#স্বপ্নলোকের_চাবি_৬০
“তুই আগে কখনো রাঙ্গামাটি আসিসনি?!!!!”
মানসদার কপালে ভাঁজ, চাউনিতে অবিশ্বাস আর বিরক্তির মিশ্রণ।
“এত ঘরকুনো কেন তুই? সারা বাংলাদেশের মানুষ এসে রাঙ্গামাটি
ঘুরে যায়, আর তুই সারাজীবন চট্টগ্রামে থেকেও রাঙ্গামাটি আসিসনি আগে কখনো!”
তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এখনি থাপ্পড় মেরে দেবে। আমি তার
কাছ থেকে একটু সরে দাঁড়ালাম। মানসদা স্বল্পদৈর্ঘ্য। ব্রিজের উপর থেকে এক পা ডানে সরলেই
আমি তার হাতের নাগালের বাইরে।
পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেলের কাছেই রাঙ্গামাটি হ্রদ। সুন্দর
ঝকঝকে একটি ব্রিজ চলে গেছে স্বচ্ছ নীল পানির মাঝখানে – অনেক দূর। চারপাশে পাহাড়ঘেরা
হ্রদের পানিতে ছোট ছোট ঢেউ। ছোট ছোট কয়েকটা নৌকা আছে ব্রিজের কাছে অস্থায়ী ঘাটে। রিনারা
সাত-আটজন মিলে নৌকা ভাড়া করে হ্রদের পানিতে ঘুরছে। আমরা মানসদার নেতৃত্বে হ্রদের পাড়ে
অনেকক্ষণ হাঁটার পর ব্রিজে উঠে দাঁড়িয়েছি রেলিং ধরে।
যীশু চোখে ক্যামেরা লাগিয়ে পানির দিকে তাকিয়ে আছে অনেকক্ষণ।
কিসের ছবি তুলছে জানি না। রিল আছে মাত্র একটি। সব মিলিয়ে ছত্রিশটির বেশি ছবি তোলা যাবে
না। একটু আগেই সে বলেছে পঁচিশটি হয়ে গেছে। পঁচিশটির মধ্যে আমাদের যদি দুটো ছবিও থাকে
– খুশি হয়ে যেতে হবে। ফ্রেমে রাখী কিংবা লিপি না থাকলে সে ছবিই তুলতে চায় না। এখন সম্ভবত
সে জুম করে রাখীদের নৌকার ছবি তুলছে।
চারপাশটা এত সুন্দর! হ্রদটাকে কানায় কানায় ভরা জোয়ারের নদী
বলে মনে হচ্ছে। এতদিন কেন আসিনি এখানে? আগে কোনদিন আসিনি শুনেই মানসদা ক্ষেপে গেছে।
মানস চক্রবর্তীর ছোটবেলা কেটেছে রাঙ্গামাটিতে। কখন কীভাবে তারা এখানে এসেছিল জানি না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে এখন বাঙালি বসতি। অথচ এই অঞ্চলের পুরোটাই ছিল আদিবাসিদের
আদিভূমি।
পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ রাঙ্গামাটি। চট্টগ্রাম থেকে
রাঙ্গামাটির দূরত্ব মাত্র ৭২ কিলোমিটার। অথচ আগে একবারও আসিনি এখানে! থিওরি পরীক্ষার
পর হঠাৎ করে রাঙ্গামাটি আসার সিদ্ধান্ত না হলে কখন আসতাম বা আদৌ আসতাম কি না জানি না।
রাঙ্গামাটি যাবার সিদ্ধান্তটা হঠাৎ করে হয়ে গিয়েছিল। থিওরি
পরীক্ষা শেষ হবার পর প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার ডেট দিয়েছে জানুয়ারির ত্রিশ তারিখ থেকে।
সহপাঠীদের মধ্যে হারুন, মইনুল, দিলীপ, রিনা, প্রেমাঙ্কর, যীশু, অঞ্জন, আনন্দ আর আমি
– এই নয়জন থিসিস করছি। আকতার আর দেলোয়ার হোসেন দুলাল থিসিস শুরু করেছিল। কিন্তু শেষ
মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদল করে প্র্যাকটিক্যাল গ্রুপে চলে যায়। প্র্যাকটিক্যাল গ্রুপের
পরীক্ষাও আগে শেষ হয়, রেজাল্টও আগে হয়ে যায়। এমনিতেই আমাদের তিন বছরেরও বেশি সময় নষ্ট
হয়ে গেছে সেশনজটে। এখন যত আগে পাস করে বের হওয়া যায় ততই ভালো। চাকরি খোঁজার সংগ্রামে
যোগ দিতে হবে তো।
একদিনের রাঙ্গামাটি সফরের আইডিয়াটি কার মাথা থেকে বের হয়েছিল
জানি না। কিন্তু আমাদের করিৎকর্মা সংগঠকরা দ্রুতই ব্যবস্থা করে ফেললো। মাস্টার্স পরীক্ষা
দিয়ে ফেলার পরেও স্যার-ম্যাডামদের খবরদারি সহ্য করার কোন মানে হয় না। তাই স্যার-ম্যাডামদের
কিছু জানানো হলো না।
ক্যাম্পাস থেকে রওনা হতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। রাঙ্গামাটি
এসে পৌঁছেছি সোয়া দুইটার দিকে। প্যাকেট বিরিয়ানি সাথে এসেছে। পর্যটনের মোটেলের সামনে
বাস থেকে নেমেই প্রথম কাজ হলো খাওয়া।
পিকনিকের সিজন। এখানে ওখানে সবখানে বাস, মাইকে হিন্দি গান
বাজছে উচ্চস্বরে। খাবারের ফেলে দেয়া প্যাকেটে রাস্তাঘাট ভরে উঠেছে। আমরা ঘাসের উপর
যেখানে বসে খেলাম, সেই জায়গাটা মিনিট দশেকের মধ্যেই নোংরা করে ফেললাম। উচ্ছিষ্ট হাড়,
বেচে যাওয়া ভাত, প্যাকেট, প্লাস্টিক সবকিছু যেখানে খুশি ছুঁড়ে ফেলতে আমাদের জুড়ি নেই।
তারপর যতটুকু পারা যায় আশেপাশে ঘুরে দেখা। হ্রদটাই সবচেয়ে
সুন্দর। এখানে ব্রিজের উপর থেকে অনেকদূর দেখা যায়। জানুয়ারির আকাশ ঝকঝকে নীল। সেই নীলের
প্রতিফলনে হ্রদের পানিও নীল হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই টলটলে পানিতে টলমল করে ভাসছে আমাদের
কৃতকর্ম - প্লাস্টিকের ঠোঙা, খাবারের প্যাকেট, চিপ্সের আবরণ, সিগারেটের ফিল্টার, ছাইপাস
আরো কত কী।
হ্রদের পাড়ে বেশিক্ষণ থাকার উপায় নেই। সূর্যাস্তের আগেই রাঙ্গামাটির
মিলিটারির চেক-পয়েন্ট অতিক্রম করে যেতে হবে। শান্তিবাহিনীর আক্রমণ ঘটে মাঝে মাঝে। সশস্ত্র
সামরিক বাহিনী মোতায়েন আছে এখানে অনেক বছর থেকে। শীতকালীন সূর্য বেশিক্ষণ থাকে না আকাশে।
বাসে উঠে রাঙ্গামাটি শহরের কাছাকাছি আরেকটি পাহাড়ি নিসর্গে কিছুক্ষণ বসলাম। সহপাঠীদের
সাথে এটাই আমাদের শেষ পিকনিক। এভাবে সবার সাথে একসাথে আর কোনদিন হয়তো দেখা হবে না।
জীবন আমাদের কাকে কোথায় নিয়ে যাবে জানি না। কারো কারো সাথে হয়তো এটাই শেষ দেখা। ভাবলেই
কেমন যেন হতাশ লাগে।
“গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে” গানে রবীন্দ্রনাথ
যে রাঙা মাটির কথা লিখেছেন সেটা নিশ্চয় এই রাঙ্গামাটি নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাঙ্গামাটি
এসেছিলেন কি না সে ব্যাপারে কোথাও কিছু লেখা নেই। তবে রাঙ্গামাটি আসার পথে বাসের মধ্যে,
এখানে আসার পর সারাক্ষণ এই গানটিই কিলবিল করছে মাথার মধ্যে। মাথা থেকে নেমে উচ্চস্বরে
মুখ দিয়ে বের হচ্ছে। “ওরে কার পানে মন হাত বাড়ি-এ-এ-এ-এ-এ-এ” করতে শুরু করার সাথে সাথে
রাখীর রামধমক – “অ্যাই গাধা চুপ কর্।“
গাধা চুপ করলো। কিন্তু গাধার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কেউ একজন বললো,
“ইউ সিং ওয়েল।” উত্তরে আমার কিছু একটা বলা উচিত বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু মুখ হা হয়ে
ফ্রিজ হয়ে গেছে। পোশাকে স্বদেশী, বাক্যে বিদেশী এই অপরূপা বালিকাকে তো আমি আগে কখনো
দেখেছি বলে মনে হয় না। এই বালিকা কে, আমাদের দলে কীভাবে ঢুকে পড়লো তাও তো জানি না।
সে আমাকে বলেছে “ইউ সিং ওয়েল।“ অর্থাৎ আমি ভালো গেয়েছি! ইচ্ছে করছে রাখীকে ডেকে বলি
এই মেয়ে কী বলছে।
আমি হা করে আছি দেখে মেয়েটি হয়তো বুঝতে পেরেছে আমার অবস্থা।
সে হড়বড় করে ইংরেজিতে আরো অনেককিছু বললো। সম্ভবত নামও বললো। কিন্তু আমি ঠিকমতো বুঝতে
পারলাম না। প্রদীপ নাথ বললো মেয়েটি আমাদের সিলেটি বন্ধুদের কারো আত্মীয়। ইংল্যান্ডে
থাকে। দেশে বেড়াতে এসে ইউনিভার্সিটিতে এসেছে। সেখান থেকে এখানে।
অনেক ভেবেচিন্তে মনে মনে বাক্য গঠন করে জিজ্ঞেস করলাম, “ডু
ইউ নো এনিথিং অ্যাবাউট মিউজিক?”
“ইয়েস। দ্যাট ওয়াজ টেগোর্স।“
এরপর তার আশেপাশে আমরা যারা ছিলাম সবাই হঠাৎ ইংরেজিতে কথা
বলতে শুরু করলাম। “আই নো সাম সাম ইংলিশ।“ – টাইপের ইংরেজি।
ফেরার পথে বাসের মধ্যে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে কয়েকবার তার দিকে
তাকাতেই আমার ঠিক পেছনের সারিতে বসা রিনা বললো, “এত কষ্ট করছিস কেন? তার পাশে গিয়ে
বসলেই তো পারিস।“
ইচ্ছে ছিল, কিন্তু চক্ষুলজ্জায় পারছিলাম না।
রাঙ্গামাটির বাস বেপরোয়া গতির জন্য বিখ্যাত। পাহাড়ী আঁকাবাঁকা
পথে এত বড় বাস যেভাবে গতি না কমিয়েই ছুটে যাচ্ছে, চিকন রাস্তায় অন্যদিক থেকে আসা বাসের
সাথে এক সুতার ব্যবধান রেখে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়াচ্ছে – তাতে পেছন ফিরে ইংরেজীভাষিনীকে
দেখার কথা কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুলে যেতে হলো।
কিন্তু মিনিট দশেক পরে বাসের পেছন দিক থেকে উচ্চস্বরে “বাস
থামাও, বাস থামাও” চিৎকার চেঁচামেচিতে পেছনে তাকাতে হলো। বিদেশিনী সমানে বমি করছে।
বিরিয়ানি সহ্য করার মতো সহ্যশক্তি তার পাকস্থলীর নেই।
পাহাড়ি বাজারে বাস থামিয়ে ডাক্তারখানার খোঁজ করা হলো। এখানে
কোন ডাক্তার নেই। ছোট্ট একটা ফার্মাসি পাওয়া গেল। ফার্মাসি ছোট হলেও ওষুধ পাওয়া গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রোগী ঘুমিয়ে পড়লো। হাফিজ
ফিসফিস করে বললো – “যেই স্লিপিং পিল দিছে, হলে গিয়ে ঘুম ভাঙলে হয়।“
হলে যাবার পরেও নাকি তার ঘুম ভাঙেনি, ভেঙেছে পরদিন দুপুরে।
ক্যাম্পাসে এসেছিল এর পরের দিন। সেমিনার লাইব্রেরিতে বসেছিল। আমি গিয়ে পরিচিতের ভঙ্গিতে
‘হাই’ বলেছিলাম। আশা করেছিলাম চিনতে পারবে। পারেনি।
জানুয়ারির ত্রিশ তারিখ থেকে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শুরু
হয়েছে। আমাদের জেনারেল ভাইভাও সেদিন থেকে শুরু হবার কথা ছিল। কিন্তু এক্সটার্নাল আসেননি
বলে ভাইভা পিছিয়ে ফেব্রুয়ারির দশ তারিখে চলে গেছে।
ইতোমধ্যে আরো একটা নতুন ব্যাচ ভর্তি হয়েছে। তাদের ক্লাসও
শুরু হয়ে গেছে। আমাদের পরের ব্যাচ আমাদেরকে বিদায় দেয়ার আয়োজন করেছে। ফেব্রুয়ারির নয়
তারিখে আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় দেয়া হলো। ভিসিস্যার প্রধান অতিথি হিসেবে এলেন।
কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের প্রবীণ অধ্যাপক শামসুদ্দিনস্যার গত ৩৯ বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে
শিক্ষকতা করছেন। তিনিও অতিথি হয়ে এসেছেন। বিদায়ী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আবুল কালাম
আকন্দ, হারুন আর আমি বক্তৃতা দিলাম। আবুল কালাম আকন্দ শিবিরের নেতা। সে খুব গুছিয়ে
রাজনৈতিক বক্তৃতা দিতে পারে। হারুন বললো বিদায় কত কষ্টের ইত্যাদি। আমি বললাম সম্পূর্ণ
উল্টো কথা। বললাম তিন বছর আগেই আমাদের এখান থেকে চলে যাবার কথা ছিল। পরিস্থিতির কারণে
আমাদের তিনটা বছর নষ্ট হয়েছে। এর জন্য আমরাও দায়ী। আমরা অনেক সময় দাবি করি অনেককিছু
না বুঝেই। যেমন আমাদের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে যত বই আছে – তা আমরা ধরেও দেখি না। অথচ
বলতে থাকি – আমাদের পর্যাপ্ত বই নেই। এরকম আরো কী কী বলেছিলাম তাৎক্ষণিকভাবে। ভিসিস্যারকে
আরেকটি মিটিং-এ যেতে হবে বলে – আমার বক্তব্যের পর পরই তিনি বক্তৃতা দিতে এলেন। তিনি
আমার বক্তব্যের এত প্রশংসা করলেন যে আমি ফুলে ফেঁপে প্রায় উড়ে যাচ্ছিলাম। ভিসিস্যার
যেহেতু প্রশংসা করেছেন, সেহেতু বাকিরাও ভালো ভালো অনেককিছু বললেন। আমি মনে মনে বেশ
আত্মপ্রসাদ লাভ করলাম।
কিন্তু কয়েকদিন পর বুঝতে পারলাম আমি আসলে কী। আয়োজকরা অনুষ্ঠানের
নির্বাচিত কিছু ছবি বাঁধাই করে সেমিনার লাইব্রেরিতে রেখেছে স্মারক হিসেবে। সেই স্মারকের
কোথাও আমার ছবি কিংবা নাম কিছুই নেই। অথচ হারুন, আবুল কালাম আকন্দসহ অন্য সবার নামনিশানা
ঠিকঠাকমতোই আছে। আমাকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে এখন থেকেই!