স্কুলের বাংলা
দ্বিতীয় পত্রে আমাদের কত রকমের ভাব যে সম্প্রসারণ করতে হতো মনে আছে তোমার? কঠিন জমাট
ভাবকে টেনে টেনে লম্বা করার নামই ছিল ভাবসম্প্রসারণ। টান দিলেই রাবার সম্প্রসারিত হয়,
তাপ দিলে বস্তু। কিন্তু ভাব সম্প্রসারিত হয় কীভাবে? ওটা নিয়ে অনেক তর্ক করতাম আমরা
এক সময়। তুমি বলতে মনের ভাব সম্প্রসারণের জন্য দরকার মনের টান। কিন্তু সে যে ভাবের
চেয়েও কঠিন। তাই কার ভাব কে সম্প্রসারণ করে! আমার হরলাল রায়ের বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা
বই ছিল। সেখান থেকেই হুবহু খেয়ে নিয়ে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে আসতাম। মনে আছে, সেই
যে – ‘তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী, কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায়
তবে মানুষ’? এই জটিল কথাগুলি কে লিখেছিলেন সেই সময় সেই প্রশ্ন মনেও আসেনি। চেনা জায়গা,
চেনা মানুষ আর এতগুলি বছর ফেলে আসার পর এতদিনে রবীন্দ্র রচনাবলিতে পেলাম এই কথাগুলি।
কিন্তু পড়তে
পড়তে মনে হলো – এই যে রবীন্দ্রনাথ বলে দিলেন তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী
– আসলেই কি তাই? এদেশে তরুলতা ও পশুপক্ষীর যত্নআত্তির জন্য কত মানুষ, কত প্রতিষ্ঠান
কাজ করছে, কত হাজার হাজার ডলার খরচ হচ্ছে! এদেশে নাকি পশুপাখিদের জন্যও মনের ডাক্তার
আছে, বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। কুকুর হাঁটানোর চাকরি করতে গিয়ে যে কুকুরের তাড়া খেয়ে
পালিয়ে এসেছিলাম সেই ঘটনা তো তোমাকে বলেছি।
একইভাবে মাথার
ভেতর আরেকটা প্রশ্ন ঘুরছে – একটি বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে বিশ্ব-বিদ্যালয় হয়ে ওঠে? ইউনিভার্সের
সাথে মিল রেখেই কি ইউনিভার্সিটি নামটি এসেছে? জ্ঞানচর্চার মহাবিশ্ব – বিশ্ববিদ্যালয়!
সেই কখন কোন্ যুগে ল্যাটিন শব্দ ইউনিভার্সিটাস থেকে ইউনিভার্সিটি কথাটার বিবর্তন ঘটেছে।
সাড়ে চারশ কোটি বছরের মধ্যবয়স্ক এই পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যত আবিষ্কার-উন্নতি-উদ্ভাবন
ঘটেছে তার প্রায় সবকিছুই ঘটেছে পৃথিবীর বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে। নতুন চিন্তার উন্মেষ
ঘটানোই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। সহজ কথায় বলাই যায় – মনের যে কোনো ভাবনাচিন্তার উন্মেষ
এবং সম্প্রসারণ করা বিশ্ববিদ্যালয়েরই কাজ। এখানে এই কাজটি দিনরাত হচ্ছে দেখে কেমন যেন
একটা কষ্ট হচ্ছে। সাত বছর যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি – সেখানে দেখেছি সময়ের কী অপচয়,
মেধার কী অপচয়। অবশ্য এখানে না এলে ভাবতাম ওটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক অবস্থা।
জানতেই পারতাম না যে মেধা, মনন ও জীবনীশক্তির কী সাংঘাতিক অপচয় হয়ে চলেছে সেখানে।
কিছু জায়গা
নিয়ে অনেকগুলি বিল্ডিং প্রতিষ্ঠা করে দিলেই তো একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে যায় না। সেখানে
যারা কাজ করেন, তাদের কাজের মাধ্যমেই তা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। ১৮৫৫ সালের ১৩ এপ্রিল
মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির আনুষ্ঠানিক ক্লাস শুরু হয়েছিল। সেদিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল
মাত্র ষোল জন। তাদের মধ্যে মাত্র চারজন শিক্ষার্থী যথাসময়ে ডিগ্রি সম্পন্ন করেছিল।
সেখান থেকে শুরু হয়ে এক শ বছরের মধ্যেই বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে পৌঁছে যেতে
পেরেছে একটা বিশ্ববিদ্যালয় কিসের শক্তিতে – যে শক্তি আমাদের নেই? আশ্চর্যের ব্যাপার
হলো ১৮৫৫ থেকে ১৯৩৪ পর্যন্ত দীর্ঘ আশি বছরে যে দশ জন শিক্ষাবিদ মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভাইস-চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেছেন – তাঁদের কেউই কোন বেতন নেননি। আশি বছর ধরে
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরের পদ ছিল অবৈতনিক। এসব পড়ি আর অবাক হই।
মাত্র দু’মাস
হলো মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্র হয়েছি। এই দুই মাসে আমি যতগুলি সেমিনার, সিম্পোজিয়াম,
পাবলিক লেকচার অ্যাটেন্ড করার সুযোগ পেয়েছি আগে সাত বছরেও পাইনি। তাও শুধুমাত্র ফিজিক্স
ডিপার্টমেন্টে। ইউনিভার্সিটির প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টেই হাজার রকমের জ্ঞানযজ্ঞ চলছে
সারাবছর। ছাত্র-অছাত্র সবার জন্যই তা উন্মুক্ত। যে কেউ যে কোনো সেমিনারে ঢুকে বসে যেতে
পারে। জুলাই মাসের প্রত্যেক শুক্রবার সন্ধ্যেবেলা ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের জুলাই লেকচার
সিরিজ চলে। ডিপার্টমেন্টের প্রফেসররা পদার্থবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কারগুলি সেখানে
এমনভাবে আলোচনা করেন যেন সবাই বুঝতে পারে। এই শীতের মধ্যেও কানায় কানায় ভর্তি হয়ে যায়
বিরাট লেকচার থিয়েটার। আগস্টের প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চলেছে ফিজিক্স জিমনিশিয়াম।
জিমনিশিয়াম শুনে আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ব্যায়াম করাবে। পরে দেখলাম মগজের ব্যায়াম। সেখানে
স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য পদার্থবিজ্ঞানের লেকচার দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত
প্রফেসররা। স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য হলেও তাদের অভিভাবকরাও আসেন তাদের সাথে লেকচার
শুনতে। আমি এই সুযোগও ছাড়িনি। প্রফেসররা কী চমৎকার করে যে ব্যাখ্যা করেন বিষয়গুলি।
পদার্থবিজ্ঞানের ভেতরের এই যে মজা – তা আমরা কেন পাইনি? আমাদের স্যার-ম্যাডামরা কেন
ক্লাসে এসেই শুধু সমীকরণের পর সমীকরণ লিখতে থাকেন? পদার্থবিজ্ঞান মানে কি শুধুই সমীকরণ?
সেদিন সন্ধ্যায়
গিয়েছিলাম আর্কিটেকচার বিল্ডিং-এ পাবলিক লেকচার শুনতে। সন্ধ্যাবেলার পাবলিক লেকচারগুলি
সবার জন্য উন্মুক্ত। এখানে জ্ঞানভিত্তিক বক্তৃতা শোনার জন্য কী ভীড় যে হয় তা নিজের
চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। আর্কিটেকচার বিল্ডিং-এর নিচের তলায় অনেকটা ভূগর্ভস্থ
লেকচার থিয়েটার – প্রিন্স ফিলিপ থিয়েটার। প্রায় বারো শ সিটের থিয়েটার হল – কানায় কানায়
ভরে গিয়েছিল মহাবিশ্বের আকার-আকৃতি সম্পর্কে জানতে। গণিতের প্রফেসর ওয়াল্টার নিউম্যান
এই পাবলিক লেকচার দিলেন ‘What Shape is the Universe?’ প্রসঙ্গে। ১৯০০ সালে গণিতবিদ
ডেভিড হিলবার্ট কিছু গাণিতিক সমস্যার তালিকা প্রকাশ করেছিলেন – যেগুলি পুরো বিংশ শতাব্দীজুড়ে
আলোচিত হয়েছে। সেখান থেকে একটা প্রশ্ন উঠে আসে – তা হলো গাণিতিকভাবে মহাবিশ্বের আকার
এবং আকৃতি মাপা কীভাবে সম্ভব? এখানে নাম্বার থিওরি কীভাবে কাজ করে? খুবই খট্মটে গাণিতিক
বিষয়। অথচ পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলেন কোন ধরনের জটিল গাণিতিক সমীকরণ ছাড়াই। চকচকে
টাকের মধ্যবয়স্ক প্রফেসর নিউম্যানের বাচনভঙ্গি খুবই সুন্দর। তবে অঙ্গভঙ্গি খুবই বিচিত্র।
কথা বলার সময় তিনি এক পা সামনে আসেন, আবার এক পা পেছনে সরে যান। দেড়ঘন্টা ধরে তিনি
অবিরাম কথা বলার সাথে সাথে এই পদসঞ্চালনও করেছেন বিরামহীন। তবে আমি ছাড়া সম্ভবত আর
কেউ এই ব্যাপারটা খেয়ালও করেনি। এখানে কীভাবে হাত-পা নাড়ালো তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ
হলো কী বলা হলো।
এখানে রিসার্চ
ডিগ্রিতে ভর্তি হতে পারলে কোন বাধ্যতামূলক কোর্সওয়ার্ক থাকে না। আমারও নেই। তবে প্রফেসর
লেস অ্যালেনের স্ক্যাটারিং থিওরির কোর্সটা করছি – যদি কিছু বুঝতে পারি এই আশায়। খুব
একটা সুবিধা সেখানে করতে পারছি না। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গাণিতিক ভিত্তি সেভাবে গড়ে
ওঠেনি আমার। সেখানে ফাঁকির যে ফাঁকফোকরগুলি মুখস্থ করে ঢেকে দিয়েছিলাম, সেগুলি এখন
বিরাট বিরাট গর্ত হয়ে আমাকে গিলতে আসছে। এর মধ্যে প্রফেসর দশটা প্রোবলেমের একটা সেট
দিয়েছেন সমাধান করার জন্য। এক সপ্তাহ সময়। আমার জন্য বাধ্যতামূলক নয়, তবে ক্লাসের অন্যরা
কোর্সওয়ার্কের স্টুডেন্ট – তাদের জন্য বাধ্যতামূলক। এই অ্যাসাইনমেন্টের নম্বর যোগ হবে
তাদের ফাইনাল পরীক্ষার নম্বরের সাথে। দু’সপ্তাহ পরে ফাইনাল পরীক্ষা।
অনেকক্ষণ ধরে
বোঝার চেষ্টা করার পর মনে হলো স্ক্যাটারিং থিওরির প্রোবলেমগুলির সমাধান করা আমার সাধ্যের
বাইরে। মন বললো – যেহেতু বাধ্যতামূলক নয়, সেহেতু অ্যাসাইনমেন্ট জমা না দিলেই হলো। কিন্তু
কোথায় যেন একটু আত্মসম্মানেও লাগছে। প্রফেসর অ্যালেন নিশ্চয় কেন্কে বলবেন। চেষ্টা
করে দেখা যাক একবার। ফিজিক্স রিসার্চ লাইব্রেরির কয়েকটা শেল্ফভর্তি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের
বই। এগুলি ঘাঁটতে থাকলে কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো সমাধানের পথ বের হয়ে আসবে।
আজ সন্ধ্যাবেলা
কার্ড পাঞ্চ করে লাইব্রেরিতে ঢুকেছিলাম। ভেবেছিলাম আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না সেখানে
– যত বই আছে সব ঘেঁটে ফেলবো আজ। কিন্তু ঢুকে দেখি র্যাচেলসহ ক্লাসের আরো পাঁচজন ছেলে-মেয়ে
সাইলেন্ট স্টাডিরুমের ফ্লোরের কার্পেটে বইয়ের স্তূপ বানিয়ে তার চারপাশে বসে শলাপরামর্শ
করছে। ভাবলাম চুপি চুপি বের হয়ে আসবো। কিন্তু তারা আমাকে দেখে ফেললো। আমাকেও যোগ দিতে
হলো অ্যাসাইনমেন্টের শলাপরামর্শে। এটা গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট নয়, অথচ সবাই একসাথে আলোচনা
করছে কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়। ব্যাপারটা খুব ভালো লাগলো আমার। বিজ্ঞান একক সাধনার
ব্যাপার নয়। যে ব্যাপারটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগলো সেটা হচ্ছে এদের সাবলীলতা। তাদের
প্রতি আমার কিছুটা সংকোচ থাকলেও আমার প্রতি তাদের কোন সংকোচ নেই। আমার গায়ের বর্ণ কিংবা
ভুল উচ্চারণ কিছুতেই যেন তাদের কিছু যায় আসে না। এই ব্যাপারটা তারা কোথায় শিখলো? তাদের
প্রত্যেকেরই বয়স আমার চেয়ে কমপক্ষে আট-নয় বছর কম। অথচ কত বেশি উদার তারা এই বয়সেই।
পরবর্তী এক
সপ্তাহের মধ্যে অ্যাসাইনমেন্ট লিখে জমা দিলাম। ভুল-শুদ্ধ যাই হোক, কাজের কাজ এটুকু
হয়েছে যে অনেকগুলি বইপত্র সিরিয়াসলি ঘাঁটা হয়েছে।
সোমবার সকালে
যে কান্ডটি ঘটেছে তার জন্য আমি তৈরি ছিলাম না। ডেস্কে বসে কী করবো ভেবে ওঠার আগেই প্রফেসর
লেস অ্যালেন রুমে ঢুকলেন। তাঁর হাতে আমার অ্যাসাইনমেন্ট। শুক্রবার বিকেলে জমা দিয়েছি,
এর মধ্যেই তিনি দেখে ফেলেছেন? ছুটির দিনেও কি ছুটি কাটান না এঁরা?
“প্রাডিব, আই
অ্যাম নট শিওর অ্যাবাউট সামথিং হিয়ার। ক্যান ইউ সি ইট?”
আমি ভুল করেছি,
তিনি সেটা কেটে দেবেন – সেটাই তো নিয়ম। তিনি তা না করে আমার সাথে আলোচনা করতে এসেছেন
আমি কেন এবং কীভাবে লিখেছি যা লিখেছি। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনিশ্চয়তার তত্ত্ব এই
ক্ষেত্রেও যে প্রযোজ্য হবে তা ভাবিনি। অনেকক্ষণ ধরে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ব্যাখ্যা
করলেন আমি যা লিখেছি তা কোথায় শুদ্ধ, কোথায় কম-শুদ্ধ। তিনি ভুল হয়েছে বললেন না একবারও।
বললেন – লেস কারেক্ট। এরকম ব্যাপার যে ফিজিক্সে থাকতে পারে তাও জানতাম না। আরো আশ্চর্যের
ব্যাপার হলো – যে সমস্যাগুলি তিনি সমাধান করতে দিয়েছেন তার সবগুলিই গবেষণার নতুন সমস্যা
– যাদের সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভুল করার পরেও কোন ধরনের লজ্জার
অনুভূতি হলো না এই প্রথম। দেশে ভাইভাতে একটা প্রশ্নের উত্তর তাৎক্ষণিকভাবে দিতে না
পারলে স্যাররা যেভাবে ধমক দিয়ে লজ্জা দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন যে আমরা পদার্থবিজ্ঞান পড়ার
উপযুক্ত নই – এখানে সেরকম কোন ব্যাপারই নেই।
প্রফেসর লেস
অ্যালেন রুম থেকে বের হবার সময় বলে গেলেন দু’সপ্তাহ পরে পরীক্ষা, এবং পরীক্ষা হবে ওপেন
বুক।
স্যার পরের পর্ব আসবে কবে?
ReplyDeleteশীঘ্রই লিখতে বসবো।
Delete