পৃথিবীর বাইরে গিয়ে পৃথিবীকে দেখার ধারণাটা প্রথম দিয়েছিলেন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস সেই ২৪০০ বছর আগে। তখনো খালিচোখে আকাশের চন্দ্র-সূর্য দেখে প্রকৃতিকে বুঝতে চেষ্টা করেছে মানুষ। তখনো মানুষের চিন্তাভাবনায় মহাবিশ্বের মূলকেন্দ্র ছিল পৃথিবী। পরবর্তী দুই হাজার বছর ধরে অনেক দার্শনিক-গবেষণা হয়েছে মহাবিশ্ব সম্পর্কে। কিন্তু সেইসব ধারণার সুনির্দিষ্ট প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে বছরের পর বছর।
পৃথিবী থেকে আকাশ দেখার দৃশ্যপট দ্রুত পালটে গেলো যখন গ্যালিলিও আকাশের দিকে তাক করলেন প্রথম টেলিস্কোপ। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও তাঁর নিজের তৈরি টেলিস্কোপ দিয়ে বৃহস্পতি গ্রহের চারপাশে ঘূর্ণনরত চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করলেন। বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদগুলোর গতিপথ দেখার পর গ্যালিলিওর মনে হলো এই উপগ্রহগুলো যেন তাদের মনিব-গ্রহের আদেশে একটি কক্ষপথে থেকে চাকরের মতো ঘুরছে মনিবের চারপাশে। ল্যাটিন ভাষায় তিনি উপগ্রহগুলোর নাম দিলেন 'satelles' (স্যাটেলিস) - যার অর্থ হলো servant বা চাকর। satelles থেকে ইংরেজিতে স্যাটেলাইট (satellite) কথাটি এসেছে। মানুষ যে কৃত্রিমভাবে স্যাটেলাইট তৈরি করে আকাশে পাঠিয়ে দিতে পারে সেরকম কোন কল্পনাও তখন কেউ করেনি। কিন্তু গ্যালিলি-যুগের পরবর্তী তিন শ বছরের মধ্যেই মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে শত শত কৃত্রিম স্যাটেলাইট – মানুষেরই কাজে।
গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের পর আরো অনেক শক্তিশালী টেলিস্কোপ তৈরি করা হয়েছে। পৃথিবী থেকেই সেসব টেলিস্কোপ মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করছে দিনরাত। কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কারণে মহাকাশ থেকে আলো আসার সময় অনেক ধরনের মিথস্ক্রিয়া ঘটে। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে অনেক আলো শোষিত হয়, ধুলাবালিতে আলো বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ফলে মহাকাশের মহাজাগতিক ঘটনাগুলি নির্বিঘ্নে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। শত শত আলোকবর্ষ দূরের উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ভেদ করে আসার সময় উজ্জ্বলতা হারায়। বায়ুমন্ডলের কারণেই তারাগুলি মিটমিট করে। ফলে অনেক কিছুই ধরা পড়ে না শক্তিশালী টেলিস্কোপেও। পৃথিবীর টেলিস্কোপগুলিকে বিভিন্ন পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপন করেও অনেক সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়নি। তাই বিশাল আকৃতির এক টেলিস্কোপকে স্যাটেলাইট হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে পৃথিবীর বাইরে। পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে মহাবিশ্বকে দেখার প্রথম শক্তিশালী এবং প্রচন্ড সফল এই টেলিস্কোপের নাম হাবল স্পেস টেলিস্কোপ।
মহাকাশে টেলিস্কোপ স্থাপনের ধারণা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩ সালে জার্মানির বিজ্ঞানী হারমান ওবের্থ-এর “দ্য রকেট ইনটু প্ল্যানেটারি স্পেস’ বইতে। তখনো কিন্তু কোন ধরনের মহাকাশযান তৈরি হয়নি। তাই ওবের্থ-এর ধারণাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি কেউ সেই সময়। এরপর ১৯৪৬ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লাইম্যান স্পিৎজার-এর “অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল আডভান্টেজেজ অব অ্যান এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল অবজারভেটরি” প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে ওবের্থ-এর ধারণা আবার সামনে চলে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে শীতল-যুদ্ধ শুরু হলে মহাকাশ গবেষণায় দ্রুত উন্নতি ঘটে। ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক মহাকাশে পাঠালে আমেরিকা দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়। ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আমেরিকান মহাকাশ প্রশাসন প্রতিষ্ঠান - নাসা।
১৯৬০ সালে প্রফেসর স্পিৎজার এবং আমেরিকার আরো অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী নাসা এবং আমেরিকান কংগ্রেসের কাছে আবেদন করেন মহাকাশে টেলিস্কোপ পাঠানোর “লার্জ অরবিটাল টেলিস্কোপ” প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেয়ার জন্য। ১৯৬৯ সালে এই প্রকল্প অনুমোদন লাভ করে। তবে সেই সময় মানুষ প্রথমবার চাঁদে অবতরণ করার পর নাসার প্রকল্পে বাজেট ঘাটতি দেখা দেয়। অনেক বড় প্রকল্প বাজেটের অভাবে ছোট করতে হয়। লার্জ স্পেস টেলিস্কোপের প্রাথমিক নকশায় মূল দর্পণের ব্যাস ছিল ১২০ ইঞ্চি। টাকার অভাবে পুরো নকশা বদলে আরো ছোট আকারের টেলিস্কোপের পরিকল্পনা করতে হয়। এবার মূল দর্পণের ব্যাস দাঁড়ালো ৯৪ ইঞ্চিতে। ১৯৭৭ সালে আমেরিকান কংগ্রেস লার্জ স্পেস টেলিস্কোপ প্রকল্প অনুমোদন করে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের বাজেট কিছু বাড়ানোর জন্য নাসা ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সাথে একটি চুক্তি করে। লার্জ স্পেস টেলিস্কোপের শতকরা ১৫ ভাগ খরচ ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি দেবে, কিন্তু তার বিনিময়ে টেলিস্কোপের শতকরা ১৫ ভাগ পর্যবেক্ষণ সময় তারা ব্যবহার করবে। অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার মধ্যে সাড়ে তিন ঘন্টা সময় থাকবে ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির জন্য সংরক্ষিত।
১৯৭৯ সালের মধ্যে স্পেস টেলিস্কোপের নকশা চূড়ান্ত হয় এবং নির্মাণ-কাজ শুরু হয়। বিশটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইওরোপিয়ান মহাকাশ সংস্থা এই নির্মাণ-কাজের সাথে যুক্ত। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল ১৯৮৩ সালের মধ্যে টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানোর। কিন্তু কাজ শুরু করার পর দেখা গেলো খরচ আর সময় কোনটাতেই কুলোচ্ছে না। ১৯৮৩ সালের মধ্যে কিছুতেই এই টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানো সম্ভব নয়। এসময় এই টেলিস্কোপের নাম লার্জ স্পেস টেলিস্কোপের বদলে রাখা হলো আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন হাবল-এর নামে ‘হাবল স্পেস টেলিস্কোপ’। ঠিক করা হয় ১৯৮৬ সালে মহাকাশে পাঠানো হবে এই টেলিস্কোপ।
১৯৮৬ সালের ২৮ জানুয়ারি স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জার দুর্ঘটনায় সাতজন নভোচারীর সবাই মর্মান্তিকভাবে নিহত হলে নাসার সব মহাকাশ প্রকল্প কয়েক বছরের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। সব প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও হাবল টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানো যায়নি তখন। অবশেষে ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল মহাকাশে পাঠানো হয় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। পরেরদিন ২৫ এপ্রিল তা কক্ষপথে পৌঁছে যায়।
স্পেস শাটল ডিসকভারি তার প্রকোষ্ঠে ভরে টেলিস্কোপটিকে পৃথিবী থেকে মহাকাশে নিয়ে গিয়ে লো-আর্থ অরবিটে রেখে আসে। পৃথিবীর ভূমি থেকে ১৫০ কিলোমিটার থেকে শুরু করে ১২০০ কিলোমিটারের মধ্যে উচ্চতায় লো-আর্থ অরবিট। হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫৪৭ কিলোমিটার উচ্চতায় ঘন্টায় প্রায় ২৭ হাজার কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। কক্ষপথে একবার ঘুরে আসতে তার সময় লাগে প্রায় ৯৫ মিনিট।
হাবল স্পেস টেলিস্কোপ একটি বিশাল আকৃতির স্যাটেলাইট। এর মূল দেহের আকৃতি ৪.৩ মিটার ব্যাসের ১৩ মিটার লম্বা একটি চোঙার মতো। মহাকাশে পাঠানোর সময় এর ভর ছিল ১০,৮০০ কিলোগ্রাম। শেষবার সার্ভিসের পর বর্তমানে এর বর্তমান ভর দাঁড়িয়েছে ১২,২০০ কিলোগ্রামে। এই টেলিস্কোপকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন যন্ত্রপাতিগুলিকে আলাদা আলাদাভাবে মেরামত করা যায় বা দরকার হলে বদলে দেয়া যায়। পৃথিবী থেকে মহাকাশচারী পাঠিয়ে এই টেলিস্কোপ মেরামত করা যায়। সেজন্য টেলিস্কোপের বাইরের খোলে বিভিন্ন জায়গায় হাতল দেয়া হয়েছে – যেন মহাকাশচারীরা সেই হাতল ধরে মহাকাশে ভাসতে ভাসতে প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারেন।
এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে সোলার প্যানেলের সাহায্যে। ৭.১ মিটার দীর্ঘ এবং ২.৬ মিটার চওড়া দুটো সোলার প্যানেল আছে এই টেলিস্কোপের দুই পাশে। প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করতে পারে এই প্যানেলদুটি। ছয়টি নিকেল-হাইড্রোজেন ব্যাটারিতে এই শক্তি সংরক্ষণ করে। এই শক্তি প্রায় ২২টি গাড়ির ব্যাটারির সঞ্চিত শক্তির সমান।
এই টেলিস্কোপটি একটি রিফ্লেকটিং টেলিস্কোপ বা প্রতিফলক দুরবিন। আলোর প্রতিফলনের জন্য দুটি আয়না আছে এই টেলিস্কোপে – প্রাইমারি মিরর বা মুখ্যদর্পণ এবং সেকেন্ডারি মিরর বা গৌণদর্পণ। মুখ্যদর্পণের ব্যাস ৯৪ ইঞ্চি বা ২.৪ মিটার এবং ভর ৮২৮ কিলোগ্রাম। গৌণদর্পণের ব্যাস মাত্র ১২ ইঞ্চি, এবং ভর ১২.৪ কিলোগ্রাম। যে কাচ দিয়ে এই আয়নাদুটো বানানো হয়েছে, সেই কাচ প্রচন্ড বা গরমেও একটুও সংকুচিত বা প্রসারিত হয় না। কাচের উপর প্রতিফলক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ম্যাগনেসিয়াম ফ্লোরাইডের উপর অ্যালুমিনিয়ামের আস্তরণ।
মহাকাশ থেকে আগত আলো টেলিস্কোপের চোঙার মধ্যে ঢুকে মুখ্যদর্পণে প্রতিফলিত হয়ে গৌণদর্পণে পড়ে। গৌণদর্পণ থেকে আবার প্রতিফলিত হয়ে মুখ্যদর্পণের মাঝামাঝি সূক্ষ্ণছিদ্রের ভেতর দিয়ে মূল টেলিস্কোপের নলে প্রবেশ করে। সেখানেই প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। টেলিস্কোপে সৃষ্ট ফোকাস পয়েন্ট – যেখানে প্রতিবিম্ব তৈরি হয় – সেখান থেকে তা টেলিস্কোপে লাগানো বিভিন্ন ক্যামেরা এবং বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ভেতর চলে যায়।
হাবল টেলিস্কোপের প্রধান পাঁচটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি হলো – ওয়াইড-ফিল্ড অ্যান্ড প্ল্যানেটারি ক্যামেরা (WF/PC), ফেইন্ট অবজেক্ট ক্যামেরা (FOC), হাইস্পিড ফটোমিটার (HSP), গডার্ড হাই-রেজ্যুলেশন স্পেকট্রোগ্রাফ (GHRS), এবং ফেইন্ট অবজেক্ট স্পেকট্রোগ্রাফ (FOS)।
১৯৯০ সালে যে যন্ত্রপাতিগুলি পাঠানো হয়েছিল পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে টেলিস্কোপ সার্ভিসিং-এর সময় সেই যন্ত্রপাতিগুলি বদলে আরো উন্নতমানের যন্ত্র প্রতিস্থাপন করা হয়েছে বিগত তিরিশ বছরে। এপর্যন্ত মোট পাঁচবার পৃথিবী থেকে নভোচারীরা হাবল টেলিস্কোপে গিয়ে যন্ত্রপাতি বদলে দিয়ে এসেছে। প্রথম সার্ভিস মিশন গিয়েছিল ডিসেম্বর ১৯৯৩, দ্বিতীয় সার্ভিস মিশন ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, তৃতীয় সার্ভিস মিশনের প্রথম ধাপ ডিসেম্বর ১৯৯৯, তৃতীয় সার্ভিস মিশনের দ্বিতীয় ধাপ ফেব্রুয়ারি ২০০২, চতুর্থ এবং শেষ সার্ভিস মিশন মে ২০০৯।
হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় WF/PC। দুইটি ক্যামেরার সমন্বয়ে WF/PC। ওয়াইড ফিল্ড ক্যামেরা বিস্তীর্ণ আকাশের বিশাল এলাকা ধারণ করে, আর প্ল্যানেটারি ক্যামেরা সেই ছবির রেজ্যুলেশন বাড়ায় এবং ছবিকে বিবর্ধিত করে। ১৯৯০ সালে টেলিস্কোপ কাজ শুরু করার পর বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে মুখ্যদর্পণে সামান্য ত্রুটি রয়ে গেছে, ফলে ছবি ঝাপসা আসছে। ১৯৯৩ সালে প্রথম সার্ভিসের সময় WF/PC প্রতিস্থাপন করে এই ত্রুটি দূর করা হয়। ২০০৯ সালে শেষবার সার্ভিসিং এর সময় আরো উন্নত-প্রযুক্তির WF/PC প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
মহাকাশে অনুজ্জ্বল বস্তুর ছবি তোলে ফেইন্ট অবজেক্ট ক্যামেরা। এই কাজ করার জন্য ইমেজ ইন্টেন্সিফায়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ২০০২ সালে সার্ভিসিং-এর সময় আরো উন্নতমানের সার্ভে ক্যামেরা লাগানো হয়েছে টেলিস্কোপের সাথে।
হাইস্পিড ফটোমিটারের কাজ হলো উচ্চশক্তির উৎস থেকে উৎপন্ন আলোর পরিবর্তন শনাক্ত করা। শুরুতে এটা ঠিকমতো কাজ করছিলো না। ১৯৯৩ সালে প্রথমবার সার্ভিসিং-এর সময় এটা বদলে একটা নতুন প্রযুক্তির COSTAR (corrective optics space telescope axial replacement) স্থাপন করা হয়।
মহাকাশ গবেষণায় আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণের গুরুত্ব অপরিসীম। লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূর থেকে আগত আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে জানা যায় আলোর উৎসের গতিপথ। আলোর তরঙ্গের দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে আমাদের বর্ণালী ভাগ করা হয়েছে। লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি, নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম। যদি আগত আলোর স্বাভাবিক বর্ণালীরেখা নীল রেখার দিকে সরতে থাকে (ব্লু-শিফ্ট) – তাহলে বুঝতে হবে বস্তুটি আমাদের দিকে আসছে, আর যদি লাল রেখার দিকে সরতে থাকে (রেড শিফ্ট) তাহলে বুঝতে হবে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাকাশের আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করার জন্য হাবল টেলিস্কোপে আছে দুইটি স্পেকট্রোগ্রাফ - গডার্ড হাই-রেজ্যুলেশন স্পেকট্রোগ্রাফ (GHRS), এবং ফেইন্ট অবজেক্ট স্পেকট্রোগ্রাফ (FOS)। দুটোই চমৎকারভাবে কাজ করেছে ১৯৯৭ পর্যন্ত। ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয় সার্ভিসিং-এর সময় এগুলি বদলে স্পেস টেলিস্কোপ ইমেজিং স্পেকট্রোগ্রাফ (STIS) হয়েছে। এই স্পেকট্রোগ্রাফ অতিবেগুনি থেকে অবলোহিত তরঙ্গ পর্যন্ত সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোই বিশ্লেষণ করতে পারে।
লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূর থেকে ছবি তোলার জন্য হাবলকে খুবই স্থির থাকতে হয়। অনেকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বোঝাতে বলে থাকেন একচুলও না হেলার কথা। হাবল একটি চুলকে এক কিলোমিটার দূর থেকে দেখলে যত ছোট দেখা যাবে – সেটুকুও না হেলে ছবি তুলতে পারে। এই কাজটি করার জন্য হাবলে আছে অত্যন্ত সংবেদী সেন্সর – ফাইন গাইডেন্স সেন্সরস (FGS)। তিনটি সেন্সর হাবল টেলিস্কোপকে কোন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির রাখতে পারে দীর্ঘ সময়।
টেলিস্কোপের যন্ত্রপাতির সাথে লাগানো আছে অনেকগুলি কম্পিউটার এবং মাইক্রোপ্রসেসর। দুটি প্রধান কম্পিউটারের একটি যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করে, অন্যটি পুরো স্যাটেলাইটকে নিয়ন্ত্রণ করে।
হাবল টেলিস্কোপের মূল নিয়ন্ত্রণ আছে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের হাতে। হাবল টেলিস্কোপের প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষ নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে। আমেরিকার পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট গডার্ডের নাম অনুসারে এই সেন্টার এবং হাবল টেলিস্কোপের স্পেকট্রোগ্রাফের নামকরণও করা হয়েছে। এখান থেকে বিজ্ঞানীরা প্রয়োজনীয় কমান্ড পাঠান। সেই কমান্ড যায় ট্রেকিং অ্যান্ড ডাটা রিলে স্যাটেলাইটে। সেখান থেকে কমান্ড যায় হাবল টেলিস্কোপে লাগানো হাই-গেইন অ্যান্টেনার সাহায্যে হাবলের কম্পিউটারে। এখন টেলিস্কোপ থেকে ছবি এবং তথ্য পৃথিবীতে পাঠানো হয় হাবলের অ্যান্টেনার সাহায্যে ট্রেকিং অ্যান্ড ডাটা রিলে স্যাটেলাইটে। স্যাটেলাইট থেকে চলে আসে পৃথিবীতে। প্রতি সপ্তাহে হাবল প্রায় ১৫০ গিগাবিট ডাটা পৃথিবীতে পাঠায়।
অন্যান্য স্যাটেলাইটের মতোই পনেরো বছর কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে পাঠানো হয়েছিল হাবল টেলিস্কোপ। কিন্তু এটা নির্বিঘ্নে কাজ করে যাচ্ছে গত একত্রিশ বছর ধরে। সার্ভিসিং এবং যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের কারণে এই টেলিস্কোপ দিনের পর পর দিন আরো শক্তিশালী হয়েছে।
হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যেই আমরা জেনেছি মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমরা প্রমাণ পেয়েছি মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে কমপক্ষে ১৩৮০ কোটি বছর আগে। হাবলের সাহায্যে প্রমাণ পেয়েছি ব্ল্যাকহোলের। হাবল আমাদের খুঁজে দিয়েছে অনেকগুলি নতুন গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা। হাবল টেলিস্কোপ জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় দিয়েছে আশ্চর্য গতি। এপর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে হাবলের সাহায্যে প্রাপ্ত উপাত্তের ভিত্তিতে।
মহাকাশে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ পাঠানো হচ্ছে। এই নতুন টেলিস্কোপ হাবল টেলিস্কোপের বিকল্প নয়, প্রতিদ্বন্দ্বীও নয়। হাবল টেলিস্কোপ যেভাবে কাজ করছে সেভাবেই কাজ করতে থাকবে আরো অনেক বছর।
তথ্যসূত্র:
রবিন কেরড ও ক্যারোল স্টট - ‘হাবল দি মিরর অন দি ইউনিভার্স’ (২০০৮), প্রদীপ দেব – ‘সবার জন্য স্যাটেলাইট’ (২০১৯), nasa.gov, ডেভিড সায়লার ও ডেভিড হারল্যান্ড – ‘দি হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ফ্রম কনসেপ্ট টু সাকসেস’ (২০১৬)।
No comments:
Post a Comment