জান বাটিস্ট
পাহ্রান (Jean Baptiste Perrin) ছিলেন খ্যাতনামা ফরাসী পদার্থবিজ্ঞানী। উনবিংশ শতাব্দীর
শেষের দশক থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক যুগান্তকারী
আবিষ্কারের সাথে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতির
যে তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তা পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করেছিলেন তিনি। সেজন্য
১৯২৬ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন তিনি।
১৮৭০ সালের
৩০ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের লিলে শহরে জন্ম হয়েছিল জান বাটিস্ট পাহরানের। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর
পর্যায়ে পড়াশোনা করেছেন ফ্রান্সের বিখ্যাত ইকল নরমাল সুপেরিয়র ইউনিভার্সিটিতে। ১৮৯৪
থেকে ১৮৯৭ পর্যন্ত তিনি সেখানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে গবেষণাসহকারী হিসেবে কাজ করেন।
সেই সময় জার্মানিতে রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কার করেছেন। পুরো ইওরোপজুড়ে তখন এক্স-রে নিয়ে
মাতামাতি শুরু হয়ে গেছে। পাহ্রানের ল্যাবেও তখন এক্স-রে ও ক্যাথোড রে নিয়ে চলছে তুমুল
গবেষণা। এই গবেষণার ভিত্তিতে ১৮৯৭ সালে থিসিস লিখে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি অর্জন করেন
পাহ্রান।
ডিএসসি অর্জন
করার পর পরই তিনি সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগে যোগ দেন। ১৯১০
সালে তিনি সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। এই পদে তিনি ছিলেন ১৯৪০ সাল
পর্যন্ত।
পাহ্রানের
প্রথম দিকের গবেষণা ছিল ক্যাথোড রশ্মি সংক্রান্ত। তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে ক্যাথোড়
রশ্মিগুলি মূলত নেগেটিভ চার্জবিশিষ্ট কণা – আমরা এখন জানি যে ওগুলি আসলে ইলেকট্রনের প্রবাহ।
১৮৯৭ সালের আগে ইলেকট্রন আবিষ্কৃত হয়নি। এক্স-রে নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন তিনি। গ্যাসের
ভেতর এক্স-রে চালনা করলে প্রবাহে কী ধরনের
পরিবর্তন হয়, তা তিনি বের করেন। শব্দের পরিচলন নিয়েও গবেষণা করেছিলেন তিনি।
কিন্তু তাঁর
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা হলো ব্রাউনিয়ান গতি সংক্রান্ত গবেষণা। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন
তাঁর একটি গবেষণাপত্রে [On the Motion of small Particles Suspended in Liquids at
Rest Required by the Molecular-Kinetic Theory of Heat, Annalen der Physik, সংখ্যা
১৭(১৯০৫), পৃষ্ঠা ৫৪৯-৫৬০] ব্রাউনিয়ান গতি (Brownian Motion) সম্পর্কে আলোচনা করলেন।
কোন তরল পদার্থের ওপর খালি চোখে দেখা যায় না এরকম ছোট ছোট পদার্থের কণা ভাসতে থাকলে
কণাগুলোর গতি কোন নির্দিষ্ট নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাদের গতি হয় অত্যন্ত অনিয়মিত।
আঠারো শতকে স্কটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ব্রাউন এ
গতি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন বলে এ গতির নাম দেয়া হয়েছে ব্রাউনিয়ান গতি। আইনস্টাইন এই
গবেষণাপত্রে প্রমাণ করেন যে এক মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের একভাগের সমান বা তার চেয়েও
ছোট কণাগুলো তরল পদার্থে ওরকম বিশৃঙ্খলভাবে চলাফেরা করার কারণ হলো তাদের থার্মাল ডায়নামিক্স।
বোল্টজম্যানের সূত্র ব্যবহার করে আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতির গাণিতিক ব্যাখ্যা দেন এবং
গ্যাসের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুগুলোর গতির গাণিতিক সূত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
পাহ্রান আইনস্টাইনের
এই তত্ত্বীয় গবেষণার ভিত্তিতে পরীক্ষাগারে ব্রাউনিয়ান গতির পরীক্ষা করে দেখেন। তাঁর
পরীক্ষার ফলাফল থেকে তিনি সঠিকভাবে এভোগাড্রো সংখ্যার মান নির্ণয় করতে সক্ষম হন। এই
গবেষণার জন্য তিনি ১৯২৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান।
বিজ্ঞানী পাহ্রানের
উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফ্রান্সের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ। পরবর্তীতে
সেখানে গবেষণা করে ফ্রান্সের অনেক বিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।
১৯৩৮ সালে ফ্রান্সের
একাডেমি অব সায়েন্স-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রফেসর জান পাহ্রান।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের
সময় ফ্রান্সের হয়ে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন জান পাহ্রান। কিন্তু দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর ১৯৪০ সালে যখন হিটলার ফ্রান্স আক্রমণ করলো, সত্তর বছরের বৃদ্ধ
পাহ্রানের আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।
১৯৪২ সালের
১৭ এপ্রিল নিউইয়র্কেই মৃত্যু হয় বিজ্ঞানী জান পাহ্রানের। ১৯৪৮ সালে ফরাসি সরকার জান
পাহ্রানের দেহাবশেষ নিউইয়র্ক থেকে প্যারিসে নিয়ে এসে দেশের মাটিতে সসম্মানে সমাহিত
করার ব্যবস্থা করে।
No comments:
Post a Comment