মহাবিশ্বে যতগুলি
কণা (particle) আছে, তাদের সবগুলিকে প্রধানত দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। একভাগের নাম বোসন,
অন্যভাগের নাম ফার্মিয়ন। বাঙালি হিসেবে আমরা গর্বের সাথে জানি – এই বোসন নামটা এসেছে
সত্যেন বসুর নাম থেকে। বোস থেকে বোসন। তেমনিভাবে, অন্যভাগের নামটা এসেছে এনরিকো ফার্মির
নাম থেকে। বোসন কণাগুলি পাউলির বর্জননীতি (Pauli’s exclusion principle) মেনে চলে না।
অর্থাৎ একই পরমাণুর মধ্যে তাদের প্রত্যেককে স্বতন্ত্র হতে হয় না। যেমন আলোর কণা ফোটন;
একই শক্তিসম্পন্ন হলে, একটি ফোটন থেকে অন্য ফোটনকে আলাদা করে চেনার উপায় থাকে না। কিন্তু
ফার্মিয়নের ব্যাপার আলাদা। ফার্মিয়ন কণাগুলি খুবই শ্রেণিবিভাজন মেনে চলে। যেমন ইলেকট্রন,
প্রোটন কিংবা নিউট্রন। একই পরমাণুর একই শক্তিস্তরে থাকলেও, তাদের প্রত্যেকের কোয়ান্টাম
সংখ্যায় কোনো না কোনোভাবে পার্থক্য থাকতে হয়। কণার এই বিভাজনের ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠিত
হয়েছিল ১৯২৭ সালে ইতালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি এবং ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী
পল ডিরাক যখন কণাগুলির জন্য ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিসটিক্স প্রতিষ্ঠা করেন। এর তিন বছর
আগে ১৯২৪ সালে আমাদের সত্যেন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে স্বয়ং আইনস্টাইনের সাথে মিলে
আবিষ্কার করেন বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স।
ইতালিয়ান বিজ্ঞানী
এনরিকো ফার্মিকে তাঁর সমসাময়িক পদার্থবিজ্ঞানীরা বলতেন “পোপ অব ফিজিক্স”। রোমান ক্যাথলিকরা
যেমন তাঁদের পোপকে সকল ধর্মীয় সমস্যার সমাধান মনে করেন, তেমনি পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে
মনে করা হতো – এনরিকো ফার্মির কাছেই আছে সকল সমস্যার সমাধান।
পদার্থবিজ্ঞানের
– বিশেষ করে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের ধারাবাহিক উন্নতি হয়েছে এনরিকো ফার্মির হাতে। আজ
আমরা নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ মাপতে দৈর্ঘ্যের খুব ছোট একটা একক ব্যবহার করি – যার নাম
ফার্মি ( ১ মিটারের ১০০০০০০০০০০০০০০০ ভাগের এক ভাগ; ১ এর পর পনেরটা শূন্য)। নিউক্লিয়াসের
ফিশান প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছেন ফার্মি। তিনিই সঠিকভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিটাক্ষয়ের
(beta decay)। প্রথম পারমাণবিক বোমার অন্যতম কারিগর ছিলেন এনরিকো ফার্মি। তাঁর হাতেই
তৈরি হয়েছে পৃথিবীর প্রথম নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর। আজ পৃথিবীর প্রয়োজনীয় জ্বালানির একটি
বড় অংশের জোগান আসছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। এরজন্য যে মানুষটাকে আমাদের প্রতিদিন
স্মরণ করা উচিত তিনি – এনরিকো ফার্মি।
১৯৩৮ সালে তিনি
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।
ইতালিতে মুসোলিনির
ফ্যাসিজম থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে আমেরিকায় চলে যেতে হয়েছিল এনরিকো ফার্মিকে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে
অধ্যাপনা করেছেন, গবেষণা করেছেন লস আলামোস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে।
খুব বেশিদিন
বাঁচেননি এই বিজ্ঞানী। ১৯০১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইতালির রোমে জন্ম হয়েছিল তাঁর। ১৯৫৪
সালের ২৮ নভেম্বর মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন পাকস্থলীর ক্যান্সারে। পারমাণবিক
বিকিরণ নিয়ে গবেষণা করতে করতে নিজেই শিকার হয়েছেন তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়।
তাঁর মৃত্যুর
পর আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি তাঁর নামে আন্তর্জাতিক পুরষ্কার প্রবর্তন করে
– এনরিকো ফার্মি পুরষ্কার। প্রথম পুরষ্কারটি এনরিকো ফার্মিকেই দেয়া হয় মরণোত্তর। একশতম
মৌলিক পদার্থের নামকরণ করা হয় – ফার্মিয়াম। আমেরিকার প্রধান একটি জাতীয় গবেষণাগারের
নাম রাখা হয় – ফার্মি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি।
তথ্যসূত্র:
1. World Book's Biographical Encyclopedia of Scientists, World Book, Chicago, 2003.
2. Gino Segre and Bettina Hoerlin, The Pope of Physics Enrico Fermi and the birth of the atomic age, Henry Holt and Company, New York, 2016.
No comments:
Post a Comment