#স্বপ্নলোকের_চাবি_৫৭
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠটিকে আজ কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছে। এতদিন এটাকে ডানে রেখে মেডিকেল সেন্টারে যাওয়ার সময়, কিংবা বামে রেখে প্রামাণিকস্যারের বাসার দিকে হাঁটার সময় দিগন্তবিস্তৃত বলে মনে হতো। আজ হঠাৎ মাঠভর্তি চেনা-অচেনা হাজার মুখের ভীড়ে, মাইক আর ঢোলের শব্দের হট্টগোলে, রঙবৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মনে হচ্ছে এক অচেনা রঙভেজা মাঠে দাঁড়িয়ে আছি এই সেপ্টেম্বরের বিকেলে। বিদায় বাঁশির সুর বেজে উঠবে একটু পরেই। তারপর এই শিক্ষাঙ্গন থেকে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে অতীত হয়ে যাবো।
শিক্ষাবর্ষের জট না লাগলে ১৯৮৯ সালে অর্থাৎ তিন বছর আগেই আমাদের মাস্টার্স শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু বছরের পর বছর আটকে রইলাম জটলাগা শিক্ষাব্যবস্থার খানাখন্দে। এই ১৯৯২র সেপ্টেম্বরের শেষে ঢাকঢোল পিটিয়ে “র্যাগ-ডে” পালন করলেও পরীক্ষার সবগুলি ধাপ শেষ হয়ে রেজাল্ট হতে হতে আগামী বছরেরও কত মাস লেগে যাবে এখনো জানি না।
আজ সকাল এগারোটায় ইউনিভার্সিটির ট্রেন স্টেশনের সামনের চত্বরে র্যাগ-ডে’র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন স্বয়ং ভাইস-চ্যান্সেলর রফিকুল ইসলাম চৌধুরি। পাস করার পর নীতিনিষ্ঠ হয়ে মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করার একটা বায়বীয় শপথবাক্য পাঠ করানো হলো। ন্যায়নীতিতে যাদের নিষ্ঠা থাকে, তাদের এমনিতেই থাকে – তারজন্য লোকদেখানো শপথবাক্য পাঠ করার দরকার হয় না। রাষ্ট্রের সেবায় জীবন উৎসর্গ করার শপথ নিয়েই যে আকন্ঠ দুর্নীতিতে মজে যায় আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা তা আমরা সবাই জানি। সুতরাং এই ভালো থাকার শপথ একটা লোকদেখানো রুটিন ছাড়া নতুন কোন অর্থ বহন করে না।
এরপর একপ্রকার আনন্দমিছিল করতে করতে ফ্যাকাল্টি ঘুরে খেলার মাঠে এসেছি। রঙের খেলা শুরু হয়ে গেছে মিছিলের মধ্যেই। মাঠে এসে রঙের বালতি নিয়ে ছুটোছুটি চলছে। আগের ব্যাচের সাথে পরের ব্যাচের একটা অদৃশ্য প্রতিযোগিতা থাকেই। ২০তম ব্যাচের র্যাগ-ডে কেমন হয়েছিল, কিংবা আদৌ কিছু হয়েছিল কিনা আমার মনেও নেই। কিন্তু আয়োজকদের একটাই কথা - ২১তম ব্যাচের র্যাগ-ডে হতে হবে স্মরণীয়। কাদের কাছে স্মরণীয়? আসলে আমাদের নিজেদের কাছেই। বিশেষ কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনা না ঘটলে আমরা আজ কী করছি তা আমরা ছাড়া আর কেউ মনে রাখবে না। অন্য ব্যাচরা মনে রাখবে তাদের নিজেদের কথা।
এই র্যাগ-ডে’র ব্যাপারটা এখন ভীষণ একটা হুলুস্থুল ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গেছে। অথচ এটা নাকি প্রথম শুরু হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া ইউনিভার্সিটিতে ১৯২৫ সালে। পাস করে বের হয়ে যাবার আগে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় মিছিল করে চাঁদা তুলে কোন উন্নয়নমূলক কিংবা দাতব্য কাজ করতো সেই সময়। রেইজ অ্যান্ড গিভ থেকে নাকি এসেছে র্যাগ কথাটি।
মাঠের একপাশে একটা বড় মঞ্চে হলভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। মাঠে উপচেপড়া দর্শক দেখে বোঝা যাচ্ছে কীরকম সাংস্কৃতিক দুর্ভিক্ষ চলছে আমাদের ক্যাম্পাসে গত ক’বছর ধরে। নিউ ফার্স্ট ইয়ার থেকে শুরু করে মাস্টার্স এর শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা এখানে এসেছে তারা সবাই সাংস্কৃতিক বুভুক্ষুর মতো গিলছে নাচ-গান-কৌতুক। এর মধ্যেই ইচ্ছেমতো রঙ দিচ্ছে যে যাকে পারে।
এই রঙ ছিটানোর ব্যাপারটা ঠিক কোত্থেকে এসেছে জানি না। শান্তি নিকেতন থেকে কি? স্টেজ থেকে ভেসে আসছে রবীন্দ্রসঙ্গীত – “তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে, অশ্রুজলের করুণ রাগে, রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে।“
উৎকর্ণ হয়ে শুনছি আর দেখছি। কী চমৎকার গলা আর গান নির্বাচন ইন্দ্রাণী মুৎসুদ্দীর। শহর গ্রুপের হয়ে গান গাইতে উঠেছে সে। এই চমৎকার গানের শিল্পীটার সাথে আমার অনাকাঙ্খিতভাবে একটা ঝগড়া লেগে গিয়েছিল ট্রেনের কামরায় প্রায় বছরখানেক আগে। ট্রেনের সিট থেকে সে আমার ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল জানালা দিয়ে। এত সুন্দর গান গায় যে, সে যে কী ভয়ংকর ঝগড়া করতে পারে তা অকল্পনীয়।
একটু পর পর বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘের গর্জন যেন গানের কথার আবহ তৈরি করছে।
“মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে
বিশ্ব-নাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে
তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও যাবার আগে আগিয়ে দিয়ে
কাঁদন-বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে
রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে।“
খারাপ ব্যবহার করেছিল বলে ইন্দ্রাণীর উপর আমার একটা চাপারাগ ছিল। তার গান সেই রাগ রাঙিয়ে দিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে।
হাফিজ সাদা টি-শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরে এসেছে। আমরা বন্ধুরা সবাই তার শার্টে-প্যান্টে অটোগ্রাফ দিয়ে ভরিয়ে ফেলতে শুরু করেছি। তার পশ্চাৎদেশ ইতোমধ্যেই ভরে গেছে গুরুগম্ভীর সব শুভেচ্ছাবাণীতে। শুভেচ্ছাবাণী রাখার কী অভিনব স্থান!
সময় যতই যাচ্ছে ততই ভেতরটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বন্ধুদের সাথে এভাবে হাসি-হুল্লোড়ের দিন আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের অনুজদের মধ্যেও অনেকে এসে কথা বলে যাচ্ছে। রঙ দিয়ে যাচ্ছে।
আজ ব্যান্ড-শো হবার কথা ছিল। কিন্তু বৃষ্টির কারণে সেটা আজ বাতিল হয়ে গেছে। আগামীকাল বিকেলে হবে যদি আবহাওয়া অনুকুল থাকে। বৃষ্টি কিছুটা ধরে এসেছে, কিন্তু রঙবৃষ্টি চলছেই। পিচকিরির বদলে এখন বালতিভর্তি রঙগোলা পানি ঢেলে দেয়া হচ্ছে যে যাকে পারছে।
এরমধ্যেই একজন হঠাৎ ছুটে এসে আমার পেছনে লুকালো। মুঠো করে ধরে ফেলেছে আমার পিঠের কাছটার টি-শার্ট। তাকে রঙ ঢালতে তাড়া করেছিল যে সে আমার সামনে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। অপরিচিত তরুণ মুখ। চোখাচোখি হতেই চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো অন্য কাউকে তাড়া করতে। আমার আশেপাশের বন্ধুরা হঠাৎ আমার দিকে ফিরে ফিরে তাকাতে শুরু করেছে। ঠিক আমার দিকে নয়, আমার পেছনে হঠাৎ আসা আগন্তুকের দিকে। তার ঘননিশ্বাস আমার পিঠে পড়ছে। ঘাড় ফেরাতেই চোখাচোখি। অন্যরকম নতুন লাগছে নতুনকে। কিন্তু পলক ফেলার আগেই কয়েক বালতি রঙ এসে ভিজিয়ে দিলো আমাদের।
শিক্ষাবর্ষের জটে পড়ে এক বছরের লেখাপড়া আমরা যেখানে তিন বছরে শেষ করেছি, সেখানে স্কুল-কলেজে তিন বছরে তিন বছরের পড়া শেষ হয়েছে। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পাস করে নতুন এখন ইতিহাসের ছাত্রী। মনে হচ্ছে কত বছর পরে দেখলাম তাকে। সময় আর পরিবেশ তাকে আরো স্মার্ট করে তুলেছে।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছিলো তার সাথে।
“টি-শার্টে এগুলি কী লিখেছেন?”
“কী?”
“আমি বিষপান করে মরে যাবো?”
“ওটা তো সুনীলের কবিতা। শেষের লাইনটাই দেখলে শুধু? কিন্তু আগের লাইনটার ভার বেশি – যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো।“
“ওসব কবিতা আমি বুঝি না। মৃত্যুর কথা বলা চলবে না।“
আমি অবাক হই। কেমন যেন অচেনা লাগে তাকে। বৃষ্টির তোড় বাড়তে শুরু করেছে। রঙ ধুয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির পানিতে।
“নির্বাসন দেয়া মানে কী?”
“জানি না।“
“আপনি নির্বাসন দেননি কাউকে?”
“না।“
ক্যাম্পাসের রাস্তাগুলি আজ বৃষ্টিভেজা, জনাকীর্ণ। রঙে রঙিন সবাই হাঁটছে, যেন কারো কোন তাড়া নেই।
“বাংলায় এখন কী মাস?”
“আশ্বিন।“
“এই আশ্বিন আমার মনে থাকবে।“
শহীদমিনারের কাছে এসে নতুন তার বন্ধুদের সাথে চলে গেল শামসুন্নাহার হলের দিকে। আজ সে হলে থাকবে।
তৌহিদ মোটরসাইকেল নিয়ে গিয়েছিল। প্রদীপনাথসহ তার পেছনে চেপে বসলাম। প্রদীপনাথকে আলাওলে নামিয়ে দিয়ে তৌহিদ একটানে চলে এলো রাস্তায়। আলাওল হল থেকে আমাকে পিটিয়ে বের করে দেয়ার সময় হুমকি দেয়া হয়েছিল হলে যদি আর কখনো যাই অবস্থা খারাপ হবে। এরপর অনেকদিন যাইনি আলাওলে। পরীক্ষার ফরম ফিল আপ করার সময় গিয়েছিলাম। শিবিরের ছেলেরা দেখেছে আমাকে, কিন্তু কিছু বলেনি। তারা হুমকি দিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না করার জন্য। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে কেউ কি কিছু করতে পারবে?
আজকেও শিবিরের কয়েকজনের সাথে চোখাচোখি হলো। হলের গেটে সারাক্ষণ পাহারা দেয় তারা। কিন্তু তারা এখন ক্যাম্পাসে নিরবে কাজ করছে। ক’দিন আগেই তারা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আক্রমণ করেছে ছাত্রলীগের উপর। কমপক্ষে বিশজন ছাত্র মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। কয়েকজনের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তাদের একজন ছাত্রলীগের মাহবুবুল আলমের মৃত্যু হয়েছে গতকাল। এসব হত্যার বিচার কি কখনোই হবে?
তৌহিদ আমাকে আমানত খান বিল্ডিং-এর সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। পরীক্ষা শেষ হলে এই বিল্ডিং থেকেও চলে যেতে হবে। কেমন যেন উদাস লাগছে, কিন্তু সেসবের এখনো অনেক দেরি আছে।
পরের একমাস দ্রুত কেটে গেলো। অক্টোবরের মাঝামাঝি দুর্গাপূজায় বাড়িতে গেলাম। এক সপ্তাহের জন্য গিয়ে তিন সপ্তাহ কাটিয়ে এলাম।
আমাদের ওদিকে অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে পালিয়ে চলে এসেছে। অনেকদিন থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে। এপর্যন্ত প্রায় লক্ষাধিক শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে টেকনাফের শরণার্থী শিবিরে। কিন্তু সেখানে গত কয়েক মাস থেকে চরম উত্তেজনা চলছে। সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা করে একজন নিরাপত্তা রক্ষীকে হত্যা করেছে। তারপর শিবিরের ভেতর সংঘর্ষ ছড়িয়ে দিয়েছে, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এবং এই সুযোগে দলে দলে শিবির থেকে বের হয়ে লোকালয়ে মিশে গেছে। সেই টেকনাফ কক্সবাজার থেকে ওদের অনেকে এখন চকরিয়া বাঁশখালীসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে দিনে দিনে।
অক্টোবরের শেষ দিনে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে – যার জন্য খুব খুশি লাগছে। পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে – এই বৈজ্ঞানিক সত্য বলার অপরাধে ১৬৩৩ সালে গ্যালিলিও গ্যালিলিকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছিল রোমান ক্যাথলিক চার্চ। গ্যালিলিওকে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছিল বছরের পর বছর। এরপর কেটে গেছে ৩৫৯ বছর। বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে অনেকদূর। এই বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে মহাবিশ্বের অনেক রহস্য এখন বিজ্ঞানীদের হাতের মুঠোয়। পোপদের প্রতি ভক্তি এখনো অনেকের থাকলেও তাদের সেই প্রতাপ আগের মতো নেই। তারাও এখন স্বীকার করে যে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে। তবে গ্যালিলিওর ওপর যে অন্যায় করা হয়েছিল তার কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল সম্প্রতি। ভ্যাটিকানের পোপ দ্বিতীয় জন পল স্বীকার করেছেন যে গ্যালিলিও ঠিক কথাই বলেছিলেন। গ্যালিলিওর উপর অবিচার করা হয়েছে। গ্যালিলিওকে যে শাস্তি দেয়া হয়েছিল সেটা ভুল ছিল। এই ভুল স্বীকার করাটাও খুব একটা সহজে হয়নি। ১৯৭৯ সালে পোপ নির্বাচিত হয়েছেন জন পল। সেবছরই তিনি কমিটি গঠন করেছিলেন গ্যালিলিওর বিচারের পুনতদন্ত করার জন্য। সেই কমিটি তেরো বছর সময় নিলো শুধু বোঝার জন্য যে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে! কমিটিতে কারা কারা ছিলেন কে জানে। তবুও ভালো যে পোপ সেই ঘটনার জন্য গ্যালিলিওর কাছে তথা বিজ্ঞানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। ভুলকে ভুল বলে স্বীকার করার মনোবৃত্তি তো অনেকেরই থাকে না। ধর্মগুরু হলে তো কথাই নেই।
এই খুশিতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স বাদ দিয়ে সারাদিন গ্যালিলিওর জীবননাট্য পড়লাম – বার্টোল্ড ব্রেশ্ট এর লেখা যে নাটকে গ্যালিলিওর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আলী যাকের। দিনশেষে আফসোস হচ্ছে- গ্যালিলিও পরে পড়লেও চলতো। পরীক্ষার বাকি আছে মাত্র সাতদিন।
No comments:
Post a Comment