Friday, 26 August 2022

সাম্প্রদায়িকতার শাস্তি

 


ছবির এই মানুষটির নাম ব্রিজিড হেইউড। দু’সপ্তাহ আগেও তিনি অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইংল্যান্ডের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। আগস্টের পাঁচ তারিখ তাঁর চাকরি চলে গেছে। এত বড় পদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করার কিছুটা সম্মানজনক উপায় হলো – পদত্যাগপত্র জমা নেয়া। আগস্টের পাঁচ তারিখ তাঁর পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে। তাঁর অপরাধ কী? না, কিছু কিছু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের মতো তিনি কোন দুর্নীতি করেননি, স্বজনপোষণ করে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-জামাতা-ভাইপো-ভাইজিকে নিয়োগ দেননি। তিনি যেটা করেছেন, সেটা আমাদের দেশে হয়তো কোন অপরাধই নয়। তিনি নিজের মুখ থেকে থুতু আঙুলে লাগিয়ে একটি বাদামী মেয়ের কপালে ডলতে ডলতে বলেছিলেন, দ্যাখো তোমার গায়ের চামড়ার রঙ কত ময়লা!

ঘটনাটি ঘটেছিল এবছর ৮ মার্চ – আন্তর্জাতিক নারী দিবসে। আর্মিডেলে – যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়টি অবস্থিত – একটি ক্লাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হচ্ছিলো। ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ব্রিজিড হেইউড সেই অনুষ্ঠানে আলোচকদের প্যানেলে ছিলেন। স্থানীয় স্কুলগুলি থেকে অনেক মেয়েকেও আনা হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে। ষোল বছর বয়সী স্কুলছাত্রীটি অভিবাসী মা-বাবার সন্তান, জন্মসূত্রে অস্ট্রেলিয়ান। জন্মসূত্রেই গায়ের বাদামী রঙ পেয়েছে। সেটা তার অপরাধ – শ্বেত চামড়ার অধিকারী ব্রিজিড হেইউইয়ের কাছে? অথচ ব্রিজিডের গায়ের বর্ণ সাদা হবার জন্য তাঁর নিজের কি কোন কৃতিত্ব আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসি হবার পরেও তাঁর সেই সামান্য যুক্তিবোধ কাজ করলো না?

তিনি হয়তো ভেবেছিলেন এটা নিয়ে কেউ কোন আপত্তি করবে না। কিন্তু সেই ব্রিটিশ যুগ কি আছে – যেই যুগে ব্রিটিশরা লাথি মারলে ভারতীয়রা জিভ দিয়ে তাদের জুতো পরিষ্কার করে দিতো বাধ্য হয়ে? অস্ট্রেলিয়া শত বছর অস্ট্রেলিয়ান অশ্বেতাঙ্গ আদিবাসীদের উপর অত্যাচারের চূড়ান্ত করার পর এখন ক্রমশ সভ্য হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা প্রদর্শনের বিরুদ্ধে এখানে আইনকানুন খুব কড়া। অভিবাসীরা এসব আইনকানুনের খবর রাখেন, বাধ্য হয়েই রাখেন। মেয়েটির স্কুলেও পড়ানো হয় সব মানুষের সমান অধিকারের কথা। সে চুপ করে রইলো না। সে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেছে ভাইস চ্যান্সেলর ব্রিজিড হেইউডের কাছে।

এদেশে যে যত বড় ক্ষমতাশালী – আইনকানুন তাকে তত বেশি মেনে চলতে হয়। মিডিয়াগুলি স্বাধীন। ফলে একজন সাধারণ মানুষ আইন ভাঙলে মিডিয়া দেখেও না দেখার ভান করতে পারে নিউজভ্যালু কম হবার কারণে। কিন্তু একজন প্রভাবশালী যদি আইন ভাঙে – তাহলে আর রক্ষা নেই। সেজন্যই দেখা যায় কোভিড-১৯ এর লকডাউনের সময় মুখে মাস্ক ছাড়া পেট্রোল পাম্প থেকে তেল নেয়ার কারণে উপপ্রধানমন্ত্রীকে ফাইন করা হয়।

যেহেতু এধরনের সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ আনা হয়েছে ভাইস-চ্যান্সেলরের বিরুদ্ধে, এবং ভিডিও ফুটেজও আছে – শেষ রক্ষা হলো না কোনভাবেই। ভিসি ব্রিজিড হেইউড পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। আদালতের বিচারে তিনি দোষী সাব্যস্ত হতে এখনো অনেক দেরি আছে। কিন্তু ভাইস-চ্যান্সেলরের মতো একটি পদের বিরুদ্ধে এধরনের অভিযোগ উঠলে তা প্রাথমিক তদন্তে যদি দেখা যায় একেবারে ভিত্তিহীন নয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চুপ করে থাকতে পারে না। এখানে বলে রাখা ভালো, অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলি চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিচালনা বোর্ডের মাধ্যমে। সরকার সেখানে মাথা গলাতে পারে না। সুতরাং এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সরকারি লেজুড়বৃত্তি করতে হয় না। আসলে লেজুড়বৃত্তি করে লাভ হলে হয়তো এখানেও করতো।

এরকম শাস্তির নজির থাকলেই কি মানুষের মন থেকে সাম্প্রদায়িক মনোভাব মুছে যাবে? সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ পুরোপুরি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত হতে পারে না। কোনো না কোনোভাবে যত সামান্য পরিমাণেই হোক না কেন তা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। সাম্প্রদায়িকতা বলতে যদিও আমরা শুধুমাত্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বুঝি, কারণ ওটা নিয়েই সবচেয়ে বেশি গন্ডগোল দেখতে আমরা অভ্যস্ত, কিন্তু বর্ণসাম্প্রদায়িকতা আরো মারাত্মক। বাংলাদেশের কথা যদি ধরি – আমাদের গায়ের বর্ণ মোটামুটিভাবে সবারই একই রকম। সেখানে গাত্রবর্ণ দেখে ধর্মনির্ণয় অসম্ভব। ধর্মীয় পরিচয় আমি ইচ্ছে করলে প্রকাশ নাও করতে পারি। কিন্তু আমার গাত্রবর্ণ লুকানোর তো কোন ব্যবস্থা নেই। আমেরিকায় বর্ণসাম্প্রদায়িকতার ফলে সংঘর্ষ প্রায়ই ঘটে, এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও। আফ্রিকান-আমেরিকান জাতিগোষ্ঠী কয়েক প্রজন্ম ধরে আমেরিকায় জন্ম নেয়ার পরেও, একজন কৃষ্ণাঙ্গ আটবছর ধরে সেই দেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করলেও – বর্ণবিদ্বেষ মুছে যায়নি। বিশ্বায়নের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের বাদামী বর্ণের মানুষগুলি যখন পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে – তখন তাদেরকেও এখন প্রায়ই বর্ণসাম্প্রদায়িকতার কদর্য অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। আমেরিকা কানাডা ইওরোপ অস্ট্রেলিয়ার মতো শ্বেতাঙ্গশাসিত দেশে তো বটেই, আফ্রিকার মতো কৃষ্ণাঙ্গ শাসিত দেশেও বাদামীরা বর্ণবাদের শিকার হচ্ছে যথেষ্ট কালো নয় বলে।

আবার বাদামীরা যে নিজেদের ভেতর কী পরিমাণ বর্ণসাম্প্রদায়িক তা আর নতুন করে বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না। চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় একজন প্রভাবশালী স্যার আমাকে প্রত্যেক ক্লাসেই সম্বোধন করতেন “এই কালাইয়া” বলে। অনেক বছর আগের সেই পরিস্থিতির কি এখন কোন উন্নতি হয়েছে?


Saturday, 13 August 2022

মহাজাগতিক রশ্মি

 


১৮৯৫ সালে এক্স-রে আবিষ্কৃত হবার পরবর্তী এক দশকের মধ্যেই পদার্থবিজ্ঞানের জগৎ নতুন নতুন তথ্য, তত্ত্ব, কণা এবং রশ্মিতে ভরে উঠতে লাগলো। পরের বছরই আবিষ্কৃত হলো তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বা রেডিওঅ্যাকটিভিটি। ঠিক তার পরের বছর ১৮৯৭ সালে জানা গেলো ইলেকট্রন হলো পদার্থের সবচেয়ে মৌলিক কণা। যদিও ইলেকট্রন যে নেগেটিভ চার্জ বহন করে তা কয়েক শ বছর আগে থেকেই জানা ছিল, কিন্তু তার অন্যান্য ধর্মগুলি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তখন মাত্র হাতে এলো। দৃশ্যমান আলো সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধারণা কয়েক হাজার বছর আগে থেকে আছে। সেই ধারণাকে সুনির্দিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রে রূপ দেয়া হয়ে গেছে ততদিনে। দৃশ্যমান আলো যে বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ তা বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক্স-রে আবিষ্কারেরও ত্রিশ বছর আগে। কিন্তু অদৃশ্য এক্স-রে কিংবা গামা-রে’র শক্তি এবং গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জানার তখনো শুরু। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের জগৎ অজানা রশ্মি ও কণাময় হয়ে উঠলো। এই অদৃশ্য রশ্মিগুলির শক্তি বিকিরণের তীব্রতা এবং যে পদ্ধতিতে এরা বিভিন্ন পদার্থের দেয়াল ভেদ করে অনায়াসে চলে যাচ্ছে তার অন্তর্গত বৈজ্ঞানিক রহস্য আবিষ্কারের জন্য অধীর হয়ে উঠলেন সারাপৃথিবীর পদার্থবিজ্ঞানীরা। আমাদের উপমহাদেশের বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুও ছিলেন সেই বিজ্ঞানীদের দলে।

তখন নতুন নতুন রশ্মি এবং কণা আবিষ্কারের ধুম লেগে গেছে। কিছুদিন পর পরই বিজ্ঞানীদের মনে হচ্ছে আরো নতুন কোন রশ্মির সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু কেউ একজন ঘোষণা দিলেই তো আর আবিষ্কার হয়ে যায় না। একজন কোন কিছু আবিষ্কার করলে, কী পদ্ধতিতে আবিষ্কার করেছেন তা জানাতে হয়। একই পদ্ধতিতে অন্যরাও যদি সেই আবিষ্কারের ফল পায় – তবেই বলা যায় যে আবিষ্কারটি সঠিক আবিষ্কার। ১৯০৩ সালে ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী প্রসপার ব্লন্ডলট ঘোষণা দিলেন তিনি নতুন এক ধরনের রশ্মি আবিষ্কার করেছেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি বেশ কয়েকটি পেপার লিখে ফেললেন কীভাবে তিনি এই নতুন রশ্মির বিকিরণ আবিষ্কার করেছেন। পাঁচ বছর আগে মেরি কুরি নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার করে নিজের জন্মভূমির নামে নামকরণ করেছিলেন পোলোনিয়াম। প্রসপার ব্লন্ডলটও সেভাবে ফ্রান্সের যে শহরে তিনি জন্মেছেন সেই শহরের নামে তাঁর রশ্মির নাম দিলেন ন্যান্সি রশ্মি বা এন-রে। তাঁর শহরে হৈ চৈ পড়ে গেল। ফ্রেন্স একাডেমি অব সায়েন্স তাঁকে পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঙ্ক পুরষ্কার দিয়ে ফেললো। দ্রুত বিখ্যাত হয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল যখন এন-রশ্মি নিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার বিজ্ঞানীরাও কাজ শুরু করলেন। ব্লন্ডলট যে পদ্ধতিতে এন-রশ্মি আবিষ্কার করেছেন বলে দাবি করেছেন তাঁর গবেষণাপত্রে, অন্যান্য বিজ্ঞানীরা একই পদ্ধতি বার বার ব্যবহার করেও এন-রশ্মির অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন না। স্বাভাবিকভাবেই এন-রশ্মির দাবি বাতিল হয়ে গেল। তবুও ন্যান্সি শহরের অনেকেই বিশ্বাস করতে থাকলেন যে তাঁদের বিজ্ঞানী আবিষ্কার ঠিকই করেছেন, অন্যান্য বিজ্ঞানীরা ষড়যন্ত্র করে তার স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে না।

সে যাই হোক, এক্স-রে গামা-রে নিয়ে তখন প্রচুর গবেষণা চলছে পৃথিবীজুড়ে। গোল্ড-লিফ ইলেকট্রোস্কোপ বা স্বর্ণপাত তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে চার্জিত কণার অস্তিত্ব এবং পরিমাণ নির্ণয় করা তখন নিয়মিত ব্যাপার। স্কটিশ বিজ্ঞানী চার্লস উইলসন তখন প্রচুর গবেষণা করছেন কীভাবে অদৃশ্য বিকিরণ ও চার্জ শনাক্ত করা যায়। উইলসন ছিলেন ইলেকট্রন আবিষ্কারক জোসেফ জন থমসনের (জে জে থমসন) ছাত্র। ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে কাজ করার সময় তিনি খেয়াল করলেন তাঁর স্বর্ণপাত তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্র মাঝে মাঝে কিছু চার্জ শনাক্ত করছে যখন আশেপাশে কোন চার্জিত বস্তু কিংবা তেজস্ক্রিয় পদার্থ নেই যেখান থেকে চার্জ কিংবা বিকিরণ নির্গত হতে পারে। অনেক খুঁজে পেতেও এর কারণ বের করতে পারলেন না উইলসন। এই ঘটনা আরো অনেক ল্যাবেই দেখা গেল। বৈদ্যুতিক চার্জগুলি যে কুলম্বের সূত্র মেনে চলে সেই চার্লস কুলম্বও শতাধিক বছর আগে এরকম রহস্যময় কিছু লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন তাঁর চার্জিত গোলক – কোন কারণ ছাড়াই চার্জ হারাচ্ছে। এই রহস্যময় ঘটনার কোন সুনির্দিষ্ট সমাধান করা যায়নি। তবে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি ধরে নিয়েছেন যে আমাদের পৃথিবী নিজেই যেহেতু তেজস্ক্রিয় নক্ষত্র থেকে উৎপন্ন হয়েছে, বিগত সাড়ে চারশ কোটি বছর ধরে বিকিরণের পরেও এখনো কিছুটা তেজস্ক্রিয়তা রয়ে গেছে এর ভেতর। সেই বিকিরণই মাঝে মাঝে ধরা দিচ্ছে তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্রে।

কিন্তু ধোঁয়াশে ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট থাকা বিজ্ঞানীদের ধর্ম নয়। এই রহস্য উন্মোচনে কাজ করছিলেন অনেকেই। ততদিনে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মৌলিক ধর্ম সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জেনে গেছেন। তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে দূরে গিয়ে তেজস্ক্রিয়তা মাপলে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ কমে যায়। কোন জায়গায় তেজস্ক্রিয় বস্তু রেখে তার এক মিটার দূরে ডিটেক্টর রাখলে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া যাবে, দুই মিটার দূরে রেখে মাপলে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ হবে চার ভাগের একভাগ। তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ দূরত্বের বর্গফলের বিপিরীত অনুপাত। পৃথিবীর ভেতরের তেজস্ক্রিয়তার অস্তিত্বই যদি বিদ্যুৎবীক্ষণ যন্ত্রে ধরা পড়ছে হবে – তাহলে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে যত উপরের দিকে এই বিদ্যুৎবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে যাওয়া হবে, তেজস্ক্রিয়তা তত কমে যাবে। বিদ্যুৎবীক্ষণ যন্ত্র ভূমির সমতলে যে পাঠ দেবে, ভূমি থেকে উপরে তার চেয়ে কম পাঠ দেবে। বিভিন্নভাবে এই পরীক্ষা করে দেখা হলো – কিন্তু উচ্চতার কারণে পাঠের কোন পার্থক্য দেখা গেলো না। তখন ভাবা হলো সামান্য দূরত্বের পার্থক্যে কিছু হবে না। দূরত্ব বাড়াতে হবে। ১৯১০ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী থিওডর বুল্‌ফ আইফেল টাওয়ারের উপরে উঠে পরীক্ষা চালালেন। ফল হলো উল্টো। দেখা গেলো আইফেল টাওয়ারের নিচে তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্রে যে পাঠ পাওয়া গেল, তিন শ মিটার উপরে আইফেল টাওয়ারের চূড়ায় সেই বিকিরণ শনাক্তের সেই পাঠ অনেক বেশি। তাহলে এটা নিশ্চিত হলো যে এই তেজস্ক্রিয়তার উৎপত্তি পৃথিবীতে নয়, পৃথিবীর বাইরে। কিন্তু কোথায়?


ভিক্টর হেস


অস্ট্রিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী ভিক্টর হেস তখন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষক। তিনি ঠিক করলেন আরো অনেক উঁচুতে উঠে পরীক্ষা চালাবেন। ১৯১১ সালে আকাশের দিকে উপরে উঠার তখনকার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা ছিল বেলুন। তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে অনেকগুলি পরীক্ষা করলেন বেলুনে চড়ে। সাড়ে চারশ মিটার উচ্চতা থেকে শুরু করে পাঠ নিতে নিতে তিনি উঠলেন পাঁচ কিলোমিটারেরও বেশি উচ্চতায়। দেখলেন যতই উপরের দিকে উঠছেন, তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ ততই বাড়ছে। তার মানে এই তেজস্ক্রিয়তা পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ভেদ করে আসছে পৃথিবীর বাইরে থেকে। তবে কি সূর্য থেকে আসছে? তাহলে দিনের বেলার পাঠ আর রাতের বেলার পাঠে পার্থক্য থাকবে। ভিক্টর হেস রাতের বেলায়ও পরীক্ষা চালালেন। অন্ধকারে যখন সূর্যের আলো বেলুনের আশেপাশে কোথাও নেই, তখনো দেখা গেলো তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ একটুও কমছে না। ঘটনা কী? তবে কি সূর্যও নয়, আরো দূরের কোন নক্ষত্র থেকে আসছে এই তেজস্ক্রিয়তা? সূর্যগ্রহণের ফলে কোন তারতম্য দেখা যায় কিনা পরীক্ষা করার জন্য ১৯১২ সালের ১৭ এপ্রিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় বেলুনে চড়ে তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্রের পাঠ নিলেন ভিক্টর হেস। কিন্তু ফলাফলে কোন তারতম্য দেখা গেল না। ১৯১৩ সাল নাগাদ বিজ্ঞানীরা মেনে নিলেন যে পৃথিবীর বাইরে এমনকি সূর্যের থেকেও দূরে মহাকাশের গভীর নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বর্ম ভেদ করে চলে আসছে এই আশ্চর্য রশ্মি। আরো প্রায় বারো বছর পরে ১৯২৫ সালে বিজ্ঞানী রবার্ট মিলিক্যান এই রশ্মির নাম দিলেন কসমিক রে – বাংলায় আমরা যাকে মহাজাগতিক রশ্মি বলছি। ১৯৩৬ সালে মহাজাগতিক রশ্মির আবিষ্কারক হিসেবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন ভিক্টর হেস।

রবার্ট মিলিক্যান যতই বলুন যে কসমিক রে আসলেই রে – মানে আলোকরশ্মির মতো তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের অংশ – বিজ্ঞানীরা সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। কসমিক রে এক্স-রে কিংবা গামা-রে’র চেয়েও বেশি শক্তিশালী এবং এদের পেনিট্রেটিং পাওয়ার বা ভেদ করে যাওয়ার ক্ষমতাও অনেক বেশি। মিলিক্যান বললেন কসমিক রে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গেরই বড়ভাই – যাদের কম্পাঙ্ক এক্স-রে ও গামা-রের কম্পাঙ্কের চেয়ে বেশি, আর তরঙ্গদৈর্ঘ্য এক্স-রে ও গামা-রে’র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে কম। মিলিক্যান বিশ্বখ্যাত আমেরিকান বিজ্ঞানী, ইলেকট্রনের চার্জ সঠিকভাবে মেপে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯২৩ সালে। তাঁর কথা অনেকেই মেনে নেবেন এটা ঠিক। কিন্তু বিজ্ঞানে প্রমাণ ছাড়া কারো কথাই কেউ মেনে নেয় না। মিলিক্যানের কথাও অনেক বিজ্ঞানীর বিশ্বাস হলো না। তাঁরা পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন কসমিক রে আসলেই রে, নাকি মহাকাশ থেকে ছুটে আসা কোন চার্জিত কণা।

ততদিনে ইলেকট্রন ও প্রোটন সম্পর্কে সবাই জেনে গেছেন। নিউট্রন তখনো স্বীকৃতি পায়নি। কসমিক রে যদি মহাকাশ থেকে ছুটে আসা রশ্মি হয়, আলোকের অংশ হয়, তাহলে সেই ফোটন পৃথিবীর সবজায়গায় সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ার কথা। কারণ ফোটন যেহেতু চার্জহীন, সেহেতু তারা কোন ধরনের বিদ্যুৎক্ষেত্র কিংবা চুম্বকক্ষেত্র দ্বারা বিক্ষিপ্ত হবে না। কিন্তু যদি তারা চার্জিত কণা হয়, তাহলে পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্রের প্রভাব তাদের গতির উপর অবশ্যই পড়বে। তাহলে দেখা যাবে পৃথিবীর মেরুর দিকে কসমিক রে বেশি ধরা পড়বে।   

ঠিক তাই হলো। অনেক বিজ্ঞানীই এই পরীক্ষা করলেন। নোবেলজয়ী আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী আর্থার কম্পটন প্রমাণ করলেন যে কসমিক রে আসলে রে নয়, পার্টিক্যাল। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে প্রচুর গবেষণা হয়েছে কসমিক রে’র বিকিরণ নিয়ে। প্রমাণিত হয়েছে কসমিক রে’র শতকরা নব্বই ভাগ কণাই হলো প্রোটন, আর সাথে কিছু (৯%) আলফা পার্টিক্যাল বা হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। বাকি এক ভাগ বিটা পার্টিক্যাল বা ইলেকট্রন। সুতরাং এদেরকে মহাজাগতিক রশ্মি না বলে মহাজাগতিক কণা বলা উচিত। কিন্তু কসমিক রে নামটা ততদিনে প্রচলিত হয়ে গেছে বলে তা আর বদলানো হলো না।

কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ চার্জিত কণার উৎস কোথায়? আমাদের কাছের নক্ষত্র সূর্যই যে একমাত্র উৎস নয়, তা প্রমাণিত হয়ে গেছে অনেক আগেই। এই মহাজাগতিক কণাগুলির উৎস সন্ধান করতে গিয়ে খুলে গেছে মহাকাশ গবেষণার আরো অনেক নতুন নতুন দিক। মহাকাশের অতল গহ্বরে কোটি আলোকর্ষ দূরে ঘটে যাওয়া সুপারনোভা বিস্ফোরণ, ব্ল্যাকহোলের উৎপত্তি এসব মহাজাগতিক ঘটনা থেকে উৎপন্ন মহাজাগতিক কণাগুলির অংশবিশেষ আমাদের পৃথিবীতে এসে পৌঁছাচ্ছে। এদের কিছু কিছু কণার শক্তি লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে উৎপন্ন সবচেয়ে শক্তিশালী কণার চেয়েও বেশি শক্তিসম্পন্ন। এদের উৎপত্তির রহস্যের কিনারা এখনো করা যায়নি। কসমিক রে’ আবিষ্কারের এক শ বছরেরও বেশি অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, এখনো এর আদ্যোপান্ত জানা যায়নি।

২০১৭ সালে নাসা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে আইস-ক্রিম (ISS-CREAM International Space Station – Cosmic Ray Energies and Mass) পরীক্ষা চালিয়েছে তিন বছর ধরে। মহাকাশ স্টেশন থেকে চালানো এই পরীক্ষায় দেখতে চেয়েছে সুপারনোভা বিস্ফোরণ থেকেই বেশিরভাগ কসমিক রে’র উৎপত্তি কিনা, আর কসমিক রে’র সব শক্তির বর্ণালী কোন একটি নির্দিষ্ট নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায় কিনা। তথ্য এবং উপাত্ত বিশ্লেষণ এখনো চলমান। মহাকাশের রহস্য উন্মোচনে কসমিক রে’র ভূমিকা ক্রমশ বাড়ছে।

কিন্তু পৃথিবীতে যেসব কসমিক রে প্রতিনিয়ত আসছে তাদের ফলে আমাদের শরীরের কি ক্ষতি হচ্ছে? পৃথিবীতে আমরা প্রতি বছর গড়ে প্রায় পাঁচ মিলিসিভার্ট বিকিরণ শোষণ করি। তার মধ্যে মাত্র দশমিক চার মিলিসিভার্ট আসে মহাজাগতিক কণা থেকে। আলাদাভাবে এই কণাগুলি আমাদের শরীরের তেমন কোন ক্ষতি করে না, কারণ এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলির শক্তি অত্যন্ত বেশি বলে এরা আমাদের শরীরের একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বের হয়ে যায় প্রায়-আলোর গতিতে। তাই পৃথিবীপৃষ্ঠে এগুলি থেকে ক্ষতির সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।

তথ্যসূত্র: টুডুর স্টানেভ, হাই এনার্জি কসমিক রেজ, স্প্রিংগার (২০১০); বব বারম্যান, ঝ্যাপ্‌ড, লিটল ব্রাউন কোম্পানি (২০১৭); আইজাক আসিমভ, আন্ডারস্ট্যান্ডিং ফিজিক্স, বার্নিস অ্যান্ড নোবল (১৯৬৬)।

_______________

বিজ্ঞানচিন্তা জুন ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত






Wednesday, 10 August 2022

শারমিন আক্তার সাথীর 'কিছু সাদা টিউলিপ'

 



ইয়ামিন আর প্রকৃতির ভালোবাসার গল্প ‘কিছু সাদা টিউলিপ’। দু’জন দুই পথের, দুই ধর্মের, দুই প্রকৃতির মানুষ – কিন্তু ভালোবাসার টানে মিলে যায় এক পথের মোহনায়; ভালোবাসার পথ। দোর্দন্ডপ্রতাপ ক্ষমতাসীন দুর্নীতিবাজ এমপি মজিবর শাহ – চোরাচালানসহ যাবতীয় দুষ্কর্ম করে থাকেন। এসব কাজে তার ভাগনে ইয়ামিন তার ডানহাত। ক্ষমতাশালী মামা থাকলে যা হয় – তা বুঝে নিতে আমাদের সমস্যা হয় না। এই ইয়ামিনের প্রেমে পড়ে যায় একটি বিউটি পার্লারের মালিক খ্রিস্টান তরুণী প্রকৃতি। শুরুতে এক তরফা। ইয়ামিন এসে প্রকৃতির বিউটি পার্লারে ভাঙচুর চালায়। পরে তার ক্ষতিপূরণ দেয়। এতেই হয়তো ইয়ামিনের একটা কোমল মনের পরিচয় পায় প্রকৃতি। তাতেই ভালো লাগা। কাহিনিতে এমপি সাহেবের জীবন আছে। এমপি সাহেব তার আপন শালীকে একা পেয়ে ধর্ষণ করে। সেই ঘটনা চাপা দিতে এমপির স্ত্রী তার বোনের সাথে স্বামীর বিয়ে পড়িয়ে দেয়। সে নিয়ে দুই বোনের টানাপোড়েন আছে। ওদিকে প্রকৃতির মা-বাবা, ভাই-বোনের কথা আছে। সব মিলিয়ে কাহিনি এগিয়ে চলে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে। মিলনাত্মক পরিণতি আকাঙ্খিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিরহে পরিণত হয়।

বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালের বইমেলায়। অনেকে নতুন লেখক পুরনো লেখক এভাবে ভাগ করে ফেলেন। আমি মনে করি লেখকদের মধ্যে নতুন পুরনোতে ভাগ হয় না। যে কোনো লেখকই যখন নতুন কোন লেখা নিয়ে আসেন, তখন তো তিনি নতুনই। শারমিন আক্তার সাথীর আর কোনো লেখা আগে পড়িনি। 

শারমিন আক্তার সাথীর এই উপন্যাসের কাহিনি সোজাসাপ্টা। সংলাপগুলি মাঝে মাঝে অহেতুক দার্শনিকতায় আক্রান্ত হলেও খুব বেশি ঝামেলা করে না। কিছু কিছু দার্শনিক উক্তি বেশ জোরালো। যেমন, ‘পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় স্বার্থ হচ্ছে ভালোবাসা। আর আমরা আমাদের জীবনে বহু মানুষ, প্রাণী বা বস্তুকে ভালোবাসি, তারাও আমাদের ভালোবাসে। সে হিসেবে আমরা সবাই স্বার্থপর।‘

বইটি প্রকাশ করেছে তাম্রলিপি। কিন্তু বানান কেন নির্ভুল করা যাচ্ছে না, বুঝতে পারছি না। প্রুফ রিডার এবং সম্পাদকরা কেন এগুলি দেখেন না? একটা জায়গায় লেখক হয়তো পান্ডুলিপিতে নোট লিখে রেখেছিলেন, “এখানের একটা অংশ বাড়তি কাগজে লিখে দিলাম”। সেটাই ছাপানো হয়ে গেছে বইয়ের অংশ হিসেবে (পৃ ৭৫)!

প্রকৃতির স্বপ্ন ছিল নেদারল্যান্ডে গিয়ে সাদা টিউলিপের বাগান দেখে আসার। ইয়ামিন তার সেই স্বপ্নপূরণের স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্ন পূরণ হয়নি বলেই এই কাহিনির সমাপ্তি যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। 


Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts