ইংরেজি ভাষায়
যে ক’জন ভারতীয় লেখক উপন্যাস লিখে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন – চেতন ভগত তাঁদের অন্যতম। শুধুমাত্র
অন্যতম বললে কম বলা হবে, চেতন ভগতের লেখা সবগুলি উপন্যাস খুবই পাঠকপ্রিয় হয়েছে। কোন্
বই কতটা ভালো লেগেছে পাঠকের – তা বিচারের প্রধান মাপকাঠি হলো সেই বইয়ের কত কপি বিক্রি
হয়েছে। চেতন ভগতের প্রতিটি বই বিক্রি হয় দশ লক্ষ কপিরও বেশি। সে তো গেলো মূল ইংরেজিতে।
অন্যান্য ভাষাতেও তাঁর বইয়ের বৈধ-অবৈধ অনেক অনুবাদ হচ্ছে। বৈধ অনুবাদ হচ্ছে মূল লেখক
এবং/অথবা মূল প্রকাশকের অনুমোদিত অনুবাদ, আর অবৈধ অনুবাদ হচ্ছে – যে অনুবাদের কথা লেখক/প্রকাশক
জানেনও না।
চেতন ভগতের
লেখা কেন এত মানুষের ভালো লাগছে? তাঁর লেখার সাহিত্যমূল্য কোন স্তরের? এই প্রশ্নের
উত্তর দেয়া সহজ নয়। কারণ গল্প-উপন্যাসের মান বিচার করার ব্যাপারটা বস্তুনিষ্ঠ নয়। একেকজনের
ভালো লাগার কারণ একেক রকম। নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিকের লেখাও যে সবার ভালো
লাগবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
আর কে নারায়ণের
প্রত্যেকটি উপন্যাস কালোত্তীর্ণ, কিন্তু সেভাবে জনপ্রিয় নয়। জনপ্রিয় হবার উপাদান চেতন
ভগত খুব ভালো করেই জানেন কীভাবে পাঠকপ্রিয় হওয়া যায়। তাঁর লেখার ভাষা, ঘটনার বর্ণনা,
সংলাপ পড়ার সময় মনে হয় বই নয়, সিনেমা পড়ছি। সিনেমার বিজ্ঞাপনের মতো করেই তিনি তাঁর
বই প্রকাশের আগে বইয়ের বিজ্ঞাপন প্রচার করেন।
চেতন ভগতের
সবগুলি বই থেকেই সিনেমা তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। তিনি নিজেও সিনেমার চিত্রনাট্য লেখেন।
তাঁর প্রথম বই Five Point Someone অবলম্বনে আমির খানের বিখ্যাত সিনেমা Three
Idiots তৈরি হলেও সেই সিনেমাতে চেতন ভগতকে সেভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। তারপর থেকে তিনি
অনেক বেশি সতর্ক। নিজে সরাসরি যুক্ত থাকেন চিত্রনাট্য তৈরিতে।
তার উপন্যাসগুলির
লক্ষ্য থাকে ইংরেজিপড়ুয়া তরুণ উচ্চমধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পাঠকদের মন জয় করা। আধুনিক
প্রেম, যৌনতা, এবং ভারতীয় তরুণরা যেসব সমস্যার
সামনে প্রায় প্রতিদিন পড়ে – সেগুলিকেই তুলে আনেন কাহিনি-বিন্যাসে, বর্ণনায় এবং সংলাপে।
তাঁর সাম্প্রতিক
বইগুলি সরাসরি থ্রিলার। The girl in room 105, One arranged murder, এবং 400
days - রোমাঞ্চকর থ্রিলার গোত্রের। কেশব আর
সৌরভ – দুই বন্ধু – গোয়েন্দা। অপেশাদার গোয়েন্দা। এদেরকে দিয়েই জটিল রহস্যের সমাধান
করিয়ে নিচ্ছেন চেতন ভগত। কেশবের জবানীতেই ঘটনা এগোয়।
400 days এর
কাহিনি আবর্তিত হয়েছে একটি বারো বছরের মেয়ের অপহরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। দাদাবাড়ির
নিরাপদ বাড়ি থেকে রাতের বেলা উধাও হয়ে যায় আলিয়া-মনীশ দম্পতির বারো বছর বয়সী কন্যা
সিয়া। রাতের বেলা নিজের ছোট বোন সুহানা আর চাচাতো ভাইদের সাথে এক রুমে ঘুমিয়েছিল সিয়া।
কিন্তু সকালে দেখা গেলো সিয়া উধাও। কেউ জানে না সে কোথায়। কেবল সুহানা বললো রাতে কেউ
একজন এসে ছুরি দেখিয়ে সিয়াকে নিয়ে গেছে। সুহানার বয়স মাত্র পাঁচ। সে ঘুমের ঘোরে কী
দেখেছে ঠিকমতো বলতেও পারে না। আলিয়া-মনীশ অত্যন্ত ধনী ব্যবসায়ী। টাকা-পয়সা প্রভাব-প্রতিপত্তির
অভাব নেই। কিন্তু পুলিশ-গোয়েন্দা কেউই কিছু করতে পারলো না। ধরে নেয়া হয় যে সিয়াকে মেরে
ফেলা হয়েছে। সবাই হাল ছেড়ে দিলেও সিয়ার মা আলিয়া হাল ছেড়ে দেয় না। আলিয়া মেয়ের খোঁজ
করার জন্য কেশব আর সৌরভের সাহায্য চায়। মূলত কেশবেরই সাহায্য চায়। কেশব সৌরভকেও কাজে
লাগায়।
প্রচলিত গোয়েন্দা-কাহিনীর
চেয়ে চেতন ভগতের স্টাইল কিছুটা ভিন্ন। এখানে আলিয়া ও মনীশের প্রেম-কাহিনীর বিশদ বিবরণ
আছে। আবার কেশব আর আলিয়াও পরস্পর প্রেমে পড়ে যায়। এই প্রেম ভারতীয় রক্ষণশীল টাইপের
প্রেম নয়। উদ্দাম ইওরোপিয়ান স্টাইলের প্রেম – যেখানে মনের সাথে, অনেকটা মনের আগেও শরীর
এগোয়। শরীরের ব্যাপারে কোন ধরনের জড়তা দেখা যায় না চেতন ভগতের নায়ক-নায়িকাদের। সে রক্ষণশীল
মধ্যবিত্ত সতেরো বছরের মেয়ে আলিয়া হোক – কিংবা ত্রিশ বছরের গৃহবধূ আলিয়া হোক।
তবে এখানেও
আছে প্রচলিত পদ্ধতি – কেউই সন্দেহের উর্ধ্বে নয়, আবার শেষপর্যন্ত দেখা যায় – যার দিকে
সন্দেহের তীর কম ছোড়া হয়েছে সে-ই দোষী। তবে ভারতীয় পুলিশকে যেরকম অদক্ষ প্রমাণ করা
হয়েছে – জানি না এত বাস্তব সমস্যার সমাধান তারা কীভাবে করেন।
চেতন ভগতের
লেখা পাঠককে টেনে রাখে এটাই সবচেয়ে বড় গুণ তাঁর লেখার। আর কোন নতুন কারণ খুঁজে পাচ্ছি
না। 400 Days স্বতন্ত্র কিছু নয়, রহস্যও আহামরি রকমের কোন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নয়। কিন্তু
তাঁর ভাষা চমৎকার। অহেতুক বর্ণনার বাহুল্য নেই। সেন্স অব হিউমার অসাধারণ।
কিন্তু গল্পের
বিচার করলে বলতে হয় - আজকাল ভালো গোয়েন্দা গল্পের অভাব দেখা দিয়েছে, নাকি গোয়েন্দাগল্প
বেশি পড়ার কুফল বুঝতে পারছি না।
No comments:
Post a Comment