#স্বপ্নলোকের_চাবি_৫৯
তিরানব্বই সাল শুরু হতে না হতেই দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে সবকিছু।
বিরানব্বইয়ের শেষের দিনগুলি দেশজুড়ে কেমন যেন অস্থিরতা। ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়ায়
বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর অত্যাচার চলছে বিভিন্নভাবে। আমার শেষ থিওরি পরীক্ষা ছিল ডিসেম্বরের
১২ তারিখ। কিন্তু ছয় তারিখ রাত থেকে দেশজুড়ে যেসব তান্ডবের খবর পাচ্ছিলাম রেডিওর খবরে
তাতে মনের ভেতর প্রচন্ড আতঙ্ক দানা বেঁধেছে। খুব দরকার না হলে যীশু কিংবা আমি কেউই
রুম থেকে বের হচ্ছি না। বাথরুমে যাবার সময় কিংবা খাবার-দাবার কিনতে দোকানে যাবার সময়
করিডোরে কিংবা রাস্তায় পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে মনে হচ্ছে তারা এমনভাবে আমাদের দিকে
তাকাচ্ছে যেন বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য আমরাও দায়ী। এটা আমার মনের ভুলও হতে পারে, কিংবা
ভয়ের কারণেও হতে পারে।
ভয়ের পাশাপাশি এক ধরনের গ্লানিও লাগছে। যুক্তিহীন অনুশাসনে
আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু আমার অবিশ্বাস দিয়ে তো আমার জন্মগত ধর্মপরিচয় মুছে ফেলা যাবে
না। মুষ্টিমেয় কিছু ধর্মান্ধ মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে সারাপৃথিবীতেই ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক
উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য ধর্মের নামে হানাহানি করে। এধরনের হানাহানি সরাসরি যারা করে
তাদের সংখ্যা সংখ্যার বিচারে এত কম, অথচ তাদের জোর এত বেশি যে রাষ্ট্রও তাদের রুখতে
পারে না? আসলে রাষ্ট্রের কর্ণধাররা আন্তরিকভাবে চান না এসব হানাহানি বন্ধ হোক। নিজেদের
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য ধর্মীয় হানাহানি উস্কে দেয়ার মতো মোক্ষম অস্ত্র
আর হয় না। এসব ব্যাপার সবাই জানে, জেনেও চুপ করে থাকে। কারণ চুপ করে থাকলে আরামে বেঁচে
থাকার সম্ভাবনা কিছুটা বাড়ে এই দেশে।
আমরাও চুপচাপ ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে এলাম। পরীক্ষার
আগেরদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি দোকানপাটে আক্রমণ করা হয়। সীতাকুন্ডে
হিন্দুপাড়ায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় কয়েকশ ঘরবাড়ি। সরকার এসব এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি
করে রেখেছে নয় তারিখ থেকে। কিন্তু কোন ধারাতেই কোন কাজ হচ্ছে না। যীশু লেপের নিচে রেডিও
নিয়ে বিবিসির খবর শুনে আর আতঙ্কে কাঁপতে থাকে। এধরনের আতঙ্ক সংক্রামক, আমার মধ্যেও
সংক্রান্ত হয়। সলিড স্টেট ফিজিক্সের পড়া মাথায় ওঠে।
এতকিছুর পরেও পরীক্ষা দিতে পেরে অনেক হালকা লাগে নিজেকে।
পরীক্ষা দিয়ে মেসে এসেই যীশু ঝটপট ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। এবার একেবারেই চলে যাচ্ছে
বাসায়। আমার বাড়ি যাওয়া দরকার। আমি জানি না গ্রামের কী অবস্থা হয়েছে এই অস্থির সময়ে।
পরদিন সকালে রওনা দিয়ে দুপুর নাগাদ বাড়ি পৌঁছলাম। পঞ্চাশ
কিলোমিটার রাস্তা যেতে প্রায় চার ঘন্টা লেগে যায়। পরীক্ষার জন্য অনেকদিন বাড়ি আসা হয়নি।
আমার বাবা আবেগপ্রবণ মানুষ। কিন্তু এবারের আবেগ মনে হলো আগের চেয়ে বেশি। দুর্যোগের
সময় সন্তান ঘরের বাইরে থাকলে মা-বাবার মনের অবস্থা যে কী হয় তা মা-বাবাই জানেন।
আমাদের গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা আছে। হিন্দুপাড়া
আর মুসলমানপাড়া পাশাপাশি শান্তিতে বাস করে আসছে দীর্ঘদিন। এখানে হিন্দু-মুসলমান সবাই
সবাইকে আত্মীয়ের সম্বোধনেই ডাকে। বাস থেকে নেমে মাত্র বিশ-ত্রিশ মিটার পথ হেঁটে বাড়িতে
ঢোকার মধ্যেই অন্তত দশজন চাচা-জ্যাঠা জিজ্ঞেস করে, “ভাই-পুত ক্যান আছস? অ-বাজি এন্গরি
ফুয়াই কেয়া গেইয়স?” তাদের কথায় যে আন্তরিক আদর প্রকাশ পায় তাতে মন ভরে যায়। দেশের এই
অস্থির পরিস্থিতিতেও আমাদের গ্রামে কোন সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প জমে উঠতে পারেনি – মানুষে
মানুষে হৃদ্যতার কারণে। অবশ্য সবাই যে অসাম্প্রদায়িক তা বলা যাবে না। তা হলে তো মুক্তিযুদ্ধের
সময়টাতে আমাদের ঘরবাড়ি পোড়ানো হতো না, গ্রামে কোন রাজাকার থাকতো না।
বাবার সাথে আমার সম্পর্ক বন্ধুর মতো। পিতা-পুত্রের সম্পর্ক
কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে একটা সংস্কৃত শ্লোক তিনি প্রায়ই বলেন, “লালয়েৎ পঞ্চবর্ষানি,
দশবর্ষানি তাড়য়েৎ। প্রাপ্তে তু ষোড়শবর্ষানি পুত্রং মিত্রবৎ-আচরয়েৎ।“ পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত
কোন ধরনের শাসন ছাড়া পিতা পুত্রকে লালন করবে। তারপর দশ বছর পর্যন্ত আদরে-শাসনে রাখবে।
যেই ষোল বছর হবে পিতা-পুত্র বন্ধু হয়ে যাবে। বাবা এই নিয়ম শুধু উচ্চারণ করেন না, মেনেও
চলেন। দুপুরে খাওয়ার পর পিতা-পুত্র পাশাপাশি শুয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলি। আমার দাদা-দিদির
ক্ষেত্রে বাবা ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত গিয়ে দেখে এসেছেন তারা কী করছে, কীভাবে করছে। আমার
ক্ষেত্রে বাবা আমার উচ্চমাধ্যমিকের পর আর মাথা ঘামাননি। সেটা তিনি ইচ্ছে করে করেছেন,
নাকি শরীরে কুলোচ্ছে না বলে করেছেন তা জিজ্ঞেস করিনি।
ব্যক্তিগত কথাবার্তা শেষ হবার পর দেশের সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক
আক্রমণের কথা উঠলো। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়েছে। তখন দলে দলে হিন্দুরা
চলে গেছে ভারতে। আমার বাবা তখন ছাব্বিশ বছরের যুবক। কেন তিনি সেসময় ভারতে চলে যাননি?
এরপর মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তখনো মাটি কামড়ে এখানেই পড়ে
রইলেন। পচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর থেকে সাম্প্রদায়িক শক্তি রাষ্ট্রের ক্ষমতায়।
এত বৈরিতার মধ্যেও একবারও দেশত্যাগের কথা কেন তাঁর মনে হয়নি – খুব জানতে ইচ্ছে করলো।
এর আগেও হয়তো এ ব্যাপারে কথা হয়েছে, কিন্তু এভাবে সরাসরি হয়নি।
বাবা আমার সব কেনোর উত্তর দিলেন মাত্র দুই লাইনের দুটো প্রশ্নে।
“এটা আমার জন্মভূমি। এর খারাপ অবস্থা হয়েছে দেখেই একে ত্যাগ করে চলে যাবো? আমার অবস্থা
খারাপ হলে, তোদের ঠিকমতো দেখাশোনা না করতে পারলে তোরা কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবি? অন্য
কাউকে বাবা বলে ডাকবি?”
আমার বাবার লেখাপড়া ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। দেশের রাজনীতি অর্থনীতি
সমাজনীতি বাজেট – কোনকিছু নিয়েই তিনি ভাবেন বলে মনে হয়নি কখনো। জীবনযুদ্ধে যতবার পরাজিত
হয়েছেন, ততোবারই উঠে দাঁড়িয়েছেন। একবারও তাঁর দুরাবস্থার জন্য দেশকে দায়ী করেননি। এই
মানুষটা নিজের জন্মভূমিকে নিজের মা-বাবার মতোই ভালোবাসেন। আমার কেমন একটা গর্বের অনুভূতি
হতে থাকে।
তিরানব্বই সাল শুরু হতেই বাড়ী থেকে চলে আসতে হলো। প্র্যাকটিক্যাল
গ্রুপের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শুরু হবে। তাদের পরীক্ষার সময়েই আমাদের জেনারেল ভাইভা
হয়ে যাবে। থিসিসের কাজও পুরোপুরি শুরু করতে হবে। কিন্তু শহরে এসেই খবর পেলাম শহরের
এক প্রান্তে তুলকালাম ঘটনা ঘটছে। হালিশহরে নৌবাহিনীর সদস্যদের সাথে স্থানীয়দের ব্যাপক
সংঘর্ষ ঘটেছে। দশ জন মানুষ মারা গেছেন গুলিতে, পাঁচশ’র বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। নির্বিচারে
আগুন লাগানো হয়েছে ঘরবাড়িতে। প্রাণভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে মানুষ। নিজের দেশের
মানুষের উপর নিজের দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা অত্যাচার করছে! পরপর তিন-চারদিন ধরে
হামলা চলছে। কী হচ্ছে এখানে?
উচ্চপর্যায়ের সামরিক হস্তক্ষেপের পর পরিস্থিতি কিছুটা সামাল
দেয়া হলো নৌবাহিনীর চার জন অফিসার ও পনেরো জন নাবিককে বরখাস্ত করার মাধ্যমে। কিন্তু
এতো ভয়ানক ঘটনা কীভাবে ঘটাতে পারলো অস্ত্রধারী সৈনিকেরা?
এর মধ্যেই জানুয়ারির দশ তারিখে সিলেটে যা ঘটলো তার বিবরণ
পত্রিকায় পড়ে বুঝতে পারছিলাম না আমরা বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে আছি, নাকি হাজার বছর আগের
কোন অন্ধযুগে আছি। ছাতকছরা গ্রামের বাইশ বছর বয়সী তরুণী গৃহবধু নুরজাহানকে গ্রাম্য
মাতব্বরদের নির্দেশে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনা হয়েছে নিজের ঘর থেকে। বেশ কিছুদিন আগে
নুরজাহানকে তার স্বামী তালাক দেয়। নুরজাহান সম্প্রতি আবার বিয়ে করেছে তাদেরই গ্রামের
মোতালেবকে। এই বিয়ে ধর্মীয় মতে সাক্ষী রেখে কলমা পড়েই হয়েছে। কিন্তু এখন গ্রামের মৌলানা
মান্নানের নেতৃত্বে মোল্লারা বলতে শুরু করেছে নুরজাহানের তালাক নাকি ঠিকমতো তালাক ছিল
না। তাই তার বর্তমান বিয়ে অবৈধ। বিয়ে যেহেতু অবৈধ, সেহেতু মোতালেবের সাথে নুরজাহান
ঘর করছে – এটাও অবৈধ। মৌলানা মান্নান ফতোয়া দিলেন – নুরজাহান ও মোতালেবকে গলাপর্যন্ত
মাটিতে পুঁতে ফেলে পাথর নিক্ষেপ করা হোক। আর নুরজাহানের আব্বা যেহেতু মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন
– সেহেতু নুরজাহানের আব্বাকে পঞ্চাশ ঘা দোর্রা মারা হোক। এধরনের শাস্তি কার্যকর করতে
উৎসাহী মানুষের অভাব হয় না। আর এরকম শাস্তির মজা দেখার জন্য রয়েছে পুরো গ্রাম। নুরজাহানকে
টেনে-হেঁচড়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসে শাস্তি কার্যকর করা হলো গ্রামের সব মানুষের সামনে।
পাথর মারা হলো, দোর্রা মারা হলো। সবকিছু হলো ধর্মের নামে। কেউ কিছু বললো না। ধর্মের
নামে মানুষ খুন করলে যেখানে কেউ কিছু বলে না, সেখানে এ-তো সামান্য পাথর আর দোর্রা।
পাথরের আঘাতে নুরজাহানের মৃত্যু হয়নি। কিন্তু নুরজাহানের আত্মসম্মান অনেক বেশি। এর
অপমান সইবার শক্তি তার ছিল না। সে ঘটনার পর অপমানে গলায় দড়ি দেয়।
ধর্মের নামে এসব যারা করে তাদের কি থামাবার মতো কেউ নেই কোথাও?
নাকি সবাই – ধর্ম বড় স্পর্শকাতর বিষয় বলে এড়িয়ে যায়? আসলে ধর্ম কি এতই লজ্জাবতী লতা
যে একটু যুক্তির স্পর্শেই কাতর হয়ে যাবে? জানি না। দোতলায় উঠে তৌহিদভাইয়ের খোঁজ করলাম।
তিনি ফতেয়াবাদ গার্লস স্কুলের ধর্মশিক্ষক। তিনি যদি ব্যাখ্যা করতে পারেন। তাঁকে পেয়ে
গেলাম ছাদে। স্কুল থেকে এসে গোসল করে ছাদে কাপড় মেলছেন। নুরজাহানের ব্যাপারটা জিজ্ঞেস
করতেই দেখলাম তিনি হঠাৎ ক্ষুধার্ত হয়ে উঠলেন। সেই মুহূর্তেই ভাত খেতে না পারলে তিনি
মুর্ছা যাবেন এরকম ভাব করে দ্রুত নেমে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে।
No comments:
Post a Comment