত আসতে শুরু করলে সেই পাখিগুলি আবার একই পথে উড়তে উড়তে নিজের দেশে একই জায়গায় ফিরে আসে। কীভাবে পথ দেখে তারা? তাদের কি কোন জিপিএস আছে? বিজ্ঞানীরা আজ প্রমাণ পেয়েছেন এসব পাখি পৃথিবীর চুম্বকত্ব কাজে লাগিয়ে পথ দেখে। সব পাখির কিন্তু এই ক্ষমতা নেই, শুধুমাত্র পরিযায়ী পাখিদের আছে। এদের চোখের রেটিনায় আলো পড়ে প্রতিটি ফোটন থেকে দুটো ফ্রি রেডিক্যাল তৈরি হয়। এই ফ্রি রেডিক্যালগুলির নিজস্ব কৌণিক ঘূর্ণনবেগ আছে, নিজের অক্ষে একে অপরের সাথে অনুরণনে তারা ঘুরতে থাকে। পৃথিবীর চৌম্বকত্বের প্রভাবে এই ফ্রি রেডিক্যালের ঘূর্ণনবেগ প্রভাবিত হয়। উড়ে চলার সময় পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তনের কারণে পাখির রেটিনার ফ্রি রেডিক্যাল দুটির একটির সাথে অন্যটির রেজোনেন্স পরিবর্তিত হলে তাদের শরীরে প্রতিক্রিয়া হয় এবং এই পরিবর্তন শরীর মনে রাখে। ফিরে যাওয়ার সময়ও একই ধরনের চৌম্বকীয় পরিবর্তন তৈরি করতে করতে তারা ফিরে যায়। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই চৌম্বকীয় ব্যাখ্যা আরো অনেক কীট-পতঙ্গের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়।
আমরা কীভাবে গন্ধ পাই – তার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে হলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স লাগবে। আমাদের ঘ্রাণ-ইন্দ্রীয় বা অলফ্যাক্টরি নার্ভ অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন গন্ধ বুঝতে পারে। কিন্তু কীভাবে কাজ করে এই ঘ্রাণ ইন্দ্রীয়? জীববিজ্ঞানের সাধারণ ব্যাখ্যা হলো গন্ধ উৎপাদনকারী অণুগুলোর আকার ও আকৃতির উপর নির্ভর করে আমরা কী ধরনের গন্ধ পাবো। আমাদের নাকের মধ্যে আছে গন্ধ চেনার সেন্সর বা সংবেদী কোষ যাদের বলা হয় স্মেল রিসেপ্টর। এই কোষগুলোর মধ্যে আছে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির সেন্সর। গন্ধ উৎপাদনকারী অণুগুলোর আকার ও আকৃতি যে সেন্সরের আকার ও আকৃতির সাথে মিলে যাবে সেই গন্ধের সিগনাল চলে যাবে মস্তিষ্কে। তখন মস্তিষ্কের অলফ্যাক্টরি নার্ভ সেই সিগনাল প্রসেস করে আমাদের গন্ধের অনুভূতি দেয়। কিন্তু আমাদের নাকের মধ্যে আছে মাত্র চারশ রকমের স্মেল রিসেপ্টর। অথচ আমরা কয়েক হাজার রকমের গন্ধ পাই। যদি একেক গন্ধের জন্য একেক রকমের রিসেপ্টর নির্দিষ্ট থাকতো তাহলে আমরা চারশ রকমের চেয়ে বেশি গন্ধ পেতাম না কোনভাবেই। অথচ কয়েক লক্ষ রকমের গন্ধ আমরা বুঝতে পারি। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এই গন্ধরহস্য ভেদ করতে পেরেছে। কোয়ান্টাম জীববিজ্ঞান এই গন্ধতত্ত্বের নাম দিয়েছে ভাইব্রেশান থিওরি অব অলফেকশান। গন্ধ উৎপাদনকারী অণুর পারমাণবিক বন্ধন বা অ্যাটমিক বন্ড তরঙ্গের মত কাজ করে। আর আমাদের নাকের সেন্সর এই তরঙ্গের কম্পন শনাক্ত করে। গন্ধের তীব্রতা ও প্রকৃতিভেদে অসংখ্য কম্পাঙ্কের গন্ধ-তরঙ্গ তৈরি হবার সম্ভাবনা থাকে। এই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম অনুযায়ী আমরা অসংখ্য ধরনের গন্ধ পেতে পারি।
আমাদের রোগনির্ণয় ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনেক অত্যাধুনিক যন্ত্র এবং পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে – যাদের মূল বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স। অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তুলনামূলকভাবে বড় আকারের ভাইরাস দেখতে পাওয়া যায় - যেমন গুটিবসন্তের ভাইরাস ভ্যারিওলা। কিন্তু যেসব ভাইরাসের আকার আরো ছোট, অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে সেগুলি দেখা যায় না। সেগুলো দেখার জন্য ব্যবহার করা হয় এক্স-রে। ১৮৯৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানী রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কার করার পর পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি জীববিজ্ঞানেও অনেক নতুন পথ খুলে যায়। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং বোরের পারমাণবিক তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে ১৯১২ সালে পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স ফন লাউ আবিষ্কার করেন যে এক্স-রে'র তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কোন ক্রিস্টালের ভেতরের পরমাণুগুলোর মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্যের সাথে তুলনীয়। অর্থাৎ কোন ক্রিস্টালে এক্স-রে প্রয়োগ করলে সেই এক্স-রে বিচ্ছুরিত হয়। শুরু হলো এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতি। পরের বছর এক্স-রে ডিফ্রাকশান ব্যবহার করে ক্রিস্টালের গঠন বিশ্লেষণ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন অস্ট্রেলিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম হেনরি ব্র্যাগ ও তাঁর ছেলে লরেন্স ব্র্যাগ । এক্স-রের বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে ক্রিস্টালের গঠন বিশ্লেষণ করা যায় যে পদ্ধতিতে সেই পদ্ধতিতে জীববিজ্ঞানের অনেককিছুর গাঠনিক বিশ্লেষণ ও আকার-আকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৩৪ সালে আইরিশ পদার্থবিজ্ঞানী জন বার্নেল এবং তাঁর ছাত্রী ডরোথি হজকিন মলিকিউলার বায়োলজিতে এক্স-রে ডিফ্রাকশান প্রয়োগ করে পেপসিনের গঠন বিশ্লেষণ করেন। বার্নেল ও হজকিনের এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতি স্ট্রাকচারাল বায়োলজি-র বিকাশে বিশাল ভূমিকা রাখে। এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতিতে সরাসরি প্রোটিন বা অন্য কোন জৈব পদার্থের অভ্যন্তরীণ ছবি তোলা হয় না, কিন্তু জৈব পদার্থের আণবিক বিন্যাস থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে আসা এক্স-রে সিগনালগুলোকে একত্রিত করে পুরো বিন্যাসটি পুনর্গঠন করা হয়। কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এক্স-রে ডিফ্রাকশান পদ্ধতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এই পদ্ধতিতে জৈব যৌগ বিশ্লেষণ খুব সহজ হয়ে গেছে।
১৯৩৩ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী আর্নস্ট রুশকা এবং ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ম্যাক্স নল (Max Knoll) ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ উদ্ভাবন করেন। সাধারণ মাইক্রোস্কোপে আলোর মাধ্যমে বিবর্ধন ঘটানো হয়। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে আলোর কণা ফোটনের পরিবর্তে ইলেকট্রন ব্যবহার করা হয়। ইলেকট্রনও আলোর মত কণা এবং তরঙ্গ উভয় ধর্মই প্রদর্শন করে। ইলেকট্রনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের চেয়ে প্রায় এক হাজার গুণ ছোট। তার মানে হলো স্বাভাবিক মাইক্রোস্কোপে যত ছোট বস্তু দেখা সম্ভব, ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে তার চেয়েও এক হাজার গুণ ছোট বস্তু দেখা সম্ভব। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ উদ্ভাবিত হবার পর থেকে জীববিজ্ঞানে অণুজীব, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির গঠন নির্ণয় করা অনেকটাই সহজ হয়ে গেল।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে লেজারের ব্যবহার হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। লেজার উৎপাদনের মূলনীতি হলো পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নীতি। পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রনগুলি নিউক্লিয়াসের চারপাশে নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়মে এগুলি কক্ষপথে বিন্যস্ত থাকে – প্রথম কক্ষপথে ২টি, ২য় কক্ষপথে ৮টি, ৩য় কক্ষপথে ১৮টি ইত্যাদি। ইলেকট্রনের কক্ষপথগুলি হলো তাদের শক্তিস্তর। একটি কক্ষপথে যতগুলি ইলেকট্রন থাকে সবগুলি ইলেকট্রনের শক্তি সমান। নিউক্লিয়াসের সবচেয়ে কাছের যে কক্ষপথ (১ম কক্ষপথ) – সেই কক্ষপথে যেসব ইলেকট্রন থাকে তাদের শক্তি সবচেয়ে কম। এই শক্তিস্তরকে গ্রাউন্ড স্টেট বলা হয়। ইলেকট্রনগুলি যদি কোনভাবে শক্তি শোষণ করে তখন তারা উত্তেজিত হয়ে নিজেদের শক্তিস্তর থেকে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। কিন্তু একটু পরেই সেই অতিরিক্ত শক্তি ত্যাগ করে নিজের শক্তিস্তরে ফিরে আসে। স্বতস্ফূর্তভাবে শক্তি নির্গমনের এই প্রক্রিয়াকে স্পনটেনিয়াস এমিশান (spontaneous emission) বলা হয়। পরমাণুর ইলেকট্রনগুলিকে যদি নির্দিষ্ট শক্তির ফোটনের সাথে মিথস্ক্রিয়া ঘটানো যায়, তাহলে ফোটনের শক্তি শোষণ করে ইলেকট্রনগুলি উত্তেজিত হয়ে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। তারপর যখন নিজের শক্তিস্তরে ফিরে আসে তখন যে শক্তি শোষণ করেছিল তা ফোটনের মাধ্যমে বের করে দেয়। এই নির্গত ফোটনের শক্তি শোষিত ফোটনের শক্তির সমান। ফোটনের প্রবাহ যদি অনবরত চলতে থাকে – তাহলে একটি ফোটন থেকে একই শক্তির ২টি ফোটন, ২টি থেকে ৪টি, ৪টি থেকে ৮টি ফোটন – এভাবে সেকেন্ডের মধ্যে কোটি কোটি ফোটনের প্রবাহ পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি ফোটনের শক্তি সমান এবং প্রত্যেকেই একই সাথে একই দিকে যায়। তীব্র প্রাবল্যের এই ফোটনপ্রবাহই লেজার। চিকিৎসাব্যবস্থায় অনেক রকমের ও শক্তির লেজার ব্যবহার করা হয়। কসমেটিক সার্জারি, ত্বকের চিকিৎসায়, ক্ষতস্থান নিরাময়ে, অসাড় স্নায়ুর উদ্দীপনা জোগাতে, দাঁতের চিকিৎসায়, চোখের চিকিৎসায় – ভিন্ন ভিন্ন রকমের লেজার রশ্মি প্রয়োগ করা হয়। কী ধরনের লেজার প্রয়োগ করা হবে তা নির্ভর করে শরীরের সাথে লেজারের কী ধরনের ইন্টার অ্যাকশান বা মিথস্ক্রিয়া ঘটানো দরকার তার উপর।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা হলো এম আর আই বা ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং। মানুষের শরীরের হাইড্রোজেন পরমাণুকে শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের মাধ্যমে অনুরণন ঘটিয়ে শরীরের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেখান থেকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গণিত দিয়ে শরীরের ভেতরের চিত্র তৈরি করা হয়। এম-আর-আই এক্স-রে’র চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রে। জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ব্যবহার ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে শরীরে ওষুধ প্রয়োগেও কোয়ান্টাম মেকানিক্স ভূমিকা রাখবে।
একটা কথা এখানে মনে রাখা দরকার – কোয়ান্টাম মেকানিক্সের রহস্যময়তার সুবিধা নিয়ে অনেকে কোয়ান্টাম নাম দিয়ে অনেক রকমের অপবিজ্ঞান ও অপচিকিৎসা চালু করেছে। বিজ্ঞান আর অপবিজ্ঞানের পার্থক্য বুঝতে পারাটা অত্যন্ত জরুরি। অপবিজ্ঞান প্রতিহত করাও বিজ্ঞানপ্রেমীদের দায়িত্ব।
তথ্যসূত্র
১। ফিলিপ বল, ন্যাচার, সংখ্যা ৪৭৪, ২০১১।
২। আড্রিয়ানা ম্যারিস প্রমুখ, ইন্টারফেস, সংখ্যা ১৫, ২০১৮।
৩। জনজো ম্যাকফ্যাডেন ও জিম আল-খলিলি, লাইফ অন দি এজ, ক্রাউন পাবলিশার্স, নিউইয়র্ক, ২০১৪।
৪। মাসানারি আসানো প্রমুখ, কোয়ান্টাম অ্যাডপ্টিভিটি ইন বায়োলজি: ফ্রম জেনেটিক্স টু কগনিশান, স্প্রিঙ্গার, ২০১৫।
No comments:
Post a Comment