Sunday, 31 July 2022

নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর

 



মহাবিশ্বের মহাজাগতিক কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করার জন্য অনেকগুলি শক্তিশালী টেলিস্কোপ মহাকাশে স্থাপন করা হয়েছে। কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে ছুটে আসা মহাজাগতিক তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ শনাক্ত এবং বিশ্লেষণ করে মহাজাগতিক ঘটনার প্রমাণ সংগ্রহ করার জন্য মহাকাশেই স্থাপন করা হয়েছে ‘অবজারভেটরি’ বা মানমন্দির। এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবজারভেটরি যা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক লক্ষ চল্লিশ হাজার কিলোমিটার দূরে মহাকাশে ভেসে ভেসে মহাজাগতিক ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করছে তার নাম ‘চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি’। যাঁর নাম অনুসারে এই অবজারভেটরির নাম রাখা হয়েছে তিনি আমাদের উপমহাদেশের সন্তান জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর - বিজ্ঞানী মহলে যিনি ‘চন্দ্র’ নামে পরিচিত। 

১৯৯৮ সালে নাসা তাদের নতুন এক্স-রে অবজারভেটরির জন্য নাম আহ্বান করে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানশিক্ষার্থী ও বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে। প্রায় ছয় হাজার মানুষ চিঠি লিখে নাম পাঠান। এর মধ্যে বেশির ভাগই বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখরের নাম প্রস্তাব করেন। ১৯৯৮ সালের ২১ ডিসেম্বর নাসার সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করা হয় এক্স-রে অবজারভেটরির নাম রাখা হবে ‘চন্দ্র’। অবজারভেটরি সেন্টারের পরিচালক হার্ভি ট্যানানবাম বলেন, “বিশ্বব্রহ্মান্ডকে বোঝার জন্য সারাজীবন নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন চন্দ্রশেখর।“ ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনোমার জেনারেল মার্টিন রিজের মতে - আইনস্টাইনের পর চন্দ্রই একমাত্র ব্যক্তি যিনি মহাবিশ্ব নিয়ে এত দীর্ঘসময় ধরে এবং এত গভীরভাবে ভেবেছেন। পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসনের মতে চন্দ্রশেখর মহাবিশ্বকে বুঝেছিলেন আইনস্টাইনের চেয়েও সঠিকভাবে, কারণ আইনস্টাইন ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব স্বীকার করেননি, আর চন্দ্রশেখর ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন।  জ্যোতির্বিজ্ঞানের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৮৩ সালে। নক্ষত্রের ভরের সীমা সংক্রান্ত যে গবেষণার জন্য তিনি নোবেল পুরষ্কার পান সেই গবেষণার সূত্রপাত হয়েছিল এই উপমহাদেশে ১৯২৯ সালে - চন্দ্রশেখরের বয়স তখন মাত্র উনিশ বছর।

চন্দ্রশেখর নিজের জন্মতারিখ বলতেন ‘নাইন্টিন টেন নাইন্টিন টেন’ অর্থাৎ উনিশ দশ উনিশ শ’ দশ। ১৯১০ সালের ১৯ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের লাহোরে (বর্তমানে পাকিস্তান) জন্ম চন্দ্রশেখরের। চন্দ্রশেখরের বাবা সুব্রাহ্মনিয়ান ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের ফাইন্যান্সিয়াল সিভিল সার্ভিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। কাকা ভেঙ্কটরামনও (নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী সি ভি রামন) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার আগপর্যন্ত ফাইন্যান্সিয়াল সিভিল সার্ভিসে কাজ করতেন। ১৯১০ সালে চন্দ্রশেখরের জন্মের সময় সুব্রাহ্মনিয়ান নর্থ ওয়েস্টার্ন রেলওয়ের ডেপুটি অডিটর-জেনারেল হিসেবে লাহোরে কর্মরত ছিলেন। বদলির চাকরির কারণে কয়েক বছর পর পর তাঁদের বাসস্থান বদলে যেতো। ফলে চন্দ্রশেখরের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় বাড়িতেই। এগারো বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতে বাবা ও প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়াশোনা করেছে চন্দ্রশেখর। ইচ্ছেমত গণিত ও ইংরেজির পাঠ নিয়েছে। চন্দ্রশেখরের ১২ বছর বয়সের সময় তাঁর বাবা মাদ্রাজে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। চৌদ্দ বছরে স্কুল সার্টিফিকেট পাস করে চন্দ্রশেখর ভর্তি হলেন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিতে ডিস্টিংশানসহ উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেন চন্দ্রশেখর। পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে বিএসসিতে ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে।

১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সিরিজ বক্তৃতা দিয়ে মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে বক্তৃতা দিতে এলেন আর্নল্ড সামারফেল্ড। এত বড় একজন পদার্থবিজ্ঞানীর লেকচার শুনতে পারবেন ভেবে চন্দ্রশেখর ভীষণ উত্তেজিত।  তিনি ইতোমধ্যেই পড়ে ফেলেছেন সামারফেল্ডের বিখ্যাত বই ‘অ্যা্টমিক স্ট্রাকচার অ্যা্ন্ড স্পেকট্রা লাইন্‌স।‘ শুধু পড়া নয় - বইতে বর্ণিত সমস্যাগুলোর সমাধানও করে ফেলেছেন নিজে নিজে। 

সামারফেল্ডের বক্তৃতার পরের দিন আত্মবিশ্বাসী তরুণ চন্দ্রশেখর হোটেলে গিয়ে দেখা করলেন সামারফেল্ডের সাথে। চন্দ্রশেখরের আগ্রহ আর এত কম বয়সেই পরমাণুর গঠন সম্পর্কিত জটিল ধারণাগুলো আয়ত্ব করে ফেলার ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হলেন সামারফেল্ড। কিন্তু তিনি যখন বললেন তাঁর ‘অ্যা্টমিক স্ট্রাকচার’ বইতে বর্ণিত কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্বগুলো ইতোমধ্যেই পুরনো হয়ে গেছে - স্তম্ভিত হয়ে গেলেন চন্দ্রশেখর। সামারফেল্ড অনেকক্ষণ ধরে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাম্প্রতিক আবিষ্কারের কথা বললেন চন্দ্রশেখরকে। বললেন শ্রোডিংগার, হাইজেনবার্গ, ডিরাক ও পাউলির নতুন কোয়ান্টাম তত্ত্বের কথা। চন্দ্রশেখর ম্যাক্সওয়েল-বোল্টজম্যান এর ক্লাসিক্যাল স্ট্যাটিস্টিক্‌স আত্মস্থ করেছেন ইতোমধ্যে। কিন্তু সামারফেল্ড জানালেন ম্যাক্সওয়েল-বোল্টজম্যান তত্ত্বেও পরিবর্তন আসছে। সামারফেল্ড কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আলোকে ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্টিক্‌স সম্পর্কিত তাঁর প্রকাশিতব্য একটা গবেষণাপত্রের প্রুফ পড়তে দিলেন চন্দ্রশেখরকে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের আলোকে পদার্থের ইলেকট্রন তত্ত্বের ওপর প্রথম পেপারটি পড়ে ফেললেন চন্দ্রশেখর প্রকাশিত হবার আগেই। 

সামারফেল্ডের সাথে সাক্ষাতের পর পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় মনপ্রাণ ঢেলে দিলেন চন্দ্রশেখর। কয়েক মাসের মধ্যেই ১৯২৮ সালে ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্সে প্রকাশিত হলো চন্দ্রশেখরের প্রথম গবেষণাপত্র ‘থার্মোডায়নামিক্স অব দি কম্পটন ইফেক্ট উইথ রেফারেন্স টু দি স্টার্‌স।’

তারপর সামারফেল্ডের সাথে আলোচনা ও তাঁর ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্টিক্‌স এর পেপারটির ওপর ভিত্তি করে দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটি রচনা করেন চন্দ্রশেখর। ‘দি কম্পটন স্ক্যাটারিং অ্যা্ন্ড দি নিউ স্ট্যাটিস্টিক্‌স’ শিরোনামের পেপারটির বিষয়বস্তুর নতুনত্ব ও গুরুত্বের কথা চিন্তা করে চন্দ্রশেখর ভাবলেন পেপারটি রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস এ প্রকাশ করবেন। কিন্তু রয়েল সোসাইটির কোন ফেলোর সুপারিশ ছাড়া রয়েল সোসাইটিতে প্রকাশের জন্য কোন গবেষণাপত্র বিবেচিত হয় না। চন্দ্রশেখর চাইলেই তাঁর কাকা ভেঙ্কট রামনের মাধ্যমে পেপারটি রয়েল সোসাইটিতে পাঠাতে পারেন। কিন্তু তিনি চাননি ব্যক্তিগত পরিচিতি কাজে লাগাতে। মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে গিয়ে নতুন আসা সায়েন্টিফিক জার্নাল খুঁজে দেখলেন রয়েল সোসাইটির ফেলো রাল্‌ফ ফাওলার ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্টিক্‌স কাজে লাগিয়ে শ্বেত-বামনের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। চন্দ্রশেখর জার্নাল থেকে ঠিকানা নিয়ে রাল্‌ফ ফাওলারের কাছে তাঁর পেপারটি পাঠিয়ে দিলেন। ফাওলার এত উঁচুমানের পেপার পেয়ে খুশি হয়েই রয়েল সোসাইটিতে পাঠিয়ে দিলেন। ১৯২৯ সালে রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস এ প্রকাশিত হলো চন্দ্রশেখরের দ্বিতীয় গবেষণাপত্র।  ১৯৩০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স পাস করার আগেই চন্দ্রশেখরের আরো দুটো পেপার প্রকাশিত হয় ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে। 

সেবছরই স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যান্ডে রওনা হলেন চন্দ্রশেখর কেমব্রিজে গিয়ে প্রফেসর রাল্‌ফ ফাওলারের তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করার জন্য। প্রফেসর ফাওলারের শ্বেতবামন তত্ত্ব সংক্রান্ত যত পেপার প্রকাশিত হয়েছে তার সবগুলোই গভীর মনযোগ দিয়ে পড়েছেন চন্দ্রশেখর কেমব্রিজে যাওয়ার আগেই। ফাওলারের তত্ত্ব সম্প্রসারণ করে নিজেই একটা পেপার লিখে সাথে নিয়েছিলেন জাহাজে ওঠার আগে। আর জাহাজে বসে হাত দিলেন নতুন আরেকটি পেপার লেখার কাজে। প্রফেসর রাল্‌ফ ফাওলার শ্বেত-বামন নক্ষত্রের ধর্মাবলী ব্যাখ্যা করেছেন ফার্মি-ডিরাক সংখ্যায়ন ব্যবহার করে। 

যে সব নক্ষত্র জ্বলতে জ্বলতে তাদের নিউক্লিয়ার শক্তি নিঃশেষ করে ফেলেছে - সাধারণত সেই সব নক্ষত্রদের হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা শ্বেত-বামন বলা হয়। এই নক্ষত্রগুলির মাধ্যাকর্ষণ-বল এত বেড়ে যায় যে তাদের ঘনত্ব সাধারণ পদার্থের চেয়ে হাজার হাজার গুণ বেশি হয়ে পড়ে। ঘনত্ব বেড়ে গিয়ে আয়তনে ছোট হয়ে যাবার পর সেগুলি তাপ বিকিরণ করে আস্তে আস্তে ঠান্ডা হতে শুরু করে। ফাওলার শ্বেত-বামনের ভর ও ঘনত্বের মধ্যে গাণিতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন যা সেই সময়ের পরীক্ষামূলক ফলাফলের সাথে মিলে যায়। 

জাহাজে বসে চন্দ্রশেখর নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন শ্বেত-বামনের ঘনত্ব ও ভর নিয়ে। ফাওলার ইলেকট্রনকে নন-রিলেটিভিস্টিক বা অনাপেক্ষিক কণা হিসেবে ধরে নিয়ে হিসেবের মধ্যে নিউটনিয়ান মেকানিক্স প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু শ্বেত-বামনের কেন্দ্রে ইলেকট্রনগুলো এত জোরে ছুটে বেড়াচ্ছে যে তারা কিছুতেই অনাপেক্ষিক থাকতে পারে না। আইনেস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এখানে প্রয়োগ করতেই হবে। নক্ষত্রগুলির একটি নির্দিষ্ট রাসায়নিক গঠন ধরে নিয়ে ফাওলার হিসেব করে দেখিয়েছেন শ্বেতবামনের ঘনত্ব হবে ভরের বর্গের সমানুপাতিক। একটু ভেবে দেখলেই এর সত্যতা বোঝা যায়। নক্ষত্রের ভর যত বেশি হবে মাধ্যাকর্ষণ বল তত বেশি হবে ফলে নক্ষত্রের ভেতরের পদার্থগুলি ঘন হয়ে নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে যাবে - আর ঘনত্ব বেড়ে যাবে। ফলে নক্ষত্রের আয়তন খুব কমে যাবে। সেগুলি এত ছোট হয়ে যাবে যে তাদের আর দেখা যাবে না। সে কারণেই সূর্যের চেয়ে বেশি ভরের কোন শ্বেত-বামন নক্ষত্র দেখা যায় না। 

চন্দ্রশেখর আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রয়োগ করে দেখলেন ভরের তুলনায় শ্বেত-বামনের ঘনত্ব ফাওলারের হিসেবের তুলনায় আরো অনেক বেড়ে যায়। ভর বৃদ্ধির সাথে ঘনত্বের দ্রুত বৃদ্ধিই শুধু হয় না, একটা নির্দিষ্ট ভরের বেশি হলে ঘনত্বের পরিমাণ হয়ে যায় অসীম। ভরের এই নির্দিষ্ট সীমা-ই পরে ‘চন্দ্রশেখর লিমিট’ হিসেবে গৃহীত হয়। ভরের এই সীমা নক্ষত্রের রাসায়নিক উপাদানের উপর নির্ভর করে।

চন্দ্রশেখর জাহাজে বসে ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর আগেই লিখে শেষ করলেন তাঁর পেপার “দি ম্যাক্সিমাম মাস অব আইডিয়েল হোয়াইট ডোয়ার্ফ।“ তিনি হিসেব করে দেখিয়েছিলেন যে কোন শ্বেত-বামনের ভর সূর্যের ভরের শতকরা ৯০ ভাগের বেশি হলে তার ঘনত্ব অসীম হয়ে যাবে। পরে অবশ্য এই মান কিছুটা পরিবর্তিত হয়। বর্তমানে চন্দ্রশেখর লিমিট হলো সূর্যের ভরের ১.৪ গুণ। 

এর ৫৩ বছর পর ১৯৮৩ সালে চন্দ্রশেখর নোবেল পুরষ্কার পান এই কাজের জন্য যা তিনি করেছিলেন মাত্র ১৯ বছর বয়সে ভারত থেকে ইংল্যান্ড যাবার পথে জাহাজে বসে।

কেমব্রিজে গিয়ে প্রফেসর ফাওলারের সাথে দেখা করলেন চন্দ্রশেখর। ফাওলারের সাথে দেখা করেই তিনি নতুন লেখা পেপারদুটো দেখালেন। প্রথম পেপার যেটাতে ফাওলারের কাজকে বিস্তৃত করা হয়েছে তা খুশি মনে মেনে নিলেন ফাওলার এবং  রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস এ প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় পেপার যেটাতে চন্দ্রশেখর ভরের সীমা হিসেব করেছেন - সেটা নিয়ে ফাওলার দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লেন। ফাওলার বললেন পেপারটা এডওয়ার্ড মিলনির কাছে পাঠিয়ে মতামত নিতে। কিন্তু কয়েক মাস পরেও ফাওলার বা মিলনির কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেলো না পেপারটির ব্যাপারে। চন্দ্রশেখর বুঝতে পারলেন যে ফাওলার হয়তো চাচ্ছেন না যে পেপারটি এখন প্রকাশিত হোক। চন্দ্রশেখর আর অপেক্ষা করলেন না। পেপারটির ছোট একটা সংস্করণ (মাত্র দুই পৃষ্ঠা) পাঠিয়ে দিলেন আমেরিকার অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে। পরের বছর অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হলো চন্দ্রশেখরের বিখ্যাত গবেষণাপত্র – দি ম্যাক্সিমাম মাস অব আইডিয়েল হোয়াইট ডোয়ার্ফ (অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল, (১৯৩১) সংখ্যা ৭৪, পৃ ৮১-৮২)। 

রিলেটিভিস্টিক আয়োনাইজেশান ও মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করে ১৯৩৩ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করলেন চন্দ্রশেখর। এরপর ট্রিনিটি কলেজের ফেলোশিপ পেলেন। রামানুজনের পরে চন্দ্রশেখরই হলেন দ্বিতীয় ভারতীয় যিনি এই ফেলোশিপ পেলেন।  ১৯৩৪ সালের মধ্যে রিলেটিভিস্টিক কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আলোকে শ্বেত-বামনের ভর ও ঘনত্বের সীমা নিয়ে বিস্তারিত হিসেবসহ দুটো পেপার প্রকাশের জন্য রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিতে জমা দিলেন। রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির আমন্ত্রণে ১৯৩৫ সালের জানুয়ারি মাসে সোসাইটির মাসিক সভায় বক্তৃতা দেন চন্দ্রশেখর। সভায় উপস্থিত ছিলেন স্যার আর্থার এডিংটন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে সেই সময় এডিংটনের কথাই শেষ কথা। এডিংটন চন্দ্রশেখরের গবেষণাকে স্বীকৃতিতো দিলেনই না, বরং অপমান করলেন। এডিংটনের মতে যে কোন তারাই শক্তিক্ষয়ের পর একসময় প্রাকৃতিক নিয়মেই মরে যাবে। সেখানে শ্বেতবামন বা ভরের সীমার কোন শর্ত থাকতে পারে না।

এর প্রায় দুই যুগ পর ‘চন্দ্রশেখর লিমিট’ নিজের যোগ্যতাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় আবিষ্কারগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। চন্দ্রশেখরের সীমার চেয়ে বেশি ভরের তারাগুলোর ভবিষ্যত কী? এ প্রশ্নের উত্তর সেদিন পাওয়া না গেলেও আজ আমরা সবাই জানি যে এরা ‘নিউট্রন স্টার’ কিংবা  ‘ব্ল্যাক হোল’এ রূপান্তরিত হয়।

এডিংটনের কারণে ইংল্যান্ডের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাবার সম্ভাবনা শূন্য হয়ে গিয়েছিল চন্দ্রশেখরের। ১৯৩৫ সালে তিনি পাড়ি দিলেন আমেরিকায়। চার মাস কাজ করলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর যোগ দিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪২ সালে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং ১৯৪৪ সালে ফুল প্রফেসর হন চন্দ্রশেখর। ১৯৫২ সালে ‘মরটন ডি হাল ডিস্টিংগুইস্‌ড সার্ভিস প্রফেসর’ হন। ১৯৮৫ সালে অবসর গ্রহণের পরেও এমেরিটাস প্রফেসর হিসেবে আমৃত্যু শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলেন চন্দ্রশেখর। ৪৮ বছরের শিক্ষকতা জীবনে একান্ন জন গবেষক পিএইচডি ডিগ্রি পান চন্দ্রশেখরের তত্ত্বাবধানে। ১৯৯৫ সালের ২১ শে আগস্ট চন্দ্রশেখর মারা যান।


তথ্যসূত্র

আর জে টেইলরের ‘সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর: বায়োগ্রাফিক্যাল মেমোরিজ অব ফেলোজ অব দি রয়েল সোসাইটি (১৯৯৬), কামেশ্বর সি ওয়ালির ‘চন্দ্র: এ বায়োগ্রাফিক্যাল পোট্রেট’ (২০১০), প্রদীপ দেবের ‘উপমহাদেশের এগারজন পদার্থবিজ্ঞানী (২০১৭)। 

______________
বিজ্ঞানচিন্তা মে ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত








Friday, 22 July 2022

জোসেলিন বেল

 


১৯৬৭ সালে এই আইরিশ তরুণীর বয়স ছিল মাত্র চব্বিশ বছর। তরুণীর নাম জোসেলিন বেল। ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগো থেকে ফিজিক্সে বিএসসি পাস করে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর অ্যান্টনি হিউইশের তত্ত্বাবধানে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে পিএইচডি গবেষণার মাঝামাঝি সময় তখন জোসেলিনের। ফিজিক্সের একটি আলাদা শাখা হিসেবে তখনো সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি অ্যাস্ট্রোফিজিক্স। রেডিও অ্যাস্ট্রোনমার অ্যান্টনি হিউইশ তখনো তেমন প্রভাবশালী কেউ নন।

 গবেষণার বেশিরভাগ কাজ একেবারে গোড়া থেকেই করতে হচ্ছিল জোসেলিনকে। অনেক খেটেখুটে একটি রেডিওটেলিস্কোপ বানিয়েছেন জোসেলিন। তার জন্য একশ মাইলের বেশি লম্বা তামার তার জুড়তে হয়েছে নিজের হাতে কেম্ব্রিজের কাছে মাঠের মধ্যে। সেই যন্ত্র দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জেগে চালিয়েছেন। মহাকাশ থেকে ভেসে আসা ডাটা বিশ্লেষণ করেছেন হাতে আঁকা গ্রাফ পেপারের মধ্যে। যেগুলি একটির পর একটি জুড়লে কয়েক মাইল লম্বা হবে। লক্ষ লক্ষ ডাটা বিশ্লেষণ করে জোসেলিন দেখলেন মহাকাশের বিশেষ অঞ্চল থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর অস্বাভাবিক সিগনাল পাওয়া যাচ্ছে। অনেক বিশ্লেষণ করে জোসেলিন নিশ্চিত হলেন যে এই সিগনাল আসছে আমাদের সৌরজগতের বাইরের মহাকাশ থেকে। আবিষ্কৃত হলো পালসার। 

পরপর চারটি পালসার আবিষ্কৃত হলো জোসেলিনের হাত দিয়ে। অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের নতুন দিগন্ত খুলে গেল। তরুণী জোসেলিন এই আবিষ্কারের ফলাফল প্রকাশ করলেন, থিসিস লিখলেন, পিএইচডি ডিগ্রি পেলেন। কিন্তু ঠিক ওইটুকুই। এর সাত বছর পর ১৯৭৪ সালে যখন পালসার আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার দেয়া হলো, জোসেলিনের নামও উল্লেখ করা হলো না। পুরষ্কারটি দেয়া হলো জোসেলিনের থিসিস সুপারভাইজার অ্যান্টনি হিউইশকে। শুধুমাত্র কমবয়সী একটি মেয়ে বলেই কি আবিষ্কারের কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল জোসেলিনকে? ঠিক তাই। 

জোসেলিন যদি সেখানেই থেমে যেতেন - তাহলে হয়তো তাঁর কথা কেউ মনেও রাখতো না আজ। জোসেলিন সেখানে থেমে থাকেননি। তিনি আরো অনেক বেশি পরিশ্রম করে অনবরত গবেষণার মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করেছেন বার বার। নোবেল পুরষ্কার ছাড়া বিজ্ঞানের গবেষণার অন্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ পুরষ্কার আছে তিনি তার সবগুলিই পেয়েছেন। পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনগুলির ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন। মেয়েদের বিজ্ঞান গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করার কাজে তিনি এই ৮১ বছর বয়সেও তারুণ্যের শক্তিতে নিবেদিত। 

প্রফেসর জোসেলিন বেলকে কয়েকবার দেখার এবং তার সেমিনারে অংশ নেয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। একটি মানুষের মধ্যে কী বিপুল পরিমাণ শক্তি থাকলে তিনি বলতে পারেন, "আমি নোবেল পুরষ্কার পাইনি তো কী হয়েছে, আমার আবিষ্কৃত পালসার তো পেয়েছে!" 

ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স ফাউন্ডেশান ২০১৮ সালে তাঁকে তিরিশ লক্ষ ডলার অর্থমূল্যের 'স্পেশাল ব্রেকথ্রু প্রাইজ' দিলে তিনি পুরো টাকাটাই দিয়ে দিয়েছেন মেয়েদেরকে গবেষণাবৃত্তি দেয়ার জন্য। 

১৯৪৩ সালের ১৫ জুলাই নর্থ আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে জন্মেছিলেন জোসেলিন। জন্মদিনে সকল বিজ্ঞানপ্রেমীর পক্ষ থেকে তাঁকে জানাই শ্রদ্ধা। কামনা করছি তাঁর কর্মময় জীবন আরো দীর্ঘ হোক।

Thursday, 21 July 2022

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌনহয়রানি

 


সারা পৃথিবীতেই শিক্ষাঙ্গনকে শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ অঙ্গন হিসেবে ধরে নেয়া হয়। সন্তান যেমন তার মায়ের বুকে নিরাপদে থাকে, তেমনি শিক্ষার্থীরাও তাদের ক্যাম্পাসে সবচেয়ে নিরাপদে থাকার কথা। যে শিক্ষায়তন থেকে আমরা শিক্ষা লাভ করি, সেই শিক্ষাঙ্গনকে আমরা সারাজীবন সম্মান করি আলমা ম্যাটার হিসেবে। আলমা ম্যাটার শব্দযুগলের আক্ষরিক অর্থ অনেকটা ধাত্রী মায়ের মতো – যে আমাদের আদরযত্নে লালনপালন করে, শিক্ষা দিয়ে, নিরাপত্তা দিয়ে কাজের জন্য উপযুক্ত করে তোলে। শিক্ষাঙ্গনের ভালোমন্দ সবকিছুই নির্ভর করে তার নীতিনির্ধারকদের উপর। বাংলাদেশের  বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকরা ভীষণ ক্ষমতাবান। পৃথিবীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে তাঁরা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কীভাবে চলে তা তাঁদের না জানার কথা নয়। নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছা থাকলে শিক্ষাঙ্গনে যৌন হয়রানিসহ যেকোনো ধরনের অন্যায়ের প্রতিরোধ শুধু নয়, নির্মূল করাও যে অসম্ভব নয়, তা সবাই জানে। কিন্তু বড়কর্তারা লোভের বশে, আর ছোটকর্তারা বড় হতে পারবে না এই ভয়ের বশে সবসময়ই একটা নতজানু নীতি বজায় রেখেছে। পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই – যেখানে কোন অন্যায় ঘটনা প্রায় হয় না বললেও চলে – সেখানকার ক্যাম্পাসেরও বিভিন্ন জায়গায় জরুরি ফোনবুথ থাকে। একটা বোতাম টিপলেই  নিরাপত্তা রক্ষীদের কাছে ফোন চলে যায়। নিরাপত্তা রক্ষীরা সেখানে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বেতন নেয়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না। কোন ঘটনা ঘটলে, বা ঘটার উপক্রম ঘটলেও – তা ধামাচাপা না দিয়ে সেই ঘটনার পুঙ্খানুপুংখ তদন্ত করা হয়, এবং সেরকম ঘটনা যেন আর কখনো না ঘটে তার ব্যবস্থা করা হয়।

আমার প্রিয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সাথে একই রকমের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। গত পঞ্চাশ বছরে অনেকবার ঘটেছে। অথচ ক্যাম্পাস ছাত্রীদের জন্য নিরাপদ করার কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। প্রতিটি ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে যেকোনোভাবে – শক্তি দিয়ে কিংবা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আন্দোলন থামানো হয়েছে, কিন্তু প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কষ্ট লাগে – যখন দেখি যারা এক সময় শিক্ষার্থী হিসেবে এই একই অন্যায়ের প্রতিকার চেয়ে আন্দোলন করেছিলেন, তাঁরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা হবার পর হাত গুটিয়ে বসে আছেন আরো উপরে উঠার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে।

রাতারাতি হঠাৎ সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে এটা আশা করার কোন উপায় নেই। ক্যাম্পাসে ঢুকে যারা শিক্ষার্থীদের সম্ভ্রম নষ্ট করার চেষ্টা করতে পারে, তাদের মতো নষ্ট মানুষ কীসের ক্ষমতার জোরে বুক ফুলিয়ে ক্যাম্পাসে ঘোরে তা সবাই জানে। নষ্টরা যে পার্টির ছায়াতেই থাকুক, তাদের নষ্ট বলে পরিত্যাগ করার সৎ সাহস বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকদের কেন থাকবে না?

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজ শিক্ষার্থীরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে দেখে ভালো লাগছে। আশা করি একদিন তারা যখন নীতিনির্ধারক হবে, তাদের এই প্রতিবাদী মনোভাব অটুট থাকবে।
*প্রতিবাদের ছবিটি নিয়েছি তন্ময় শাওনের ওয়াল থেকে।

Tuesday, 19 July 2022

একজন হুমায়ূন আহমেদ

 



মুনীর চৌধুরী সে কোন যুগে বলে গিয়েছিলেন – মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়।  দশ বছর হয়ে গেলো হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন। এই দশ বছর ধরে আমরা যাঁরা বেঁচে আছি, প্রত্যেকেই বদলে গেছি কোনো না কোনোভাবে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতার কাছে, নির্লজ্জ দুর্নীতিবাজদের কাছে নতজানু হতে হতে আমরা ভূমির সাথে মিশে গিয়েছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই শারীরিকভাবে বেঁচে থাকলেও মানসিকভাবে মরে পচে গেছি। কিন্তু মৃত্যুর দশ বছর পরেও হুমায়ূন আহমেদ এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। মানুষ আর লেখকের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। লেখকরা মরেন না। আসলে লেখকের মূল পরিচয় তো তাঁর লেখায়, লেখাগুলি বেঁচে থাকে। লেখার সাথে লেখকও।

বিজ্ঞানে কিছুটা সাহিত্য থাকতেও পারে, কিন্তু সাহিত্য বিজ্ঞান নয় কিছুতেই। সাহিত্য পুরোপুরি সৃষ্টিশীল কাজ। সেখানে পুনরাবৃত্তির খুব একটা কদর নেই। আর সাহিত্যের বিচারের ব্যাপারটা মোটেও বস্তুনিষ্ঠ নয়। বিজ্ঞানে যেটা ভুল – সেটা সবার কাছেই ভুল। কিন্তু সাহিত্যে ভুল বলে কিছু নেই। ভালোমন্দ লাগার ব্যাপারটাও পাঠকের নিজস্ব ব্যাপার। সাহিত্যের যে বই একেবারে অ্যাকাদেমি পুরষ্কার পেয়ে আকাশে উঠে গেছে, সেই বইও অনেক পাঠকের কাছে তীব্র বিবমিষাময় মনে হতে পারে। অনেক পাঠকের যে বই ভালো লাগে, সেই বই পাঠকপ্রিয় হয়, সেই লেখক প্রিয় লেখক হয়ে উঠেন। সেখানে যখন দেখা যায় একজন লেখক, আরেকজন লেখককে বলছেন – খারাপ লেখক – প্রশ্ন জাগে – ভালো-খারাপ মাপার মাপকাঠিটি কী ভাই? হুমায়ূন আজাদ হুমায়ূন আহমেদকে “অপন্যাসিক” বলতেন। ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে তা তিনি বলতেই পারেন। তার অর্থ এই নয় যে হুমায়ূন আজাদ হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে ভালো লেখক। কার কোন্‌ লেখককে ভালো লাগবে তার তো কোন নিয়ম নেই। ভালো লাগার স্বাধীনতা সবার আছে। যে লেখা পড়ে আনন্দ পাওয়া যায় – সেই লেখা যদি মানুষ পড়ে – লেখককে যদি মাথায় তুলে রাখতে চায়, তাহলে দোষের কী আছে? হুমায়ূন আহমেদকে বাংলাদেশের বেশিরভাগ পাঠক মাথায় তুলে রেখেছেন। মৃত্যুর দশ বছর পরেও তাঁর অবস্থান সেখানেই।

তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস নন্দিত নরক প্রকাশিত হয়েছিল ডক্টর আহমদ শরীফের লেখা ভূমিকাসহ। সেই ১৯৭২ সালে আর কোন উপন্যাসে এরকম অন্য বিখ্যাত মানুষের ভূমিকা প্রকাশিত হয়েছিল আমার জানা নেই। ডক্টর আহমদ শরীফ সেই ভূমিকায় লিখেছিলেন, “মাসিক মুখপত্রের প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় গল্পের নাম ‘নন্দিত নরকে’ দেখেই আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কেননা ঐ নামের মধ্যেই যেন একটি নতুন জীবনদৃষ্টি, একটি অভিনব রুচি, চেতনার একটি নতুন আকাশ উঁকি দিচ্ছিল। লেখক তো বটেই, তাঁর নামটিও ছিল আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত। তবু পড়তে শুরু করলাম ঐ নামের মোহেই। পড়ে আমি অভিভূত হলাম। গল্পে সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছি একজন সূক্ষ্মদর্শী শিল্পীর, একজন কুশলী স্রষ্টার পাকা হাত। বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে এক সুনিপুণ শিল্পীর, এক দক্ষ রূপকারের, এক প্রজ্ঞাবান দ্রষ্টার জন্মলগ্ন যে অনুভব করলাম।“ বাংলা সাহিত্যে যে বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে শুরু করেছিলেন শিল্পী হুমায়ূন আহমেদ, পরবর্তী চল্লিশ বছর ধরে তিনি বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাস-নাটকে ফসলের বান বইয়ে দিয়েছিলেন।

নন্দিত নরকে পড়ে সাহিত্যিক আবুল ফজল লিখেছিলেন, “লেখকের যেন কোন বক্তব্য নেই, কোন দৃষ্টিকোণ নেই, আশ্চর্য এক নির্লিপ্তির সাথে তুমি তোমার গল্প বলে গেছ। গল্প বলা তো নয়, এ যেন ছবি আঁকা। যাতে একটি রেখাও অযথা টানা হয়নি। আমাকে সবচে বিস্মিত করেছে তোমার পরিমিতিবোধ আর সংযম। এত অল্প বয়সে রচনায় এমন সংযম খুব কম দেখা যায়। তোমার লেখনী জয়যুক্ত হোক।“ হুমায়ূন আহমেদের লেখনী যেভাবে জয়যুক্ত হয়েছে, বাংলাদেশের সাহিত্যে অন্য কোন লেখকের ক্ষেত্রে ততটা ঘটেনি।

হুমায়ূন আহমেদ এর লেখার সমালোচনা করতে গিয়ে প্রায়ই দেখা যায় – ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদের জীবনযাপন, বিশ্বাস, প্রেম-ভালোবাসা-বিবাহ এসব নিয়ে কথা বলা যাবে না তা নয়। অবশ্যই যাবে। জনপ্রিয় মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ব্যক্তিগত গন্ডির বাইরে চলে আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার ভিত্তিতে তাঁর লেখার বিচার করা অবিচারেরই নামান্তর। আর একজন লেখকের সব লেখাই সবার ভালো লাগবে – সেটা আশা করাও কোন কাজের কথা নয়।

নন্দিত নরকে শেষ হয়েছে এভাবে - “ভোর হয়ে আসছে। দেখলাম চাঁদ ডুবে গেছে। বিস্তীর্ণ মাঠের উপরে চাদরের মতো পড়ে থাকা ম্লান জ্যোৎস্নাটা আর নেই।“ ওখান থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের ভুবন।


Sunday, 10 July 2022

বিশ্ববীণা বাজে যেথায় - ৫

 


স্কুলের বাংলা দ্বিতীয় পত্রে আমাদের কত রকমের ভাব যে সম্প্রসারণ করতে হতো মনে আছে তোমার? কঠিন জমাট ভাবকে টেনে টেনে লম্বা করার নামই ছিল ভাবসম্প্রসারণ। টান দিলেই রাবার সম্প্রসারিত হয়, তাপ দিলে বস্তু। কিন্তু ভাব সম্প্রসারিত হয় কীভাবে? ওটা নিয়ে অনেক তর্ক করতাম আমরা এক সময়। তুমি বলতে মনের ভাব সম্প্রসারণের জন্য দরকার মনের টান। কিন্তু সে যে ভাবের চেয়েও কঠিন। তাই কার ভাব কে সম্প্রসারণ করে! আমার হরলাল রায়ের বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা বই ছিল। সেখান থেকেই হুবহু খেয়ে নিয়ে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে আসতাম। মনে আছে, সেই যে – ‘তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী, কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবে মানুষ’? এই জটিল কথাগুলি কে লিখেছিলেন সেই সময় সেই প্রশ্ন মনেও আসেনি। চেনা জায়গা, চেনা মানুষ আর এতগুলি বছর ফেলে আসার পর এতদিনে রবীন্দ্র রচনাবলিতে পেলাম এই কথাগুলি।

কিন্তু পড়তে পড়তে মনে হলো – এই যে রবীন্দ্রনাথ বলে দিলেন তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী – আসলেই কি তাই? এদেশে তরুলতা ও পশুপক্ষীর যত্নআত্তির জন্য কত মানুষ, কত প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, কত হাজার হাজার ডলার খরচ হচ্ছে! এদেশে নাকি পশুপাখিদের জন্যও মনের ডাক্তার আছে, বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। কুকুর হাঁটানোর চাকরি করতে গিয়ে যে কুকুরের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছিলাম সেই ঘটনা তো তোমাকে বলেছি।

একইভাবে মাথার ভেতর আরেকটা প্রশ্ন ঘুরছে – একটি বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে বিশ্ব-বিদ্যালয় হয়ে ওঠে? ইউনিভার্সের সাথে মিল রেখেই কি ইউনিভার্সিটি নামটি এসেছে? জ্ঞানচর্চার মহাবিশ্ব – বিশ্ববিদ্যালয়! সেই কখন কোন্‌ যুগে ল্যাটিন শব্দ ইউনিভার্সিটাস থেকে ইউনিভার্সিটি কথাটার বিবর্তন ঘটেছে। সাড়ে চারশ কোটি বছরের মধ্যবয়স্ক এই পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যত আবিষ্কার-উন্নতি-উদ্ভাবন ঘটেছে তার প্রায় সবকিছুই ঘটেছে পৃথিবীর বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে। নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটানোই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। সহজ কথায় বলাই যায় – মনের যে কোনো ভাবনাচিন্তার উন্মেষ এবং সম্প্রসারণ করা বিশ্ববিদ্যালয়েরই কাজ। এখানে এই কাজটি দিনরাত হচ্ছে দেখে কেমন যেন একটা কষ্ট হচ্ছে। সাত বছর যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি – সেখানে দেখেছি সময়ের কী অপচয়, মেধার কী অপচয়। অবশ্য এখানে না এলে ভাবতাম ওটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক অবস্থা। জানতেই পারতাম না যে মেধা, মনন ও জীবনীশক্তির কী সাংঘাতিক অপচয় হয়ে চলেছে সেখানে।

কিছু জায়গা নিয়ে অনেকগুলি বিল্ডিং প্রতিষ্ঠা করে দিলেই তো একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে যায় না। সেখানে যারা কাজ করেন, তাদের কাজের মাধ্যমেই তা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। ১৮৫৫ সালের ১৩ এপ্রিল মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির আনুষ্ঠানিক ক্লাস শুরু হয়েছিল। সেদিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ষোল জন। তাদের মধ্যে মাত্র চারজন শিক্ষার্থী যথাসময়ে ডিগ্রি সম্পন্ন করেছিল। সেখান থেকে শুরু হয়ে এক শ বছরের মধ্যেই বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে পৌঁছে যেতে পেরেছে একটা বিশ্ববিদ্যালয় কিসের শক্তিতে – যে শক্তি আমাদের নেই? আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ১৮৫৫ থেকে ১৯৩৪ পর্যন্ত দীর্ঘ আশি বছরে যে দশ জন শিক্ষাবিদ মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেছেন – তাঁদের কেউই কোন বেতন নেননি। আশি বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরের পদ ছিল অবৈতনিক। এসব পড়ি আর অবাক হই।

মাত্র দু’মাস হলো মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্র হয়েছি। এই দুই মাসে আমি যতগুলি সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, পাবলিক লেকচার অ্যাটেন্ড করার সুযোগ পেয়েছি আগে সাত বছরেও পাইনি। তাও শুধুমাত্র ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে। ইউনিভার্সিটির প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টেই হাজার রকমের জ্ঞানযজ্ঞ চলছে সারাবছর। ছাত্র-অছাত্র সবার জন্যই তা উন্মুক্ত। যে কেউ যে কোনো সেমিনারে ঢুকে বসে যেতে পারে। জুলাই মাসের প্রত্যেক শুক্রবার সন্ধ্যেবেলা ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের জুলাই লেকচার সিরিজ চলে। ডিপার্টমেন্টের প্রফেসররা পদার্থবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কারগুলি সেখানে এমনভাবে আলোচনা করেন যেন সবাই বুঝতে পারে। এই শীতের মধ্যেও কানায় কানায় ভর্তি হয়ে যায় বিরাট লেকচার থিয়েটার। আগস্টের প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চলেছে ফিজিক্স জিমনিশিয়াম। জিমনিশিয়াম শুনে আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ব্যায়াম করাবে। পরে দেখলাম মগজের ব্যায়াম। সেখানে স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য পদার্থবিজ্ঞানের লেকচার দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত প্রফেসররা। স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য হলেও তাদের অভিভাবকরাও আসেন তাদের সাথে লেকচার শুনতে। আমি এই সুযোগও ছাড়িনি। প্রফেসররা কী চমৎকার করে যে ব্যাখ্যা করেন বিষয়গুলি। পদার্থবিজ্ঞানের ভেতরের এই যে মজা – তা আমরা কেন পাইনি? আমাদের স্যার-ম্যাডামরা কেন ক্লাসে এসেই শুধু সমীকরণের পর সমীকরণ লিখতে থাকেন? পদার্থবিজ্ঞান মানে কি শুধুই সমীকরণ?  

সেদিন সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম আর্কিটেকচার বিল্ডিং-এ পাবলিক লেকচার শুনতে। সন্ধ্যাবেলার পাবলিক লেকচারগুলি সবার জন্য উন্মুক্ত। এখানে জ্ঞানভিত্তিক বক্তৃতা শোনার জন্য কী ভীড় যে হয় তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। আর্কিটেকচার বিল্ডিং-এর নিচের তলায় অনেকটা ভূগর্ভস্থ লেকচার থিয়েটার – প্রিন্স ফিলিপ থিয়েটার। প্রায় বারো শ সিটের থিয়েটার হল – কানায় কানায় ভরে গিয়েছিল মহাবিশ্বের আকার-আকৃতি সম্পর্কে জানতে। গণিতের প্রফেসর ওয়াল্টার নিউম্যান এই পাবলিক লেকচার দিলেন ‘What Shape is the Universe?’ প্রসঙ্গে। ১৯০০ সালে গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট কিছু গাণিতিক সমস্যার তালিকা প্রকাশ করেছিলেন – যেগুলি পুরো বিংশ শতাব্দীজুড়ে আলোচিত হয়েছে। সেখান থেকে একটা প্রশ্ন উঠে আসে – তা হলো গাণিতিকভাবে মহাবিশ্বের আকার এবং আকৃতি মাপা কীভাবে সম্ভব? এখানে নাম্বার থিওরি কীভাবে কাজ করে? খুবই খট্মটে গাণিতিক বিষয়। অথচ পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলেন কোন ধরনের জটিল গাণিতিক সমীকরণ ছাড়াই। চকচকে টাকের মধ্যবয়স্ক প্রফেসর নিউম্যানের বাচনভঙ্গি খুবই সুন্দর। তবে অঙ্গভঙ্গি খুবই বিচিত্র। কথা বলার সময় তিনি এক পা সামনে আসেন, আবার এক পা পেছনে সরে যান। দেড়ঘন্টা ধরে তিনি অবিরাম কথা বলার সাথে সাথে এই পদসঞ্চালনও করেছেন বিরামহীন। তবে আমি ছাড়া সম্ভবত আর কেউ এই ব্যাপারটা খেয়ালও করেনি। এখানে কীভাবে হাত-পা নাড়ালো তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো কী বলা হলো।

এখানে রিসার্চ ডিগ্রিতে ভর্তি হতে পারলে কোন বাধ্যতামূলক কোর্সওয়ার্ক থাকে না। আমারও নেই। তবে প্রফেসর লেস অ্যালেনের স্ক্যাটারিং থিওরির কোর্সটা করছি – যদি কিছু বুঝতে পারি এই আশায়। খুব একটা সুবিধা সেখানে করতে পারছি না। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গাণিতিক ভিত্তি সেভাবে গড়ে ওঠেনি আমার। সেখানে ফাঁকির যে ফাঁকফোকরগুলি মুখস্থ করে ঢেকে দিয়েছিলাম, সেগুলি এখন বিরাট বিরাট গর্ত হয়ে আমাকে গিলতে আসছে। এর মধ্যে প্রফেসর দশটা প্রোবলেমের একটা সেট দিয়েছেন সমাধান করার জন্য। এক সপ্তাহ সময়। আমার জন্য বাধ্যতামূলক নয়, তবে ক্লাসের অন্যরা কোর্সওয়ার্কের স্টুডেন্ট – তাদের জন্য বাধ্যতামূলক। এই অ্যাসাইনমেন্টের নম্বর যোগ হবে তাদের ফাইনাল পরীক্ষার নম্বরের সাথে। দু’সপ্তাহ পরে ফাইনাল পরীক্ষা।

অনেকক্ষণ ধরে বোঝার চেষ্টা করার পর মনে হলো স্ক্যাটারিং থিওরির প্রোবলেমগুলির সমাধান করা আমার সাধ্যের বাইরে। মন বললো – যেহেতু বাধ্যতামূলক নয়, সেহেতু অ্যাসাইনমেন্ট জমা না দিলেই হলো। কিন্তু কোথায় যেন একটু আত্মসম্মানেও লাগছে। প্রফেসর অ্যালেন নিশ্চয় কেন্‌কে বলবেন। চেষ্টা করে দেখা যাক একবার। ফিজিক্স রিসার্চ লাইব্রেরির কয়েকটা শেল্‌ফভর্তি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বই। এগুলি ঘাঁটতে থাকলে কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো সমাধানের পথ বের হয়ে আসবে।

আজ সন্ধ্যাবেলা কার্ড পাঞ্চ করে লাইব্রেরিতে ঢুকেছিলাম। ভেবেছিলাম আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না সেখানে – যত বই আছে সব ঘেঁটে ফেলবো আজ। কিন্তু ঢুকে দেখি র‍্যাচেলসহ ক্লাসের আরো পাঁচজন ছেলে-মেয়ে সাইলেন্ট স্টাডিরুমের ফ্লোরের কার্পেটে বইয়ের স্তূপ বানিয়ে তার চারপাশে বসে শলাপরামর্শ করছে। ভাবলাম চুপি চুপি বের হয়ে আসবো। কিন্তু তারা আমাকে দেখে ফেললো। আমাকেও যোগ দিতে হলো অ্যাসাইনমেন্টের শলাপরামর্শে। এটা গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট নয়, অথচ সবাই একসাথে আলোচনা করছে কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়। ব্যাপারটা খুব ভালো লাগলো আমার। বিজ্ঞান একক সাধনার ব্যাপার নয়। যে ব্যাপারটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগলো সেটা হচ্ছে এদের সাবলীলতা। তাদের প্রতি আমার কিছুটা সংকোচ থাকলেও আমার প্রতি তাদের কোন সংকোচ নেই। আমার গায়ের বর্ণ কিংবা ভুল উচ্চারণ কিছুতেই যেন তাদের কিছু যায় আসে না। এই ব্যাপারটা তারা কোথায় শিখলো? তাদের প্রত্যেকেরই বয়স আমার চেয়ে কমপক্ষে আট-নয় বছর কম। অথচ কত বেশি উদার তারা এই বয়সেই।

পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে অ্যাসাইনমেন্ট লিখে জমা দিলাম। ভুল-শুদ্ধ যাই হোক, কাজের কাজ এটুকু হয়েছে যে অনেকগুলি বইপত্র সিরিয়াসলি ঘাঁটা হয়েছে।

সোমবার সকালে যে কান্ডটি ঘটেছে তার জন্য আমি তৈরি ছিলাম না। ডেস্কে বসে কী করবো ভেবে ওঠার আগেই প্রফেসর লেস অ্যালেন রুমে ঢুকলেন। তাঁর হাতে আমার অ্যাসাইনমেন্ট। শুক্রবার বিকেলে জমা দিয়েছি, এর মধ্যেই তিনি দেখে ফেলেছেন? ছুটির দিনেও কি ছুটি কাটান না এঁরা?

“প্রাডিব, আই অ্যাম নট শিওর অ্যাবাউট সামথিং হিয়ার। ক্যান ইউ সি ইট?”

আমি ভুল করেছি, তিনি সেটা কেটে দেবেন – সেটাই তো নিয়ম। তিনি তা না করে আমার সাথে আলোচনা করতে এসেছেন আমি কেন এবং কীভাবে লিখেছি যা লিখেছি। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনিশ্চয়তার তত্ত্ব এই ক্ষেত্রেও যে প্রযোজ্য হবে তা ভাবিনি। অনেকক্ষণ ধরে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ব্যাখ্যা করলেন আমি যা লিখেছি তা কোথায় শুদ্ধ, কোথায় কম-শুদ্ধ। তিনি ভুল হয়েছে বললেন না একবারও। বললেন – লেস কারেক্ট। এরকম ব্যাপার যে ফিজিক্সে থাকতে পারে তাও জানতাম না। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো – যে সমস্যাগুলি তিনি সমাধান করতে দিয়েছেন তার সবগুলিই গবেষণার নতুন সমস্যা – যাদের সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভুল করার পরেও কোন ধরনের লজ্জার অনুভূতি হলো না এই প্রথম। দেশে ভাইভাতে একটা প্রশ্নের উত্তর তাৎক্ষণিকভাবে দিতে না পারলে স্যাররা যেভাবে ধমক দিয়ে লজ্জা দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন যে আমরা পদার্থবিজ্ঞান পড়ার উপযুক্ত নই – এখানে সেরকম কোন ব্যাপারই নেই।

প্রফেসর লেস অ্যালেন রুম থেকে বের হবার সময় বলে গেলেন দু’সপ্তাহ পরে পরীক্ষা, এবং পরীক্ষা হবে ওপেন বুক।


বিশ্ববীণা বাজে যেথায় - ৪

 



আলীবাবা ও চল্লিশ চোরের কাহিনি নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার। চোরদের গুপ্ত গুহায় ঢুকে ধনরত্ন হীরা-জহরতের পাহাড় দেখে আলীবাবার ভাই কাসেমের যে অবস্থা হয়েছিল, এখানে লাইব্রেরিগুলির বইয়ের সমুদ্রে ঢুকে আমার সেই অবস্থা হচ্ছে বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ লাইব্রেরি প্রবন্ধে যা যা বলেছেন মনে হচ্ছে এতদিনে তা উপলব্ধি করতে পারছি - “লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানবহৃদয়ের অতলস্পর্শে নামিয়াছে। যে যে-দিকে ধাবমান হও, কোথাও বাধা পাইবে না।“

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি বাধাহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি একটার পর একটা লাইব্রেরিতে। বিষয়ভিত্তিক গবেষণায় ‘পথ হারাবো বলেই আমি পথে নেমেছি’ বলার সুযোগ নেই। সেখানে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ আছে, কিন্তু নিলেই বিপদ। লাইব্রেরির সহস্র পথের চৌমাথায় দাঁড়িয়ে পথ চিনতে ভুল করলে অহেতুক সময় নষ্ট হবে। এসব জানা থাকা সত্ত্বেও আমি মুক্তপাঠের আনন্দে মেতে উঠেছি, যে আনন্দ পুরোপুরি পাবার জন্য কিছুটা লক্ষ্যবিহীন স্বেচ্ছাচারীও হতে হয়। এক্ষেত্রে এখন আমি পুরোপুরি স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছি। লাইব্রেরি থেকে এক সাথে ষাটটা বই ধার করে বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে জেনে পুস্তকনির্বাচনে প্রয়োজনের চেয়েও ভালো লাগাকে প্রশ্রয় দিতে শুরু করেছি। ভ্রমণ, মনস্তত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস এসবের সাথে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের দূরতম সম্পর্কও নেই, কিন্তু আমি হাত ভর্তি করে ফেলেছি এ ধরনের বইতে। ব্যাইলিউ লাইব্রেরির উপরের তলার একদিক থেকে শুরু করে মাঝামাঝি পর্যন্ত আসতেই হাত ভর্তি হয়ে গেছে। সামনে আরো শত শত তাকে সারি সারি বই চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে।

এই ক্যাম্পাসে অনেকগুলি লাইব্রেরি। প্রত্যেকটি ডিপার্টমেন্টেই আছে বিষয়ভিত্তিক রিসার্চ লাইব্রেরি। ফিজিক্স বিল্ডিং-এর ছয় তলায় আমাদের ফ্লোরেই ফিজিক্স রিসার্চ লাইব্রেরি। ওখানে ফিজিক্সের দরকারি সব জার্নালের সবগুলি সংখ্যা পাওয়া যায়। আমার অন্য কোনো লাইব্রেরিতে যাওয়ারই দরকার নেই। কিন্তু দরকারের গন্ডিতে বন্দী থাকতে কি ভালো লাগে? ফিজিক্স লাইব্রেরিতে দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা যে কোনো সময়েই ঢুকতে পারি ইলেকট্রনিক কার্ড দিয়ে। কিন্তু অন্য লাইব্রেরিগুলিতে নির্ধারিত সময়ের বাইরে আমার প্রবেশাধিকার নেই। তাই যখনই সুযোগ পাচ্ছি – একটার পর একটা লাইব্রেরিতে ঢু মেরে দেখছি কী কী বিষয়ের বই আছে সেখানে। কম্পিউটারে লাইব্রেরির ক্যাটালগ থেকেই জানা যায় কোথায় কী বই আছে। কিন্তু বইয়ের গায়ে হাত দিয়ে দেখার যে আনন্দ তা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করি কেন।

এই কাজটি আমি বাংলাদেশে যে ক’টা লাইব্রেরিতে ঢুকতে পেরেছি – সব জায়গায় করেছি। সবগুলি বইয়ের তাক ঘুরে ঘুরে দেখেছি কোথায় কী বই আছে। পুরো চট্টগ্রাম শহরে যতগুলি লাইব্রেরি আছে তার চেয়ে অনেক বেশি লাইব্রেরি আছে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির এই পার্কভিল ক্যাম্পাসে। গত তিন সপ্তাহে আমি সবগুলো লাইব্রেরিতে ঢু মেরেছি। এদের মধ্যে অনেকগুলি লাইব্রেরিতে আমার আর না গেলেও চলবে। যেমন আমাদের বিল্ডিং থেকে বের হয়ে ওল্ড জিওলজি বিল্ডিং-এর সামনে আর্কিটেকচার বিল্ডিং-এর দোতলার লাইব্রেরিতে সব বিল্ডিং ডিজাইনের বই – আর যেতে হবে না সেখানে। কেমিস্ট্রি, ম্যাথস, বায়োলজি ওসবেও আর যেতে হবে না। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পেছনে লাল রঙের পুরনো মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিল্ডিং-এর ইঞ্জিনিয়ারিং লাইব্রেরিতেও আর যেতে হবে বলে মনে হয় না।

গ্র্যাটান স্ট্রিট পার হয়ে ইউনিভার্সিটি স্কোয়ারের সামনে মেলবোর্ন বিজনেস স্কুল। এটা নাকি পৃথিবীর প্রথম পাঁচটি বিজনেস স্কুলের একটি। পৃথিবীর অনেক বড় বড় কোম্পানির এক্সিকিউটিভরা এখানে আসে এমবিএ করার জন্য। মেডিসিনের টিউশন ফি’র চেয়েও বেশি বিজনেস স্কুলের টিউশন ফি। এখানেও একটি খুব হাই ফাই লাইব্রেরি আছে। সেই লাইব্রেরিতেও ঘুরে এসেছি। খটখটে বিজনেস পেপারে ভর্তি। আমার আর যেতে হবে না ওখানে।

বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ভেতরের লাইব্রেরিগুলি ছাড়াও আলাদা আলাদা সম্পূর্ণ বিল্ডিং নিয়ে যে তিনটি বিশাল লাইব্রেরি আছে এই ক্যাম্পাসে সেগুলি হলো ইস্টার্ন রিসোর্স সেন্টার বা ই-আর-সি লাইব্রেরি, ব্যাইলিউ লাইব্রেরি আর বায়োমেডিক্যাল লাইব্রেরি। এগুলিতে একবার করে ঢুকেই বুঝতে পেরেছি বার বার যেতে হবে।

ব্যাইলিউ লাইব্রেরিতে আজকের আগেও কয়েকবার এসেছি। প্রথমবার এসেছিলাম এখানে পার্টটাইম কাজের জন্য। কাজ হয়নি। আজ এসেছি বই দেখার জন্য। কত লাখ বই যে এখানে আছে!

মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি এই ব্যাইলিউ লাইব্রেরি। অস্ট্রেলিয়ান ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ উইলিয়াম ব্যাইলিউর টাকায় এই লাইব্রেরি তৈরি হয়েছে। বিশাল পাঁচতলা এই লাইব্রেরি বিল্ডিংটি তৈরি হয়েছে ১৯৫৮ সালে। দেখে মনে হয় না যে এই বিল্ডিং-এর বয়স চল্লিশ হয়ে গেছে। পাঁচ তলা বিল্ডিং-এর দোতলা পর্যন্ত মাটির নিচে। একেবারে নিচের তলায় আছে দুষ্প্রাপ্য সব ছবি, গানের রেকর্ড, পত্রিকা। লিটল ম্যাগাজিনে ভর্তি এর পরের তলা। সব ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে এলাম পঞ্চম তলায়। এখানেই মূল সংগ্রহশালা।

ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে অনেকগুলি বই হাতে উঠে এলো। ইস্যু করে নিয়ে যেতে হবে। আরো বই দেখতে দেখতে ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় লেখা বইয়ের অংশে এলাম। ফরাসি, জার্মানের কাছাকাছি রাশিয়ান আর চায়নিজ ভাষায় লেখা বইও পাওয়া গেল। আমার চোখ দ্রুত ঘুরছে, ক্ষীণ একটা আশা মনে জেগে উঠেছে। আশাতীতভাবে পরের সারিতেই দেখা দিলেন রবীন্দ্রনাথ। “শঙ্খের মধ্যে যেমন সমুদ্রের শব্দ শুনা যায়, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে কি হৃদয়ের উত্থানপতনের শব্দ শুনিতেছ?” কী এক আশ্চর্য সুখে হৃদয় আন্দোলিত হয়ে উঠলো। রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৬১ সালে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলির সবগুলি খন্ডই আছে এখানে। তার পাশে অন্নদাশংকর রায়ের সত্যাসত্য উপন্যাসের চার খন্ড, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী, সুবোধ ঘোষের ভারত প্রেমকথা, আর ত্রৈলোক্যনাথ রচনাবলীর এক খন্ড। মাত্র এই ক’টা বাংলা বই – তাতেই মনে হচ্ছে আমি সোনার খনি পেয়ে গেছি। এখানে এই বই কীভাবে এলো তার ইতিহাস আমি জানি না। নিশ্চয় কোন বাঙালি শিক্ষাবিদ এই বইগুলি আনার ব্যবস্থা করেছেন। আমি কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে। এতক্ষণ যেসব বই হাতে নিয়েছিলাম সেগুলি রেখে দিলাম লাইব্রেরির ট্রলিতে। রবীন্দ্র রচনাবলীতে হাত দিলাম। ভীষণ ভারী এক এক খন্ড। এক সাথে পাঁচ খন্ডের বেশি নেয়া গেল না। কাল আবার আসতে হবে। সবগুলি বই বাসায় নিয়ে গিয়ে পড়তে হবে। বাংলা থেকে দূরে না গেলে বোঝা যায় না বাংলার জন্য কেমন তৃষ্ণা জাগে। 




বিশ্ববীণা বাজে যেথায় - ৩

 


সপ্তাহের সাতদিনই আমার ক্যাম্পাসে কাটে। খুব সিরিয়াসলি পড়াশোনা করছি ভাবার কোন কারণ নেই। যে বাসায় সাবলেট থাকি – সেখানে ছোট্ট একটা রুমের বাইরে বাথরুম ছাড়া আর কোথাও যাবার উপায় নেই। ডিপার্টমেন্টে আমার রুমে যখন-তখন আসা যায়। ছুটির দিনে কেউ থাকে না – মনে হয় পুরো বিল্ডিং-টাই আমার। কিন্তু একদম কেউ যে থাকে না তা নয়। রিসার্চ-স্টুডেন্টদের কেউ না কেউ থাকেই। তবে আমার ফ্লোরে কাউকে তেমন দেখা যায় না ছুটির দিনে।

রোববার সকালে মেলবোর্ন সেন্ট্রাল আর ভিক্টোরিয়া মার্কেটে একটা চক্কর দিয়ে ক্যাম্পাসের কাছাকাছি আসতেই মনে হলো উৎসব চলছে সারা ক্যাম্পাস জুড়ে। গতকাল বিকেল থেকেই কিছু কিছু আয়োজন চোখে পড়েছিল। কী হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারিনি। এখন দেখছি দলে দলে লোকজন আসছে ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাসের সবগুলি বিল্ডিং আজ খোলা। নানা রঙের ব্যানার ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে ক্যাম্পাস। এখানে ওখানে বড় বড় ব্যানারে লেখা – ডিসকভারি ডে। আজ কি মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির জন্মদিন? ১৮৫৩ সালের আজকের দিনেই কি এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল?

টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। শীতকালে বৃষ্টি হওয়া মেলবোর্নের বৈশিষ্ট্য। এই বৃষ্টিকে এখানে কেউ পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। অনেক প্রশ্ন আর ভেজা ছাতা মাথায় নিয়ে সোয়ান্সটন স্ট্রিট আর এলগিন স্ট্রিটের কোণা দিয়ে ফিজিক্স বিল্ডিং-এ ঢুকলাম। আজ ছুটির দিনেও তালা খুলতে হলো না। ডিসকভারি ডে উপলক্ষে সবকিছু খোলা।

বিল্ডিং-এর ভেতরে বাইরের উৎসবের কোন রেশ নেই। লিফ্‌ট দিয়ে ছ’তলায় উঠে বুঝতে পারলাম কেউ আসেনি এখানে। করিডোরের লাইট নেভানো। অন্যদিন দিনের বেলায়ও লাইট জ্বলে এখানে। রুমে ঢুকে আমার টেবিলের দিকে তাকিয়ে একটু অপরাধবোধ হলো। বইপত্র যেগুলি এক সপ্তাহ আগে খুলেছিলাম – এখনো সেভাবেই হা করে আছে।

ফাঁকিবাজি ব্যাপারটা যে ছোঁয়াচে তা আবারো প্রমাণিত হলো। এই প্রমাণ সংগ্রহের জন্য দূরে যাবার দরকার নেই, আমার নিজের দিকে তাকানোই যথেষ্ট। আমার সিনিয়র সহপাঠী ম্যান্ডি ক’দিন থেকে ডিপার্টমেন্টে আসছে না। আর জিনেট সকালে এসে ডেস্কে ব্যাগ রেখে, কিছুক্ষণ টেবিলে রাখা ছোট ছোট খেলনাগাড়িগুলি নিয়ে খেলাধূলা করে রুম থেকে বের হয়ে যায়। সারাদিন আর দেখা যায় না তাকে। এই ব্যাপারটাই ছোঁয়াচে রোগের মতো আমাকেও ধরে ফেলেছে। কেন্‌ ইওরোপে যাবার পর দু’দিন যেতে না যেতেই মনে হচ্ছে আমার পায়ে চাকা গজিয়ে গেছে। আমি কনকনে ঠান্ডাকে পাত্তা না দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি মেলবোর্ন শহরের অলিতে গলিতে।

কেন্‌ ইওরোপে যাবার পর ম্যান্ডি শুধু একদিন এসেছিল। তারপর কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেছে। তার ডেস্কে রাজ্যের কাগজপত্র, কোকের খালি ক্যান, একজোড়া জুতা। পড়ার টেবিলে এভাবে জুতা তুলে রাখতে আর কাউকে দেখিনি। শুনেছি তার পিএইচডির তৃতীয় বর্ষ চলছে। তাহলে তো তার শীঘ্র থিসিস জমা দেয়ার কথা। কিন্তু সে ব্যাপারে তার ভেতর কোন তাড়া দেখছি না।

জিনেটের সাথে আমার যেদিন পরিচয় হলো – সেদিন সে দীর্ঘ ছুটি থেকে ফিরেছে। ডিপার্টমেন্টে সে খুবই পপুলার। সে যতক্ষণ রুমে থাকে – সারাক্ষণ কেউ না কেউ আসে তার কাছে, আর হাহা-হিহি করে অনবরত কী কী নিয়ে গল্প করতে থাকে। এদের উচ্চারণের বেশিরভাগই আমি বুঝতে পারি না। তারাও সেটা জানে, সেজন্য রুমে আমার উপস্থিতিকে তারা মোটেও গ্রাহ্য করে না। জিনেট পিএইচডি শুরু করেছে দু’বছর হয়ে গেল, অথচ এখনো নাকি কিছুই এগোয়নি তার প্রজেক্ট। কিন্তু তাতে তার কোন উদ্বেগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। ডেস্কে সে একা থাকলে খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলতে বসে। খেলনা গাড়ি নিয়ে শিশুরা ছাড়া আর বড়রাও যে নিয়মিত খেলতে বসে এটাও আগে দেখিনি কখনো।

কেনের পোস্টডক্টরেট ফেলো ডক্টর পিটার ডর্টসম্যানও গেছেন কেনের সাথে। এখন বেশিরভাগ সময়েই পুরো রুমটা আমার নিজের দখলে থাকে। বিশাল কম্পিউটার পড়ে থাকে চোখের সামনে। কিন্তু আমার চোখ চলে যায় নিজের টেবিল ছেড়ে কম্পিউটার-টেবিলের উপর দিয়ে জানালায়। এই জানালা দিয়ে ক্যাম্পাসের অনেকবিল্ডিং-এর চূড়া দেখা যায়, আরো দেখা যায় মেলবোর্ন সেন্ট্রালের বিশাল গম্বুজ। এদিকে তাকালেই মনে হয় এরা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

লেখাপড়া না করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে মনের ভেতর একটু খচখচ করলেও – যাযাবর মন, ফাঁকিবাজ মন আমাকে বোঝায় – ম্যান্ডি আর জিনেট কি পড়াশোনা করছে? তোমার সুপারভাইজার তো যাবার সময় কোন পড়া দিয়ে যাননি যে বসে বসে পড়তে হবে। তাছাড়া নতুন জায়গায় এসে রুমে বসে থাকলে হবে? পথঘাট চিনে নিতে হবে না?

পথঘাট চিনে নেয়ার জন্য পথেঘাটে ঘুরে বেড়ালে অন্যদের কী হয় জানি না – আমার অদ্ভুত এক আনন্দ হয়। সেটা চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকা শহরেও যেমন হয়, এখানে মেলবোর্নেও হচ্ছে। যেটুকু জায়গা নিয়ে মেলবোর্ন শহরের সিবিডি বা সেন্ট্রাল বিজনেজ ডিস্ট্রিক্ট, ম্যাপে দেখা যাচ্ছে তার চেয়েও বেশি জায়গা নিয়ে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির পার্কভিল ক্যাম্পাস। একটা একটা করে এই ক্যাম্পাসের সবগুলি রাস্তায় হাঁটছি, সবগুলি বিল্ডিং-এ ঢু মারতে শুরু করেছি। আজ সকালেও মেলবোর্ন সেন্ট্রাল আর ভিক্টোরিয়া মার্কেটে ঘুরে এসেছি। ভিক্টোরিয়া মার্কেটে অবশ্য গিয়েছিলাম কাজের খোঁজে। কাজ হয়নি।

ওখান থেকে আসার সময় ভেবেছিলাম রুমে বসে কিছুক্ষণ লেখাপড়া করার চেষ্টা করবো। কিন্তু জানালায় দাঁড়িয়ে দেখছি নিচে ক্যাম্পাসজুড়ে লোকজনের মেলা। দেখে আসা দরকার, কী হচ্ছে। যাবার আগে টেবিলের বইগুলি কি বন্ধ করে যাবো?

“হ্যাই, ইউ আর হিয়ার টুডে!”

খোলা দরজা দিয়ে ঝড়ো হাওয়ার মতো রুমে ঢুকে পড়েছে ইভন। ইভন পার্টিক্যাল ফিজিক্সে পিএইচডি করছে প্রফেসর রে ভলকাসের কাছে। প্রফেসর রে’র অফিস করিডোরের শুরুতে। লিফ্‌ট থেকে বের হলেই তাঁর সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। তিনি গম্ভীর মানুষ, কখনো কথা বলেননি আমার সাথে, হাসেনওনি। কিন্তু তাঁর ছাত্রী ইভন প্রচন্ড হাসিখুশি মানুষ। ইভন দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে ক্লাস সিক্স-সেভেনের বাচ্চার মতো ছোটখাট। চেহারায় চৈনিক ছাপ আছে। কিন্তু কথাবার্তায় খাঁটি অস্ট্রেলিয়ান। আমার সাথে তার পরিচয় হয়েছে সপ্তাহ খানেক আগে। ফার্স্ট ইয়ারের ফিজিক্স ল্যাবের ডেমনেস্ট্রেশনে সে আমার পাশের ল্যাবে ছিল। সেখানে একটু করে হাই-হ্যালো হয়েছে। আমার একই ফ্লোরে কয়েকটা রুম পরেই তার রুম। সেদিন বিকেলে সে হঠাৎ রুমে এসে আমাকে বললো, “এক থেকে বারোর মধ্যে যে কোন একটি সংখ্যা বলো।“

“নয়।“

“যে কোনো একটা সব্‌জির নাম বলো।“

“আলু।“

“তুমি একটা জটিল মানুষ। সরল মানুষেরা সাত আর গাজর বলে।“

এ ধরনের আপাত-মনস্তাত্ত্বিক প্রশ্ন আমরা কত শুনেছি আগে। সংখ্যা – সাত, ফুল – গোলাপ ইত্যাদি। ইভন কী কারণে আমার মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা নিলো তা জানতে চাইনি। এরপর থেকে দেখা হলেই ইভন অনেক কথা বলে।

ইভনকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হচ্ছে আজ ক্যাম্পাসে?”

“ডিসকভারি ডে। স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য ইউনিভার্সিটিতে কী কী সাবজেক্ট পড়ানো হয়, ভর্তি হতে গেলে কী কী সাবজেক্ট লাগে ইত্যাদি দেখানোর জন্য।“

মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। স্কুলের ছেলেমেয়েরা ইউনিভার্সিটির ভর্তি নিয়ে এখন কী কারণে মাথা ঘামাবে? তাছাড়া ইউনিভার্সিটি তো হবে রহস্যময় জায়গা। সেখানে কী হয় – তা তারা জানবে কেন? কিন্তু আমরা যেভাবে দেখেছি – সেভাবে তো এখানে হয় না। ইভনের কাছ থেকে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেল।

অস্ট্রেলিয়ায় স্কুল পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থা রাজ্যসরকারের অধীনে। অস্ট্রেলিয়ার ছয়টি রাজ্য আর দুইটি টেরিটরির শিক্ষাব্যবস্থা আলাদা-আলাদা। সিলেবাস এবং সাবজেক্টে মিল এবং অমিল দুটোই আছে। বারো বছর স্কুল-শিক্ষার পর রাজ্যজুড়ে একটি পরীক্ষা হয় – যেটা আমাদের দেশের উচ্চ মাধ্যমিকের সমতুল্য। এখানে অর্থাৎ ভিক্টোরিয়া রাজ্যে এই পরীক্ষার নাম ভিক্টোরিয়া সার্টিফিকেট অব এডুকেশন বা ভিসিই। নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যে ওটার নাম আমাদের মতোই – এইচএসসি। এই পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়।

ইভন কিছুক্ষণ বকবক করার পর চলে গেল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে। একটু রোদের আভাসও দেখা যাচ্ছে। তবে এই রোদে কোন উত্তাপ নেই। কিন্তু বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে তাতেই আমি খুশি। বাইরে বের হলাম।

এখানে রাস্তাঘাট এত ঝকঝকে পরিষ্কার রাখে কীভাবে সেটা যতটুকু আশ্চর্যের, তার চেয়েও অবাক হচ্ছি ক্যাম্পাসের এতগুলি বিল্ডিং-এর সবগুলি ভেতরে-বাইরে এত ঝকঝকে কীভাবে আছে! কোথাও কোন দেয়ালে কোন স্লোগান লেখা নেই। এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ছাত্ররাজনীতি নেই? কোন পার্টি নেই? কোনো মিছিল-মিটিং-সমাবেশ কিছুই দেখছি না ক্যাম্পাসে। অথচ বিশাল তিনতলা ভবন আছে – স্টুডেন্ট ইউনিয়ন হাউজ।

স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সর্বশেষ যে অভিজ্ঞতা আমার আছে সেটা চাকসু – চিটাগং ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন। এখানেও আছে উমসু – ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন স্টুডেন্ট ইউনিয়ন। ইউনিয়ন হাউজের দেয়ালে দেখলাম জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে – বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্য। ইউনিয়নের নির্বাচন হয় প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে। তার মানে সামনের মাসে নির্বাচন – অথচ কোন উত্তেজনা নেই কোথাও। ছাত্র হিসেবে আমারো তো ভোটাধিকার আছে এখানে। কিন্তু এখনো তো কেউ ভোট চাইতে এলো না। এখানে ভোট চায় কীভাবে? কীভাবে চলে নির্বাচনী প্রচারণা? মাথায় কত প্রশ্ন আসে দিচ্ছে না কেউ জবাব তার – অবস্থা আমার।

লাঞ্চটাইম – ইউনিয়ন হাউজ গমগম করছে। নিচের তলায় বিশাল এক ফুডকোর্ট – অনেকগুলি খাবারের দোকান। চায়নিজ, মালয়শিয়ান, মেক্সিকান, ইন্ডিয়ান – কতো রকমের কতো দেশের যে খাবার। সবগুলি আউটলেটের সামনে লম্বা লাইন। বেশিরভাগই স্কুলের ছেলে-মেয়েরা, সাথে তাদের মা-বাবা।

বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে চলে তা দেখার সবচেয়ে বড় সুযোগ এই ডিসকভারি ডে-তে। নামটা যথার্থ হয়েছে। আজকেই আবিষ্কার করা যাবে কোথায় কী হচ্ছে এখানে।

স্কুল পাস করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য দরখাস্তের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয় সরকারিভাবে। ভিক্টোরিয়ান টারিশিয়ারি এডমিশান সেন্টার বা ভিট্যাক রাজ্যের সবগুলি স্কুলে ভর্তির দরখাস্তের ফরম পূরণ করার জন্য যা যা লাগে সব ব্যবস্থা করে দেয়। ভিসিই বা এইচএসসি পরীক্ষা হবার আগেই পছন্দমতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অপশন দিয়ে ভর্তির দরখাস্ত পাঠিয়ে দিতে হয়। একজন শিক্ষার্থী পছন্দের ক্রমানুসারে অনেকগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের চয়েজ দিতে পারে। এখন কে কী পড়তে চায়, কেন পড়তে চায়, কোথায় পড়বে, কোন্‌ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন্‌ বিভাগে কী কী সুবিধা এসব না জেনে অপশন দেবে কীভাবে? সেজন্যই এসব জানানোর ব্যবস্থা হলো ডিসকভারি ডে।

রাজ্যের সবগুলি বিশ্ববিদ্যালয় আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে রবিবারগুলিতে এই আয়োজন করে। এমনভাবে তারিখ ঠিক করা হয় যেন একদিনে একাধিক বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসকভারি ডে না পড়ে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের চোখে দেখে যায় তাদের ভালো লাগা, ভালো না লাগা। কোন্‌ সাবজেক্টে ভর্তি হতে গেলে কেমন রেজাল্ট করতে হয়, কী কী সাবজেক্ট নিতে হয়। পাস করার পর কোথায় কোথায় চাকরির সুযোগ পেতে পারে, কিংবা আরো উচ্চতর শিক্ষা নেবার কী কী সুযোগ আছে – সব তথ্য তারা সরাসরি একদিনেই পেয়ে যায়।

পরীক্ষার আগে ভর্তির দরখাস্ত পূরণ করার পর – পরীক্ষা শেষ হলে পছন্দের ক্রম পরিবর্তন করার একটি সুযোগ দেয়া হয় – যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের পরীক্ষার সম্ভাব্য ফলাফল বিবেচনা করে পছন্দের ক্রম পরিবর্তন করতে পারে। এরপর এইচএসসির রেজাল্ট বের হলে সেই রেজাল্ট সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও চলে যায়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি দরখাস্ত এবং রেজাল্টের ভিত্তিতে অফার লেটার পাঠায় শিক্ষার্থীদের কাছে। যারা ভালো তারা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার পায়। তখন তারা বেছে নেয় – কোথায় ভর্তি হবে।

পুরো ব্যাপারটা আমার জন্যও ভীষণ নতুন। আমিও ঘুরতে লাগলাম এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিং-এ, এক ডিপার্টমেন্ট থেকে অন্য ডিপার্টমেন্টে। মেডিসিন ফ্যাকাল্টিতে ভীড় সবচেয়ে বেশি। এমনিতেই মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি র‍্যাংকিং-এর দিক থেকে  অস্ট্রেলিয়ার এক নম্বর। এবছর ১৯৯৮ সালে সামগ্রিকভাবে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিং ১৯। মেডিসিনে এই র‍্যাংক আরো সামনের দিকে। এখানে ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন তাই অনেকের। ভিসিইতে র‍্যাংক শতকরা নিরানব্বই এর উপরে না থাকলে মেডিসিনে ভর্তি হওয়া প্রায় অসম্ভব। মেডিসিনে বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এনাটমি মিউজিয়ামে শরীরের অলিগলি দেখে এলাম। ফিজিওলজিতে দেখলাম ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে শরীরের এক একটি কোষের গঠন এবং তাতে অনুজীব কীভাবে আক্রমণ করে। ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টিতে গেলাম। এদেশে মাঝারি মানের রেজাল্ট নিয়েও ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হওয়া যায় জেনে আমার আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা। কমার্সে ভর্তি হতে যত নম্বর লাগে, তার চেয়েও কম নম্বর লাগে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হতে।

উইলসন হলে প্রফেশনাল ইনফরমেশান দেয়ার জন্য অনেকগুলি সরকারি এবং বহুজাতিক নিয়োগ সংস্থার কর্মকর্তারা এসেছেন দরকারি তথ্য দিতে। আগামী বছরগুলিতে দেশের চাকরির বাজার কেমন হবে, কোম্পানিগুলি কোন্‌ কোন্‌ পোস্টে লোক নেবে, নিয়োগের জন্য কী কী বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে ইত্যাদি বলে দিচ্ছেন যারা ভবিষ্যতে পাস করে বের হবে তাদেরকে। এবছর যারা ক্লাস ইলেভেনে আছে, দুবছর পর তারা ইউনিভার্সিটিতে আসবে। পাস করে বের হতে আরো তিন-চার বছর। অর্থাৎ আগামী পাঁচ-ছয় বছর পর কোন্‌ কোন্‌ পেশার চাহিদা বাড়বে, কতজন লোক দরকার হবে, কী কী স্কিল দরকার হবে – সব তথ্য আগেভাগে জানা থাকলে পাস করার পর কাউকেই তো বেকার থাকতে হবে না। শুনলাম, যে সাবজেক্টের কোন চাহিদা থাকে না, ইউনিভার্সিটিগুলি নাকি সেই সব সাবজেক্ট বন্ধ করে দেয়।


বিশ্ববীণা বাজে যেথায় - ২

 


দক্ষিণ গোলার্ধে এক মাস কেটে গেলো। আক্ষরিক অর্থেই খুব ঠান্ডাভাবে দিন কাটছে এই নতুন দেশে এসে। আগস্ট মাসের এই সময়ে বাংলাদেশে শ্রাবণ-ভাদ্রের তালপাকা গরম। আর এখানে হাঁড়কাঁপানো শীত। তার উপর গোমড়ামুখো আকাশ থেকে যখন-তখন বৃষ্টি ঝরছে। তবে এই বৃষ্টিকে কিছুতেই ‘ঝরঝর বরিষে বারিধারা’ বলা যাবে না। বাংলাদেশের বৃষ্টির সৌন্দর্য এখানে নেই।

জুন জুলাই আগস্ট – এই তিন মাস এখানে অফিসিয়াল উইন্টার। অনেকে বলে মেলবোর্নে নাকি সারাবছরই উইন্টার থেকে যায় – কোনো না কোনোভাবে। বাংলাদেশে শীতের যে আলাদা একটা আরাম আছে – এখানে সেই আরাম নেই। অবশ্য তাসের দেশ-এ রবিঠাকুর আরামের অভ্যাসকে তুলোধোনা করেছেন। বলেছেন ‘ব্যাঙের আরাম এঁদো কুয়োর মধ্যে।‘ কুয়োর ব্যাঙ হয়ে মোটামুটি আরামেই তো ছিলাম। কিন্তু সেই আরাম ত্যাগ করে যখন নতুন দেশে এসেই পড়েছি – তখন আর আগের আরাম আশা করি কীভাবে। তাসের দেশের রাজপুত্রের মতো আমিও যদি আশা করতে পারতাম -

“অচিন মনের ভাষা,
শোনাবে অপূর্ব কোন্‌ আশা,
বোনাবে রঙিন সুতোয় দুঃখসুখের জাল,
বাজবে প্রাণে নতুন গানের তাল,
নতুন বেদনায় ফিরব কেঁদে হেসে।“

কিন্তু মনের ভাষা বোঝা তো দূরের কথা, মুখের ভাষাই বুঝতে পারছি না এদের। মুখের মধ্যে মার্বেল নিয়ে কথা বললে যেরকম শোনায় এদের উচ্চারণ আমার কাছে সেরকমই মনে হয়। পরিচিত শব্দগুলিও কেমন যেন অদ্ভুত লাগে। “হোয়াডিউ ডু টু-ডাই” শুনে মনে হয়েছিল – এটা কী ধরনের প্রশ্ন? আমি মরার জন্য কী করি? টুডে যে এখানে টু-ডাই তা আমি কোন ইংরেজিতে পাইনি। “হাউয়াইয়া”  যে ‘হাউ আর ইউ’ তা বুঝতে আমার কয়েক সপ্তাহ লেগেছে। তার উপর আছে ইংরেজি বাগধারা; এরা এত বেশি ব্যবহার করে কথার মধ্যে! সেদিন ম্যান্ডিকে জিজ্ঞেস করছিলাম কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট-আউট কীভাবে নিতে হয়। আমাদের রুমে একটা কম্পিউটার আছে, কিন্তু কোন প্রিন্টার নেই। জবাবে ম্যান্ডি বললো, “হ, ইট্‌স অ্যা পিস অব কেক।“ আমাদের ডিপার্টমেন্টে মাঝে মাঝে কেক-পেস্ট্রি-ডোনাট এসব খাওয়ানো হয়, বিশেষ করে সেমিনারের আগে। আমি ভাবলাম ম্যান্ডি সেরকম কোন কেকের সন্ধান দিচ্ছে আমাকে। আমি সরল মনে জিজ্ঞেস করলাম, “হোয়ার ইজ দ্য কেক?” আমার অবস্থা দেখে ম্যান্ডি হো হো করে হেসে উঠেছিল। তারপর ইংরেজি বাগ্‌ধারা সম্পর্কে কিছুক্ষণ জ্ঞান বিতরণ করলো। শেখার মধ্যে লজ্জা থাকতে নেই – বলা সহজ। কিন্তু লজ্জা ত্যাগ করে যেকোনো শিক্ষা যে কারো কাছে থেকে সহজভাবে নিতে পারার মতো শক্তি অর্জন করা সহজ নয়। ম্যান্ডির সামনে কী যে লজ্জা লাগছিলো আমার। এত লজ্জা সংকোচ নিয়ে কীভাবে আশা করি যে  “বাজবে প্রাণে নতুন গানের তাল?”

রুমের তালা খোলার সময় দেখলাম কেনের অফিস বন্ধ। ইওরোপে গেছেন তিনি। সম্ভবত কোন কনফারেন্সে। আমাদের রুমের আর কেউ এখনো আসেনি। ফিজিক্স বিল্ডিং-এর ছয় তলার এই ৬১২ নম্বর রুমে আমরা চারজন বসি। ম্যান্ডি আর জিনেট পিএইচডি করছে, আমি রিসার্চ মাস্টার্স, আর ইমাজিন অনার্স। রুমের চার কোণায় চারটি ডেস্ক। ভেতরের দেয়াল ঘেঁষে আরেকটা টেবিল, সেখানে বিশাল এক কম্পিউটার। কম্পিউটারের আবার নামও আছে এখানে। এটার নাম হিগ্‌স। হিগ্‌স কী বস্তু এখনো জানি না। এই কম্পিউটারটি নাকি আমাদের গ্রুপের – অর্থাৎ Theory Q  বা কোয়ান্টাম থিওরি গ্রুপের। আমার সুপারভাইজার কেন্‌ অ্যামোস এই গ্রুপের হেড। গ্রুপের আরেকজন প্রফেসর হলেন লেস অ্যালেন। তাঁর সাথে পরিচয় হয়েছে, কিন্তু তাঁর তত্ত্বাবধানে যারা গবেষণা করছে তাদের কারো সাথে এখনো পরিচয় হয়নি। ম্যান্ডি কেনের ছাত্রী। সে হিসেবে আমার সতীর্থ। জিনেট আর ইমাজিন প্রফেসর হলেনবার্গের ছাত্রী। প্রফেসর হলেনবার্গকে এখনো দেখিনি।

যাই হোক, এই কম্পিউটারটি বেশিরভাগ সময় ব্যবহার করেন কেনের পোস্ট-ডক্টরেট ফেলো পিটার ডর্টসম্যান। ছোট-খাট সাইজের লম্বাচুলের এই মানুষটিকে দেখলে আঠারো-উনিশ বছরের ছেলে বলে মনে হয়। কিন্তু তিনি পিএইচডি করেছেন ১৯৯২ সালে। তারপর গত ছয় বছর ধরে পোস্টডক্টরেট ফেলো হিসেবে গবেষণা করছেন কেনের সাথে। অন্যদিন তিনি এতক্ষণে এসে কাজ শুরু করে দেন। আজ আসেননি। তিনিও কেনের সাথে ইওরোপে গেছেন কিনা জানি না।

এই রুমের কম্পিউটারটা আমি দিনের বেলায় ব্যবহার করি না। চার তলার কম্পিউটার রুমে তিরিশটা কম্পিউটার আছে ফিজিক্সের গবেষকদের ব্যবহারের জন্য। সেখানেই চলে যাই যখন সময় পাই। আজ রুমে কেউ নেই বলে হিগ্‌স কম্পিউটারে লগ ইন করলাম। এই কম্পিউটারের মাথামুন্ডু এখনো কিছুই ঠিকমতো বুঝি না। বই দেখে দেখে কমান্ড দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে এগোতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে আমার কম্পিউটার ব্যবহারের ইতিহাস বিবেচনা করলে আমাকে কম্পিউটার-নিরক্ষর বলা চলে। সেই ইতিহাস খুবই সংক্ষিপ্ত। আমার বন্ধু দেবাশিস আর মহিউদ্দিন কম্পিউটার শেখানোর স্কুল খুলে ফেলেছিল আমি অনার্স পাস করার আগেই। যীশু, প্রদীপ, অজিত – এরা কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখেছে অনার্স পরীক্ষা দিয়ে। কিন্তু আমি কোন আগ্রহই দেখাইনি। মাস্টার্সের থিসিস করার সময় ‘ওয়ার্ড পারফেক্ট’ শিখেছিলাম দেবাশিস আর মহিউদ্দিনের স্কুলে। তখনো মাউস আসেনি সেখানে। কমান্ড মোডে ছোট্ট চৌদ্দ ইঞ্চি স্ক্রিনে টাইপ করতে শিখেছিলাম। কয়েক বছরের মধ্যেই সব ভুলেও গিয়েছি। ততদিনে আমার আরেক বন্ধু অঞ্জন কম্পিউটার কোম্পানিতে জয়েন করে কিছুদিন পর ইনফরমেশান টেকনোলজির ম্যানেজার হয়ে গিয়েছে। নিজেই একটা কম্পিউটার কোম্পানি খুলেছে মোমিন রোডে। আমি সেখানে গিয়ে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে পাঠানোর জন্য ই-মেইল টাইপ করতাম ওয়ার্ড পারফেক্টের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে। এখানে আসার আগে অঞ্জন আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে কীভাবে ইমেইল করতে হয়। মোমিন রোডের মাথার বইয়ের দোকান কথাকলি থেকে “ইমেইল করার নিয়মকানুন” নামে বাংলায় লেখা একটি বইও কিনে নিয়ে এসেছি। কিন্তু সেই বই কিংবা পূর্বজ্ঞানের কিছুই এখানে কাজে লাগাতে পারছি না। কারণ এখানকার কম্পিউটারগুলির অপারেটিং সিস্টেম আমি আগে কখনো দেখিনি। এখানে মাউস আছে। কিন্তু সামান্য পরিচয় ছিল যে উইন্ডোজের সাথে – আমার নাগালের মধ্যে যে ক’টা কম্পিউটার আছে তাদের কোনটাতেই উইন্ডোজ নেই। ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেম সবগুলিতে। এই অপারেটিং সিস্টেম নাকি ফ্রি। বাংলাদেশে সবাই উইন্ডোজ ব্যবহার করে শুনে সেদিন জিনেট প্রশ্ন করেছিল, “ফ্রি ও-এস ব্যবহার করে না! বাংলাদেশ কি অনেক ধনী দেশ নাকি?” আমি কোন উত্তর দিইনি। কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম কী জিনিস সেটাই তো জানি না এখনো।

“হেই প্রাডিব, ডু ইউ নো হোয়ার ইজ কেন্‌ টুডাই?”

ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম ম্যান্ডি রুমে ঢুকে বৃষ্টি-ভেজা টকটকে লাল জ্যাকেট খুলে চেয়ারে ঝুলিয়ে রাখছে। কেন্‌ যে ইওরোপে গেছেন তা সম্ভবত ম্যান্ডি জানে না। ইংরেজি বাক্য গঠন করতে আমার অনেক সময় লাগে। প্রক্রিয়াটি এখনো অনেক দীর্ঘ আমার কাছে। ইংরেজি প্রশ্ন শুনে মনে মনে সেটার বাংলা অনুবাদ করার পর বুঝতে পারি। তারপর বাংলায় তার উত্তর তৈরি করে সেই উত্তরের ইংরেজি অনুবাদ করার পর তা উচ্চারণ করতে করতে অনেক দেরি হয়ে যায়। ততক্ষণে শ্রোতার মনযোগ অন্যদিকে চলে যেতে পারে। কিন্তু আজ দেখলাম ম্যান্ডি অপেক্ষা করছে আমার উত্তরের জন্য। জ্যাকেটের পর এখন সে সোয়েটারটাও খুলতে শুরু করেছে। ইউনিভার্সিটির সবগুলো বিল্ডিং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বলে রুমের ভেতর সোয়েটার-জ্যাকেট ছাড়াও থাকা যায়। আমি যে বাসায় থাকি – সেখানে রুম হিটিং-এর কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে কনকনে ঠান্ডায় কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে থাকতে হয়। সেই তুলনায় ইউনিভার্সিটিতে অনেক আরাম। তাই যতক্ষণ পারি আমি ইউনিভার্সিটিতেই থাকি। কিন্তু এখানেও আমাকে জ্যাকেট পরে থাকতে হচ্ছে সারাক্ষণ। ম্যান্ডি যেরকম ভারী জ্যাকেট পরে এসেছে আমার জ্যাকেট সেরকম নয়। অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় হকার্স মার্কেট থেকে যে সেকেন্ড হ্যান্ড জ্যাকেট কিনেছিলাম – আট বছর পরেও সেটা আমাকে উষ্ণতা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এদেশের ছেলে-মেয়েদের মনে হচ্ছে শীতের অনুভূতি কম।

“হোয়াট হ্যাপেন? হোয়ার ইজ কেন্‌?”

ম্যান্ডি দুটো আবরণ খুলে ফেলে এখন পাতলা একটা টি-শার্ট পরে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর আমি তার দিকে নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে আছি। থতমত খেয়ে বললাম, “ইওরোপ, লাস্ট থার্স ডে।“

“লাকি বাস্টার্ড।“

শব্দ প্রয়োগের এই স্বেচ্ছাচারিতা বুঝতেও ঝামেলা হয় আমার। ম্যান্ডি নিশ্চয় কেনের জন্ম পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলছে না এখানে। তবে এখানে বাস্টার্ড বলার অর্থ কী? দরকারই বা কী? ম্যান্ডি এর পর যেসব কথাবার্তা বললো তাতে বোঝা গেল – কেন্‌ প্রতি বছর শীতকালে ইওরোপে চলে যান। ওখানে এখন গ্রীষ্মকাল। জার্মানি, ফ্রান্স, হাঙ্গেরিতে তাঁর গবেষক বন্ধুরা আছেন। তাঁদের আতিথ্য গ্রহণ করেন। আর ওখানে যখন শীতকাল থাকে – তখন উনারা এখানে চলে আসেন অস্ট্রেলিয়ান গ্রীষ্ম উপভোগ করার জন্য। ম্যান্ডি কেনের এই সুযোগে ভীষণ ঈর্ষান্বিত। ম্যান্ডিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। শুনে আমারও ঈর্ষা হচ্ছে।

“কেন্‌ যেহেতু নেই, আমার আর এখানে থাকার দরকার নেই। আমি বাসায় চলে যাবো।“ কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার সোয়েটার-জ্যাকেট পরে চলে গেলো ম্যান্ডি। সুপারভাইজার না থাকলে ফাঁকিবাজি তাহলে এরাও করে?

দশটা থেকে প্রফেসর লেস অ্যালেনের স্ক্যাটারিং থিওরির ক্লাসটা করতে হবে। ওটা মূলত অনার্সের কোর্স। এখানকার অনার্সের সাথে আমাদের অনার্সের পার্থক্য আছে। আমরা তো ফার্স্ট ইয়ার থেকেই অনার্সের ছাত্র। কিন্তু এখানে তিন বছর পড়ে বিএসসি পাস করার পর এক বছরে অনার্স কোর্সে ভর্তি হতে হয়। বিএসসিতে কমপক্ষে শতকরা পঁচাত্তর ভাগ নম্বর পেতে হয় অনার্সে ভর্তি হবার জন্য। এক বছরের অনার্স কোর্সের প্রথম সেমিস্টার কোর্সওয়ার্ক। চারটি কোর্স নিতে হয়। পরের সেমিস্টার থিসিস। অনার্স পাস করার পর সরাসরি পিএইচডি-তে ভর্তি হওয়া যায়। অনার্সে শতকরা আশি ভাগ নম্বর পেলে ফার্স্ট ক্লাস। ফার্স্ট ক্লাস অনার্স থাকলে পিএইচডি করার জন্য স্কলারশিপ পাওয়া যায়। এদেশের ছেলেমেয়েদের জন্য রিসার্চ-ডিগ্রি সম্পূর্ণ ফ্রি। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা যেখানে বছরে সতেরো-আঠারো হাজার ডলার টিউশন ফি দিয়ে পড়ছে, সেখানে এদেশের ছেলেমেয়েদের জন্য তা সম্পূর্ণ ফ্রি। তবুও নাকি এদেশের ছেলেমেয়েরা পিএইচডি করতে আগ্রহী হয় না তেমন। তা অবশ্য দেখতেই পাচ্ছি। এবার ফিজিক্সে অনার্স করছে বিশ জনেরও কম। স্ক্যাটারিং থিওরি ক্লাসে আছে মাত্র সাত জন। আমিসহ আট জন হয়েছি।

লেস অ্যালেনের ক্লাস করতে গিয়ে আবার নতুন করে বুঝতে পারলাম যে অনার্স-মাস্টার্সে কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়ার পরেও আমি তার কলকব্জা কিছুই বুঝতে পারিনি। অথচ এই বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলি জটিল সমীকরণের সবকিছুই বুঝে।

ক্লাসে যে সাত-জন আছে সবার বয়সই একুশ-বাইশের মধ্যে। এরা আঠারো বছরে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়, একুশে গ্রাজুয়েট, বাইশে অনার্স, পঁচিশ-ছাব্বিশে পিএইচডি কমপ্লিট করে ফেলে যারা করতে চায়। তবে বেশিরভাগই স্নাতক পাস করেই চাকরিতে ঢুকে যায়। একুশ-বাইশ বছরের তরুণ-তরুণীদের মাঝে একত্রিশ বছরের নিজেকে খুবই বুড়ো মনে হয়। তবে লেখাপড়ার জন্য বয়সের যে কোন বাধা এদেশে নেই তা নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। ফার্স্ট ইয়ার ফিজিক্সের ল্যাব-ক্লাস নিচ্ছি আমি এই সেমিস্টারে। সেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের একজন ছেলে আছে যার বয়স পঞ্চাশের কম নয়। আমি আগ্রহ নিয়ে তার সাথে কথা বলেছি। এমবিএ পাস করে কর্পোরেট চাকরি করেছে অনেক বছর। এখন ইচ্ছে হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয়েছে এবছর।

দরজায় টোকার শব্দে দরজার দিকে তাকালাম। ম্যান্ডি রুমের দরজা খোলা রেখেই চলে গিয়েছে। এখন দরজার সামনে বিশাল একটা ফোল্ডার নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর লেস অ্যালেন। 

“লেট্‌স গো টু ক্লাস।“

“ইয়েস স্যার।“

“ওহ্‌ নট অ্যাগেইন। নো স্যার প্লিজ।“

আমাদের দেশে শিক্ষকদের নাম ধরে ডাকার কথা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। আর এখানে আসার এক মাসের মধ্যেই নাম ধরে ডাকার সংস্কৃতি আয়ত্ব হয়ে যাবে? লেসের অফিস এই ফ্লোরের একেবারে অন্য মাথায়। তিনি সেখান থেকে হেঁটে এসে আমাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন ক্লাস করার জন্য। এ কোন্‌ দেশে এলাম?


বিশ্ববীণা বাজে যেথায় - ১

 


আজ সকাল আটটায় ডিপার্টমেন্টে এসে নিজের ডেস্কে বসে পড়াশোনা করার চেষ্টা করছিলাম। এতদিন স্কুল থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত সবপর্যায়েই সর্বোচ্চ ফাঁকিবাজী করেও কোন রকমে পার পেয়ে গিয়েছি। সারাবছর পড়াশোনা না করে পরীক্ষার ডেট দিলে পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন করেছি। গৎবাঁধা কিছু প্রশ্নের উত্তর লাইনের পর লাইন মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে দিয়ে পাস করে ফেলেছি। কিন্তু এখানে তো সে সুযোগ নেই। মুখস্থ করে কি গবেষণা করা যায়? বুঝতে পারছি এখানে ফাঁকিবাজি চলবে না। তাই একটু সিরিয়াস হয়ে পড়তে বসেছি্লাম।

মাইক্রোস্কোপিক অপটিক্যাল থিওরি সম্পর্কে কিছুটা পড়েছিলাম মাস্টার্সের নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে। পড়া মানে স্যার যেভাবে ক্লাসে এসে রয় এন্ড নিগমের নিউক্লিয়ার ফিজিক্স বই থেকে লাইনের পর লাইন বোর্ডে লিখে গেছেন, আমরাও লাইনের পর লাইন মুখস্থ করেছি। কিন্তু শিখিনি কিছুই। এখন মজা বেরোচ্ছে। এই থিওরির ভিত্তিতে লেখা গবেষণাপত্রগুলোর মাথামুন্ড কিছুই বুঝতে পারছি না। লাইব্রেরি থেকে রয় এন্ড নিগমের বইটা নিয়ে এলাম। পুরনো বই দেখলে হয়তো মাথার জট কিছুটা খুলবে। বইয়ের অপটিক্যাল মডেল অধ্যায়ে অনেকবার রেফারেন্স হিসেবে এসেছে কেন্‌ অ্যামোসের নাম। তখন তো এসব রেফারেন্সের দিকে চোখও পড়েনি। নিউক্লিয়ার থিওরির এই বিখ্যাত প্রফেসর কেন্‌ অ্যামোসের কাছে গবেষণা শুরু করেছি ভাবতেই কেমন একটা ভালোলাগা ঘিরে ধরলো আমাকে। মনের ভেতর স্বপ্নের পাখিরা ডানা মেলতে শুরু করলো- ‘একদিন আমিও…’ ঠিক তখুনি মাথার ওপর আলতো ব্যাগের বাড়ি।

“হেই প্রাডিব। ইউ আর স্লিপিং হিয়ার?”

মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চোখ তুলে তাকালাম ম্যান্ডির দিকে। ম্যান্ডি ব্যস্ত হাতে জ্যাকেটের চেইন খুলছে আর খিলখিল করে হাসছে।

“গুড মর্নিং ম্যান্ডি।

“মর্নিং। ডিড ইউ গো হোম লাস্ট নাইট?”

এই মেয়ে কি বিদ্রুপ করছে আমাকে? জানতে চাচ্ছে আমি রাতে এখানে ঘুমিয়েছি কি না? এ জাতীয় প্রশ্নের যুৎসই উত্তর দেবার মত ইংরেজি আমার জানা নেই। কোন রকমে বললাম, “আমি ঘুমাচ্ছিলাম না। পড়ছিলাম।

“আমি জানি। মজা করছিলাম তোমার সাথে। আমি কী ঠিক করেছি জানো? এখন থেকে এই রুমেই বসবো। এটাই আমার ডেস্ক। এতদিন ওদিকে চার নম্বর রুমে বসতাম। ওখানেও আমার একটা ডেস্ক আছে। এখন থেকে এখানে বসবো কেন জানো? মনে হচ্ছে এখানে সময়টা অনেক মজায় কাটবে। তুমি কি মজা করতে পছন্দ করো? পিক্‌ যে চলে যাচ্ছে তুমি জানো? পিকের সাথে পরিচয় হয়েছে না? পিক্‌ মানে পিটার...”

ম্যান্ডির সাথে পরিচয় হয়েছে মাত্র গতকাল। অথচ সে এমন ভাবে কথা বলছে যেন শৈশব থেকেই দেখছে আমাকে। অস্ট্রেলিয়ানরা জাতিগতভাবে বেশ খোলামেলা স্বভাবের। কিন্তু ম্যান্ডি মনে হচ্ছে তার চেয়েও বেশি। এত কথা যে কীভাবে বলে মেয়েটা!

সকাল নটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত ম্যান্ডির বক-বক শুনতে শুনতে কাবুলিওয়ালার মিনির কথা মনে পড়লো। রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা শুরু হয়েছে এভাবে, “আমার পাঁচ বছর বয়সের ছোটো মেয়ে মিনি এক দন্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারে না। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া ভাষা শিক্ষা করিতে সে কেবল একটি বৎসর কাল ব্যয় করিয়াছিল, তাহার পর হইতে যতক্ষণ সে জাগিয়া থাকে এক মুহূর্ত মৌনভাবে নষ্ট করে না। মিনির আদলে ম্যান্ডিকে নিয়েও লেখা যায়- “আমার পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সের সহপাঠিনী ম্যান্ডি এক দন্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারে না। আমার সহিত পরিচয় হইবার পর একটা মাত্র দিন অতিবাহিত হইয়াছে। এর পর হইতে যতক্ষণ সে আমার ডেস্কের পাশে কম্পিউটারের সামনে বসিয়াছে, এক মুহূর্ত মৌনভাবে নষ্ট করে নাই।    

ম্যান্ডি কম্পিউটার দখল করে বসে আছে দেখে পিটার এসে ‘হাই ম্যান্ডি, হাই প্রাডিব বলে একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে চলে গেছেন। আমি ভেবেছিলাম পিটারকে দেখে ম্যান্ডি কম্পিউটার ছেড়ে উঠে যাবে। আমি হলে তাই করতাম। কিন্তু ম্যান্ডি পিটারকে পাত্তাই দিলো না। কম্পিউটারের পর্দায় চোখ রেখে অনবরত কথা বলেই চলেছে। 

কোন কাজ সে আসলে করছে না। ইন্টারনেটে কিছুক্ষণ সাজ-পোশাক দেখেছে। এখন ওয়ার্ল্ড জিওগ্রাফি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করছে। 

“হেই প্রাডিব, ইউ আর ফ্রম ব্যাঙলাড্যাশ- রাইট?”

“ইট্‌স বাংলাদেশ ম্যান্ডি। বাং-লা-দে-শ। নট ব্যাঙলাড্যাশ। বাংলা ইজ আওয়ার ল্যাংগুয়েজ এন্ড কালচার, দেশ মিন্‌স কান্ট্রি।

ম্যান্ডিকে বাংলাদেশ সম্পর্কে জ্ঞান দিতে গিয়ে এই শীতের সকালেও ঘাম বের হয়ে যাবার জোগাড়। আমার ইংরেজি শব্দের ভান্ডার যে এত ছোট আগে বুঝতে পারিনি।

ম্যান্ডি ইন্টারনেটে বাংলাদেশ সম্পর্কিত অনেক তথ্য বের করে পড়তে শুরু করেছে আর একটু পর পর আমাকে জিজ্ঞেস করছে-বাংলাদেশের কোথায় বাড়ি তোমাদের? চিটাগং শব্দের অর্থ কী? এত ছোট একটা দেশে তোমরা এত বেশি মানুষ কীভাবে থাকো?

তার প্রশ্নের উত্তরে “যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় নয় জন জাতীয় কিছু একটা বলতে পারতাম। কিন্তু তেঁতুলের ইংরেজি জানা না থাকায় কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।

“আই নিড এ কাপ অব কফি। ডু ইউ ওয়ান্ট?”

“থ্যাংক ইউ ম্যান্ডি।

“ইয়েস থ্যাংক ইউ, অর নো থ্যাংক ইউ?”

“নো থ্যাংক ইউ।

“ওকেই

কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেলো ম্যান্ডি। সে কি একটু মনক্ষুন্ন হলো?  সুন্দরী মেয়েরা নাকি কোন প্রস্তাবেই ‘না শুনতে অভ্যস্ত নয়।

পৌনে এগারোটায় পিটার এসে দাঁড়ালেন রুমের সামনে। কেনের কলোকুইয়াম এগারোটায়। পিটার বললেন, “তুমি কি জানো যে কলোকুইয়ামের আগে ফ্রি খাবারের ব্যবস্থা আছে?”

“তাই নাকি? কোথায়?”

“চলো। উপরের স্টাফ রুমে।

কেন্‌ও বেরোলেন একই সময়ে। সাত তলায় উঠে হেড অব দি স্কুলের অফিসের সামনে স্টাফ রুম। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার মিকি দেখিয়েছিলেন সেদিন। এর মধ্যেই ভীড় জমে গেছে সেখানে। টেবিলে রাখা ডোনাটের উপর প্রায় হামলে পড়ছে সবাই। আমি কেন্‌ আর পিটারের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। বাকি সব মুখ এখনো অপরিচিত।

“গুডাকেন্‌, হোয়াট ইয়া টাকিন টু ডাই?”

প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হলাম। চোখে পুরু চশমা, মাথায় ধবধবে সাদা চুল, বাচ্চাদের মত মুখ, পরনে হাফ-শার্ট আর হাফ-প্যান্ট। প্যান্ট-টা কাঁধের সাথে বেল্ট দিয়ে আটকানো। কেনের একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বুঝতে চেষ্টা করছি তিনি কেন্‌কে কী জিজ্ঞেস করলেন। ‘টু ডাই’ কথাটা প্রায়ই শোনা যায় এখানে। সবাই শুধু শুধু মৃত্যুর কথা বলবে কেন? নিশ্চয় শুনতে ভুল করছি আমি। দেখি কেন্‌ কী উত্তর দেন।

“হাই জেফ্‌। হাউ থিংস?”

“থিংস আ ফাইন। কান্ট কম্‌প্লাইন। সো হোয়াট ইয়া টাকিন টু ডাই?”

“সাম নিউ স্টাফ, পিটার এন্ড মি ডুয়িং লেইট্‌লি

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রাডিব ইজ স্টার্টিং সুন। প্রাডিব, মিট জেফ। এ ভেরি গুড ফ্রেন্ড অব মাইন।“

জেফের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে হঠাৎ পরিষ্কার হয়ে গেলো ‘টু-ডাইমানে কী। হায়রে অস্ট্রেলিয়ান উচ্চারণ - ‘ডে যদি ‘ডাই হয়ে যায় কীভাবে বুঝবো! ‘হোয়াট ইয়া টাকিন টু ডাই অর্থাৎ ‘হোয়াট ইউ টকিং টুডে?” গতকাল ম্যান্ডি যখন জিজ্ঞেস করেছিল ‘হ্যাভ ইয়া কাম টু-ডাই?’- ভেবেছিলাম ঠাট্টা করে জানতে চাচ্ছে মরতে এসেছি কি না। অথচ সে জিজ্ঞেস করছিলো “আজকে এসেছো?”

এগারোটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে হারকাস থিয়েটারে এসে ঢুকলাম সবার সাথে। একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, ডোনাট খাওয়ার জন্য যারা এসেছিলেন তাদের অনেকেই মাঝপথে হাওয়া হয়ে গেছেন। বিনেপয়সার বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা শোনার আগ্রহের চেয়ে বিনেপয়সার খাবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবুও এখানে এটা আশা করিনি।

কেনের বক্তৃতা শুরু হবার পর বুঝতে পারলাম এরকম খটমটে বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা শোনার আগ্রহ সবার হবার কথা নয়। বিষয়ভিত্তিক কোন পূর্ব-ধারণা ছাড়া এ ধরনের বক্তৃতা বোঝা সম্ভব নয়। নিউক্লিয়ার থিওরি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা সত্ত্বেও আমি তেমন কিছুই বুঝতে পারলাম না। বক্তৃতা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বটা মূল বক্তৃতার চেয়েও আকর্ষণীয়। প্রশ্ন করার জন্যও একটা ন্যূনতম জ্ঞান দরকার হয়। আমি জানি না আমার সে পরিমাণ জ্ঞানার্জন কবে হবে বা আদৌ হবে কি না।

লাঞ্চের সময় স্টুডেন্ট সাপোর্ট সেন্টারে গিয়ে পার্ট-টাইম জবের বিজ্ঞপ্তিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম। বেশ ভীড় এখানে। আমার মত সবারই চাকরি দরকার। বাংলাদেশে ছাত্রাবস্থায় পার্ট-টাইম চাকরি বলতে টিউশনিই বুঝতাম। এখানে মনে হয় টিউশনি ব্যাপারটাই নেই। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতেই কি সবকিছু পড়িয়ে দেয়া হয়? গৃহশিক্ষক লাগে না এদেশে?

বেবি সিটারের চাহিদা মনে হচ্ছে অনেক বেশি। কয়েকজন সম্ভাব্য চাকরিদাতার ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর লিখে নিয়ে এলাম। রুমে যখন কেউ থাকবে না তখন ফোন করতে হবে। কারো সামনে ফোন করতে গেলে সংকোচে গলা দিয়ে শব্দ বেরোবে না। ম্যান্ডির সামনে তো নয়ই।

বলা হয়েছে বিকেল পাঁচটার পর ফোন করতে। পাঁচটা বাজার অনেক আগেই রুম খালি হয়ে গেছে। ম্যান্ডি চলে গেছে আমি লাইব্রেরি থেকে ফিরে আসার একটু পরে। কেন্‌ চলে গেছেন পৌনে পাঁচটার দিকে। যাবার সময় আমার রুমে উঁকি দিয়ে ‘গুড নাইট’ বলে গেছেন। যদিও বাইরে দিনের আলো নিভে গেছে, তবুও বিকেল পৌনে পাঁচটায় কি শুভরাত্রি বলা চলে? কিন্তু না বলেও তো উপায় নেই। ইংরেজির নিয়মে বিদায়ের সময় তো আর গুভ ইভনিং বা শুভসন্ধ্যা বলা যায় না।

পাঁচটা বাজার কিছুক্ষণ পর রুমের দরজা বন্ধ করে টেলিফোন নিয়ে বসলাম। খাতায় যেভাবে লিখে এনেছি সে অর্ডারেই ফোন করা শুরু করলাম। প্রথমটা ডেফ্‌নি জোন্‌স।

“হ্যালো, মে আই স্পিক টু ডেফ্‌নি জোন্‌স প্লিজ

“স্পিকিং। হু ইজ ইট?”

বললাম, “ম্যাডাম, বেবি সিটারের বিজ্ঞপ্তি দেখে ফোন করছি।

ও প্রান্তে কিছুক্ষণ কোন সাড়াশব্দ নেই।

“ম্যাডাম, হ্যালো, হ্যালো, ম্যাডাম।

“সরি, দি পজিশান ইজ নো লংগার এভয়েলেভল।

কী সুন্দর কথা। চাকরিটি এখন আর খালি নেই। মানে হলো আমাকে পছন্দ হয়নি ম্যাডাম ডেফ্‌নি জোন্‌সের। নো প্রোবলেম। দ্বিতীয় নম্বরে ডায়াল করলাম।

“হ্যালো, আই এম কলিং এবাউট দি বেবি সিটার পজিশান। মে আই স্পিক টু নিকি ফার্নান্ডেজ প্লিজ।

“স্পিকিং। হোয়াট্‌স ইওর নেম?”

ভদ্রমহিলার উচ্চারণে ইন্ডিয়ান টান। নিকি ফার্নান্ডেজ কি ভারতীয় নাম? শ্রীলংকানও হতে পারেন। বললাম, “আমার নাম প্রদীপ দেব

“মনে হচ্ছে ঠিক মত শুনতে পাচ্ছি না। আপনিই কি চাকরিপ্রার্থী?”

“হ্যাঁ, আমার বিশেষ অভিজ্ঞতা আছে শিশু-রক্ষণাবেক্ষণ কাজে।কথাটা মিথ্যে নয়। আমার ভাগ্নে-ভাগ্নি-ভাইজি বাবু-রুপু-পূজা তাদের কয়েক ঘন্টা বয়স থেকে শুরু করে এক মাস আগেও আমার তত্ত্বাবধানে থেকেছে কোন না কোন সময়। ছোটবেলায় তারা অবলীলায় প্রাকৃতিক কাজ-কর্ম সেরেছে আমার কোলে, গায়ে, মাথায়। এখানে কাজে লাগবে জানলে আসার সময় দিদি আর বৌদির কাছ থেকে বেবি সিটার হিসেবে অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতার সনদপত্র নিয়ে আসতে পারতাম।

“আপনার নাম প্রদীপ দেব। কিন্তু আপনার গলার স্বর ঠিক মেয়েদের মত লাগছে না। আপনার কি ঠান্ডা লেগেছে?”

“না ম্যাডাম। আমার ঠান্ডা লাগেনি। আমার গলা মেয়েদের মত লাগছে না কারণ আমি মেয়ে নই। আমি পুরুষ।

“কিন্তু এ কাজ তো মেয়েদের।

“ম্যাডাম, বিজ্ঞপ্তিতে তো এরকম কিছু লেখা নেই।

“সরি মিস্টার দেব। আইনগত কারণে বিজ্ঞপ্তিতে অনেক কিছু লেখা যায় না। বেবি সিটিং আসলে মেয়েদের কাজ। আমি একটা ছোট্ট বেবি কেয়ার সেন্টার চালাই। সেখানে একদম বাচ্চা বাচ্চা শিশুদের দেখাশোনা করার কাজ। আমি খুব দুঃখিত মিস্টার দেব।

লাইন কেটে গেলো। বাকি নম্বরে ফোন করার কোন মানে হয় না। বেবি সিটিং মিশন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ‘ফেইলিওর ইজ দি পিলার অব সাকসেস বাক্যটি যদি সত্য হয় তাহলে আমার ভবিষ্যৎ সাফল্যের ভিত্তিতে আরো কয়েকটা পিলার যোগ হলো আজ! যে হারে ব্যর্থ হচ্ছি তাতে তো মনে হচ্ছে কয়েক দিনের মধ্যেই আমার সাফল্যের ক্ষেত্র পিলারময় হয়ে যাবে। কিন্তু শুধুমাত্র পিলার দিয়ে কি বিল্ডিং তৈরি করা যায়?


Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts