পরমাণুর নিউক্লিয়াস কে আবিষ্কার করেছেন? প্রোটন কে আবিষ্কার করেছেন? আলফা, বিটা, গামা রেডিয়েশান – কে আবিষ্কার করেছেন? কার হাত ধরে পদার্থবিজ্ঞানের নতুন শাখা - নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের পথ চলা শুরু হয়েছিল সেই বিংশ শতাব্দীর শুরুতে? তেজস্ক্রিয়তার প্রথম এককের নাম কী ছিল? এরকম আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর হলো - রাদারফোর্ড। সর্বকালের সেরা তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মতে সর্বকালের সেরা পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন আর্নেস্ট রাদারফোর্ড।
আশ্চর্য হলেও সত্যি – রাদারফোর্ড হতে চেয়েছিলেন স্কুল-শিক্ষক। নিউজিল্যান্ডের কোন সাধারণ স্কুলে পড়ানোর জন্য তিনবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। সেই রাদারফোর্ড অচিরেই হয়ে উঠেছিলেন এতবড়ো বিজ্ঞানী – যিনি পদার্থবিজ্ঞানী হয়েও ১৯০৮ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন রসায়নে – তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য। পরে আরো দুটো নোবেল পুরষ্কার তিনি পেতে পারতেন – প্রোটন কিংবা নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের জন্য। তাঁর প্রায় দুই ডজন গবেষক-ছাত্র এবং গবেষণা-সহযোগীর মধ্য থেকে পরবর্তীতে এগারোজন নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে। [ফ্রেডেরিক সডি – কেমিস্ট্রি – ১৯২১, নিল্স বোর – ফিজিক্স ১৯২২, জেমস চ্যাডউইক – ফিজিক্স ১৯৩৫, জর্জ ডি হেবেসি – কেমিস্ট্রি ১৯৪৩, অটো হ্যান – কেমিস্ট্রি ১৯৪৪, এডওয়ার্ড অ্যাপ্লেটন – ফিজিক্স ১৯৪৭, প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট – ফিজিক্স ১৯৪৮, সিসিল পাওয়েল – ফিজিক্স ১৯৫০, আর্নেস্ট ওয়াল্টন – ফিজিক্স ১৯৫১, জন কক্ক্রফট – ফিজিক্স ১৯৫১, পিয়ত্র ক্যাপিৎসা – ফিজিক্স ১৯৭৮]
পদার্থবিজ্ঞানের যে শাখার নাম আমরা এখন নিউক্লিয়ার ফিজিক্স হিসেবে জানি – সেই পুরো শাখাটির উৎপত্তি হয়েছে রাদারফোর্ডের নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। পরমাণুর প্রধান উপাদানগুলির আবিষ্কারের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন রাদারফোর্ড। ইলেকট্রনের আবিষ্কারক থমসন ছিলেন রাদারফোর্ডের গবেষণা-শিক্ষক। রাদারফোর্ড আবিষ্কার করেছেন প্রোটন এবং নিউক্লিয়াস, তাঁর ছাত্র চ্যাডউইক আবিষ্কার করেছেন নিউট্রন। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের জনক বলা হয় রাদারফোর্ডকে। আধুনিক বিজ্ঞানের জগতের এই মহানায়ক রাদারফোর্ড ছিলেন একজন চাষীর ছেলে, যার শৈশবের বেশিরভাগ কেটেছে নিউজিল্যান্ডের এক অখ্যাত গ্রামে।
নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডের একটি ছোট্ট শহর নেলসন। এই শহর থেকে বেশ কিছু দূরে ব্রাইটওয়াটার ও স্প্রিং-গ্রোভের মাঝামাঝি একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের জন্ম ১৮৭১ সালের ৩০ আগস্ট। তাঁর বাবা-মা খুব ছোটবেলায় নিউজিল্যান্ডে এসেছিলেন অভিবাসী হয়ে। বাবা জেমস রাদারফোর্ড এসেছিলেন স্কটল্যান্ড থেকে আর মা মার্থা এসেছিলেন ইংল্যান্ড থেকে। মার্থা একটি স্কুলে পড়াতেন, আর জেমস চাষাবাদের পাশাপাশি ঘোড়ার গাড়ির কাঠের চাকা মেরামত করতেন। জেমস-মার্থার বারোটি ছেলেমেয়ের মধ্যে চতুর্থ সন্তান – আর্নেস্ট। আর্নেস্টের বয়স যখন সাড়ে পাঁচ তখন তাদের পরিবার আরো পাঁচ কিলোমিটার দূরে ফক্সহিলে চলে যায়। সেখানে সাধারণ সরকারি স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি বাবা ও বড় ভাইদের সাথে জমিতে চাষাবাদের কাজও করতে হতো আর্নেস্টকে। বড় হয়ে দক্ষ আলুচাষী হবার প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলো আর্নেস্ট তার অন্যান্য ভাইদের সাথে।
স্কুলের লেখাপড়ায় রাদারফোর্ড খুব যে অসাধারণ মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তা নয়। মা-বাবার অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছিল খুবই কম। স্কলারশিপ না পেলে বেশিদূর পড়াশোনা করার সুযোগ ছিল না। তাই স্কুল-কলেজের স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য যতটুকু রেজাল্ট করলে হতো – ঠিক ততটুকুই করতেন রাদারফোর্ড। ছোটবেলায় বিজ্ঞানের প্রতি আলাদা করে কোন আকর্ষণ তৈরি হয়নি। কিন্তু হাইস্কুল এবং কলেজে পড়ার সময় যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে উৎসাহ পেতেন রাদারফোর্ড।
১৮৮৭ সাল থেকে ১৮৮৯ পর্যন্ত নেলসন কলেজে মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনার পর ক্যান্টারবারি কলেজে ভর্তি হন। ক্যান্টারবারি কলেজই অনেক বছর পরে ক্যান্টারবারি ইউনিভার্সিটিতে পরিবর্তিত হয়। রাদারফোর্ডের পরীক্ষণ বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় এখান থেকেই। তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন তিনি এই সময়। বেতারতরঙ্গ প্রেরণ ও গ্রহণ করার একটি কার্যকরী যন্ত্র তৈরি করেন তিনি। ১৮৯২ সালে তিনি বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। বিএ পাস করার পর স্কুলের শিক্ষক হয়ে বিয়েসাদী করে সুখে দিন যাপন করার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। তাঁর প্রেমিকা মেরি নিউটনও এরকম সুখী-গৃহকোণের স্বপ্ন দেখেছিলেন তখন। কিন্তু স্কুলে চাকরি পাননি রাদারফোর্ড। কিন্তু বিএ পরীক্ষার রেজাল্টের ভিত্তিতে এমএ পড়ার জন্য একটা স্কলারশিপ পেলেন রাদারফোর্ড। বিয়ে মুলতবি রেখে ১৮৯৩ সালে এমএ পাস করলেন রাদারফোর্ড।
নিউজিল্যান্ডের এমএ ডিগ্রিতেও একটি স্কুলমাস্টারি জুটছে না। রাদারফোর্ড স্থির করলেন ইওরোপে চলে যাবেন আরো লেখাপড়া করার জন্য। কিন্তু সেই সময় ইওরোপের ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ পেতে হলে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় দরখাস্ত করতে হতো। রাদারফোর্ড তাই এমএ পাস করার পরেও আবার বিএসসি কোর্সে ভর্তি হলেন ১৮৯৪ সালে। এই সময় ক্রাইস্টচার্চ বয়েজ হাইস্কুলের একজন শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়লে রাদারফোর্ড কিছুদিন খন্ডকালীন শিক্ষকতা করার সুযোগ পান। কিন্তু সেই বেতনে ঘরসংসার করা সম্ভব ছিল না। তিনি ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করার জন্য একটি স্কলারশিপের দরখাস্ত করলেন।
ব্রিটিশ সরকার ১৮৫১ সাল থেকে তাদের কলোনিভুক্ত দেশগুলি– ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের জন্য কিছু স্কলারশিপের ব্যবস্থা করেছিল। এসব দেশ থেকে মাত্র একজন বা দু’জনকে বছরে ১৫০ পাউন্ড করে দুই বছর পড়াশোনার জন্য এই স্কলারশিপ দেয়া হতো। ১৮৯৫ সালে নিউজিল্যান্ডের জন্য মাত্র একটি স্কলারশিপ ছিল। রাদারফোর্ড দরখাস্ত করেছিলেন, কিন্তু প্রথমে তিনি স্কলারশিপটি পাননি। অকল্যান্ডের একজন কেমিস্ট জেমস ম্যাকলরিন স্কলারশিপটি পেয়েছিলেন। কিন্তু ম্যাকলরিন তখন একটি চাকরি পেয়ে গেছেন আর সদ্য বিয়ে করেছেন, ইংল্যান্ডে যাবার কোন ইচ্ছে নেই তাঁর। ম্যাকলরিন স্কলারশিপটি প্রত্যাখ্যান করার পর তা রাদারফোর্ডকে দেয়া হয়।
স্কলারশিপ পাবার খবরটি যখন আসে – তখন রাদারফোর্ড আলুক্ষেতে আলু তুলছিলেন। স্কলারশিপের চিঠি পাওয়া প্রসঙ্গে পরে তিনি বলেছেন – “ঐদিনই ছিল আমার জীবনের শেষ আলু তোলা।“
১৮৯৫ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে যোগ দিলেন রাদারফোর্ড। তিনিই ছিলেন ক্যাভেন্ডিস ল্যাবের প্রথম বহিরাগত ছাত্র। এর আগে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই স্নাতক পাস করে স্নাতকোত্তর গবেষণায় ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে ঢোকার সুযোগ পাওয়া যেতো। জোসেফ জন থমসনের (জে জে থমসন) তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করলেন রাদারফোর্ড।
ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে গবেষণা শুরু করার মাসখানেক পরেই ১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাসে জার্মানিতে রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কার করেন। ইওরোপের সব পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানীই তখন এক্স-রে সম্পর্কিত গবেষণায় আগ্রহী হয়ে উঠলেন। ক্যাভেন্ডিস ল্যাবের পরিচালক জে জে থমসন তখন আয়ন সংক্রান্ত গবেষণা করছিলেন। গ্যাসের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ-প্রবাহ চলার সময় এক্স-রে প্রয়োগ করলে কী প্রতিক্রিয়া হয় তা দেখার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠলেন তিনি। পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানী হলেও জে জে থমসন হাতের কাজে খুব বেশি দক্ষ ছিলেন না। তাঁকে সাহায্য করার জন্য একজন দক্ষ সহযোগী দরকার। ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে কাজ শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই সবাই রাদারফোর্ডের কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে গেছেন। রাদারফোর্ড ক্যান্টারবারি কলেজের ল্যাবে বসে তৈরি করেছিলেন বেতারতরঙ্গের ডিটেক্টর। সেই ডিটেক্টর তিনি কেমব্রিজে নিয়ে এসেছেন। সেটা নিয়েই কাজ করছিলেন তিনি। বেতারতরঙ্গ প্রেরণ ও গ্রহণের যন্ত্র নিয়ে সেই সময় ইতালিতে মার্কনি আর ভারতবর্ষে জগদীশচন্দ্র বসু স্বতন্ত্রভাবে কাজ করছিলেন। সেইসময় কোথায় কী গবেষণা হচ্ছে তা সবসময় জানার সুযোগ ছিল না।
থমসন যখন রাদারফোর্ডকে বললেন তাঁর এক্স-রে ও আয়নের গবেষণায় যোগ দিতে – রাদারফোর্ড রাজি হয়ে গেলেন। এক্স-রে আবিষ্কৃত হবার কিছুদিন পরেই ফরাসী পদার্থবিজ্ঞানী হেনরি বেকুয়েরেল তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেছেন। রাদারফোর্ড এক্স-রে ও রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি সংক্রান্ত গবেষণার উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখতে পেলেন।
রাদারফোর্ড ও জে জে থমসনের যৌথ গবেষণার ফসল পেতে দেরি হলো না। ১৮৯৭ সালে আবিষ্কৃত হলো – ইলেকট্রন। এক্স-রে’র ফলে যে আয়নাইজেশান হয় – তাও থমসন ও রাদারফোর্ড প্রথম আবিষ্কার করেন।
তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কৃত হবার পর ফ্রান্সে মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরি তেজস্ক্রিয়তার রাসায়নিক ধর্ম সংক্রান্ত গবেষণা করতে করতে আবিষ্কার করেছেন তেজস্ক্রিয় মৌল রেডিয়াম ও পোলোনিয়াম। রাদারফোর্ড শুরু করলেন তেজস্ক্রিয়তার ভৌত-ধর্ম সংক্রান্ত গবেষণা। ১৮৯৭ সালের মধ্যেই রাদারফোর্ড আবিষ্কার করলেন ইউরেনিয়াম থেকে দুই ধরনের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বের হয়। এক ধরনের বিকিরণ খুব বেশিদূর যেতে পারে না – তিনি কাজের সুবিধার্থে গ্রিক অক্ষর অনুসারে তাদের নাম দিলেন আলফা রেডিয়েশান। আরেক ধরনের বিকিরণ – আলফা বিকিরণের তুলনায় অনেক দূর যেতে পারে (কয়েক সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার পর্যন্ত)। রাদারফোর্ড এই বিকিরণের নাম দিলেন বিটা রেডিয়েশান। আরো কয়েক বছর পরে রাদারফোর্ড আরো এক ধরনের বিকিরণ আবিষ্কার করেন – যার নাম দিলেন গামা রেডিয়েশান।
গবেষণায় এত দ্রুত এতকিছু আবিষ্কার করার পরেও তখনো পর্যন্ত কোন স্থায়ী চাকরি হয়নি রাদারফোর্ডের। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর চাকরি হবার কোন সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না – কারণ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনো পর্যন্ত কোন বহিরাগতকে অধ্যাপনা করার সুযোগ দেয়া হতো না। শুধুমাত্র কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরদেরই নিয়োগ দেয়া হতো সেখানে। অন্য জায়গায় চাকরি খুঁজতে শুরু করলেন রাদারফোর্ড। তাঁর দ্রুত একটি স্থায়ী চাকরি দরকার – কারণ মেরি নিউটনের সাথে তাঁর বিয়েটা ঝুলে আছে অনেকদিন। নিউজিল্যান্ড থেকে মেরি নিয়মিত চিঠি লিখে তাগাদা দিচ্ছেন তাঁকে।
রাদারফোর্ড দরখাস্ত করলেন কানাডার মন্ট্রিয়েলের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে বেশ বড় একটি নতুন ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে উইলিয়াম ম্যাকডোনাল্ড নামের একজন ধনী তামাক-ব্যবসায়ীর টাকায়। সেই ল্যাবে গবেষণা পরিচালনার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে ম্যাকডোনাল্ড প্রফেসর পদ। অনেক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী এই পদের জন্য দরখাস্ত করলেও জে জে থমসনের সুপারিশে পদটি দেয়া হয় ২৭ বছরের তরুণ রাদারফোর্ডকে। ১৮৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে কেমব্রিজ থেকে কানাডায় চলে গেলেন রাদারফোর্ড। পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে তিনি ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টকে উত্তর আমেরিকার সেরা ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে পরিণত করেন। রেডিওঅ্যাক্টিভিটি সংক্রান্ত গবেষণাই হয়ে ওঠে রাদারফোর্ডের প্রধান গবেষণার বিষয়।
দু’বছর পর ১৯০০ সালে অবশেষে রাদারফোর্ডের সময় এবং অর্থনৈতিক সামর্থ্য হয় নিউজিল্যান্ডে গিয়ে মেরিকে বিয়ে করে কানাডায় নিয়ে আসার। আর্নেস্ট ও মেরি রাদারফোর্ডের দাম্পত্যজীবন ছিল বৈচিত্র্যহীন, কিন্তু শান্তিপূর্ণ। রাদারফোর্ডের গবেষণার কিছুই বুঝতেন না মেরি। কিন্তু স্বামীর গর্বে খুবই গর্বিত ছিলেন তিনি। তাঁদের একমাত্র সন্তান এইলিনের জন্ম হয় ১৯০১ সালে।
রাদারফোর্ডের তেজস্ক্রিয়তার গবেষণায় প্রচুর রাসায়নিক কাজকর্ম দরকার। তাঁর গবেষণায় সাহায্য করার জন্য তিনি খুঁজে বের করলেন ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ডেমন্সট্রেটর ফ্রেডেরিক সডিকে। ফ্রেডেরিক সডি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে কানাডায় এসেছেন চাকরি নিয়ে। ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে রাদারফোর্ডের গবেষণা পদার্থবিজ্ঞানের জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আলফা ও বিটা রেডিয়েশানের ফলে তেজস্ক্রিয় মৌলের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। ইউরেনিয়াম মৌল থেকে একটি আলফা কণা বেরিয়ে গেলে ইউরেনিয়াম থোরিয়ামে পরিণত হয়। আবার থোরিয়াম থেকে একটি আলফা কণা বের হয়ে গেলে থোরিয়াম পরিণত হয় রেডিয়ামে। তেজস্ক্রিয়তার ফলে মৌলের এই যে পরিবর্তন – এটা প্রথম আবিষ্কার করেন রাদারফোর্ড। এই আবিষ্কারের জন্য তিনি রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পান ১৯০৮ সালে। রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর রাদারফোর্ড বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর জুনিয়র সহকর্মী ফ্রেডেরিক সডিও রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯২১ সালে।
১৯০৩ সালে রাদারফোর্ড রয়েল সোসাইটির ফেলো মনোনীত হন। ১৯০৪ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির রামফোর্ড মেডেল অর্জন করেন। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয় রাদারফোর্ডের প্রথম বই ‘রেডিওঅ্যাকটিভিটি’। এই বইটি ছিল রেডিওঅ্যাকটিভিটির উপর পৃথিবীর প্রথম টেক্সটবুক। সেই সময় সারাপৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বইয়ের মাধ্যমেই এই বিষয়টির শিক্ষা দেয়া শুরু হয়। পরের বছর এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন রাদারফোর্ড। ১৯০৬ সালে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর দ্বিতীয় বই ‘রেডিওঅ্যাকটিভ ট্রান্সফরমেশান্স’।
কানাডা থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে চাচ্ছিলেন রাদারফোর্ড। ১৯০৭ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন। এখানে তাঁর সহযোগী হিসেবে তিনি পান জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী হ্যান্স গেইগার এবং তাঁর তরুণ ছাত্র আর্নেস্ট মার্সডেনকে। তেজস্ক্রিয়তার গবেষণা অব্যাহত থাকে। হ্যান্স গেইগার এই গবেষণার জন্যই উদ্ভাবন করেন রেডিয়েশান ডিটেক্টর – যা এখন আমরা সবাই জানি গেইগার কাউন্টার হিসেবে।
১৯০৯ সালে আলফা কণার ধর্ম পরীক্ষা করার জন্য রাদারফোর্ড ও মার্সডেন অনেকগুলি ধারাবাহিক পরীক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সেই পরীক্ষায় দেখা গেল ইউরেনিয়াম সল্ট থেকে আলফা কণা নির্গত হয়ে বেশিরভাগই পাতলা সোনার পাতের দিয়ে বাধাহীনভাবে চলে গেল। কিন্তু কিছু কিছু আলফা কণা যেদিক থেকে নির্গত হয়েছে – পাতলা সোনার পাত থেকে সেদিকেই ফিরে এসেছে। এই ঘটনাকে রাদারফোর্ড পরে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে – “মনে হচ্ছিলো একটা পনেরো কেজি ভরের কামানের গোলা একটি টিস্যু পেপারে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছে।“ এই পরীক্ষণের পর ধারাবাহিকভাবে আরো অনেক পরীক্ষা করার পর রাদারফোর্ড এই সিদ্ধান্তে এলেন যে পরমাণুর কেন্দ্রে আছে অত্যন্ত ঘনীভূত ভর – যা পরে নিউক্লিয়াস হিসেবে পরিচিত হয়। পরমাণুতে নিউক্লিয়াসের উপস্থিতির পর ইলেকট্রন ও নিউক্লিয়াসের ভিত্তিতে ১৯১১ সালে পরমাণুর রাদারফোর্ড মডেল প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেখানে ইলেকট্রনগুলি কীভাবে থাকে সে ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা না থাকায় – মডেলটির সংশোধনের দরকার হয়। ১৯১২ সালে নীল্স বোর ম্যাঞ্চেস্টারে এলেন রাদারফোর্ডের সাথে গবেষণা করার জন্য। নীল্স বোর রাদারফোর্ডের সহযোগিতায় আবিষ্কার তাঁর বিখ্যাত ‘বোর মডেল’।
১৯১৩ সালে রাদারফোর্ড প্রকাশ করেন তাঁর তৃতীয় বই ‘রেডিওঅ্যাক্টিভ সাবস্ট্যান্স অ্যান্ড দেয়ার রেডিয়েশান্স’। ১৯১৪ সালে রাদারফোর্ডকে ব্রিটিশ সরকার ‘নাইট’ উপাধি দেন। নাইটহুড অর্জন করার পর তিনি হলেন স্যার রাদারফোর্ড। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত রাদারফোর্ড ব্রিটিশ নেভির উদ্ভাবন ও গবেষণাকেন্দ্রে কাজ করেন।
১৯১৯ সালে জে জে থমসন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের ‘মাস্টার’ নিযুক্ত হলে ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবের পরিচালক পদ থেকে সরে আসেন। তাঁর সুপারিশে সেই পদে যোগ দেন রাদারফোর্ড। আমৃত্যু এই পদেই ছিলেন রাদারফোর্ড। ক্যাভেন্ডিস ল্যাবের দায়িত্ব নিয়ে তিনি তাঁর ছাত্র জেমস চ্যাডউইকের সাথে গবেষণা শুরু করেন। ১৯১৯ সালে প্রোটন আবিষ্কার করেন। তাঁর ও চ্যাডউইকের দীর্ঘ গবেষণার ফসল নিউট্রন। ১৯২৮ সালে নিউট্রন আবিষ্কৃত হয়। এজন্য চ্যাডউইক নোবেল পুরষ্কার পান ১৯৩৫ সালে।
১৯২৫ সালে রাদারফোর্ডকে যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মান ‘অর্ডার অব মেরিট’ দেয়া হয়। ১৯২৫ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত রয়েল সোসাইটির সভাপতি ছিলেন রাদারফোর্ড। ১৯৩৭ সালে রাদারফোর্ডের চতুর্থ বই ‘দি নিউয়ার আলকেমি’ প্রকাশিত হয়। সেই বছরের ১৯ অক্টোবর রাদারফোর্ডের মৃত্যু হয়।
মানুষ হিসেবে খুবই সোজাসাপ্টা ভালোমানুষ ছিলেন রাদারফোর্ড। খুব উচ্চস্বরে কথা বলতেন তিনি। তিনি এত জোরে কথা বলতেন যে অনেক সময় নয়েজ সেন্সেটিভ যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যেতো তার ল্যাবে। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে তিনি কখনোই নাক গলাতেন না। এত এত সম্মাননা পাওয়ার পরেও তাঁর আচরণে কোন পরিবর্তন হয়নি।
তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর সম্মানে রেডিওঅ্যাক্টিভিটির প্রথম একক হিসেবে ‘রাদারফোর্ড’ গৃহীত হয় ১৯৪৬ সালে। প্রতি সেকেন্ডে ১০ লক্ষ কণার বিকিরণের হারকে এক রাদারফোর্ড ধরা হয়। ১৯৫৩ সালে এর চেয়েও বড় আরেকটি একক প্রচলন করা হয় – মেরি কুরির নামে। এক কুরি হলো সেকেন্ডে ৩৭ বিলিয়ন বিকিরণ। ১৯৭৪ সালে প্রচলন করা হয় বিকিরণের আন্তর্জাতিক একক – বেকুয়েরেল। প্রতি সেকেন্ডে একটি বিকিরণ হলো বেকুয়েরেল। ১৯৭৫ সাল থেকে রাদারফোর্ড একক আর ব্যবহার করা হয় না। ১৯৯৭ সালে ১০৪ প্রোটনবিশিষ্ট পরমাণুর নাম রাখা হয় রাদারফোর্ডিয়াম (Rf)।
তথ্যসূত্র
১। ওয়ার্ল্ডস বুক্স বায়োগ্রাফিক্যাল এনসাইক্লোপিড়িয়া অদ সায়েন্টিস্টস, সপ্তম খন্ড, ২০০৩।
২। জন গ্রিবিন, দ্য সায়েন্টিস্ট, র্যান্ডম হাউজ, নিউইয়র্ক ২০০২।
৩। ইওয়ান জেমস, রিমার্কেবল ফিজিসিস্ট, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৪।
৪। রিচার্ড রিভস, এ ফোর্স অব ন্যাচার: দি ফ্রন্টিয়ার জিনিয়াস অব আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, নরটন অ্যান্ড কোম্পানি, ২০০৮।
No comments:
Post a Comment