‘আকাশভরা সূর্যতারা’
দেখেনি পৃথিবীতে এমন মানুষ মেলা ভার। সূর্যাস্তের পর অন্ধকার নেমে এলেই মেঘহীন আকাশে
তারা ঝকমক করতে শুরু করে। বুদ্ধিমান মানুষ, কৌতূহলী মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই অপার বিস্ময়ে
আকাশের প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি যেমন দেখছে, তেমনি গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অনেক প্রাকৃতিক
ঘটনারই রহস্য উন্মোচন করে ফেলেছে। মহাবিশ্বের মহাজাগতিক ঘটনাবলি বৈজ্ঞানিক উপায়ে পর্যবেক্ষণ
এবং বিশ্লেষণ করার যে জ্যোতির্বিজ্ঞান – তার ইতিহাস অনেক পুরনো। খালি চোখে মকাকাশ পর্যবেক্ষণ
করার আদি সময় আমরা পার হয়ে এসেছি গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের ভেতর দিয়ে। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও
যখন আকাশের দিকে টেলিস্কোপ তাক করে বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ আবিষ্কার করে ফেললেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানের
আকাশে নতুন সূর্যোদয় হলো। এর আগের প্রায় আড়াই হাজার বছরের জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার
ধরন বদলে গেল গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের মাধ্যমে।
পরবর্তী কয়েক
শ বছরের মধ্যে একের পর এক তৈরি হতে থাকলো আরো অনেক শক্তিশালী টেলিস্কোপ। টেলিস্কোপ
দিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করার জন্য তৈরি হলো অবজারভেটরি বা মানমন্দির। পৃথিবী থেকেই
এসব টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীতে বসানো টেলিস্কোপ
যত শক্তিশালীই হোক, তাদের কিছু গুণগত সীমাবদ্ধতা কিছুতেই দূর করা সম্ভব হয়নি। যেকোনো
টেলিস্কোপের প্রধান কাজ হলো মহাকাশ থেকে আসা আলো অনুসন্ধান করে শনাক্ত করা এবং সেই
আলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা। সুদূর মহাকাশ থেকে আলো পৃথিবীতে আসার সময় পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের
সাথে বিভিন্ন ধরনের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেয়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডল মহাকাশের আলোর কিছু অংশ
শোষণ করে ফেলে। আবার কিছু অংশ পৃথিবীর ধূলিকণার গায়ে লেগে বিক্ষিপ্ত হয়। আলোর স্ক্যাটারিং
থিওরি বা আলোর বিক্ষেপণের তত্ত্ব থেকে আমরা জানি যে আলোর বিক্ষেপণের ফলেই দিনের বেলায়
পৃথিবীর আকাশ নীল দেখায়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কারণে মহাকাশের মহাজাগতিক ঘটনাগুলি নির্বিঘ্নে
পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কোটি আলোকবর্ষ দূরের উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো পৃথিবীতে
আসতে আসতে উজ্জ্বলতা হারায়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কারণে দীপ্তমান তারাগুলিও মিটমিট করতে
থাকে পৃথিবীর আকাশে। ফলে মহাকাশের অনেক রহস্যই অধরা থেকে যায় পৃথিবীতে স্থাপিত সবচেয়ে
শক্তিশালী টেলিস্কোপগুলিতেও। অনেক উঁচু পাহাড়ের উপর মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করে সেখানে
টেলিস্কোপ স্থাপন করেও এই সমস্যার পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হয়নি।
এতসব অসুবিধা
থাকা সত্ত্বেও জ্যোতির্বিজ্ঞানের অসংখ্য আবিষ্কার, মহাবিশ্বের অসংখ্য রহস্যের সমাধান
পৃথিবীতে স্থাপিত টেলিস্কোপের মাধ্যমেই বিজ্ঞানীরা করে ফেলেছেন। তাতে আনন্দ যেমন আছে,
অতৃপ্তিও আছে। অতৃপ্তি হলো যেকোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূল প্রেরণা। বিংশ শতাব্দীর
মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয়েছে স্যাটেলাইট যুগ। বিজ্ঞানীরা মহাকাশে কৃত্রিম স্যাটেলাইট
পাঠাতে শুরু করে। শুরু হয় মহাকাশকে জানার নতুন পদ্ধতি। ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল মহাকাশে
পাঠানো হয় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। এর মাধ্যমে স্থাপিত হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের আরেকটি নতুন
যুগ – স্যাটেলাইট টেলিস্কোপের যুগ।
প্রায় ১৩ মিটার
লম্বা ও ৪.৩ মিটার চওড়া এগারো টন ভরের হাবল স্পেস টেলিস্কোপ পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৭ কিলোমিটার
উচ্চতায় ঘন্টায় প্রায় সাতাশ হাজার কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে গত বত্রিশ
বছর ধরে। প্রতি সপ্তাহে হাবল টেলিস্কোপ প্রায় ১৫০ গিগাবিট ডাটা পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে।
হাবল টেলিস্কোপের পাঠানো ডাটা থেকেই আমরা জেনেছি মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমরা
প্রমাণ পেয়েছি মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে কমপক্ষে ১৩৮০ কোটি বছর আগে। হাবল টেলিস্কোপের
ডাটার সাহায্যে আমরা প্রমাণ পেয়েছি ব্ল্যাকহোলের। বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন বিশালাকৃতির
ব্ল্যাকহোল। হাবল আমাদের খুঁজে দিয়েছে অনেকগুলি নতুন গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা।
হাবল টেলিস্কোপ জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় দিয়েছে আশ্চর্য গতি। এপর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার
বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে হাবলের সাহায্যে প্রাপ্ত উপাত্তের ভিত্তিতে।
কিন্তু এটুকুতে
খুশি হয়ে বসে থাকা বিজ্ঞানীদের কাজ নয়। হাবল টেলিস্কোপের যেটুকু দুর্বলতা আছে – সেটুকু
দূর করে মহাকাশে আরো শক্তিশালী টেলিস্কোপ স্থাপনের পরিকল্পনা বিজ্ঞানীরা করছেন অনেক
বছর থেকে। যেমন হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীর কক্ষপথের কাছাকাছি ঘুরছে বলে অনেক সময় পৃথিবী
নিজেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় হাবল টেলিস্কোপের দৃষ্টিপথে। আবার হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীর চারপাশে
ঘোরার সময়ে ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশান বেল্টের একটা অংশের কাছ দিয়ে যায়। তখন পৃথিবীর
চৌম্বকক্ষেত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে হাবল টেলিস্কোপের যন্ত্রপাতিতে ব্যাকগ্রাউন্ড
নয়েজ সৃষ্টি করে যা ডাটা সংগ্রহে বিঘ্ন ঘটায়। হাবল টেলিস্কোপের ফেইন্ট অবজেক্ট ক্যামেরা
এবং ফেইন্ট অবজেক্ট স্পেকট্রোমিটার অতিদূর নক্ষত্র থেকে আসা ক্ষীণতম আলো থেকে যে ছবি
নির্মাণ করে – তা খুবই অনুজ্জ্বল আর অস্পষ্ট। এসব ত্রুটি দূর করে সম্পূর্ণ নতুন একটি
স্যাটেলাইট নির্মাণ করে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে যার নাম জেমস ওয়েব।
২০২১ সালের
২৫ ডিসেম্বর জ্যোতির্বিজ্ঞানে শুরু হয়েছে নতুন বিপ্লব। সেদিন পৃথিবী থেকে মহাকাশে পাঠানো
হয়েছে হাবল টেলিস্কোপের চেয়েও অনেক গুণ শক্তিশালী নতুন টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ।
হাবল টেলিস্কোপের সাথে জেমস ওয়েবের গঠনে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। হাবল টেলিস্কোপের আকার
যদি একটি পঞ্চাশ সিটের বাসের সমান হয়, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আকার একটি টেনিস কোর্টের
সমান। হাবলের দর্পনের ব্যাস ২.৪ মিটার, জেমস
ওয়েবের দর্পণের ব্যাস ৬.৫ মিটার। হাবলে যে ক্যামেরাগুলি আছে সেগুলি অতিবেগুনি আলো,
দৃশ্যমান আলো এবং নিয়ার-ইনফ্রারেড বা কাছের অবলোহিত আলোর তরঙ্গ শনাক্ত করে ছবি তুলতে
পারে। জেমস ওয়েবের ক্যামেরাগুলি কাজ করে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলোকতরঙ্গে। হাবল টেলিস্কোপ
যেখানে পৃথিবী থেকে ৫৪৭ কিলোমিটার দূরে থেকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে, সেখানে জেমস ওয়েব
টেলিস্কোপ স্থাপন করা হয়েছে পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে – চাঁদের অক্ষের কাছাকাছি
দূরত্বে। এর ফলে মহাকাশের অনেক ভেতরে চোখ রাখা সম্ভব হচ্ছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের।
মহাকাশে পূর্বনির্দিষ্ট
কক্ষপথে স্থাপন করার পর গত ছয় মাস ধরে চলছিল প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষাগুলোর বিভিন্ন ধাপ।
এখন সেসব ধাপ সফলভাবে পার হয়ে মূল বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে জেমস ওয়েব স্পেস
টেলিস্কোপ। শুরুতেই বিশ্বব্যাপী হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে। ত্রিশ বছর আগে হাবল টেলিস্কোপ যেরকম
হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল মহাকাশের নতুন নতুন তথ্য ও ছবি দিয়ে – সেরকম আরো অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন
টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব বিশ্ববাসীকে উত্তেজনায় টান টান করে দিয়েছে তার প্রথম কয়েকটি ছবি
প্রকাশিত হতে না হতেই।
এবছরের ১২ জুলাই
আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম চারটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। প্রায় এক দশক ধরে প্রস্তুতির পর
এক হাজার কোটি ডলারের টেলিস্কোপ – জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানো হয়েছে
যে উদ্দেশ্যে – সেই উদ্দেশ্য সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছে। প্রথম প্রকাশিত ছবিগুলি
থেকেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এতদিন আগের সবচেয়ে শক্তিশালী হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যে
মহাকাশের যেসব চিত্র আবছা দেখা গিয়েছিল – এবার তা স্পষ্ট হলো। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের
ছবিগুলি হাবল টেলিস্কোপের ছবিগুলি থেকে দুই থেকে তিন গুন বেশি স্পষ্ট।
ঠিক কী কী বৈজ্ঞানিক
লক্ষ্য ঠিক করে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে? বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যগুলিকে
চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম লক্ষ্য হলো একেবারে শৈশবের মহাবিশ্বের স্বরূপ
উদ্ঘাটন। বিগ ব্যাং এর পর থেকে প্রথম যুগের গ্যালাক্সিগুলির আলোর সন্ধান করতে পারলে
বোঝা যাবে কীভাবে এই গ্যালাক্সিগুলির উৎপত্তি হয়েছিল। দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো গ্যালাক্সিগুলির
বিবর্তন অনুসন্ধান। প্রথম যুগের গ্যালাক্সিগুলি থেকে বর্তমান যুগের গ্যালাক্সিগুলির
মধ্যে কী কী বিবর্তন হয়েছে, এবং কীভাবে হয়েছে। তৃতীয় লক্ষ্য হলো নক্ষত্রগুলি কীভাবে
সৃষ্টি হয়েছে – একেবারে প্রথম পর্যায় থেকে
শুরু করে তাদের গ্রহ-উপগ্রহসহ নক্ষত্রজগতের সৃষ্টি কীভাবে হয়েছে তা খুঁজে বের করা।
আর চতুর্থ লক্ষ্য হলো আমাদের সৌরজগতসহ অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলির বিভিন্ন ভৌত এবং রাসায়নিক
ধর্মাবলি পরীক্ষা করে দেখা। এবং আমাদের পৃথিবী ছাড়া অন্য কোন গ্রহ বা উপগ্রহে প্রাণের
সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা।
পৃথিবীর কাছাকাছি
হওয়াতে হাবল টেলিস্কোপ সরাসরি আমাদের সূর্যের
দিকে তাকাতে পারে না। ফলে সূর্যের কাছের গ্রহ বুধ, ও শুক্রের খুব বেশি তথ্য হাবল সরাসরি
সংগ্রহ করতে পারেনি। জেমস ওয়েবের সেই সীমাবদ্ধতা নেই। আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলিকে আরো
গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্যও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আছে।
জেমস ওয়েব স্পেস
টেলিস্কোপের শক্তিশালী ক্যামেরাগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এগুলি ইনফ্রারেড রে বা অবলোহিত
আলোকরশ্মি শনাক্ত করতে পারে এবং সেই আলোতে ছবি তুলতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো অবলোহিত
আলোকরশ্মি শনাক্ত করার দরকার কী? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের আলোর পদার্থবিজ্ঞান
কিছুটা বুঝতে হবে। আলোর গতিবেগ শূন্য মাধ্যমে
যে সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বা তিন লক্ষ কিলোমিটার তা আমরা জানি। আলোর কোয়ান্টাম
তত্ত্ব অনুসারে – আলোর শক্তি তার কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। আলো যখন কোন উৎস থেকে উৎপন্ন
হয়ে একই মাধ্যমে চলতে থাকে, তখন এর গতিবেগের কোন পরিবর্তন ঘটে না। কিন্তু আলোক তরঙ্গ
হলো তড়িৎচূম্বক তরঙ্গ, যার কম্পাঙ্ক এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য একে অপরের বিপরীত অনুপাতিক। অর্থাৎ
তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি বেড়ে যায়, কম্পাঙ্ক কমে যায়। হাবল টেলিস্কোপ থেকে আমরা জেনেছি মহাবিশ্ব
ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্ব যখন প্রসারিত হচ্ছে, একই সাথে আলোর তরঙ্গও প্রসারিত
হচ্ছে। তার মানে সময়ের সাথে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যাচ্ছে। দৃশ্যমান আলোর বর্ণালীর সবচেয়ে
বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্য হচ্ছে লাল আলোর, আর সবচেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্য হচ্ছে বেগুনি আলোর। লাল
আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গেলে তা হয়ে পড়ে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলো। এটি আমাদের দৃষ্টিশক্তির
সীমানার বাইরে। অর্থাৎ অবলোহিত আলো আমরা দেখতে পাই না।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে
আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গিয়ে লাল বর্ণের দিকে সরে যাওয়াকে বলা হয় রেড শিফ্ট। আবার
তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে গিয়ে বেগুনি বা নীল বর্ণের দিকে সরে যাওয়াকে বলা হয় ব্লু শিফ্ট।
এই রেড শিফ্টের পরিমাণ হিসেব করে জানা যায় মহাবিশ্ব কতটুকু সম্প্রসারিত হয়েছে, এবং
সেই সময়ে আলো কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করেছে। সেই দূরত্বের হিসেব থেকে সময়ের হিসেব বের
করা যায়। আলো এক সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার যায়। সে হিসেবে আলো এক বছরে যতটুকু দূরত্ব
অতিক্রম করে সেই দূরত্বকে বলা হয় এক আলোকবর্ষ। এখন কোন একটি নক্ষত্র যদি পৃথিবী থেকে
এক আলোকবর্ষ দূরে থাকে, সেখান থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগবে এক বছর। যেমন সূর্য
থেকে আমাদের পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে আট মিনিট বিশ সেকেন্ড। এই সময়কে আলোর গতি দিয়ে
গুণ করলে আমরা সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব বের করতে পারি। একই ভাবে আমরা বলতে পারি
– পৃথিবী থেকে যখন আমরা সূর্যকে দেখি তখন আসলে দেখি আট মিনিট বিশ সেকেন্ড অতীতের সূর্য।
অনুরূপভাবে আমরা বলতে পারি আকাশভর্তি যেসব সূর্য-তারা আমরা দেখি সেগুলি থেকে আলো পৃথিবীতে
এসে পৌঁছাতে যদি কোটি বছর লাগে – তাহলে সেগুলি কোটি বছর আগের নক্ষত্র আমরা দেখছি।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের
ইনফ্রারেড ক্যামেরা কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি থেকে ভেসে আসা অবলোহিত আলো শনাক্ত
করতে পারে। কোটি বছরের সফর শেষে এই আলো জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আয়নায় এসে প্রতিফলিত
হয়। ইনফ্রারেড ওয়েভ ডিটেকটর সেই আলো শনাক্ত করে। সেখান থেকে তৈরি হয় গভীর মহাকাশের
ছবি। শুধু তাই নয়, ইনফ্রারেড স্পেকট্রোগ্রাফ থেকে মহাবিশ্বে ভাসমান সব ধরনের অণুর ধর্মাবলি
বিশ্লেষণ করে দেখতে পারবে পৃথিবীর অন্য কোনো সৌরজগতের অন্য কোন গ্রহে প্রাণী আছে কি
না।
এই টেলিস্কোপের
প্রোগ্রাম ডিজাইনের সাথে সরাসরি যুক্ত আমেরিকান মহাকাশ সংস্থা – নাসা (NASA), ইউরোপিয়ান
স্পেস এজেন্সি – ইসা (ESA), ক্যানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি – সিসা (CSA)। টেলিস্কোপের সায়েন্স
অপারেশান সেন্টার – যেখান থেকে মহাকাশের বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে
– সেটা হলো আমেরিকার বাল্টিমোরে স্থাপিত স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইন্সটিটিউট। এখান
থেকে হাবল স্পেস টেলিস্কোপের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলিও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। গত ১২ জুলাই
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের যে কয়টি ছবি আনুষ্ঠানিকভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে – সেগুলি বাছাই করেছেন স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স
ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা। জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন একটি জগতের পর্দা সরে গেলো এই ছবিগুলির
মাধ্যমে।
চারটি ছবির
একটি হলো SMACS 0723
এই ছবিটি তোলা
হয়েছে টেলিস্কোপের নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা দিয়ে। এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে হাজার হাজার
গ্যালাক্সি। সামনের উজ্জ্বল গ্যালাক্সির দল পেছনের গ্যলাক্সির আলোকে কিছুটা ম্লান করে
দিয়েছে। সামনের গ্যালাক্সির বয়স আমাদের পৃথিবীর বয়সের কাছাকাছি চার দশমিক ছয় বিলিয়ন
বছর বা ৪৬০ কোটি বছর। পেছনের গ্যালাক্সিদল তৈরি হয়েছিল প্রায় তের বিলিয়ন বছর আগে, অর্থাৎ
১৩০০ কোটি বছর আগে। জেমস ওয়েব এই গ্যালাক্সিগুলোর অনেক ডাটা সংগ্রহ করতে শুরু করেছে।
এই ডাটা থেকে আমরা বুঝতে পারবো – কীভাবে প্রথম প্রজন্মের গ্যালাক্সিগুলি গঠিত হয়েছিল।
এই গ্যালাক্সিগুলির মধ্যেই থাকতে পারে সবচেয়ে দূরের গ্যালাক্সি – যেগুলি তৈরি হয়েছিল
বিগ ব্যাং এর পাচ শ মিলিয়ন বা পঞ্চাশ কোটি বছরের মধ্যে – মহাবিশ্বের একেবারে শুরুর
দিকে। জেমস ওয়েবের এই ছবির ডাটা থেকে আমরা এতদিনের অনেক প্রশ্নের উত্তর পেতে পারি।
সবচেয়ে প্রথম
নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল? বিগ ব্যাং-এর পর প্রথম কিছুক্ষণ (সময়
তখনো শুরু হয়নি) সবকিছু অন্ধকার ছিল। পদার্থ যদি কিছু থেকে থাকে – তা ছিল সব ডার্ক
ম্যাটার। ডার্ক ম্যাটার কোন আলো নির্গমন করে না, প্রতিফলন করে না। অথবা ছিল নিউট্রাল
হাইড্রোজেন কিংবা হিলিয়াম। তারপর কয়েক শত মিলিয়ন বছর পর (প্রায় দশ কোটি বছর) পর গ্যাসগুলি
আস্তে আস্তে জোট বাঁধতে বাঁধতে গ্যাসীয় নক্ষত্রের সৃষ্টি হলো। প্রথম আলোর আবির্ভাব
হলো। এই আলোর বিকিরণের ফলে নিউট্রাল গ্যাস আয়নিত হলো। মহাবিশ্ব আস্তে আস্তে গ্যাস থেকে
ফুটন্ত তরল তারপর গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ উপগ্রহের স্ট্রাকচার পেলো। এগুলি আমরা
নির্ভরযোগ্য তত্ত্ব থেকে জানি। কিন্তু সরাসরি তেমন জোরালো প্রমাণ এখনো আমাদের হাতে
নেই। জেমস ওয়েব আমাদের সেই প্রমাণ জোগাবে বলে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস।
প্রকাশিত দ্বিতীয় ছবিটি স্টিফেন্স কুইনটেট (Stephan’s Quintet)। এই ছবিটি হলো এপর্যন্ত জেমস ওয়েবের তোলা সবচেয়ে বড় ছবি। এর ব্যাস চাঁদের ব্যাসের এক পঞ্চমাংশ। পনেরো কোটি পিক্সেলের এই ছবিতে আছে পাঁচটি গ্যালাক্সির একটি গ্রুপ – পরস্পরের কাছাকাছি আসছে ২৯০ মিলিয়ন আলোক-বর্ষ দূরের পেগাসাস নক্ষত্রপুঞ্জে। এই ছবি থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে – এর কেন্দ্রে আছে একটি সুপারম্যাসিভ – প্রচন্ড ভরসম্পন্ন ব্ল্যাকহোল – যেখান থেকে একটি নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে। এখান থেকে যে ডাটা পাওয়া গেছে সেখান থেকে জানা যাবে নক্ষত্রের জন্ম কীভাবে হয়, সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের জন্মও কীভাবে হয়।
তৃতীয় ছবিটি ক্যারিনা নেবুলা (CARINA NEBULA)
সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং বৃহত্তম নেবুলা হচ্ছে ক্যারিনা নেবুলা। নেবুলা হচ্ছে নক্ষত্রের জন্মভূমি – গ্যাস ও ধুলিকণা যেখান থেকে নক্ষত্রের জন্ম হয়। নক্ষত্রের উপাদানগুলির ভেতরের অনেক তথ্য জানা যাবে এখান থেকে – কারণ ইনফ্রারেড রে শনাক্ত করে বিশ্লেষণ করার উপায় আছে জেমস ওয়েবে। এথেকে নক্ষত্র কীভাবে সৃষ্টি হয় তা আরো ভালোভাবে জানা যাবে। ক্যারিনা নেবুলা সাউদার্থ কনস্টেলেশান ক্যারিনা থেকে ৭৬০০ আলোক-বর্ষ দূরে। এই ছবিতে যতগুলি ছোট ছোট উজ্জ্বল বিন্দু দেখা যাচ্ছে সেগুলি সবই নতুন নক্ষত্র। শত শত নতুন নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে এই ছবিতে। আরো অনেক পরিষ্কার ঘটনা দেখা যাচ্ছে যেগুলি নতুন তথ্য দেবে আমাদের।
চতুর্থ ছবি
সাউদার্ন
রিং নেবুলা (SOUTHERN RING NEBULA)
সাউদার্ন রিং নেবুলা হলো – প্লেনেটারি নেবুলা – যেখানে আছে গ্যাসের মেঘ যা সম্প্রসারিত হচ্ছে চারদিকে। গ্যাসগুলি মৃতপ্রায় নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরছে, অথবা দুটো মৃতপ্রায় নক্ষত্র – একে অপরের চার পাশে ঘুরছে । এর ব্যাস প্রায় অর্ধ-আলোকবর্ষ (এক আলোকবর্ষের অর্ধেক)। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব প্রায় দুই হাজার আলোকবর্ষ। ফেনার মতো কমলা রঙের যে কোষগুলি দেখা যাচ্ছে – ওগুলি হাইড্রোজেন অণু। দুটো হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে হাইড্রোজেন অণু তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রে যে নীল রঙের অংশ দেখা যাচ্ছে – সেগুলি আয়নিত গ্যাস। ডান পাশের চিত্রে দেখা যাচ্ছে দুটো নক্ষত্র ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে কেন্দ্রে। এখান থেকে যে ডাটা সংগ্রহ করা হচ্ছে সেখান থেকে জানা যাবে নক্ষত্রের মৃত্যু কীভাবে হয়। নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ এর আগে কখনো হয়নি।
জেমস ওয়েব স্পেস
টেলিস্কোপ তার বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য অনুসারে মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্রহে অনুসন্ধান চালাচ্ছে
সেখানে কোথাও কোন প্রাণ ধারণের উপাদান পাওয়া যায় কি না। প্রাথমিক ছবিগুলির মধ্যে আমাদের
সৌরজগতের বাইরের এক বিশাল গ্যাসীয় গ্রহ WASP-96 b তে পানির অস্ত্বিত্বের প্রমাণ প্রকাশ
করেছে। আমাদের সূর্যের মতো একটি নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরছে এই বিশাল গ্যাসীয় গ্রহ। শত
শত আলোকবর্ষ দূরের গ্রহের গ্যাসীয় উপাদান বিশ্লেষণ করার বৈজ্ঞানিক দক্ষতা আছে জেমস
ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের – এই ছবি তারই প্রমাণ।
মহাকাশ দেখার
এতদিনের শক্তিশালী মাধ্যম হাবল টেলিস্কোপ মহাকাশ সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা দিয়েছিল
– সেই ধারণার সরাসরি প্রত্যক্ষ করার জন্য আরো শক্তিশালী টেলিস্কোপ – জেমস ওয়েব স্পেস
টেলিস্কোপ – আমাদের চোখের সামনে এনে দিচ্ছে মহাকাশের গভীর থেকে গভীরের চিত্র। আগে যা
আমাদের কল্পনা করে নিতে হয়েছে এখন সেগুলি বাস্তবে চলে আসতে শুরু করেছে। আগামী দশ বছর
ধরে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ আমাদের মহাবিশ্বের অনেক নতুন রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম
হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
তথ্যসূত্র:
১। মারিয়া আরিয়াস,
দ্য কসমস অ্যাজ উই হ্যাভ নেভার সিন বিফোর, নিউ সায়েন্টিস্ট, ৯ জুলাই ২০২২।
২। মার্টিন
বারস্টো, দ্য কনভারসেশান ১৩ জুলাই, ২০২২।
৩। কার্ল গ্ল্যাজারব্রুক ও সাইমন ড্রাইভার, দ্য কনভারসেশান,
১৩ জুলাই ২০২২।
৪। বিজ্ঞানচিন্তা
নভেম্বর ২০২১।
৫।
webb.nasa.gov
No comments:
Post a Comment