মুনীর চৌধুরী
সে কোন যুগে বলে গিয়েছিলেন – মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। দশ বছর হয়ে গেলো হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন। এই দশ
বছর ধরে আমরা যাঁরা বেঁচে আছি, প্রত্যেকেই বদলে গেছি কোনো না কোনোভাবে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতার
কাছে, নির্লজ্জ দুর্নীতিবাজদের কাছে নতজানু হতে হতে আমরা ভূমির সাথে মিশে গিয়েছি। আমাদের
মধ্যে অনেকেই শারীরিকভাবে বেঁচে থাকলেও মানসিকভাবে মরে পচে গেছি। কিন্তু মৃত্যুর দশ
বছর পরেও হুমায়ূন আহমেদ এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। মানুষ আর লেখকের মধ্যে পার্থক্য
এখানেই। লেখকরা মরেন না। আসলে লেখকের মূল পরিচয় তো তাঁর লেখায়, লেখাগুলি বেঁচে থাকে।
লেখার সাথে লেখকও।
বিজ্ঞানে কিছুটা
সাহিত্য থাকতেও পারে, কিন্তু সাহিত্য বিজ্ঞান নয় কিছুতেই। সাহিত্য পুরোপুরি সৃষ্টিশীল
কাজ। সেখানে পুনরাবৃত্তির খুব একটা কদর নেই। আর সাহিত্যের বিচারের ব্যাপারটা মোটেও
বস্তুনিষ্ঠ নয়। বিজ্ঞানে যেটা ভুল – সেটা সবার কাছেই ভুল। কিন্তু সাহিত্যে ভুল বলে
কিছু নেই। ভালোমন্দ লাগার ব্যাপারটাও পাঠকের নিজস্ব ব্যাপার। সাহিত্যের যে বই একেবারে
অ্যাকাদেমি পুরষ্কার পেয়ে আকাশে উঠে গেছে, সেই বইও অনেক পাঠকের কাছে তীব্র বিবমিষাময়
মনে হতে পারে। অনেক পাঠকের যে বই ভালো লাগে, সেই বই পাঠকপ্রিয় হয়, সেই লেখক প্রিয় লেখক
হয়ে উঠেন। সেখানে যখন দেখা যায় একজন লেখক, আরেকজন লেখককে বলছেন – খারাপ লেখক – প্রশ্ন
জাগে – ভালো-খারাপ মাপার মাপকাঠিটি কী ভাই? হুমায়ূন আজাদ হুমায়ূন আহমেদকে “অপন্যাসিক”
বলতেন। ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে তা তিনি বলতেই পারেন। তার অর্থ এই নয় যে হুমায়ূন
আজাদ হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে ভালো লেখক। কার কোন্ লেখককে ভালো লাগবে তার তো কোন নিয়ম
নেই। ভালো লাগার স্বাধীনতা সবার আছে। যে লেখা পড়ে আনন্দ পাওয়া যায় – সেই লেখা যদি মানুষ
পড়ে – লেখককে যদি মাথায় তুলে রাখতে চায়, তাহলে দোষের কী আছে? হুমায়ূন আহমেদকে বাংলাদেশের
বেশিরভাগ পাঠক মাথায় তুলে রেখেছেন। মৃত্যুর দশ বছর পরেও তাঁর অবস্থান সেখানেই।
তাঁর প্রথম
প্রকাশিত উপন্যাস নন্দিত নরক প্রকাশিত হয়েছিল ডক্টর আহমদ শরীফের লেখা ভূমিকাসহ। সেই
১৯৭২ সালে আর কোন উপন্যাসে এরকম অন্য বিখ্যাত মানুষের ভূমিকা প্রকাশিত হয়েছিল আমার
জানা নেই। ডক্টর আহমদ শরীফ সেই ভূমিকায় লিখেছিলেন, “মাসিক মুখপত্রের প্রথম বর্ষের তৃতীয়
সংখ্যায় গল্পের নাম ‘নন্দিত নরকে’ দেখেই আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কেননা ঐ নামের মধ্যেই যেন
একটি নতুন জীবনদৃষ্টি, একটি অভিনব রুচি, চেতনার একটি নতুন আকাশ উঁকি দিচ্ছিল। লেখক
তো বটেই, তাঁর নামটিও ছিল আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত। তবু পড়তে শুরু করলাম ঐ নামের মোহেই।
পড়ে আমি অভিভূত হলাম। গল্পে সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছি একজন সূক্ষ্মদর্শী শিল্পীর, একজন
কুশলী স্রষ্টার পাকা হাত। বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে এক সুনিপুণ শিল্পীর, এক দক্ষ রূপকারের,
এক প্রজ্ঞাবান দ্রষ্টার জন্মলগ্ন যে অনুভব করলাম।“ বাংলা সাহিত্যে যে বিপুল সম্ভাবনা
নিয়ে শুরু করেছিলেন শিল্পী হুমায়ূন আহমেদ, পরবর্তী চল্লিশ বছর ধরে তিনি বাংলাদেশের
গল্প-উপন্যাস-নাটকে ফসলের বান বইয়ে দিয়েছিলেন।
নন্দিত নরকে
পড়ে সাহিত্যিক আবুল ফজল লিখেছিলেন, “লেখকের যেন কোন বক্তব্য নেই, কোন দৃষ্টিকোণ নেই,
আশ্চর্য এক নির্লিপ্তির সাথে তুমি তোমার গল্প বলে গেছ। গল্প বলা তো নয়, এ যেন ছবি আঁকা।
যাতে একটি রেখাও অযথা টানা হয়নি। আমাকে সবচে বিস্মিত করেছে তোমার পরিমিতিবোধ আর সংযম।
এত অল্প বয়সে রচনায় এমন সংযম খুব কম দেখা যায়। তোমার লেখনী জয়যুক্ত হোক।“ হুমায়ূন আহমেদের
লেখনী যেভাবে জয়যুক্ত হয়েছে, বাংলাদেশের সাহিত্যে অন্য কোন লেখকের ক্ষেত্রে ততটা ঘটেনি।
হুমায়ূন আহমেদ
এর লেখার সমালোচনা করতে গিয়ে প্রায়ই দেখা যায় – ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে সমালোচনা
শুরু হয়। ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদের জীবনযাপন, বিশ্বাস, প্রেম-ভালোবাসা-বিবাহ এসব নিয়ে
কথা বলা যাবে না তা নয়। অবশ্যই যাবে। জনপ্রিয় মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ব্যক্তিগত গন্ডির
বাইরে চলে আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার ভিত্তিতে তাঁর লেখার বিচার করা অবিচারেরই
নামান্তর। আর একজন লেখকের সব লেখাই সবার ভালো লাগবে – সেটা আশা করাও কোন কাজের কথা
নয়।
নন্দিত নরকে
শেষ হয়েছে এভাবে - “ভোর হয়ে আসছে। দেখলাম চাঁদ ডুবে গেছে। বিস্তীর্ণ মাঠের উপরে চাদরের
মতো পড়ে থাকা ম্লান জ্যোৎস্নাটা আর নেই।“ ওখান থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের
সাহিত্যের ভুবন।
No comments:
Post a Comment