Thursday, 21 December 2023

অ্যাটোসেকেন্ড পদার্থবিজ্ঞান

 


পূরবীর শেষ বসন্ত কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “সময় রয়েছে বাকি; সময়েরে দিতে ফাঁকি, ভাবনা রেখো না মনে কোনো।“ কিন্তু কবি যতই নিশ্চিন্ত আশ্বাসের বাণী দিন, ভাবনা রয়ে যায়। বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয় হলো – সময়। এখানে এখন ক্ষুদ্রতম সময়েরেও ফাঁকি দেয়া দিনে দিনে অসম্ভব হয়ে উঠছে। ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম বইতে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং দেখিয়েছেন মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক বিবর্তন আর সময়ের ইতিহাস সমতুল। সময় এবং স্থানের পারস্পরিক জটিল সম্পর্কের ভেতর থেকে আইনস্টাইন বের করে এনেছেন আপেক্ষিকতার তত্ত্ব – যা বদলে দিয়েছে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। সময় সম্পর্কে আমরা যতই জানছি – ততই জটিল হয়ে যাচ্ছে সময়ের সংজ্ঞা, সময়ের সমীকরণ। 

সময়ের ধারণা কীভাবে ধরা দেয় আমাদের মনে? আমরা আমাদের পারিপার্শ্বিক ঘটনার পরিবর্তনের সাথে তুলনা করে সময় বোঝার চেষ্টা করি। যেমন হৃৎপিন্ডের একটি স্পন্দনের সময় – মোটামুটি এক সেকেন্ড ধরা যায়। দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনায় আমরা অনেক সময় বলে থাকি এক নিমেষেই ঘটে গেল সব। বাংলায় এই নিমেষ হলো চোখের পলক ফেলতে যতটুকু সময় লাগে। চোখের পলক ফেলতে গড়ে একশ থেকে দেড়শ মিলিসেকেন্ড সময় লাগে, অর্থাৎ ধরা যায় এক সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ সময় লাগে। নিমেষের হিসেবে ধরলেও এক সেকেন্ড অনেক লম্বা সময়। 

কোনো একটি ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ সময় লাগে তা স্বাভাবিক নিয়মে হিসেব করতে হলে আমাদের ঘটনাটা ঘটতে দেখা চাই। আবার যেকোনো কিছু সরাসরি দেখার জন্য আমাদের আলোর দরকার। কিন্তু আলো থাকলে এবং আমাদের চোখের সামনে ঘটনা ঘটলেই কি আমরা দেখতে পাই সবকিছু? না, পাই না। কারণ আমাদের চোখের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের চোখের স্বাভাবিক রেজ্যুলেশান বা সূক্ষ্মদর্শনের ক্ষমতা মাত্র একশ মাইক্রোমিটার। অর্থাৎ কোন বস্তু যদি এক মিলিমিটারের দশ ভাগের এক ভাগের চেয়ে ছোট হয়, স্বাভাবিক চোখে আমরা তা দেখতে পাবো না। 

আবার দেখার জন্য যে আলো লাগে – সেই আলোর তরঙ্গের খুব সামান্য অংশই – চার শ ন্যানোমিটার থেকে সাত শ ন্যানোমিটার পর্যন্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো – আমাদের চোখের রেটিনার কোষের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করতে পারে। তাই চারশ ন্যানোমিটারের কম বা সাত শ ন্যানোমিটারের বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের  আলো আমরা দেখতে পাই না। বাতাস ভরযুক্ত অক্সিজেন, নাইট্রোজেনসহ আরো কয়েকটি গ্যাসের মিশ্রণ – কিন্তু আমরা বাতাস দেখতে পাই না। রাসায়নিক কিংবা ভৌতবিক্রিয়া অনবরত ঘটছে আমরা জানি, কিন্তু সরাসরি তা দেখতে পাই না। বলা যায় বস্তুজগতের বেশিরভাগ সূক্ষ্ম ঘটনা, দ্রুততম সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। 

কিন্তু সরাসরি দেখতে না পারলে কী হবে, পরোক্ষভাবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঘটনাগুলি দেখার অনেক পদ্ধতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। ২০২৩ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে এমনই আশ্চর্যজনক ক্ষুদ্রতম সময়ে ঘটা ঘটনাগুলি দেখার পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য – যার নাম দেয়া হয়েছে অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্স। এই অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্স দ্রুততম সময়ে ঘটা ইলেকট্রনের কাজকর্ম দেখারও সুযোগ করে দিচ্ছে। এটা এমনই এক আশ্চর্যজনক ফিজিক্স – যা বুঝতে হলে আমাদের ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে অনেককিছু। 

শুরুতেই দেখা যাক – অ্যাটোসেকেন্ড বলতে কতটুকু সময় বোঝায়। এক অ্যাটোসেকেন্ড হলো ১০-১৮ সেকেন্ড। অর্থাৎ এক সেকেন্ডকে একশ কোটি ভাগ করে তার এক ভাগকে আবার এক শ কোটি ভাগ করলে এক ভাগের যে সময় হবে সেটা। আলো এক সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার যেতে পারে। অটোসেকেন্ডের হিসেব করলে এক মিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে আলোর সময় লাগবে প্রায় তিনশ ত্রিশ কোটি অ্যাটোসেকেন্ড।  অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্স হলো অ্যাটোসেকেন্ড স্কেলের পরিমাপের মতো সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আলোর স্পন্দন তৈরি করার পদার্থবিজ্ঞান – যে স্পন্দনের মাধ্যমে সেই সূক্ষ্মতম স্কেলে পরিমাপযোগ্য সময়ের ভেতর ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি দেখা সম্ভব।

দ্রুততম সময়ে ঘটা ঘটনাগুলি আমরা কীভাবে দেখতে পারি? যেমন ক্রিকেট খেলার কথা ধরা যাক। একজন ফাস্টবোলার যখন বল করেন, তখন ক্যামেরাম্যানরা সেই বল ব্যাটারের ব্যাটে লাগার মুহূর্তের ছবি তোলার জন্য লম্বা লম্বা লেন্স তাক করে বসে থাকেন। তখন তাদের ক্যামেরার শাটার স্পিড এমনভাবে  সেট করা থাকে যেন দ্রুততম সময়ে ঘটনাটির ছবি তোলা যায়। ঘটনাটি যে বেগে ঘটবে, শাটারের বেগ হতে হবে তার চেয়ে বেশি। নইলে ছবি ঝাপসা হয়ে যাবে। শাটারের বেগ বেশি হবার অর্থ হলো ক্যামেরার ডায়াফ্রাম খোলা হবে খুব কম সময়ের জন্য। প্রচন্ড গতিশীল বস্তুর উপর তখন খুব কম সময়ের জন্য আলো পড়ে সেই সময়টিকে স্থির করে ধরে নেবে ক্যামেরায়। 

কিন্তু ক্রিকেট বলের গতির চেয়ে কোটি কোটি গুণ দ্রুত ঘটে পরমাণুর ইলেকট্রনের কাজকর্ম। ইলেকট্রনের কক্ষপথ কিংবা শক্তিস্তরের পরিবর্তন ঘটতে সময় নেয় মাত্র কয়েকশ অ্যাটোসেকেন্ড। অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্স-এর প্রয়োগে ইলেকট্রনের দ্রুততম গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার সম্ভাবনার দরজা খোলার চেষ্টা করে চলেছেন যে ক’জন বিজ্ঞানী গত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে – তাঁদেরই তিনজন অগ্রনায়ককে এবছর পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়েছে। এই তিনজন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী হলেন – অ্যান লুইলিয়ের, ফেরেঙ্ক ক্রাউজ এবং পিয়ের আগস্তিনি। 


 পিয়ের আগস্তিনি, ফেরেঙ্ক ক্রাউজ এবং অ্যান লুইলিয়ের


নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের মধ্যে নারী বিজ্ঞানীর সংখ্যা এখনো পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। ১৯০১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত – চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন মাত্র তেরো জন নারী, রসায়নে মাত্র আট জন, এবং পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে কম – মাত্র পাঁচজন। ১৯০৩ সালে মেরি কুরির পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পাবার পরবর্তী ষাট বছর আর কোন নারী পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পাননি। ১৯৬৩ সালে মারিয়া গোয়েপার্ট মেয়ার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার জয়ী দ্বিতীয় বিজ্ঞানী। এরপর আবার পঞ্চান্ন বছরের দীর্ঘ বিরতি। অবশেষে ২০১৮ সাল থেকে এবছর পর্যন্ত আরো তিনজন নারী পদার্থবিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্সের অগ্রনায়ক প্রফেসর অ্যান লুইলিয়ার নোবেলজয়ী পঞ্চম নারী পদার্থবিজ্ঞানী। এবছরের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার সেহিসেবেও অনন্য মাত্রা পেয়েছে। 

অ্যান লুইলিয়ার (Anne L’Huillier)-এর জন্ম ১৯৫৮ সালের ১৬ আগস্ট ফ্রান্সের প্যারিসে। প্যারিসের ইকোল নরমাল সুপেরিয়র থেকে পদার্থবিজ্ঞানে বিএ পাস করার পর পিয়ের অ্যান্ড মেরি কুরি ইউনিভার্সিটি থেকে গণিত ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে ডাবল মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানে ১৯৮৬ সালে। তাঁর থিসিসের শিরোনাম ছিল ‘মাল্টিফোটন অ্যান্ড মাল্টিইলেকট্রন আয়নাইজেশান’। উচ্চ তীব্রতার লেজার রশ্মি প্রয়োগে একাধিক ফোটন এবং ইলেকট্রনের আয়নাইজেশান সংক্রান্ত গবেষণা করেন তিনি তাঁর পিএইচডির সময় – যা পরবর্তীতে আরো গভীরে গিয়ে তাঁর নোবেল পুরষ্কারের পথ তৈরি করেছিল। 

পিএইচডি করার পর তিনি সুইডেনের গুথেনবার্গের কালমার্স ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে পোস্টডক ফেলো হিসেবে যোগ দেন, এবং এর কিছুদিন পর আমেরিকার লস এঞ্জেলেস-এ ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যান। তবে বেশিদিন ছিলেন না সেখানে। ইতোমধ্যে তিনি ফ্রান্সের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের অধীনে যে নয়টি গবেষণাকেন্দ্র আছে – তাদের অন্যতম কেন্দ্র স্যাকলে সেন্টারে গবেষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯২ সালে তিনি সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে টাইটানিয়াম-স্যাফায়ার সলিড স্টেট লেজার সিস্টেমে কাজ করেন। ওটা ছিল ইওরোপের প্রথম ফেমটোসেকেন্ড পাল্‌স উৎপাদনক্ষম লেজার। ফেমটোসেকেন্ড হলো ১০-১৫ সেকেন্ড, অর্থাৎ এক সেকেন্ডের একশ কোটি ভাগের একভাগ সময়কে আরো দশ লক্ষ ভাগ করলে প্রতি ভাগ সময়ের সমান। ফেমটোসেকেন্ড পাল্‌স হলো ফেমটোসেকেন্ড স্থায়ী আলোর স্পন্দন। লেজারের সাহায্যে এরকম স্পন্দন তৈরি করা শুরু হয়েছিল ১৯৯০র দশকে। ১৯৯৪ সালে অ্যান পাকাপাকিভাবে প্যারিস থেকে সুইডেনে চলে যান লুন্ড ইউনিভার্সিটির লেকচারার হিসেবে। ১৯৯৭ সালেই তিনি লুন্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ২০০৪ সালে তিনি সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্যপদ লাভ করেন। ২০০৭ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত তিনি নোবেল কমিটি ফর ফিজিক্সের সদস্য ছিলেন। সেই আট বছর তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন। 

তাঁর গবেষণা –  তাঁকে নোবেল পুরষ্কার ছাড়াও আরো অনেক পুরষ্কার এনে দিয়েছে। ২০০৩ সালে তিনি পেয়েছেন জুলিয়াস স্প্রিঙ্গার প্রাইজ, ২০১১ সালে পেয়েছেন ইউনেস্কোর লরিয়াল ওম্যান ইন সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড, ২০১৩ সালে পেয়েছেন কার্ল-জেইস রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড, ২০১৮ সালে মনোনীত হয়েছেন আমেরিকান ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের ফরেন অ্যাসোসিয়েট, ২০১৯ সালে পেয়েছেন ইওরোপিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটির প্রাইজ ফর ফান্ডামেন্টাল এস্পেক্টস অব কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড অপটিক্স। ২০২১ সালে তিনি পেয়েছেন অপটিক্যাল সোসাইটি অব আমেরিকার ম্যাক্স বর্ন অ্যাওয়ার্ড। ২০২২ সালে তিনি পেয়েছেন ইজরায়েলের উল্‌ফ ফাউন্ডেশানের উল্‌ফ প্রাইজ ফর ফিজিক্স। গত বেশ কয়েক বছর থেকে দেখা যাচ্ছে যাঁরা উল্‌ফ প্রাইজ পান, তাঁদের নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় অনেকগুণ। তাই ২০২২ সালে উল্‌ফ প্রাইজ পাবার পর অনেকেই সঠিকভাবে ধারণা করেছিলেন যে অ্যান লুইলিয়ার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পাবেন। 

২০২২ সালের উল্‌ফ ফিজিক্স প্রাইজ পেয়েছেন তিনজন – যাদের মধ্যে দু’জন এবার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। দ্বিতীয় জন হলেন জার্মানির প্রফেসর ফেরেঙ্ক ক্রাউজ (Ferenc Krausz) । ম্যাক্স প্ল্যাংক ইন্সটিটিউট অব কোয়ান্টাম অপটিক্স -এর পাঁচজন ডিরেক্টরের একজন হলেন ফেরেঙ্ক ক্রাউজ। একই সাথে তিনি মিউনিখ লুডবিগ ম্যাক্সিমিলান ইউনিভার্সিটিরও প্রফেসর। 

ফেরেঙ্ক ক্রাউজের জন্ম ১৯৬২ সালের ১৭ মে হাঙ্গেরিতে। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত তিনি হাঙ্গেরির ইউটভোস লোরান্ড ইউনিভার্সিটিতে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি এবং টেকনিক্যাল ইউইভার্সিটি অব বুদাপেস্ট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ভিয়েনায় চলে যান পিএইচডি করার জন্য। ১৯৯১ সালে তিনি ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিক্সে পিএইচডি অর্জন করেন। এরপর মাত্র দুবছরের মধ্যেই তিনি ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে ‘হ্যাবিলিটেশান’ সম্পন্ন করেন। এই হ্যাবিলিটেশান পদ্ধতিটি  ইওরোপের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে অবশ্যই লাগে। শুধুমাত্র পিএইচডি সম্পন্ন করলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত থেকে দীর্ঘদিন ধরে ক্লাসরুমে পড়ানো এবং গবেষণার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন নিয়মিত বেতন-ভাতাও পাওয়া যায় না। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটির কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়। গবেষণার জন্য গবেষণা-বক্তৃতা দিতে হয় এবং প্রতিপক্ষের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। অনেক সময় পাঁচ থেকে দশ বছর সময় লেগে যায় এসব সম্পন্ন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে। অবশ্য এটা হয়ে গেলে তখন পূর্ণ অধ্যাপকের মর্যাদা পাওয়া যায়। ফেরেঙ্ক ক্রাউজ খুব কম সময়ের মধ্যে ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির শিক্ষক হয়ে গেলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ফুল প্রফেসর হয়ে গেলেন। ২০০০ সালে তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এডভান্সড লাইট সোর্সেস-এর ডিরেক্টর নিযুক্ত হলেন। এর তিন বছর পর ২০০৩ সালে তিনি জার্মানিতে ম্যাক্স প্লাংক ইন্সটিটিউট অব কোয়ান্টাম অপটিক্‌স এর ডিরেক্টর পদে যোগ দেন। ২০০৪ সাল থেকে তিনি মিউনিখের লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান ইউনিভার্সিটির এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সেরও চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করে আসছেন। 

অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্সের একজন পথিকৃৎ বলে ধরা হয় প্রফেসর ক্রাউজকে। এবছরের নোবেল পুরষ্কার পাবার আগে তিনি গত দুই দশক ধরে অনেকগুলি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা পুরষ্কার পেয়েছেন। ২০০৫ সালে পেয়েছেন জার্মান রিসার্চ ফাউন্ডেশানের লিবনিজ প্রাইজ, ২০০৬ সালে পেয়েছেন ইলেকট্রোঅপটিক সোসাইটির কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিক্স অ্যাওয়ার্ড এবং ব্রিটিশ রয়েল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রগ্রেস মেডেল। ২০১১ সালে পেয়েছেন ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানির গবেষণা পুরষ্কার, ২০১৩ সালে পেয়েছেন কিং ফয়সাল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, একই বছর পেয়েছেন অটো হ্যান পুরষ্কার, ২০১৯ সালে পেয়েছেন ভ্লাডিলেন লেটোকভ মেডেল, ২০২২ সালে পেয়েছেন উল্‌ফ প্রাইজ ইন ফিজিক্স। 

এবছরের তিনজন নোবেলজয়ীর মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র অথচ সবচেয়ে নিভৃতচারী বিজ্ঞানী হলেন ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক পিয়ের আগস্তিনি (Pierre Agostini)। নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার আগে এই মানুষটির কোন উইকিপিডিয়া পেজও ছিল না। ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটেও যেনতেনভাবে একটি পুরনো ছবির সাথে মাত্র দু-তিন লাইনের পরিচিতি ছিল প্রফেসর আগস্তিনির। পুরষ্কার ঘোষণার আগে নোবেল কমিটি ফোনে যোগাযোগও করতে পারেননি পিয়েরের সাথে। [ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পোস্টডক করার সময় পিয়ের আগস্তিনিকে এবং তাঁর কাজকর্মের কিছুটা কাছ থেকে  দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। তখন তিনি চৌষট্টি বছর বয়সে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সবেমাত্র যোগ দিয়েছেন প্রফেসর হিসেবে। তাঁর কাজকর্মে কেমন যেন একটা সন্নাসীসুলভ আচরণ ছিল, কিছুতেই যেন কিছু যায় আসে না এরকম একটা ভাব। এত বছর পর বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ পুরষ্কার নোবেলস্বীকৃতি পাবার পরেও তাঁর ভেতর সেরকম কোন উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। তাঁর মেয়ে ফোন করে তাঁকে জানিয়েছেন যে তিনি গুগলে দেখেছেন যে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।]

১৯৪১ সালের ২৩ জুলাই ফ্রেন্স টিউনিসিয়ার টিউনিসে জন্ম পিয়ের আগস্তিনির। ১৯৫৯ সালে ফ্রান্সের প্রাইতানি ন্যাশনাল মিলিটারি স্কুল থেকে স্কুল পাস করে দক্ষিণ ফ্রান্সের এইক্স-মারসিলি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলেন। ১৯৬১ সালে ফিজিক্সে বিএড এবং ১৯৬২ সালে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি অপটিক্সে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। আলট্রাভায়োলেট রশ্মির মাল্টিলেয়ার ডায়ইলেকট্রিক ফিল্টার নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করেন আগস্তিনি। পিএইচডি করার পরের বছরই পিয়ের যোগ দেন ফ্রান্স এটমিক এনার্জি কমিশনের স্যাকলে সেন্টারে। সেখানেই তিনি গবেষণা করেছেন পরবর্তী চৌত্রিশ বছর। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত  অ্যান লুইলিয়ার এই গবেষণাকেন্দ্রে পিয়ের আগস্তিনির সহকর্মী ছিলেন। কিন্তু সেই সময় তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যৌথগবেষণা সেরকম হয়নি। তাঁরা যে একদিন নোবেল পুরষ্কার শেয়ার করবেন সেদিন কেউই ভাবতে পারেননি। ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ পর্যন্ত পিয়ের আগস্তিনি নিউইয়র্কের ব্রুকহ্যাভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করার পর ২০০৫ সালে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন প্রফেসর হিসেবে। ২০১৮ সালে ৭৭ বছর বয়সে তিনি অবসর গ্রহণ করার পর ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এবছর তিনি নোবেল পুরষ্কার পাবেন এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। অবশ্য এর আগে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পুরষ্কার পেয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে ফ্রেন্স একাডেমি অব সায়েন্সের গুস্তাভ রিবাউড প্রাইজ, ২০০৩ সালে গে-লুসাক-হামবোল্ট প্রাইজ, ২০০৭ সালে অপটিক্যাল সোসাইটি অব আমেরিকার মেগার্স অ্যাওয়ার্ড ইন স্পেকট্রোস্কোপি। 

এবার দেখা যাক অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্সের উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ কীভাবে ঘটেছে। গত শতকের শেষের দুই দশকে লেজার বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নত ঘটেছে। লেজারের সাহায্যে ফেমটোস্কেলের আলোর স্পন্দন উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় আণবিক স্কেলের পরিবর্তনগুলি দেখা সম্ভব হয়েছে ফেমটোসেকেন্ড স্পন্দনের মাধ্যমে। উদ্ভব হয়েছিল ফেমটোকেমিস্ট্রির। বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষে ১৯৯৯ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছিল ফেমটোকেমিস্ট্রির জন্য। ফেমটোমিটার হলো ১০-১৫ মিটার। ক্যালটেকের প্রফেসর আহমেদ জিওয়াইল নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় অণুর মধ্যে পরমাণুগুলি কীভাবে চলাচল করে তা দেখার একটি পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য। তিনি সেটা করেছিলেন লেজার টেকনিক ব্যবহার করে। তখন ফেমটোকেমিস্ট্রির আবিষ্কার নিয়ে উদ্দীপ্ত হয়েছিল বিজ্ঞানসমাজ। এর কয়েক বছরের মধ্যেই জন্ম অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্সের।

ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়ের জন্য আলোর স্পন্দন তৈরি করা সম্ভব লেজার রশ্মির মাধ্যমে। এটা বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে লেজার কীভাবে তৈরি হয়। লেজার শব্দটি এসেছে লাইট অ্যামপ্লিফিকেশান বাই স্টিমুলেটেড এমিশান অব রেডিয়েশান (Light Amplification by Stimulated Emission of Radiation) থেকে। বিশেষ উদ্দীপনায় আলোর বিকিরণ ঘটিয়ে সাধারণ আলোর ক্ষমতা ও শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে তুলে লেজার তৈরি করা হয়। লেজার তৈরির প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯১৭ সালে। তিনি তাঁর ‘অন দি কোয়ান্টাম থিওরি অব রেডিয়েশান’ গবেষণাপত্রে ফোটনের ধর্ম কাজের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন [On the Quantum Theroy of Radiation, Physikalische Zeitschrift, vol 18 (1917) pp 121-128]। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন যদি কোন ফোটন কোন পরমাণুর ইলেকট্রনকে ধাক্কা দেয়, তবে ইলেকট্রনটি ফোটনের শক্তি শোষণ করে উত্তেজিত হবে। উত্তেজিত হয়ে ইলেকট্রনটি তার মূল শক্তিস্তর থেকে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যাবে। কিন্তু যদি ফোটন কোন উচ্চ শক্তিস্তরের ইলেকট্রনকে ধাক্কা দেয়, তখন উচ্চ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন তার অতিরিক্ত শক্তি ত্যাগ করে নিজের মূল শক্তিস্তরে ফিরে আসবে। এই শক্তিস্তর পরিবর্তনের সময় যে শক্তি ত্যাগ করবে সেই শক্তি যে ফোটনটি ধাক্কা দিয়েছিল সেই ফোটনের শক্তির সমান। এক্ষেত্রে একই শক্তির দুটি ফোটন একই দিকে একইভাবে ছুটে যাবে। এই দুটি ফোটন যদি আবার দুটি উত্তেজিত ইলেকট্রনকে ধাক্কা দেয়, আরো দুটি সমান শক্তির ফোটন পাওয়া যাবে। মোট ফোটন হবে চারটি। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে এই চারটি থেকে আটটি, আটটি থেকে ষোলটি, ষোলটি থেকে বত্রিশটি – এভাবে কোটি কোটি একই শক্তির ফোটনের স্রোত তৈরি হবে। এই ফোটনগুলির প্রত্যেকটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য সমান। ফলে এদের সম্মিলিত প্রাবল্য হবে সাধারণ আলোর চেয়ে অনেক বেশি। 


লেজার উৎপাদনের মূল পদ্ধতি


লেজার উৎপাদনের মূলনীতি হলো পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নীতি। পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রনগুলি নিউক্লিয়াসের চারপাশে নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়মে এগুলি কক্ষপথে বিন্যস্ত থাকে – প্রথম কক্ষপথে ২টি, ২য় কক্ষপথে ৮টি, ৩য় কক্ষপথে ১৮টি ইত্যাদি। ইলেকট্রনের কক্ষপথগুলি হলো তাদের শক্তিস্তর। একটি কক্ষপথে যতগুলি ইলেকট্রন থাকে সবগুলি ইলেকট্রনের শক্তি সমান। নিউক্লিয়াসের সবচেয়ে কাছের যে কক্ষপথ (১ম কক্ষপথ) – সেই কক্ষপথে যেসব ইলেকট্রন থাকে তাদের শক্তি সবচেয়ে কম। এই শক্তিস্তরকে গ্রাউন্ড স্টেট বলা হয়। ইলেকট্রনগুলি যদি কোনভাবে শক্তি শোষণ করে তখন তারা উত্তেজিত হয়ে নিজেদের শক্তিস্তর থেকে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। কিন্তু একটু পরেই সেই অতিরিক্ত শক্তি ত্যাগ করে নিজের শক্তিস্তরে ফিরে আসে। স্বতস্ফূর্তভাবে শক্তি নির্গমনের এই প্রক্রিয়াকে স্পনটেনিয়াস এমিশান (spontaneous emission) বলা হয়। পরমাণুর ইলেকট্রনগুলিকে যদি নির্দিষ্ট শক্তির ফোটনের সাথে মিথস্ক্রিয়া ঘটানো যায়, তাহলে ফোটনের শক্তি শোষণ করে ইলেকট্রনগুলি উত্তেজিত হয়ে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। তারপর যখন নিজের শক্তিস্তরে ফিরে আসে তখন যে শক্তি শোষণ করেছিল তা ফোটনের মাধ্যমে বের করে দেয়। এই নির্গত ফোটনের শক্তি শোষিত ফোটনের শক্তির সমান। ফোটনের প্রবাহ যদি অনবরত চলতে থাকে – তাহলে একটি ফোটন থেকে একই শক্তির ২টি ফোটন, ২টি থেকে ৪টি, ৪টি থেকে ৮টি ফোটন – এভাবে সেকেন্ডের মধ্যে কোটি কোটি ফোটনের প্রবাহ পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি ফোটনের শক্তি সমান এবং প্রত্যেকেই একই সাথে একই দিকে যায়। তীব্র প্রাবল্যের এই ফোটনপ্রবাহই লেজার। সাধারণ দৃশ্যমান আলোতে ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের যে কোন তরঙ্গ থাকতে পারে। তাই আলোকরশ্মি সমশক্তির হয় না এবং বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মিশ্রণের কারণে সবগুলি ফোটন একদিকে না গিয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু লেজারে সবগুলি ফোটনের শক্তি সমান, ফলে তরঙ্গদৈর্ঘ্যও সমান। ফলে তারা সব একবিন্দুতে কেন্দ্রীভূত থাকে। লেজার রশ্মি তাই একটুও না ছড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। পৃথিবী থেকে চাঁদের পৃষ্ঠে লেজার রশ্মি পাঠানো হয়, সেই রশ্মি একটুও ছড়িয়ে না পড়ে চাঁদের পিঠে রাখা আয়নাতে প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। 

সব ধরনের লেজারেরই মূল প্রস্তুত প্রণালী কমবেশি একই রকম। প্রথমে দরকার একটি উপযুক্ত পদার্থের অ্যামপ্লিফাইয়িং মিডিয়াম বা গেইন মিডিয়াম বা অ্যাকটিভ মিডিয়াম। এই মিডিয়ামের ইলেকট্রনকে উত্তেজিত করে ফোটন বের করা হয়। এই মিডিয়াম কঠিন, গ্যাস, সেমিকন্ডাক্টর ইত্যাদি হতে পারে। এই পদার্থের উপর বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের   আলো প্রয়োগ করলে পদার্থের ইলেকট্রন উত্তেজিত হয় এবং ফোটন নির্গত হয়। অ্যাকটিভ মিডিয়ামের আলোর ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মিডিয়ামের চারপাশে বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা করা হয়, অথবা অন্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোক রশ্মি প্রয়োগ করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় পাম্পিং। ফ্ল্যাশ লাইট বা অন্য লেজার দিয়েও এই পাম্পিং করা যায়। পাম্পিংসহ অ্যাকটিভ মিডিয়ামকে একটি সিলিন্ডার আকৃতির নলের মধ্যে স্থাপন করা হয়। এই নলটিকে বলা হয় লেজার ক্যাভিটি। এই নলের দুই প্রান্তে দুটি আয়না বসানো থাকে। নলের ভেতর যে আলো উৎপন্ন হয় সেই আলো এই আয়না দুটোতে অনবরত প্রতিফলিত হতে থাকে। একটি আয়না নলের ভেতরের সব আলোর প্রতিফলন ঘটায়। অন্যদিকের আয়নাটি পুরোপুরি প্রতিফলক নয়। সেই আয়না কিছুটা স্বচ্ছ – যার ভেতর দিয়ে লেজার রশ্মি বের হয়ে আসে। সাধারণত অ্যাকটিভ মিডিয়ামের নাম অনুসারে লেজারের নাম হয়ে থাকে। যেমন অ্যাকটিভ মিডিয়াম রুবি হলে – রুবি লেজার, গেইন মিডিয়াম আর্গন গ্যাস হলে আর্গন লেজার ইত্যাদি। বিভিন্ন মিডিয়াম থেকে উৎপন্ন লেজারের শক্তি এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্যও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

লেজারের ক্ষমতা ফেমটোসেকেন্ড স্পন্দনে আটকে ছিল অনেকগুলি বছর। ফেমটোসেকেন্ড পার হয়ে অটোসেকেন্ডে আসার জন্য আরো ছোট সময়ের পালস তৈরি করতে হয়েছে বিজ্ঞানীদের। কীভাবে সম্ভব হয়েছে এত ক্ষুদ্র সময়ের আলোর স্পন্দন তৈরি করা? 

একটি পদ্ধতি হলো – হাই হারমোনিক জেনারেশন (HHG) পদ্ধতি যেখানে পরমাণুর একটি ইলেকট্রন অনেকগুলি কম শক্তির ফোটন শোষণ করতে থাকে একের পর এক। এরপর একটি উচ্চশক্তির ফোটন বের করে দেয়। কিন্তু কয়েক দশক আগে এ ধরনের প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে ফোটনের শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে ফোটন নির্গমনের হার কমে যাচ্ছে। ফলে উচ্চ শক্তির আলোর স্পন্দন তৈরি করা সম্ভব হচ্ছিল না। 

১৯৮৭ সালে অ্যান লুইলিয়ার এবং তাঁর গবেষকদল আর্গন গ্যাসে ইনফ্রারেড লেজার (অবলোহিত লেজার) প্রয়োগ করে দেখলেন যে শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে নির্গত ফোটনের সংখ্যা সেভাবে কমে না গিয়ে বরং একটা স্থিতাবস্থায় আসছে। এই ব্যাপারটি খুবই আশাপ্রদ মনে হয়েছে তাঁর দলের কাছে। এর কয়েক বছরের মধ্যেই লুইলিয়ার এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন এইচএইচজি-তে আসলে কী হচ্ছে। 

আর্গন গ্যাসের মধ্যে লেজার রশ্মি চালনার ফলে  ইলেকট্রন তিনটি কাজ করছে এক সাথে। প্রথমত কোয়ান্টাম টানেলিং-এর মাধ্যমে ইলেকট্রন পরমাণু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তারপর ত্বরণ লাভ করে দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে। এরপর আবার আলোর তরঙ্গের দিক পরিবর্তনের সময় ইলেকট্রন তার নিজের জায়গায় ফিরে আসছে – শক্তিক্ষয় করে। এই শক্তিক্ষয় হচ্ছে উচ্চশক্তির ফোটন নির্গমণের মাধ্যমে। আর্গনে লেজার প্রয়োগ করার পর এই ব্যাপারটি একাধিকবার ঘটছে – ফলে আলট্রাফাস্ট অ্যাটোসেকেন্ড স্কেলের আলোর স্পন্দন তৈরি হচ্ছে গ্যাসের মধ্যে।

অ্যান লুইলিয়ারের কাজ থেকে একটি কর্মক্ষম অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের উৎস তৈরি করতে আরো দুটো ধাপ পার হতে হয়েছে। দুটো নতুন দরকারি পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হয়েছে। প্রথমত স্পন্দনের সময় মাপতে হয়েছে, দ্বিতীয়ত আলাদা আলাদা স্পন্দন তৈরি করতে হয়েছে। পদ্ধতিদুটোর কোনটিই সহজ নয়। এত ক্ষুদ্র সময়ের স্পন্দন মাপার একটি পদ্ধতির নাম FROG – ব্যাঙ পদ্ধতি। Frequency Resolved optical gating – FROG. কিন্তু অ্যাটোসেকেন্ড মাপা সম্ভব নয় এই পদ্ধতিতে। কারণ FROG পদ্ধতি খুবই কম শক্তি সম্পন্ন। এটি ফেমটোসেকেন্ডে সীমাবদ্ধ। 

২০০১ সালে পিয়ের আগস্তিনি নতুন পদ্ধতি বানালেন – র‍্যাবিট (খরগোশ) পদ্ধতি। RABBIT – Reconstruction of Attosecond Beating by Interference of two-photon transitions. যেখানে একটি অপটিক্যাল লেজারের তড়িৎক্ষেত্র অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের সাথে যোগ করে দেয়া হয়। এই পদ্ধতিতে পিয়ের আগস্তিনি এবং তাঁর দল ২৫০ অটোসেকেন্ডের ধারাবাহিক আলোর স্পন্দন তৈরি করতে সমর্থ হন। 

এদিকে প্রফেসর ফেরেঙ্ক ক্রাউজের দল জার্মানিতে স্বতন্ত্রভাবে একই ধরনের আরেকটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন – যেখানে তিনি অ্যাটোসেকেন্ড স্ট্রিকিং (Streaking) পদ্ধতিতে ৬৫০ অটোসেকেন্ডের স্পন্দনকে স্বতন্ত্রভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হন। এভাবে অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন পদ্ধতি আয়ত্বে আসার পর অতিক্ষুদ্র আলোর স্পন্দন তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে এখন। 

প্রফেসর লুইলিয়ার এবং ক্রাউজ তাঁদের অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্সের গবেষণা ক্রমাগত চালিয়ে গেলেও – প্রফেসর পিয়ের আগস্তিনি আশাও করেননি যে বিশ বছর আগে তিনি যা উদ্ভাবন করেছিলেন তা এতদিন পরে এত গুরুত্ব পাবে। 

অ্যাটোসেকেন্ড পাল্‌স বা স্পন্দনের অনেক বাস্তব ব্যবহারিক সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। রাসায়নিক কার্যকলাপ দেখার জন্য ফেমটোসেকেন্ড কেমিস্ট্রি যথেষ্ট। কিন্তু আরো সুনির্দিষ্টভাবে ইলেকট্রনের কার্যক্রম দেখতে হলে অ্যাটোসেকেন্ড পাল্‌স দরকার। অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন এত বেশি সুনির্দিষ্ট এবং সূক্ষ্ম যে পরমাণুর ইলেকট্রনের কাজকর্ম দেখতে পারবে সেটা। তার মানে ইলেকট্রনের কাজকর্ম সরাসরি দেখা যাবে। অ্যাটোসেকেন্ড পাল্‌স সলিডের ধর্মাবলি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, অপরিবাহীকে পরিবাহীতে রূপান্তরিত করতে পারবে। খুব কম সময়ের মধ্যেই – ইলেকট্রনিক্সের ডায়নামিক্স পরিবর্তন করা যাবে। আলট্রাফাস্ট সুইচিং সম্ভব হবে যেখানে  – সিলিকন ডাই অক্সাইড – অপরিবাহী থেকে দ্রুত পরিবাহীতে পরিণত হতে পারে। ফলে ইলেকট্রনিক্সের জগতে এর বিরাট ব্যবহারিক ক্ষেত্র উন্মুক্ত হবে। উদ্ভাবিত হবে খুবই ফাস্ট ইলেকট্রনিক্স – জন্ম নেবে অনেক নতুন প্রযুক্তির। 

মানুষের রোগ নির্ণয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে অ্যাটোসেকেন্ড পাল্‌স – যা হয়ে উঠবে মলিকিউলার ফিঙ্গার প্রিন্ট অব বায়োলজিক্যাল স্যাম্পলস। যেমন, রক্তের নমুনায় অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের এর মাধ্যমে রক্তের উপাদানের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিবর্তনও লক্ষ্য করা সম্ভব হবে। ফুসফুসের ক্যান্সারের কথাই ধরা যাক – যেখানে রক্তের পরিবর্তন ধরতে পারা জরুরি। রক্তের উপাদানের রসায়নে কোন পরিবর্তন হলে তা দ্রুত মনিটর করা যাবে। দ্রুততম সময়ে শনাক্ত করতে পারলে উপযুক্ত চিকিৎসা সম্ভব হবে। ক্ষুদ্রতম সময়ের আলোর স্পন্দন যতবার দরকার শরীরে প্রবেশ করানো যাবে, তাতে কোন ক্ষতি হবে না, কারণ এই আলো স্বাভাবিক কপাঙ্কের আলো – যার তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নেই। 

মৌলিক গবেষণা এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতেও বিরাট ভূমিকা রাখবে অ্যাটোসেকেন্ড পাল্‌স। যেমন, আইনস্টাইনের ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে। আলোর ফোটন বস্তুর উপর পড়ার পর ধাতু থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয়। ধারণা করা হয় এই পদ্ধতিতে আলো পড়ার সাথে সাথেই ইলেকট্রন নির্গত হয়। কিন্তু অ্যাটোসেকেন্ড পাল্‌স দেখাচ্ছে যে এই পদ্ধতি সাথে সাথে ঘটছে না। আলো শোষণ এবং ইলেকট্রন নির্গমনের মধ্যে বেশ কয়েক অ্যাটোসেকেন্ড ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানের আরো অনেক নতুন নতুন বিষয় জানা যাবে, কিংবা পুরনো বিষয় আরো ভালোভাবে জানা যাবে। অদূর ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম বায়োলজি অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে। ফেমটোকেমিস্ট্রি থেকে অটোকেমিস্ট্রির জগত খুলে যাবে।


তথ্যসূত্র

১। সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ৩ অক্টোবর ২০২৩। 

২। www.nobelprize.org October 3, 2023. 

৩। ফেরেঙ্ক ক্রাউজ ও মিশা ইভানভ, অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্স, ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল, কানাডা, ২০০৯। 

৪। প্রদীপ দেব, রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় পদার্থবিজ্ঞান, প্রথমা, ২০২২। 

৫। phys.org, October 3, 2023. 

__________________
বিজ্ঞানচিন্তা অক্টোবর ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত











Thursday, 30 November 2023

চন্দ্রায়ন ৩

 




মহাবিশ্বে পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ চাঁদ পৃথিবী থেকে গড়ে মাত্র ৩,৮৪,৪০০ কিলোমিটার দূরে থাকে। সৌরজগতের অন্য গ্রহগুলি এবং তাদের উপগ্রহগুলির দূরত্বের সাথে তুলনা করলে চাঁদই পৃথিবীর নিকটতম প্রতিবেশী। এই প্রতিবেশী উপগ্রহই এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর বাইরে একমাত্র জায়গা যেখানে পৃথিবীর মানুষ সশরীরে গিয়ে ঘুরে এসেছে ছয় বার। তাও সেই ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে। ১৯৫৩ সাল থেকে শুরু করে এই ২০২৩ সালের এপর্যন্ত গত সত্তর বছরে পৃথিবী থেকে মোট ১৪৬টি মিশন পরিচালনা করা হয়েছে চাঁদের উদ্দেশ্যে। 

পৃথিবীর এতগুলি দেশের মধ্যে মাত্র বারোটি দেশ চাঁদের মিশনের সাথে যুক্ত হয়েছে। তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ৫৮টি মিশন পরিচালনা করেছিল – যার মধ্যে ১৮টি সফল হয়েছে, বাকি ৪০টি মিশন ব্যর্থ হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর রাশিয়া মাত্র একটি চাঁদের মিশন পরিচালনা করেছে সম্প্রতি (লুনা ২৫), কিন্তু তা ব্যর্থ হয়েছে। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা) এপর্যন্ত ৫৯টি চাঁদের মিশন পরিচালনা করেছে, যার মধ্যে চল্লিশটি সফল হয়েছে। নাসাই এখনো পর্যন্ত একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছে। জাপান ছয়টি মিশন পরিচালনা করেছে যার মধ্যে তিনটি সফল হয়েছে। চীন পাঁচটি মিশন চালিয়ে পাঁচটিতেই সফল হয়েছে। ভারত তিনটি মিশন চালিয়ে দুটিতে সফল হয়েছে। ইওরোপিয়ান ইউনিয়ন, লুক্সেমবার্গ, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইতালি একটি করে মিশন পরিচালনা করেছে সফলভাবে। ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি করে মিশন পরিচালনা করেছে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। পৃথিবী থেকে চাঁদে নভোযান পাঠিয়ে সফলভাবে চাঁদের পিঠে নামাতে পেরেছে মাত্র চারটি দেশ – সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, চীন এবং ভারত। আর চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সর্বপ্রথম চন্দ্রযান অবতরণ করানোর কৃতিত্ব অর্জন করেছে ভারত – অতি সম্প্রতি। 

১৯৮০র দশকে চাঁদের মিশনের প্রতি মহাকাশ সংস্থাগুলির আগ্রহ একবারেই কমে গিয়েছিল। তখন মহাকাশে উন্নত টেলিস্কোপ পাঠিয়ে মহাবিশ্বের আরো গভীরে পর্যবেক্ষণ করার দিকে নজর দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ১৯৯০র দশকের পর থেকে চাঁদের প্রতি আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। একবিংশ শতাব্দীতে মহাকাশ গবেষণায় অনেক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে – যেখানে চাঁদ একটা বিরাট ভূমিকা রাখতে পারবে ভবিষ্যতের মহাকাশ মিশনগুলিতে। 

মহাকাশবিজ্ঞানীরা পরিকল্পনা করছেন – চাঁদকে মহাকাশের স্থায়ী স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। তা কীভাবে সম্ভব হতে পারে? চাঁদে একসময় পানি ছিল তার প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন চাঁদের বিভিন্ন উপাদান বিশ্লেষণ করে। চাঁদে এখনো কিছু পানি জমাট বরফের আকারে রয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে – এরকমই ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। এরকম ভাবার কারণ কী? 

চাঁদ নিজের অক্ষের উপর যে বেগে ঘুরছে – তা পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগের তুলনায় অনেক কম। পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর চব্বিশ ঘন্টায় একবার ঘুরে আসে – যার ফলে চব্বিশ ঘন্টায় পৃথিবীর এক দিন। কিন্তু চাঁদ নিজের অক্ষের উপর একবার ঘুরতে সময় নেয় প্রায় আটাশ দিন। অর্থাৎ চাঁদের একদিন সমান পৃথিবীর ২৮ দিন। সূর্যের সাথে চাঁদের অবস্থানের কারণে চাঁদের এক পিঠে একটানা চৌদ্দ দিন সূর্যালোক পড়ে, অন্যপিঠে তখন থাকে অন্ধকার। একইভাবে অন্যপিঠে আবার চৌদ্দদিন দিনের আলো পড়ে। কিন্তু চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি এমন কিছু গর্ত আছে যেখানে কখনোই সূর্যালোক পড়ে না। সেই গর্তগুলির ভেতরের তাপমাত্রা এত কম যে মাইনাস একশ ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। সেই তাপমাত্রায় চাঁদের আদিকালের জমাট বরফ এখনো রয়ে যেতে পারে। এই জমাট বরফ মানেই তো পানি। 

এই পানির সন্ধান করাই চাঁদের সাম্প্রতিক মিশনগুলির প্রধান উদ্দেশ্য। চাঁদে পানির সন্ধান পাওয়া গেলে সেই পানি ব্যবহার করা যাবে ভবিষ্যৎ মিশনগুলিতে। পৃথিবী থেকে যদি পানি বয়ে নিয়ে যেতে না হয়, তাহলে নভোচারীদের একটা বিরাট সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, চাঁদে পানি পাওয়া গেলে ভবিষ্যতের মিশনগুলি চাঁদ থেকে পরিচালনা করা যাবে – যেখানে পানির উপাদান হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন থেকে তৈরি করা যাবে নভোযানের জ্বালানি। নভোচারীদের জন্য দরকারি অক্সিজেন চাঁদেই তৈরি করে নেয়া যাবে। 

কিন্তু পানি থাকার সবচেয়ে সম্ভাব্য যে জায়গা – সেই দক্ষিণ মেরুতে পৃথিবী থেকে পাঠানো নভোযান অবতরণ করানো খুব সহজ ব্যাপার নয়। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) তাদের চন্দাভিযান চন্দ্রায়ন-৩ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে অবতরণ করাতে পেরেছে, এটা সত্যিই যুগান্তকারী মাইলফলক। 

ভারতের চন্দ্রায়ন প্রকল্প শুরু হয়েছে একবিংশ শতাব্দীতে। প্রথম মিশন চন্দ্রায়ন-১ ছিল চাঁদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে চাঁদের তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের মিশন। ২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর পৃথিবী থেকে চাঁদের উদ্দেশ্যে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল চন্দ্রায়ন-১ স্যাটেলাইট। নির্দিষ্ট সময়ে চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছে চাঁদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে তথ্য পাঠিয়েছে পৃথিবীতে পরবর্তী দশ মাস ধরে। সেই তথ্য থেকে আশা করা যায় যে চাঁদের মেরু অঞ্চলের কিছু গর্তের ভেতর জমাট বরফে পানি থাকতে পারে। ২০০৯ সালের ২৮ আগস্ট এই মিশনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। 

এরপর শুরু হয় চন্দ্রায়ন-২ এর প্রস্তুতি। চন্দ্রায়ন-২ এর তিনটি অংশ ছিল – লুনার অরবিটার, লুনার ল্যান্ডার বিক্রম এবং লুনার রোভার প্রজ্ঞান। পরিকল্পনা অনুসারে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই উৎক্ষেপণ করা হয় চন্দ্রায়ন-২। প্রায় এক মাস ধরে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার পর ২০ আগস্ট চাঁদের এক শ কিলোমিটার দূরত্বে পৌছে চাঁদের চারপাশে ঘুরতে থাকে। সেখানে অরবিটার থেকে চাঁদে নামার জন্য ল্যান্ডার বিক্রমকে আলাদা করা হয়। হিসেব অনুযায়ী সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ বিক্রমের চাঁদে নামার কথা ছিল। সবকিছু ঠিকঠাক মতোই এগোচ্ছিল। কিন্তু চাঁদের পিঠ থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার উপরে থাকতেই বিক্রমের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ধরে নেয়া যায়, বিক্রম চাঁদের পিঠে আছড়ে পড়ে বিকল হয়ে গেছে। 

 চন্দ্রায়ন-২ ব্যর্থ হবার পরেও একটুও দমে যাননি ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীরা। চার বছরের মধ্যেই তাঁরা চাঁদে পাঠিয়েছেন পরবর্তী মিশন চন্দ্রায়ন-৩। চন্দ্রায়ন-২ এর ব্যর্থ হবার সম্ভাব্য সব কারিগরি ত্রুটি কাটিয়ে উঠে সাফল্য অর্জন করেছেন চন্দ্রায়ন-৩ প্রকল্পে। 

ইতিহাস সৃষ্টিকারী চন্দ্রায়ন-৩ প্রকল্পের খুটিনাটি একটু দেখা যাক। এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হলো চাঁদের পিঠে সঠিকভাবে একটি ল্যান্ডার অবতরণ করানো। এরপর ল্যান্ডারের ভেতর থেকে বিশেষভাবে তৈরি স্বয়ংক্রিয় গাড়ি (রোভার) বের করে চাঁদের পিঠে পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো। 

২০২৩ সালের ১৪ জুলাই সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে চাঁদের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয় তিন হাজার নয়শ কেজি ভরের চন্দ্রায়ন-৩। যার তিনটি অংশ। প্রপালশান মডিউল যা ল্যান্ডার বিক্রম এবং রোভার প্রজ্ঞানকে পৌঁছে দিয়েছে চাঁদের কক্ষপথের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে। প্রপালশান মডিউলের ভর ২,১৪৮ কিলোগ্রাম। যার মধ্যে জ্বালানির ভর ১৬৯৬ কিলোগ্রাম। পৃথিবীর চারপাশে পাঁচবার ঘুরে ৫ আগস্ট চাঁদের কক্ষপথে ঢুকে পড়ে চন্দ্রায়ন-৩র প্রপালশান মডিউল। এবার চাঁদের চারপাশে পাঁচবার প্রদক্ষিণ করার পর ১৭ আগস্ট প্রপালশান মডিউল থেকে ল্যান্ডার আলাদা হয়ে যায়। প্রপালশান মডিউল চাঁদের চারপাশে ঘুরতে থাকবে আরো ছয় মাস। এই ছয়মাস ধরে চাঁদ থেকে পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করবে এই মডিউল। এরজন্য একটি বিশেষ যন্ত্র Spectropolarimetry of Habitable Planet Earth (SHAPE) লাগানো হয়েছে প্রপালশান মডিউলের গায়ে। 


বিক্রম সারাভাই


মুন ল্যান্ডারের নাম রাখা হয়েছে ভারতের মহাকাশ গবেষণার পথিকৃৎ বিক্রম সারাভাইয়ের নামে – বিক্রম। বিক্রমের ভর ১৭২৬ কিলোগ্রাম। আয়তাকার দুই মিটার দৈর্ঘ্য, দুই মিটার প্রস্থ এবং ১.১৭ মিটার উচ্চতার একটি বড় বাক্সের মতো বিক্রম ল্যান্ডারের সাথে চারটি ধাতব পা এবং পায়ে চারটি ইঞ্জিন লাগানো আছে। বিক্রমের গায়ে লাগানো সোলার প্যানেল থেকে ৭৩৮ ওয়াট বিদ্যুৎশক্তি উৎপন্ন করা যায়। চাঁদের পিঠে নিরাপদে অবতরণ করার জন্য বিক্রমের গায়ে লাগানো আছে বেশ কয়েকটি সেন্সর – এক্সিলারোমিটার, অল্টিমিটার, ডপলার ভেলোসিমিটার, স্টার সেন্সর, ইনক্লাইনোমিটার এবং ক্যামেরা। বেতার যোগাযোগের জন্য লাগানো আছে শক্তিশালী অ্যান্টেনা। বিক্রমের ভেতর একটা প্রকোষ্ঠে সযত্নে লাগানো আছে মুন রোভার – স্বয়ংক্রিয় চন্দ্রযান প্রজ্ঞান। 

প্রপালশান মডিউল থেকে আলাদা হবার সাথে সাথেই বিক্রমের থ্রাস্টার ইঞ্জিনগুলি চালু হয়ে যায়। নিয়ন্ত্রিত গতিতে সেন্সর এবং অন্যান্য কারিগরি নিয়ন্ত্রক কাজে লাগিয়ে বিক্রম নিরাপদে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করে ২০২৩ সালের ২৩ আগস্ট। চাঁদের সেই পিঠে তখন দিন, অর্থাৎ সূর্যালোক আছে, থাকবে চৌদ্দ দিন। এই চৌদ্দ দিন কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েই চাঁদে নামানো হয়েছে বিক্রমকে। 

বিক্রমের সোলার প্যানেল সৌরবিদ্যুৎ তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছে। বিক্রমের ভেতর একটা প্রকোষ্ঠ এমনভাবে তৈরি যেন ওটা খুলে গিয়ে একটা ঢালু ধাতব পথ তৈরি করতে পারে যেখান দিয়ে বের হয়ে এসেছে চাঁদের রোভার প্রজ্ঞান। 

প্রজ্ঞান একটি ছোট্ট আয়তাকার ধাতব গাড়ি। এর দৈর্ঘ্য ৯১.৭ সেন্টিমিটার, প্রস্থ ৭৫ সেন্টিমিটার আর উচ্চতা ৩৯.৭ সেন্টিমিটার। ২৬ কিলোগ্রাম ভরের এই স্বয়ংক্রিয় গাড়িতে ছয়টি চাকা লাগানো আছে। লাগানো আছে সোলার প্যানেল যেখান থেকে ৫০ ওয়াট বিদ্যুৎশক্তি উৎপন্ন হচ্ছে। ২৩ আগস্ট বিক্রম থেকে বের হয়েই কাজ শুরু করে দিয়েছে প্রজ্ঞান। প্রজ্ঞানের গায়ে লাগানো নেভিগেশান ক্যামেরার সাহায্যে এর গতিপথ নির্ধারিত হয়, আর কী দেখছে তার সিগনাল পাঠানো হয় অ্যান্টেনার সাহায্যে ল্যান্ডার বিক্রমে।

বিক্রম যেখানে নেমেছে সেখানে কার্যকর থাকবে মোট চৌদ্দদিন। প্রজ্ঞানও তাই। চৌদ্দ দিন পর চাঁদে রাত নেমে এলে পরবর্তী চৌদ্দদিন অন্ধকারে প্রচন্ড ঠান্ডা এবং সৌরকোষ থেকে কোন শক্তি উৎপন্ন করতে না পেরে বিক্রম এবং প্রজ্ঞানের সংবেদী ইলেকট্রনিক্স আর কার্যকর থাকার সম্ভাবনা খুব কম। এই চৌদ্দ দিনের ভেতরই তারা যা করার করে ফেলছে। 

বিক্রমে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আছে। চাঁদের ভূমির তাপমাত্রার ধর্মাবলি পরীক্ষার জন্য আছে Chandra’s Surface Thermophysical Experiment (ChaSTE), চাঁদের ভূমির আশেপাশে কম্পন মাপার জন্য আছে ‘Instrument for Lunar Seismic Activity (ILSA)’, চাঁদের অতিসংবেদী আবহাওয়ায় গ্যাস ও প্লাজমা পর্যবেক্ষণের জন্য আছে Radio Anatomy of Moon Bound Hypersensitive ionosphere and Atmosphere (RAMBHA)। এই যন্ত্রপাতিগুলি সব ভারতীয় ল্যাবেই তৈরি করা হয়েছে। আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা) একটি লেজার রেট্রোরিফ্লেকটর দিয়েছে যা বিক্রমের সাথে চাঁদে গেছে চাঁদের ভূমি পর্যবেক্ষণ করার জন্য। 

প্রজ্ঞানে লাগানো আছে দুইটি যন্ত্র – আলফা পার্টিক্যাল এক্সরে স্পেকট্রোমিটার (APXS) এবং Laser Induced Breakdown Spectroscope (LIBS) - যেগুলি দিয়ে চাঁদের মাটির রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করছে। প্রজ্ঞান কাজ শুরু করার এক সপ্তাহের মধ্যেই চাঁদের মাটিতে অ্যালুমিনিয়াম, ক্যালসিয়াম, লোহা, ক্রোমিয়াম, টিন, ম্যাঙ্গানিজ, সিলিকন এবং অক্সিজেন শনাক্ত করে ফেলেছে। এগুলির অস্বিত্ব আগেও পাওয়া গিয়েছিল অন্যান্য মিশনের পরীক্ষা থেকে। কিন্তু এই প্রথম চাঁদের মাটিতে সালফারের অস্তিত্ব ধরা পড়লো সরাসরি পরীক্ষার মাধ্যমে। চাঁদের মাটিতে হাইড্রোজেনের খোঁজ চলছে, এখনো পাওয়া যায়নি। 

চন্দ্রায়নের এই সাফল্য চাঁদের অভিযানের গতি এবং সম্ভাবনা আরো অনেকদূর বাড়িয়ে দিয়েছে। নাসার আর্টেমিস মিশনের কাজ চলছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই পৃথিবীর মানুষ আবার চাঁদের বুকে পা রাখবে। কয়েক দশকের মধ্যেই হয়তো চাঁদে তৈরি হয়ে যাবে গ্রহান্তরে যাবার স্টেশন। আর যদি চাঁদে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন দুটোই পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণে, অনন্ত সম্ভাবনার দরজা খুলে যাবে। 


তথ্যসূত্র:

১। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা www.isro.gov.in

২। প্রদীপ দেব, চাঁদের নাম লুনা, মীরা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৭। 

_____________
বিজ্ঞানচিন্তা  সেপ্টেম্বর ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত








Saturday, 28 October 2023

মহাবিশ্বের গোপন রহস্য: ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি

 




বিংশ শতাব্দীর শেষে অনেকেই ভেবেছিলেন একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানীদের হাতে আবিষ্কারের জন্য সেরকম জটিল কোন সমস্যা থাকবে না। এরকম ধারণা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষেও হয়েছিল অনেকের। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের স্থপতি পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাংক যখন ছাত্রজীবনে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে আগ্রহী হচ্ছিলেন, তখন মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ফিলিপ জোলি প্ল্যাংককে বলেছিলেন, “ফিজিক্স পড়ে কী করবে? ফিজিক্সের সবকিছুই তো আবিষ্কৃত হয়ে গেছে।“ অথচ আমরা দেখলাম বিংশ শতাব্দীর পুরোটাই ছিল পদার্থবিজ্ঞানের নতুন নতুন দিক আবিষ্কারের শতক। বিংশ শতাব্দীতেই আবিষ্কৃত হয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স; আইনস্টাইনের বিশেষ ও সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব বদলে দিয়েছে আমাদের মহাবিশ্বের সমস্ত হিসেবনিকেশ; মানুষ যে শুধুমাত্র আকাশভ্রমণ শুরু করেছে তা নয় - মানুষের তৈরি স্যাটেলাইট পৌঁছে গেছে আমাদের দৃশ্যমান আকাশ ছাড়িয়ে আকাশান্তরে, চাঁদের বুকে হেঁটে এসেছে মানুষ। মহাকাশে ঘুরে ঘুরে অত্যাধুনিক দুরবিন খুঁজে নিয়ে এসেছে মহাবিশ্বের কোটি আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রের আলো। আমরা জেনে গেছি মহাবিশ্বের উৎপত্তির গোড়ার কথা। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে বের করে ফেলেছেন মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর বা ১৩৮০ কোটি বছর। কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড শনাক্ত করার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা পেয়ে গেছেন মহাজাগতিক প্রথম আলোর সন্ধান – যেখান থেকেই শুরু হয়েছিল মহাবিশ্বের বেড়ে ওঠার পালা। বিংশ শতাব্দীর শেষে তাই অনেকেই ভেবেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের কোন সমস্যা অমীমাংসিত থাকবে না, একবিংশ শতাব্দী হবে মূলত জীববিজ্ঞানের শতাব্দী – যেখানে জানা যাবে মহাবিশ্বে প্রাণের উদ্ভবের মূল কারণ এবং মানুষের জীববৈজ্ঞানিক ভবিষ্যৎ কী। 

কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে এসে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির আকাশচুম্বী সাফল্য এবং বিস্তারের পরেও বিজ্ঞানীদের হাতে এমন অনেক সমস্যা রয়ে গেছে যাদের সমাধানের ব্যাপারে কোন কূলকিনারা পাচ্ছেন না তাঁরা। বিজ্ঞানে এরকম ব্যাপারগুলি অনেকটা রহস্যকাহিনির ঘটনার মতো। যখনই মনে হয় যে রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে, তখনই দেখা যায় রহস্য নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে। আমাদের মহাবিশ্ব আমাদেরকে এরকমই রহস্যের আবরণে জড়িয়ে দিচ্ছে বারবার। 

যে মহাবিশ্বে আমরা বাস করি – কী আশ্চর্য সুন্দর  তার অবয়ব যেটুকু আমরা দেখতে পাই। কিন্তু মহাবিশ্বের ঠিক কতটুকু আমরা দেখতে পাই? প্রাগৈতিহাসিক যুগে যখন চোখ ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা ছিল না মানুষের দেখার, সেই সময় খালিচোখে আকাশ দেখেই মানুষ ভেবে নিয়েছিল আকাশই মহাবিশ্বের শেষ সীমানা। তখন মনে হতো মহাবিশ্বের পুরোটাই আমরা দেখতে পাই আকাশের দিকে তাকিয়ে। যেন প্রকৃতি আকাশের বুকে সূর্যতারাখচিত চাদরের মতো বিছিয়ে দিয়েছে পুরো মহাবিশ্বকে। তখন মনে হতো আমরা মহাবিশ্বের পুরোটাই দেখতে পাই। 

তার কয়েক হাজার বছর পর মানুষ যখন মহাকাশ জয় করে ফেললো, গ্রহ-নক্ষত্র ছাড়িয়ে মানুষের তৈরি নভোযান পাড়ি দিল আমাদের সৌরজগত থেকে  অন্য নক্ষত্রপুঞ্জে, এক গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সির দিকে – আমরা জানতে পারলাম কী প্রচন্ড গতিশীল আমাদের গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সিসহ পুরো মহাবিশ্ব। মহাবিশ্বের যত বেশি তথ্য এবং উপাত্ত বিজ্ঞানীদের হাতে আসতে শুরু করলো, মহাবিশ্বের রহস্য ততবেশি উদ্‌ঘাটিত হয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু দেখা গেলো মহাবিশ্ব নতুন নতুন রহস্যের চাদরে নিজেকে ঢাকতে শুরু করলো। এই একবিংশ শতাব্দীর সিকিভাগ পার করার মুহূর্তে আমরা এই মহাবিশ্বের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ বস্তু ও শক্তি সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছুই জানি না।  

বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক হিসেব অনুযায়ী এই মহাবিশ্বের শতকরা পঁচানব্বই ভাগই অদৃশ্য। এতবড় মহাবিশ্বের দৃশ্যমান কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি সবকিছুকে একসাথে যোগ করলে মহাবিশ্বের মাত্র পাঁচ ভাগ হয়, বাকি পঁচানব্বই ভাগ যে কীভাবে লুকিয়ে আছে তা এক অধরা রহস্য। এই পঁচানব্বই ভাগকে দেখার কোন উপায় নেই। 

কোনো কিছু দেখতে হলে আলো কিংবা তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের সাথে সেই বস্তুর মিথষ্ক্রিয়া ঘটতে হয়। মহাবিশ্বের পঁচানব্বই ভাগ বস্তু এবং শক্তির সাথে আলো কিংবা তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের কোন মিথষ্ক্রিয়া ঘটে না। ফলে তাদেরকে দেখার কোন উপায় বিজ্ঞানীরা এখনো বের করতে পারেননি। তাই অদৃশ্য অংশের নাম ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি। মহাবিশ্বের এই অদৃশ্য অংশের তেইশ ভাগ ডার্ক ম্যাটার এবং বাহাত্তর ভাগ ডার্ক এনার্জি। ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। এদের কাজ আলাদা, ইতিহাস আলাদা। শুধুমাত্র নামের মিল ছাড়া এদের মধ্যে আর কোন পারস্পরিক সম্পর্ক নেই।  

অবশ্য ডার্ক নামটি যুৎসই হয়নি। আলোর সাথে কোন মিথস্ক্রিয়া করে না বলে এদের নাম হওয়া উচিত ছিল ট্রান্সপারেন্ট বা স্বচ্ছ। অদৃশ্য বস্তু বোঝাতে ডার্ক ম্যাটার নামটি দিয়েছিলেন সুইডিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিৎজ জুইকি ১৯৩৩ সালে। তারই অনুকরণে অদৃশ্য শক্তি বোঝানোর জন্য ডার্ক এনার্জি নাম দিয়েছেন আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল টারনার ১৯৯৮ সালে। সে হিসেবে ডার্ক এনার্জি তুলনামূলকভাবে খুবই সাম্প্রতিক বিষয়। 

প্রথমে দেখা যাক ডার্ক ম্যাটারের ব্যাপারস্যাপার কী।  

বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের আকার এবং আকৃতি মাপার চেষ্টা করে যাচ্ছেন কয়েক শতাব্দী থেকে। সপ্তদশ শতকে আইজাক নিউটনের মহাকর্ষের সূত্র আবিষ্কারের পর গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্রসহ মহাবিশ্বের সবকিছুর ভর এবং গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ের উপায় মানুষের হাতে চলে এলো। মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তু একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয় মহাকর্ষ বলের কারণে। নিউটনের গতির সূত্র থেকে ত্বরণ ও বল জানা থাকলে আমরা বস্তুর ভর মাপতে পারি। মহাকর্ষ বলের টানে গ্রহ-নক্ষত্রগুলির গতির পরিবর্তন হিসেব করে গ্রহ-নক্ষত্রের ভর হিসেব করতে সক্ষম হলেন বিজ্ঞানীরা। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নিউটনের সূত্রে হিসেবে বাগড়া দিতে আবিষ্কৃত হলো আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র অনুসারে মহাবিশ্বের বস্তুগুলি যদি পরস্পরের আকর্ষণে একে অপরকে কাছে টানতে থাকে, তাহলে মহাবিশ্ব ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। 


আলবার্ট আইনস্টাইন


১৯১৫ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব প্রকাশিত হলে এই সমস্যার এক রকম সমাধান হয়ে যায়। আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব মহাকর্ষ বলের সংজ্ঞাই বদলে দেয়। নিউটনের মহাকর্ষ বল শুধুমাত্র বস্তুর গতির পরিবর্তন ঘটায়, কিন্তু আইনস্টাইনের মহাকর্ষ বল বস্তুর গতির সাথে স্থান-কাল (স্পেস-টাইম)ও বদলে দেয়। আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের জটিল গাণিতিক সমীকরণ সমাধান করে দেখা গেলো মহাবিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। আইনস্টাইন ভাবলেন এটা অস্বাভাবিক। তিনি মহাবিশ্বের আয়তন স্থির রাখার জন্য ১৯১৭ সালে তাঁর আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের সমীকরণে একটি ধ্রুবক (কসমোলজিক্যাল কন্সট্যান্ট) বসিয়ে দিলেন। ফলে গাণিতিক হিসেবে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ বন্ধ করা গেলো। 

কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। এক যুগ পরেই দেখা গেলো আইনস্টাইনের প্রাথমিক হিসেবই ঠিক ছিল। ১৯২৯ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন হাবল আবিষ্কার করলেন যে মহাবিশ্ব ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। হাবল মহাবিশ্বের গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কোটি কোটি নক্ষত্রপুঞ্জের সমষ্টি একেকটি গ্যালাক্সি থেকে যখন আলো এসে পৌঁছায় টেলিস্কোপে, সেই আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে জানা যায় – গ্যালাক্সিটি পৃথিবী থেকে কত দূরে, কত বেগে ঘুরছে। আলো তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ। দৃশ্যমান আলোর লাল বর্ণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি, বেগুনি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম। আলোর উৎস যদি টেলিস্কোপ থেকে যত দূরে চলে যেতে থাকে, আলোর তরঙ্গ ততই সম্প্রসারিত হতে থাকে। ফলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়তে থাকা মানে তা ক্রমশ লাল বর্ণের দিকে সরে যাওয়া। তাই পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলে রেডশিফ্‌ট বা লোহিত সরণ। আবার আলোর উৎস যদি কাছে আসতে থাকে, তাহলে আলোর তরঙ্গ সংকুচিত হয়ে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে যায়। অর্থাৎ তখন আলো ক্রমশ নীল কিংবা বেগুনির দিকে সরতে থাকে। তাকে বলা হয় ব্লু শিফ্‌ট বা নীল সরণ। রেড শিফ্‌ট দেখে বোঝা যায় আলো দূরে চলে যাচ্ছে, ব্লু শিফ্‌ট দেখে বোঝা যায় আলো কাছে আসছে। 


এডুইন হাবল


এডুইন হাবল দেখলেন যে দূরের গ্যালাক্সিগুলি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে দূরে চলে যাচ্ছে। তার মানে মহাবিশ্ব ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। আইনস্টাইন এই ফলাফল দেখে বুঝতে পারলেন তিনি শুরুতেই ঠিক ছিলেন। তাঁর কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট না বসালেই ঠিক ছিল। 

এডুইন হাবলের আবিষ্কারের পর আরো অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালাক্সির গতি পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন। ১৯৩৩ সালে সুইজারল্যান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিৎজ জুইকি ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির মানমন্দিরের টেলিস্কোপে পর্যবেক্ষণ করছিলেন ৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সিগুচ্ছ ‘কোমা ক্লাস্টার’-এর গতিপ্রকৃতি। এক হাজারের বেশি গ্যালাক্সির এই গুচ্ছের গ্যালাক্সিগুলি থেকে আসা আলোর বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করে ফ্রিৎজ জুইকি অবাক হয়ে গেলেন। বর্ণালীর লোহিত সরণ হিসেব করে দেখলেন যে গ্যালাক্সিগুলি অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে ঘুরছে, কিন্তু গুচ্ছ থেকে ছিটকে বের হয়ে যাচ্ছে না। একটি নির্দিষ্ট মাত্রার গতির বেশি গতিতে ছুটলে বস্তু মাধ্যাকর্ষণ অতিক্রম করে বের হয়ে যায় – যাকে এসকেপ ভেলোসিটি বা মুক্তিবেগ বলে। যেমন পৃথিবী থেকে রকেট উৎক্ষেপণ করার সময় তা পৃথিবীর মুক্তিবেগের (সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটার বা ঘন্টায় ৪০,৩২০ কিলোমিটার) বেশি বেগে উৎক্ষেপণ করতে হয়। 


ফ্রিৎজ জুইকি


জুইকি গ্যালাক্সিগুলির মোট ভর হিসেব করে দেখলেন – সেই ভরে গ্যালাক্সিগুলির মুক্তিবেগ যত হওয়া দরকার, গ্যালাক্সিগুলি তার চেয়ে অনেক বেশি বেগে ঘুরছে, তবুও ছিটকে বের হয়ে যাচ্ছে না গ্যালাক্সি থেকে। তার কারণ কী? বার বার হিসেব করেও হিসেবে কোন ভুল পেলেন না। তাহলে নিশ্চয় সেখানকার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনেক বেশি। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বেশি হওয়ার একটিই কারণ হতে পারে – সেটা হলো গ্যালাক্সিগুচ্ছের ভর অনেক বেশি। কিন্তু দৃশ্যমান পদার্থের ভর হিসেব করে যা পাওয়া গেলো তার চেয়ে চল্লিশ গুণ বেশি ভর হলে তবেই গ্যালাক্সিগুলি ঐ বেগে ছুটতে পারে। এত বিশাল পরিমাণ বস্তু কোথায় গেলো? জুইকি জার্মান ভাষায় এই অদৃশ্য বস্তুর নাম দিলেন ‘ডাংকল ম্যাটেরি’ যা ইংরেজিতে হলো ‘ডার্ক ম্যাটার’। 

জুইকির এত বড় আবিষ্কারের দিকে খুব একটা মনযোগ গেলো না তেমন কারো। ইওরোপ আমেরিকা তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়ায় উপস্থিত। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে মেতে উঠেছে প্রায় সবাই। জুইকির আবিষ্কারের বছরখানেক আগে নেদারল্যান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইয়ান ওর্ট-ও একই ধরনের ফলাফল পেয়েছিলেন আমাদের নিজেদের গ্যালাক্সি – মিল্কিওয়ে পর্যবেক্ষণ করার সময়। মিল্কিওয়ের অনেকগুলি লেজের দিকের অনেকগুলি নক্ষত্র এতবেগে ঘুরছে যে ওগুলির ভর যদি যা দেখা যাচ্ছে তা হয়, তাহলে  মিল্কিওয়ে থেকে ছিটকে বের হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না, অর্থাৎ সেখানেও যত বস্তু দেখা যাচ্ছে – তার চেয়ে অনেক বেশি বস্তু অদৃশ্য রয়ে গেছে। বছর চারেক পর ১৯৩৭ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী সিনক্লেয়ার স্মিথ পাঁচ কোটি আলোকবর্ষ দূরের ‘ভার্গো ক্লাস্টার’ গ্যালাক্সিগুচ্ছ পর্যবেক্ষণ করেও একই রকম ফল পেয়েছিলেন। কিন্তু সিনক্লেয়ার স্মিথ তাঁর গবেষণা আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার আগেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের কারণে ডার্ক ম্যাটার নিয়ে আর কেউ তেমন মাথা ঘামাননি পরবর্তী ত্রিশ বছর। 

১৯৭৫ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভেরা রুবিন অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলির উপর তাঁর পর্যবেক্ষণের বিস্তারিত ফলাফল প্রকাশ করার পর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গুরুত্বদিয়ে বিবেচনা করতে শুরু করলেন ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে। 


ভেরা রুবিন


ভেরা রুবিন খুবই বিস্তারিত গবেষণা করেছিলেন অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলিকে নিয়ে। মিল্কিওয়ে, অ্যান্ড্রোমিডা – এরকম চ্যাপ্টা সর্পিলাকার গ্যালাক্সিগুলিতে বেশিরভাগ নক্ষত্রই গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থান করে, ফলে গ্যালাক্সির ভরের বেশিরভাগই এর কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকে। গ্যালাক্সির কিনারায় এবং লেজের দিকে যে নক্ষত্রগুলি থাকে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র অনুযায়ী তাদের উচিত কেন্দ্রের নক্ষত্রগুলির তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম গতিতে ঘোরা। যেমন আমাদের সূর্যকে কেন্দ্র করে যেসব গ্রহ ঘুরছে – সূর্য থেকে তাদের দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে তাদের ঘূর্ণনের গতি কমে যায়। যেমন বুধ যে গতিতে সূর্যের চারপাশে ঘোরে (সেকেন্ডে ৪৭.৯ কিলোমিটার), বৃহস্পতির গতি তার তুলনায় অনেক কম (সেকেন্ডে ১৩.১ কিলোমিটার)। কিন্তু ভেরা রুবিন হিসেব করে দেখলেন গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে দূরের নক্ষত্রগুলির ঘূর্ণনের গতি কেন্দ্রের কাছের নক্ষত্রগুলির গতির প্রায় সমান। তার মানে নিশ্চয় গ্যালাক্সিতে এমন কোন বস্তু আছে – যার প্রভাবে মাধ্যাকর্ষণ বল তৈরি হচ্ছে, কিন্তু বস্তুগুলি দেখা যাচ্ছে না কিছুতেই। পরবর্তী পাঁচ বছরে ভেরা রুবিন আরো শতাধিক গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলি পর্যবেক্ষণ করে একই ধরনের ফলাফল পেলেন। 

বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন যে গ্যালাক্সিগুলিতে এমন কিছু অদৃশ্য বস্তু ‘ডার্ক ম্যাটার’ আছে যেগুলি গ্যালাক্সির মাঝখানে কেন্দ্রিভূত থাকার বদলে পুরো গ্যালাক্সিজুড়ে ছড়িয়ে আছে – যার ফলে গ্যালাক্সির সব জায়গায় সমান মাধ্যাকর্ষণ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু অদৃশ্য বস্তুগুলি কোন ধরনের আলোর সাথেই কোন মিথষ্ক্রিয়া করে না। সেই থেকে অবিরাম চেষ্টা করেও বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটার শনাক্ত করতে পারেননি, বা গবেষণাগারেও তৈরি করতে পারেননি। কিন্তু গ্রাভিটেশানাল লেন্সিং অর্থাৎ মহাকর্ষ বলের প্রভাবে ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতির প্রমাণ পাচ্ছেন অহরহ। 

গ্রাভিটেশানাল লেন্সিং ব্যাপারটা হলো – যখন অনেকগুলি গ্যালাক্সি একসাথে থাকে – তখন সামনের গ্যালাক্সিগুলি থেকে আলো দেখা গেলেও, পেছনের গ্যালাক্সিগুলির আলো সামনের গ্যালাক্সিগুলির কারণে দেখা যায় না। কিন্তু তাদের ভরের কারণে সৃষ্ট মাধ্যাকর্ষণের কারণে পেছনের গ্যালাক্সিগুলির আলো বেঁকে গিয়ে সামনের গ্যালাক্সিগুলির কিনারা দিয়ে বের হয়ে আসে। ভর যত বেশি হবে, মাধ্যাকর্ষণ তত বেশি হবে, আলোও তত বেশি বেঁকে যাবে। তাই আলো কতটুকু বেঁকে গেলো তা হিসেব করে কতটুকু বস্তু সেখানে আছে তা হিসেব করা যায়। গ্যালাক্সিগুলির দৃশ্যমান বস্তুর সমস্ত ভর একত্রিত করলেও আলোর যতটুকু বেঁকে যাওয়ার কথা, গ্যালাক্সিগুলিতে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে বেঁকে যাচ্ছে আলো। তাতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, গ্যালাক্সিগুলিতে হিসেবের চেয়ে কমপক্ষে ছয়গুণ বেশি বস্তু আছে। এই বস্তুগুলি অদৃশ্য ডার্ক ম্যাটার। 

ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ডার্ক ম্যাটার আসলে কী? এই প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিতভাবে বের করতে পারেননি। তবে ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে বেশ কয়েক ধরনের ধারণা দিয়েছেন অনেকে। 

একদল বিজ্ঞানীর ধারণা ছিল ডার্ক ম্যাটার সম্ভবত লুকানো ব্ল্যাকহোল। কিন্তু এই ধারণা সহজেই বাতিল হয়ে গেছে – কারণ অবস্থান জানলে ব্ল্যাকহোল খুঁজে পেতে সমস্যা হয় না। 

আরেকদল বিজ্ঞানী বললেন ডার্ক ম্যাটার হতে পারে মহাবিশ্বের গ্রহ, কিংবা নিউট্রন স্টার, ঠান্ডা হয়ে যাওয়া শ্বেত বামন কিংবা এরকম বস্তু যেগুলির নিজস্ব কোন আলো নেই। এই বস্তুগুলির একটি গালভরা নামও দেয়া হলো – ‘ম্যাসিভ অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল কম্প্যাক্ট হ্যালো অবজেক্টস’ বা ‘ম্যাচো (MACHO)। কিন্তু এই বস্তুগুলি তো আধুনিক টেলিস্কোপে ধরা পড়ার কথা। এদের নিজস্ব আলো না থাকলেও এদের গায়ে অন্য নক্ষত্রের আলো প্রতিফলিত হয়। তাছাড়া এরকম কতগুলি বস্তু মহাবিশ্বে থাকতে পারে – তাদের সম্ভাব্য সবগুলির ভর একসাথে যোগ করেও অদৃশ্য ডার্ক ম্যাটারের ভরের কাছাকাছিও পৌঁছানো যাচ্ছে না। ফলে এই সম্ভাবনাও বাতিল হয়ে যায়। 

‘ম্যাচো’ পদার্থের সম্ভাবনা বাতিল হয়ে যাবার পর আরেকটি সম্ভাবনা বিজ্ঞানীরা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছেন – সেটা হলো নতুন ধরনের কোন কণা কিংবা কণার সমষ্টি দিয়ে গঠিত হতে পারে ডার্ক ম্যাটার। এই কণাগুলি কণা পদার্থবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত কণাগুলির বাইরে নতুন কোন কণা যেগুলির ভর আছে, কিন্তু অন্য কোন কণার সাথে খুব সামান্যই মিথষ্ক্রিয়া করে। এদের নাম দেয়া হয়েছে উইকলি ইন্টার-অ্যাকটিং ম্যাসিভ পার্টিক্যালস বা উইম্প (WIMP)। ধারণা করা হচ্ছে এই কণাগুলি শুধুমাত্র মহাকর্ষ বল এবং দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে – অনেকটা নিউট্রিনোর মতো – যাদের শনাক্ত করা দুসাধ্য। ১৯৯৮ সালে জাপানি বিজ্ঞানীরা যখন নিউট্রিনোর ভর নির্ণয় করতে সক্ষম হলেন, তখন সবাই আশা করেছিল মহাবিশ্বে সম্ভাব্য সব নিউট্রিনোর ভর হিসেব করলে অদৃশ্য ডার্ক ম্যাটারের ভরের সমান হবে। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। সমস্ত নিউট্রিনোর ভর যোগ করলেও অদৃশ্য ডার্ক ম্যাটারের শতকরা এক ভাগের ভরের সমানও হয় না। বিজ্ঞানীরা আশা করে আছেন – কোনো একদিন হয়তো নিউট্রিনোর মতো কোন নতুন কণার সন্ধান পাওয়া যাবে। 

আবার একদল বিজ্ঞানী মনে করেন – ডার্ক ম্যাটার বলে হয়তো কোন পদার্থ নেই – হয়তো আইনস্টাইনের হিসেবে কোন গন্ডগোল আছে, কিংবা গ্যালাক্সির ক্ষেত্রে আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব সমীকরণে পরিবর্তন আনার দরকার আছে – ডার্ক ম্যাটারের সমস্যা মেটানোর জন্য। আরেকদল বিজ্ঞানী মনে করেন নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র হয়তো মহাবিশ্বের সব জায়গায় সমানভাবে কাজ করে না। গ্রহ-উপগ্রহের ক্ষেত্রে যা কাজ করে, তা হয়তো বৃহত্তর গ্যালাক্সির ক্ষেত্রে কাজ করে না। তারা তাদের ধারণার নাম দিলেন – মডিফাইড নিউটনিয়ান ডায়নামিক্স বা মন্ড (MOND)। 

নানা বিজ্ঞানীর নানা মত থেকে মহাবিশ্বের মোট বস্তুর প্রায় শতকরা সাতাশ ভাগ অদৃশ্য বস্তু ‘ডার্ক ম্যাটার’ সম্পর্কে এখনো সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি, এটা এখনো মহাবিশ্বের অন্যতম প্রধান অমীমাংসিত রহস্য। 

ডার্কম্যাটার রহস্যের মাঝেই নতুন রহস্য হাজির হয়েছে মহাবিশ্বে। সেটা ঘটেছে বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে এসে ১৯৯৮ সালে। আর সেই নতুন রহস্যের নাম – ডার্ক এনার্জি। এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে ডার্ক ম্যাটার থেকেই ডার্ক এনার্জির উৎপত্তি।

ডার্ক এনার্জি রহস্যের শুরু হয়েছে মহাবিশ্বের প্রসারণের গতি নির্ণয় করতে গিয়ে। আমরা ইতোমধ্যেই আলোচনা করেছি যে ১৯২৯ সালে এডুইন হাবল আবিষ্কার করেছিলেন যে গ্যালাক্সিগুলি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। কী গতিতে গ্যালাক্সিগুলি ছুটে চলেছে তার একটি সূত্র তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন – যাকে আমরা হাবলের সূত্র বলে জানি। এই সূত্র অনুযায়ী কোন একটি গ্যালাক্সির গতি পৃথিবী থেকে গ্যালাক্সির দূরত্বের সমানুপাতিক। আর এই সমীকরণের সমানুপাতিক ধ্রুবকের নাম – হাবল কনস্ট্যান্ট বা হাবল ধ্রুবক। ১৯৯০ সালে আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা ‘হাবল স্পেস টেলিস্কোপ’ মহাকাশে পাঠায় – যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হাবল ধ্রুবকের মান প্রতিষ্ঠা করা এবং সেখান থেকে মহাবিশ্বের বয়স নির্ণয় করা। পৃথিবী থেকে গ্যালাক্সির দূরত্ব নির্ণয়ের জন্য হাবল ব্যবহার করেছিলেন সেফিড নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা। সেফিড নক্ষত্রগুলির উজ্জ্বলতা একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর বাড়ে এবং কমে। এই উজ্জ্বলতার পরিমাণ হিসেব করে পৃথিবী থেকে তাদের দূরত্ব হিসেব করা যায়। দূরত্ব যত বেশি হয়, উজ্জ্বলতা তত কমতে থাকে। সেফিড নক্ষত্রগুলি আন্তনাক্ষত্রিক দূরত্ব নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ‘আদর্শ বাতি’র কাজ করে। [সেফিড নক্ষত্র সম্পর্কে আরো বিস্তারিত দেয়া আছে আবুল বাসারের ‘মহাজাগতিক প্রথম আলো’ বইতে।] সেফিড নক্ষত্রের আলো ব্যবহার করে হাবল টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের বয়স নির্ণয় করেছে ১৩৮০ কোটি বছর। 

অনেক দূরের গ্যালাক্সির দূরত্ব নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সেফিড খুব বেশি কার্যকরী নয়। কারণ অত দূর থেকে আসতে আসতে আলো অনেক বেশি ম্লান হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা তাই সেফিডের চেয়েও উজ্জ্বল কোনকিছুর খোঁজ করছিলেন যাকে ‘আদর্শ বাতি’ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ১৯৯০এর দশকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দুটো দল আলাদা আলাদাভাবে গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন সুপারনোভা-টাইপ-1aকে ‘আদর্শ বাতি’ ধরে। টাইপ-1a সুপারনোভায় একটি শ্বেত বামন (মৃত নক্ষত্র – যার সব হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম শেষ হয়ে গেছে, শুধুমাত্র কার্বন আর অক্সিজেন অবশিষ্ট আছে) অন্য একটি নক্ষত্রের সাথে যুথবদ্ধভাবে একে অপরের চারপাশে ঘুরতে থাকে। শ্বেতবামনের ঘনত্ব অন্য নক্ষত্রের চেয়ে বেশি এবং তার মাধ্যাকর্ষণও বেশি। ফলে ঘুরতে ঘুরতে অন্য নক্ষত্রের জ্বালানি এবং গ্যাসীয় পদার্থ শ্বেত বামনের দিকে চলে আসতে থাকে। ফলে শ্বেত বামনের ভর বাড়তে থাকে। চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ানের ‘চন্দ্রশেখর সীমা’ নীতি অনুযায়ী শ্বেতবামনের ভর বাড়তে বাড়তে যদি আমাদের সূর্যের চেয়ে ১.৪ গুণের বেশি হয়ে যায়, তখন সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে। কোনো গ্যালাক্সির সবগুলি নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা একসাথে যোগ করলে যে পরিমাণ উজ্জ্বলতা পাওয়া যায়, একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণে সেই পরিমাণ উজ্জ্বলতা তৈরি হয়। এই উজ্জ্বলতা কয়েকশ কোটি আলোকবর্ষ পার হয়ে এলেও পৃথিবীর টেলিস্কোপে ধরা পড়ে। 


চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ান


ক্যালিফোর্নিয়া কেন্দ্রিক ‘সুপারনোভা কসমোলজি প্রজেক্ট’ এবং আন্তর্জাতিক ‘হাই-জেড সুপারনোভা সার্চ টিম’ দুটো দলই কাজ শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যে ফলাফল পেতে শুরু করলো। পাঁচশ থেকে সাতশ কোটি আলোকবর্ষ দূরের ৪২টি সুপারনোভা এবং অপেক্ষাকৃত কম দূরত্বের আরো ১৮টি সুপারনোভার আলোর বর্ণালীর রেডশিফ্‌ট বা লোহিত সরণ হিসেব করে বিজ্ঞানীরা খুবই আশ্চর্যজনক ফলাফল পেলেন। বিগ ব্যাং-এর পর মহাবিশ্বের দ্রুত প্রসারণ ঘটতে থাকে। কিন্তু মহাকর্ষ বল তৈরি হবার পর একটা সময়ের পর থেকে মহাবিশ্বের প্রসারণের গতি কমে আসার কথা। বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন উল্টো ঘটনা ঘটছে আমাদের মহাবিশ্বে। মহাবিশ্বের বয়স পাঁচশ কোটি বছর পার হবার পরবর্তী দুইশ কোটি বছর ধরে প্রসারণের গতি কিছুটা কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু বয়স সাতশ কোটি বছর পার হবার পর থেকে মহাবিশ্বের প্রসারণের গতি ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে। মহাকর্ষ বল বস্তুকে নিজের দিকে টানার বদলে কেন বাইরের দিকে ঠেলতে শুরু করেছে তার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না বিজ্ঞানীরা। ১৯৯৮ সালে তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হবার পর বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের এই নতুন রহস্যে হতবাক হয়ে গেলেন। আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল টার্নার এর জন্য দায়ী করলেন অদৃশ্য শক্তি – ডার্ক এনার্জিকে। ডার্ক এনার্জি – যার সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট ধারণাই নেই কোন বিজ্ঞানীর। তবুও এই নতুন আবিষ্কারের জন্য সুপারনোভা প্রকল্পের দুটো গ্রুপের প্রধান বিজ্ঞানীদের তিন জন – সল পারমুটার, ব্রায়ান স্মিড এবং আদম রেইস পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ২০১১ সালে। 

২০১৩ সালে ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির প্ল্যাংক স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন পরিমাপ করে বিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন যে মহাবিশ্বের মোট ভর এবং শক্তির শতকরা ৬৮.৩ ভাগ ডার্ক এনার্জি, ২৬.৮ ভাগ ডার্ক ম্যাটার এবং মাত্র পাঁচ ভাগ আমাদের দৃশ্যমান বস্তু। অর্থাৎ এই মহাবিশ্বের শতকরা ৯৫ ভাগ সম্পর্কে আমরা এখনো নির্দিষ্টভাবে কিছুই জানি না – কেবল জানি যে তারা আছে। 


তথ্যসূত্র: 

১। লেফটেরিস পাপানটোনোপোলোস, দি ইনভিজিবল ইউনিভার্স: ডার্ক ম্যাটার অ্যান্ড ডার্ক এনার্জি, স্প্রিঙ্গার, বার্লিন ২০০৭।

২। আবুল বাসার, মহাজাগতিক প্রথম আলো, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০২২। 

৩। জন ম্যাডক্স, হোয়াট রিমেইনস টু বি ডিসকভারড, দ্য ফ্রি প্রেস, নিউইয়র্ক, ১৯৯৮। 

৪। পল স্টেইনহার্ডট ও নিল টুরক, এন্ডলেস ইউনিভার্স, ব্রডওয়ে বুক্‌স, নিউ ইয়র্ক, ২০০৭।

৫। গাইলস স্পারো, ফিফটি আইডিয়াস ইউ রিয়েলি নিড টু নো অ্যাস্ট্রোনমি, কোয়েরকাস, লন্ডন, ২০১৬। 

___________
বিজ্ঞানচিন্তা আগস্ট ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত










Tuesday, 24 October 2023

মিশন আর্টেমিস: আবার চাঁদে

 




“গগনের থালে, রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে” – রবীন্দ্রনাথের কথাগুলি খুবই সত্যি, সুন্দর। পৃথিবীর আকাশে উজ্জ্বলতম সূর্যের পরেই উজ্জ্বলতর বস্তু আমাদের চাঁদ। যদিও তার নিজের আলো নেই, সূর্যের আলোর প্রতিফলনেই সে এতটা জোছনাময়ী – সেই আমাদের পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ। মহাকাশে আমাদের নিকটতম প্রাকৃতিক প্রতিবেশী সে, পৃথিবী থেকে মাত্র তিন লক্ষ চুরাশি হাজার কিলোমিটার দূরত্বে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। এই দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাঁরা গাড়ি নিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন – দুবছর যাতায়াত করলেই তাঁরা এই দূরত্ব পেরিয়ে যান। কিন্তু পৃথিবীর পরিবেশে দূরত্ব পাড়ি দেয়া যতটা সহজ, পৃথিবী থেকে মহাকাশ পাড়ি দিয়ে চাঁদে পৌঁছানো ততটা সহজ নয়। কিন্তু মানুষ এই কঠিন কাজটি করে ফেলেছে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে – যখন মহাকাশ প্রযুক্তি আজকের তুলনায় অনেকটাই সীমিত ছিল। 


১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই চাঁদের বুকে প্রথম পা রেখেছিল পৃথিবীর মানুষ। সেদিন চাঁদে নামার আগের মুহূর্তে লুনার মডিউলের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নীল আর্মস্ট্রং বলেছিলেন, “I am going to step off the LM now. That’s one small step for a man, one giant leap for mankind.” সেদিন একজন মানুষের একটি ছোট্ট পদক্ষেপ ছিল সমগ্র মানবজাতির একটি বিশাল উল্লম্ফন। চাঁদের বুকে এই ‘ছোট্ট পদক্ষেপ’ দেয়ার জন্য দীর্ঘ পরিশ্রম করতে হয়েছে মহাকাশবিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদসহ অসংখ্য মানুষকে বছরের পর বছর। ধরতে গেলে সেই সময় মানুষের চাঁদে যাওয়ার ব্যাপারটি ছিল মূলত আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রতিযোগিতার ফসল। সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর পর। ১৯৪৬ সালে আমেরিকা চাঁদের উদ্দেশ্যে প্রথম বেতারতরঙ্গ পাঠায়। চাঁদের উদ্দেশ্যে প্রথম স্যাটেলাইট ‘স্পুটনিক’ পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৭ সালে। এরপর তারা ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত মোট চব্বিশটি ‘লুনা মিশন’ পরিচালনা করে চাঁদের উদ্দেশ্যে। তাদের বেশ কয়েকটি মিশন ব্যর্থ হলেও অনেকগুলি মিশন সফল হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন চাঁদে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করেনি। এদিকে আমেরিকা ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত পাইওনিয়ার ও র‍্যাঞ্জার প্রকল্পের আওতায় চাঁদের উদ্দেশ্যে আঠারোটি মিশন চালিয়ে মাত্র তিনটিতে আংশিক সফল হয়। এরপর ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮’র মধ্যে চাঁদের বুকে রোবট পাঠিয়ে ছবি ও ভূতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহের জন্য সাতটি সার্ভেয়ার মিশন পরিচালনা করে। সাতটির মধ্যে পাঁচটি মিশন সফল হয়। ১৯৬৬-৬৭ সালে লুনার অরবিটার প্রোগ্রামের পাঁচটি মিশন চালানো হয় সফলভাবে। এরপর আসে মানুষের চাঁদে যাওয়ার অ্যাপোলো প্রোগ্রাম। কিন্তু প্রথম মিশন অ্যাপোলো-১ উৎক্ষেপণের সময়েই আগুন লেগে পুড়ে মারা যান তিনজন নভোচারী গাস গ্রিসম, এড হোয়াইট এবং রজার শ্যাফি। চাঁদে যাওয়ার জন্য মানুষের অভিযাত্রা তাতেও দমে যায়নি। এরপর অ্যাপোলো প্রকল্পের আওতায় আরো অ্যাপোলো-২ থেকে অ্যাপোলো-১৭ পর্যন্ত মিশন পরিচালনা করা হয়েছে। অ্যাপোলো-১১ সর্বপ্রথম চাঁদে নামে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই। নীল আর্মস্ট্রং এবং এডউইন অলড্রিন চাঁদে নামেন। মানুষের চন্দ্রবিজয় সেখানেই থেমে থাকেনি। সেবছরই নভেম্বর মাসে চাঁদে পৌঁছায় অ্যাপোলো-১২। চাঁদে নামেন চার্লস কনরাড ও অ্যালেন বিন। ১৯৭০ সালে অ্যাপোলো-১৩ চাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা হলেও যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য চাঁদে পৌঁছাতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চাঁদে পৌঁছায় অ্যাপোলো-১৪। চাঁদে নামেন অ্যালেন শেপার্ড ও এডগার মিশেল। এর পাঁচ মাস পর জুলাই মাসে চাঁদে পৌঁছায় অ্যাপোলো-১৫। চাঁদে নামেন ডেভিড স্কট ও জেমস ইরউইন। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে চাঁদে পৌঁছায় অ্যাপোলো-১৬।  চাঁদে নামেন জন ইয়ং এবং চার্লস ডিউক। অ্যাপোলো-১৭ ছিল মানুষের চাঁদে যাবার সর্বশেষ মিশন। ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর চাঁদে নামেন ইউজিন কারনান ও হ্যারিসন স্মিট। তিন দিন দুই ঘন্টা ৫৯ মিনিট তাঁরা চাঁদের বুকে ছিলেন সেবার। এরপর দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে – মানুষ আর চাঁদে যায়নি। 


অ্যাপোলো-১৭ মিশনের কমান্ডার নভোচারী ইউজিন কারনান হলেন সর্বশেষ মানুষ যিনি চাঁদের মাটিতে হেঁটেছেন। তিনি একটি বই লিখেছেন ‘দ্য লাস্ট ম্যান অন দ্য মুন’ নামে (The Last Man on the Moon, St. Matin’s Griffin, New York, 2009) । অ্যাপোলো মিশনের কমান্ডার হিসেবে তিনিই ছিলেন চাঁদের বুকে সর্বশেষ মানুষ। কিন্তু তাঁর এই তকমা বদলে যাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই। চাঁদে যাওয়ার নতুন মিশন শুরু হয়ে গেছে। এখন চলছে চাঁদে মানুষের দ্বিতীয় অভিযান – মিশন আর্টেমিস। 


মানুষের উদ্ভবের আগে থেকেই চাঁদ-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রগুলি মহাবিশ্বে আলো ছড়াচ্ছে। তাই মানুষের কাল্পনিক লোককাহিনিতে চন্দ্র-সূর্যের নানারকমের অলৌকিক অবস্থান ও পরিচিতি। লোকসংস্কৃতির সম্মানে মানুষের চাঁদে যাবার প্রথম অভিযানের নাম দেয়া হয়েছিল গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর নামে। এবার দ্বিতীয় পর্যায়ের চন্দ্রাভিযানের নাম রাখা হয়েছে গ্রিক দেবী আর্টেমিসের নামে। লোককাহিনির অ্যাপোলো আর আর্টেমিস জমজ ভাইবোন হলেও - মিশন অ্যাপোলোর কার্বনকপি নয় মিশন আর্টেমিস। অ্যাপোলোর চেয়ে অনেক বেশি উন্নত এবং ব্যাপ্ত মিশন আর্টেমিস। 


১৯৬৯ সালে মানুষ যখন প্রথমবার চাঁদে যায় তখন কম্পিউটার প্রযুক্তি ছিল অত্যন্ত সীমিত। এখনকার মতো মানুষের হাতে হাতে আধুনিক কম্পিউটার থাকা তো দূরের কথা – কম্পিউটারের নামও তখন সাধারণ মানুষ শোনেনি। যে লুনার মডিউল ‘ঈগল’ প্রথম চাঁদে নামে তার কম্পিউটারের মেমোরি ছিল মাত্র ৭৪ কিলোবাইট। এখনকার শিশুদের খেলনা ইলেকট্রনিক্সেও এর চেয়ে বেশি মেমোরি থাকে। তাই ১৯৬৯-৭২ সালের চন্দ্রাভিযানের চেয়ে ২০২২-২৫ সালের চন্দ্রাভিযান অনেক বেশি উন্নত হবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই  এবারের চন্দ্রমিশনের ব্যাপ্তিও বেড়েছে অনেক। মিশন আর্টেমিস – শুধু চাঁদে যাওয়া নয় – চাঁদে বসবাস করারও একটি সুদূরপ্রসারী মিশন। চাঁদের কক্ষপথে এবং চাঁদের মাটিতে স্থায়ী মহাকাশ স্টেশন স্থাপন করার উদ্দেশ্যও আছে এই আর্টেমিস মিশনের সাথে। 


আর্টেমিস মিশনের উদ্দেশ্যগুলিকে - সমতা, প্রযুক্তি, অংশীদারিত্ব, স্থায়ীত্ব, জ্ঞান এবং সম্পদ – এই ছয়টি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। 

(১) সমতা: ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত যে ছয়টি মিশনে বারো জন নভোচারী চাঁদের বুকে পা রেখেছেন – তাঁদের প্রত্যেকেই শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। এবারের চন্দ্রাভিযানে নাসা উদ্যোগ নিয়েছে নভোচারীদের মধ্যে লিঙ্গ এবং বর্ণবৈষম্য দূর করার। তাই এই আর্টেমিস মিশনে প্রথমবার একজন নারী এবং একজন অশ্বেতাঙ্গ পুরুষ নভোচারী চাঁদে যাবেন বলে ঠিক করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নাসা চাঁদে যাবার প্রথম নভোচারীদল নির্বাচন করে ফেলেছে। আর্টেমিস-২ ও আর্টেমিস-৩ মিশনে যে চারজন নভোচারী চাঁদে যাবেন তাঁরা হলেন – কমান্ডার রেইড ওয়াইজম্যান, পাইলট ভিক্টর গ্লোভার, মিশন স্পেশালিস্ট-১ ক্রিস্টিনা হ্যামক কোচ, এবং মিশন স্পেশালিস্ট-২ জেরেমি হ্যানসেন। ভিক্টর গ্লোভার হবেন প্রথম অশ্বেতাঙ্গ নভোচারী যিনি চাঁদে যাবেন। আর ক্রিস্টিনা কোচ হবেন প্রথম নারী নভোচারী যিনি চন্দ্রবিজয় করবেন। 


 

কমান্ডার রেইড ওয়াইজম্যান, পাইলট ভিক্টর গ্লোভার, মিশন স্পেশালিস্ট-১ ক্রিস্টিনা হ্যামক কোচ, এবং মিশন স্পেশালিস্ট-২ জেরেমি হ্যানসেন।


(২) প্রযুক্তি: আর্টেমিস মিশনের জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে রকেট থেকে স্পেসস্যুট পর্যন্ত সবকিছু তৈরি করা হয়েছে – যা ভবিষ্যতে আরো দূরের মহাকাশযাত্রায় কাজে লাগবে। আর্টেমিস মিশনে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আধুনিকতম সংস্করণ ব্যবহার করা হচ্ছে এবং আরো নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন হচ্ছে। 

(৩) অংশীদারিত্ব: আমেরিকান মহাকাশ সংস্থা নাসা এবার অন্যান্য দেশের মহাকাশ সংস্থার পাশাপাশি অন্যান্য বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান – যেমন স্পেস-এক্স, বোয়িং ইত্যাদির সাথে যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এই মিশন পরিচালনা করছে। প্রথম চারজন নভোচারীর মধ্যে একজন (জেরেমি হ্যানসেন) কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সির নভোচারী। 

(৪) স্থায়ীত্ব: অ্যাপোলো মিশনের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হবে আর্টেমিস মিশনের সময়কাল। অ্যাপোলো-১৭’র নভোচারীরা সর্বাধিক তিন দিন অবস্থান করেছিলেন চাঁদের পিঠে। আর্টেমিসের নভোচারীদের চাঁদের পিঠে সপ্তাহেরও বেশি সময় থাকার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ভবিষ্যতের মিশনে লুনার গেটওয়ে স্টেশনের মাধ্যমে তিন মাস পর্যন্ত নভোচারীদের চাঁদে থাকার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

(৫) নতুন জ্ঞান: অ্যাপোলো মিশনের পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে অনেক। এই উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে আর্টেমিস মিশনের নভোচারীরা চাঁদের অনেক অজানা তথ্য আবিষ্কার করতে পারবেন যা এতদিন জানা সম্ভব হয়নি। এই মিশন শুধুমাত্র চাঁদে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ভবিষ্যতের আর্টেমিস মিশন চাঁদ থেকে মঙ্গল পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। 

(৬) চাঁদের সম্পদ: চাঁদে পানি এবং অন্যান্য দুষ্প্রাপ্য খনিজ সম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই মিশন সেই সম্ভাবনার সাথে বাস্তবের সমন্বয় করতে সক্ষম হবে। এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে চাঁদে স্থায়ী মহাকাশ স্টেশন তৈরি করে সেখান থেকে ভবিষ্যতের মহাকাশ মিশন চালানোর সম্ভাবনা বাড়বে। 


নাসার এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী মিশন আর্টেমিস। এই মিশনে চারজন নভোচারী চাঁদে যাবেন এবং চাঁদ পেরিয়ে মহাকাশের আরো চৌছট্টি হাজার কিলোমিটার গভীরে পৌঁছে যাবেন যেখানে এপর্যন্ত আর কোনো নভোচারী যাননি। যে নভোযানে চড়ে নভোচারীরা যাবেন তার নাম অরিয়ন। সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এই নভোযান এপর্যন্ত পৃথিবীতে একমাত্র নভোযান যা নভোচারীদের মহাকাশের গভীরে নিয়ে গিয়ে আবার নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবে। এই আধুনিকতম নভোযান মহাকাশে পাঠানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে সবচেয়ে শক্তিশালী রকেটসমৃদ্ধ স্পেস লঞ্চিং সিস্টেম। এই প্রজেক্টে প্রাথমিকভাবে খরচ হচ্ছে প্রায় একশ বিলিয়ন ডলার বা দশ লক্ষ কোটি টাকা। 


প্রাথমিকভাবে আর্টেমিস-১, আর্টেমিস-২, এবং আর্টেমিস-৩ এর বিস্তারিত কর্মসূচি এবং কর্মপরিকল্পনা ঘোষিত হয়েছে। তিনটি মিশন-ই চাঁদে যাওয়ার মিশন। আর্টেমিস-১ মিশন হলো চাঁদে যাবার প্রাথমিক মিশন যেখানে নভোযান উৎক্ষেপণ থেকে শুরু করে চাঁদের চারপাশে ঘুরে আসা পর্যন্ত চন্দ্রাভিযানের সবগুলি ধাপ পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে নভোচারীদের ছাড়াই। ইতোমধ্যে ১৬ নভেম্বর ২০২২ থেকে ১১ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত  আর্টেমিস-১ মিশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখন সেই মিশনের ফলাফল বিশ্লেষণ এবং পর্যালোচনা চলছে। এই মিশনের বিস্তারিত আমরা একটু পরে আলোচনা করছি। আর্টেমিস-২ মিশনে নভোচারীরা মহাকাশে গিয়ে চাঁদের চারপাশে ঘুরে পৃথিবীতে ফিরে আসবেন, এবং আর্টেমিস-৩ মিশনে নভোচারীরা চাঁদে অবতরণ করবেন এবং সপ্তাহখানেক সেখানে থেকে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। আশা করা হচ্ছে ২০২৪ সালে আর্টেমিস-২ এবং ২০২৫ সালে আর্টেমিস-৩ মিশন কার্যকর হবে। 


আর্টেমিস মিশনের যান্ত্রিক গঠনের চারটি প্রধান অংশ: (১) নভোযান – অরিয়ন, (২) লুনার গেটওয়ে, (৩) হিউম্যান ল্যান্ডিং সিস্টেম (এইচ এল এস), এবং (৪) স্পেস লঞ্চ সিস্টেম (এস এল এস) ।


আর্টেমিস মিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর নভোযান – অরিয়ন। পৃথিবীবিখ্যাত নভোযান প্রস্তুতকারি সংস্থা লকহিড মার্টিন তৈরি করেছে এই অত্যাধুনিক নভোযান অরিয়ন। এখনো পর্যন্ত অরিয়ন হলো পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক নভোযান। এই নভোযান চন্দ্রাভিযানের নভোচারীদের প্রচন্ড বেগে নিয়ে যাবে গভীর মহাকাশে, আবার নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে পৃথিবীতে। মহাকাশের তেজস্ক্রিয় থেকে রক্ষা করবে নভোচারীদের। আবার পৃথিবীতে ফেরার সময় পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষে যে অসহ্য তাপ উৎপন্ন হবে – রক্ষা করবে সেই তাপ থেকেও। অরিয়ন নভোযান অনেকবার ব্যবহার করা যাবে। আর্টেমিস-১ মিশনে অরিয়ন ইতোমধ্যে চাঁদের পাশ থেকে ঘুরে এসেছে। আবার অরিয়ন-২ ও ৩ মিশনে নভোচারীদের নিয়ে যাবে চাঁদে।  

অরিয়নের তিনটি প্রধান অংশ – লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেম, ক্রু মডিউল, এবং সার্ভিস মডিউল। তিনটি অংশের দৈর্ঘ্য ৬৭ ফুট। স্পেস লঞ্চ সিস্টেম রকেটের উপর লাগানো অবস্থায় এর উচ্চতা ৩২২ ফুট। চারজন নভোচারী নিয়ে এই নভোযান মহাকাশে একুশ দিন পর্যন্ত থাকতে পারবে। ৭৭,১৫০ ধরনের ৩,৫৫,০৫৬টি যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে অরিয়ন। 


 



মহাকাশে নভোচারীদের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিখুঁত হওয়াটা সবচেয়ে জরুরি। প্রথমবার চন্দ্রাভিযানের সময় অ্যাপোলো-১ এর তিনজন নভোচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছিল। সেরকম দুর্ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য নিশ্চিদ্র ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে অরিয়নে। এই ব্যবস্থার নাম লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেম। স্পেস লঞ্চ সিস্টেমের রকেটের সাহায্যে উৎক্ষেপণের সময় অরিয়নের ক্রু মডিউলের সামনে পঞ্চাশ ফুট দৈর্ঘ্যের এই লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেম লাগানো থাকে। এই সিস্টেমের দুইটি অংশ – ফেয়ারিং অ্যাসেম্বলি এবং লঞ্চ অ্যাবর্ট টাওয়ার। ফেয়ারিং অ্যাসেম্বলি হালকা যৌগিক ধাতুর তৈরি প্রকোষ্ঠ যেটা উৎক্ষেপণের সময় উৎপন্ন তাপ, বাতাস এবং শব্দ থেকে অরিয়নকে রক্ষা করে। লঞ্চ অ্যাবর্ট টাওয়ারে লাগানো থাকে তিনটি অত্যন্ত শক্তিশালী যান্ত্রিক মোটর যেগুলি প্রায় চার লক্ষ পাউন্ড ধাক্কা তৈরি করতে পারে। উৎক্ষেপণের সময় যদি কোন যান্ত্রিক ত্রুটি বা অন্য কোন কারণে যদি নভোচারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয় – লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেমের মোটরগুলি চালু হয়ে অরিয়নের ক্রু মডিউলে অবস্থানরত নভোচারীদের নিয়ে ক্রু মডিউলটিকে অরিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন করে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে নিরাপদ জায়গায় উড়ে যায়। লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেমের বেগ শূন্য থেকে ঘন্টায় ৮০০ কিলোমিটার উঠে যেতে পারে দুই সেকেন্ডের মধ্যে। অথচ একটি বোয়িং-৭৪৭ প্লেনের গতিবেগ ঘন্টায় শূন্য থেকে ৩৬০ কিলোমিটারে উঠতে কমপক্ষে দশ সেকেন্ড সময় লাগে। যদি কোন দুর্ঘটনা না ঘটে এবং সবকিছু ঠিকঠাকমতো উৎক্ষেপণ হয়, তখন অরিয়নের লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেমের আর কোন কাজ থাকে না। সেক্ষেত্রে শুধু শুধু এই পঞ্চাশ মিটার লম্বা যন্ত্রাংশ নিয়ে মহাকাশে ঢোকার কোন মানে থাকে না। যখন আর কোন বিপদের সম্ভাবনা থাকে না তখন অরিয়ন থেকে এই লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেম আলাদা হয়ে যায়। তখন অরিয়নের ক্রু মডিউল আর সার্ভিস মডিউল নিয়ে চাঁদের পানে চলতে থাকে স্পেস লঞ্চিং সিস্টেমের রকেট। 


অরিয়নের ক্রু মডিউল হলো মিশন চলাকালীন নভোচারীদের আবাসস্থল। এগারো ফুট উচ্চতা এবং সাড়ে ষোল ফুট ব্যাসের এই চোঙাকৃতি জায়গায় চারজন নভোচারীর থাকার ব্যবস্থা। উৎক্ষেপণের সময় থেকে শুরু করে পৃথিবী থেকে চাঁদে পৌঁছে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসা পর্যন্ত সর্বোচ্চ একুশদিন পর্যন্ত এখানে স্বচ্ছন্দে থাকতে এবং প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারবেন চারজন নভোচারী। পৃথিবী থেকে চাঁদে যাবার সময় ক্রু মডিউল এবং সার্ভিস মডিউল একসাথে গেলেও পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় শুধুমাত্র এই ক্রু মডিউলটাই ফিরে আসবে নভোচারীদের নিয়ে। ক্রু মডিউলের ভেতর নভোচারীদের বাসোপযোগী পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, আর্দ্রতা, অক্সিজেনের মাত্রা, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা প্রভৃতি স্বাস্থ্যকর পর্যায়ে রাখা হয়। স্বচ্ছ শক্ত কাচের জানালাযুক্ত ককপিট থেকে নভোচারীরা অরিয়নের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ক্রু মডিউলের দেয়াল এমনভাবে তৈরি যেন মহাকাশের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মডিউলের ভেতর প্রবেশ না করতে পারে। মিশন চলাকালীন এই মডিউলই হবে নভোচারীদের ঘরবাড়ি। এখানেই তাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা, এখানেই ওজনহীন পরিবেশে তাদের টয়লেট করার ব্যবস্থা। নভোচারীদের সুস্থ থাকার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করতে হয়। এই মডিউলে তার ব্যবস্থাও আছে। 


ক্রু মডিউলের নিচে লাগানো থাকে সার্ভিস মডিউল। ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি এই মডিউলের সব ব্যবস্থা করেছে বলে অরিয়নের এই মডিউলের নাম ইওরোপিয়ান সার্ভিস মডিউল। সার্ভিস মডিউল হলো নভোযানের পাওয়ার হাউজ। এখানেই সৌরপ্যানেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, এখানেই ইঞ্জিন এবং থ্রাস্টার। অরিয়নের সার্ভিস মডিউলের দৈর্ঘ্য ১৫.৭ ফুট এবং ব্যাস ১৬.৫ ফুট। আর্টেমিস-১ মিশনে এর ভর ৩৩,৭০০ পাউন্ড, আর্টেমিস-২ মিশনে এর ভর হবে ৩৪,৪০০ পাউন্ড। ছয় হাজার পাউন্ড ধাক্কা তৈরি করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ইঞ্জিন আছে যেটা দিয়ে অরিয়নকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই প্রধান ইঞ্জিনকে সাহায্য করার জন্য রয়েছে আটটি সাহায্যকারী ইঞ্জিন – যেগুলির প্রত্যেকে ১১০ পাউন্ড ধাক্কা তৈরি করতে পারে। গতি-প্রতিক্রিয়া সামলানোর জন্য রয়েছে আরো চব্বিশটি ছোট ইঞ্জিন – যেগুলি প্রত্যেকে ৫০ পাউন্ড ধাক্কা তৈরি করতে পারে। সৌরবিদ্যুৎ তৈরি করার জন্য রয়েছে পনের হাজার সৌরকোষ সমন্বিত চারটি সৌরপ্যানেল যেগুলি খুললে ৬২ ফুট লম্বা হয়। এগারো কিলোওয়াট বিদ্যুৎশক্তি তৈরি করতে পারে এই প্যানেলগুলি। 


আর্টেমিস মিশনে যতগুলি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে তাদের সবগুলিই একাধিকবার আলাদা আলাদাভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে আর্টেমিস-১ মিশন শুরু হবার আগে। আর্টেমিস-১ মিশনে পুরো সিস্টেমকে একসাথে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। স্পেস লঞ্চিং সিস্টেম থেকে শুরু করে অরিয়ন নভোযান। নভোচারীদের বদলে ডামি নভোচারী (মুনকিন) পাঠানো হয়েছিল এই মিশনে। 

পরপর চারবার উড্ডয়ন বাতিল হবার পর অবশেষে ১৬ নভেম্বর ২০২২ কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চপ্যাড ৩৯বি থেকে আকাশে পাড়ি দেয় আর্টেমিস-১ মিশনের নভোযান অরিয়ন। উৎক্ষেপণের ৯০ সেকেন্ডের মধ্যেই অরিয়নকে নিয়ে রকেট পৌঁছে যায় সর্বোচ্চ বায়ুমন্ডলীয় শক্তির পর্যায়ে। দুই মিনিট পরে রকেট বুস্টার আলাদা হয়ে যায়। এর আট মিনিট পরে চারটি রকেট ইঞ্জিন অরিয়নকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে রকেট এবং লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেম আলাদা হয়ে যায়। ক্রু মডিউল এবং সার্ভিস মডিউলসহ অরিয়ন তখন ইনট্রিম ক্রায়োজনিক প্রপালসান স্টেজের (আইসিপিএস) সাথে যুক্ত হয়ে চাঁদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পৃথিবীর চারপাশে একবার প্রদক্ষিণ করার পর সার্ভিস মডিউলের সোলার প্যানেল খুলে যায় এবং সৌরবিদ্যুৎ উৎপন্ন হতে শুরু করে। আইসিপিএস তখন অরিয়নকে একটি বড় ধাক্কা দিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথে থেকে সরিয়ে চাঁদের দিকে ঠেলে দেয় এবং আইসিপিএস আলাদা হয়ে যায়। পঞ্চম দিনে (২০ নভেম্বর) নভোযান অরিয়ন চাঁদের প্রভাববলয়ে প্রবেশ করে। পৃথিবীর মহাকর্ষ বলের চেয়ে চাঁদের মহাকর্ষ বল এখানে বেশি। ষষ্ঠ দিবসে (২১ নভেম্বর) অরিয়ন চাঁদের পিঠের ১৩০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে যায়। চাঁদের পাশ দিয়ে উড়ে যায় অরিয়ন। অষ্টম দিবসে চাঁদের প্রভাববলয় থেকে বের হয়ে আসে অরিয়ন। আস্তে আস্তে চাঁদ থেকে দূরে সরে আসতে থাকে অরিয়ন। দশম দিবসে অরিয়ন নভোযান জ্বালানি পুড়িয়ে ‘ডিসট্যান্ট রেট্রোগ্রেড লুনার অরবিট’এ প্রবেশ করে। চাঁদের পিঠ থেকে অনেক দূরে উড়ছিল বলে এটা ডিসট্যান্ট। আর রেট্রোগ্রেড – কারণ এটা চাঁদ যেদিকে ঘুরছিল – তার বিপরীত দিকে ঘুরছিলো। একাদশ দিবসে (২৬ নভেম্বর) অরিয়ন মহাকাশে ইতিহাস তৈরি করে। নভোচারীদের বহন করার জন্য তৈরি নভোযান এর আগে মহাকাশের এত গভীরে আর প্রবেশ করেনি। এর আগে অ্যাপোলো-১৩ পৃথিবী থেকে ৪,০০,১৭১ কিলোমিটার দূরে উড়েছিল। অরিয়ন তেরোতম দিবসে ৪,৩২,২১০ কিলোমিটার দূরত্বে উড়েছিল। ১৬তম দিবসে (১ ডিসেম্বর) আরেকবার জ্বালানি পুড়িয়ে অরিয়ন ডিসট্যান্ট রেট্রোগ্রেড লুনার অরবিট থেকে বের হয়ে পৃথিবীর দিকে রওনা দেয়। ২০তম দিবসে (ডিসেম্বর ৫) অরিয়ন চাঁদের পিঠের আরো কাছাকাছি ১২৮ কিলোমিটারের মধ্যে উড়ে যায়। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ ব্যবহার করে অরিয়ন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের ভেতর চলে আসে। ডিসেম্বরের ১১ তারিখে সান দিয়েগোর তীরে প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ করে অরিয়ন। আর্টেমিস-১ মিশনে পঁচিশ দিন ১০ ঘন্টা ৫৩ মিনিটে প্রায় তেইশ লক্ষ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে অরিয়ন। 

 

আর্টেমিস-১ মিশন পৃথিবী থেকে চাঁদ প্রদক্ষিণ করে সফলভাবে পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। অরিয়নের ক্রু মডিউলে নভোচারীদের সিটে তিনটি ডামি নভোচারী বসানো হয়েছিল। কমান্ডার মুনিকিনের (প্রধান ডামি) সিটের পেছনে এবং মাথার পেছনে দুটো সেন্সর বসানো হয়েছিল – মিশন চলাকালীন ত্বরণ ও কম্পনের মাত্রা রেকর্ড করার জন্য। ডামি নভোচারীর পোশাকের সাথে আরো পাঁচটি ত্বরণমাপক যন্ত্র বসানো হয়েছিল ত্বরণ রেকর্ড করার জন্য। হেলগা এবং জোহর নামে আরো দুটো ডামি নভোচারী পাঠানো হয়েছিল। তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ৫৬০০ পরোক্ষ বিকিরণমাপক যন্ত্র এবং ৩৪টি প্রত্যক্ষ বিকিরণমাপক যন্ত্র বসানো হয়েছিল মহাকাশের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মেপে দেখার জন্য। এই ডাটা থেকে দেখা যাবে আর্টেমিস-২ ও আর্টেমিস-৩ এর সময় নভোচারীরা বিকিরণ থেকে নিরাপদ থাকবেন কি না। 


আর্টেমিস-১ এর সাফল্যের পর এখন প্রস্তুতি চলছে আর্টেমিস-২ মিশনের। আর্টেমিস-২ মিশনে চারজন নভোচারীকে চাঁদে পাঠানো হবে দশ দিনের জন্য। চাঁদের উল্টোপিঠে অরিয়ন থেকে পরিক্রমা করবেন তাঁরা। এই মিশনে অরিয়নের উৎক্ষেপণ হবে আর্টেমিস-১ এর অনুরূপ। অরিয়ন এবং আইসিপিএস পৃথিবীকে দুবার প্রদক্ষিণ করে নিশ্চিত করবে যে সবগুলি সিস্টেম ঠিকমতো কাজ করছে। প্রথমবার পৃথিবীর কাছাকাছি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে – (১৮৫ থেকে ২৯০০ কিলোমিটার উচ্চতায়), এবং দ্বিতীয়বার পৃথিবী থেকে দূরে উপবৃত্তাকার পথে – (৩৮০ কিলোমিটার থেকে ১ লক্ষ ১০ হাজার কিলোমিটার উচ্চতায়) ঘুরবে অরিয়ন। এরপর চলে যাবে চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের দিকে। চাঁদের কাছাকাছি পৌঁছে চাঁদের যে পিঠ পৃথিবী থেকে দেখা যায় না, সেই পিঠে চৌষট্টি হাজার কিলোমিটার উড়ে উড়ে দেখবে। ফিরে আসার সময় পৃথিবীর মহাকর্ষ কাজে লাগিয়ে মুক্তভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসবে যেভাবে এসেছে আর্টেমিস-১ মিশনে। 


আর্টেমিস-৩ মিশন হবে মানুষের দ্বিতীয় পর্যায়ে চাঁদে নামার মিশন। এই মিশনে চারজন নভোচারী চাঁদে যাবেন। তাঁদের মধ্যে দু’জন নভোচারী হিউম্যান ল্যান্ডিং সিস্টেমের মাধ্যমে চাঁদের বুকে নামবেন। তাই এই মিশনের আগে একটি সার্ভিস মিশনের মাধ্যমে হিউম্যান ল্যান্ডিং সিস্টেম এবং অরিয়ন ডকিং সিস্টেম চাঁদে স্থাপন করা হবে। চাঁদের কক্ষপথে একটি মহাকাশ স্টেশন - লুনার গেটওয়ে স্থাপনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে যার সম্পর্কে একটু পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। চাঁদের ঠিক কোন্‌ জায়গায় হিউম্যান ল্যান্ডিং সিস্টেম স্থাপন করা হবে এবং ঠিক কোথায় নভোচারীরা চাঁদে নামবেন তা এখনো নির্দিষ্টভাবে ঠিক করা হয়নি। চাঁদের চারপাশ থেকে প্রতিনিয়ত ছবি তুলে পাঠাচ্ছে লুনার রিকনিসেন্স অরবিটার স্যাটেলাইট। বছরের প্রতিদিন চাঁদের কোথায় কী পরিবর্তন হচ্ছে তা বোঝা যায় সেই ছবিগুলি থেকে। বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন চাঁদের পিঠে এমন একটি জায়গা খুঁজে বের করতে যেখানে প্রচুর সূর্যালোক থাকবে যেন তাপমাত্রার পার্থক্য খুব কম হয়, যেখানে ল্যান্ডিং সহজ হবে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় কোন বিচ্যুতি ঘটবে না। আর্টেমিস-৩ এর নভোচারীরা চাঁদের পিঠ থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোগ্রাম নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসবেন। 


আর্টেমিস মিশনের আরেকটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হলো লুনার গেটওয়ে – স্পেস স্টেশন স্থাপন করা। চাঁদের চারপাশে ঘুরবে এই বিশেষ মহাকাশ স্টেশন – লুনার গেটওয়ে। এই স্টেশনে নভোচারীরা এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত অবস্থান করে চাঁদের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে অনেকগুলি পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারবেন। পৃথিবী থেকে তিন লক্ষ ৮৫ হাজার কিলোমিটার দূরে থেকে মহাকাশের ভবিষ্যৎ মিশনগুলির কারিগরি সহায়তা দেয়া হবে এই স্টেশন থেকে। আর্টেমিস-৩ এ নভোচারীরা যখন চাঁদে অবতরণ করবেন, তখন এই স্টেশন অনেক কাজে আসবে। 


নাসা অনেক বছর থেকেই চেষ্টা করছে চাঁদের পাশে স্টেশন তৈরি করার। ২০১২ সালে নাসা চাঁদের উল্টোপিঠে [যে পিঠ পৃথিবী থেকে দেখা যায় না] লুনার স্টেশন তৈরি করার পরিকল্পনা পর্যালোচনা করে। ২০১৭ সালে নাসা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চাঁদের পাশে ‘ডিপ স্পেস গেটওয়ে’ মহাকাশ স্টেশন তৈরি করবে। ২০১৮ সালে স্পেস স্টেশনের নাম ঠিক করা হয় – লুনার অরবিটাল প্লাটফরম-গেটওয়ে। এখন স্পেস স্টেশনটি গেটওয়ে নামেই পরিচিত। 


আমেরিকার সবচেয়ে বড় বহুজাতিক মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান নরথ্রপ গ্রুম্যান করপোরেশন লুনার গেটওয়ের হ্যাবিটেশন ও লিজিস্টিক আউটপোস্ট – হ্যালো (HALO) নির্মাণ করেছে। এর আগে নরথ্রপ গ্রুম্যান কোম্পানি জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের বিভিন্ন অংশ তৈরি করেছে। হ্যালো মডিউলটি তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যন্ত্রপাতি এবং নভোচারীদের জন্য রসদ পাঠানোর জন্য ব্যবহৃত কার্গো মহাকাশযান সিগনাসের অনুকরণে। গেটওয়ের আয়তন সীমিত রাখা হয়েছে যেন তাকে মহাকাশে পাঠাতে কোন বেগ পেতে না হয়। বর্তমানে যেসব রকেটের মাধ্যমে সিগনাস পাঠানো হয় – সেই রকেটেই গেটওয়ে পাঠানো যায় মহাকাশে। গেটওয়ের হ্যালো মডিউল তৈরিতে খরচ হচ্ছে প্রায় ১১২২ মিলিয়ন ডলার (১১,২২০ কোটি টাকা)। গেটওয়ের হ্যালোতে চারজন নভোচারী তিরিশ দিন পর্যন্ত চাঁদের কাছাকাছি গিয়ে থাকতে পারবে এবং আবার ফিরেও আসতে পারবে। ২০২৪ সালে স্পেস-এক্স ফ্যালকন হ্যাভি রকেটের সাহায্যে গেটওয়ে পাঠানো হবে মহাকাশে। 


মহাকাশ স্টেশনের পাওয়ার অ্যান্ড প্রপালশান মডিউল তৈরি করছে আমেরিকার বিখ্যাত স্যাটেলাইট প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সার টেকনোলজিস। সৌরবিদ্যুৎ তৈরি করে সেই বিদ্যুতের মাধ্যমে চলবে এই মডিউল। চাঁদের চারপাশে এটা ঘুরবে, এবং ভবিষ্যতে এই স্টেশনকে যখন মঙ্গলে অভিযাত্রার কাজে লাগানো হবে, তখন প্রয়োজনীয় কারিগরি পরিবর্তন করা সম্ভব হবে। ২০২৪ সালে স্পেস-এক্স ফ্যালকন হ্যাভি রকেটের সাহায্যে এই মডিউল মহাকাশে পাঠানো হবে। 


লুনার স্পেস স্টেশন গেটওয়েতে নভোচারীরা সবসময় থাকবেন না। সর্বোচ্চ তিরিশ দিন থাকার পর তাঁরা যখন পৃথিবীতে ফিরে আসবেন, পরবর্তী মিশনে আরেকদল নভোচারী যাওয়ার আগপর্যন্ত সেই স্টেশন খালি থাকবে। তখন তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় মেরামতি কাজ করার জন্য অত্যাধুনিক রোবটিক হাতের ব্যবস্থা করছে কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি। এই রোবটিক হাতের নাম কানাডার্ম-৩। স্পেস শাটল এবং ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনেও তাদের কানাডার্ম- ১ ও ২ কাজ করছে। কানাডার্ম -৩ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন বলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনেক দরকারি কাজ নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে করে ফেলতে পারে। আগামী চব্বিশ বছরে কানাডা এ বাবদ দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি (বাংলাদেশ টাকায় প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকা) খরচ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।  


স্পেস-এক্স কোম্পানি গেটওয়ের কার্গো সার্ভিসের দায়িত্ব নিয়েছে। তাদের কার্গোযানের নাম দেয়া হয়েছে ড্রাগন। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ড্রাগন নিয়মিত পণ্য সরবরাহ করে। গেটওয়ের কার্গোর নাম ড্রাগন এক্স-এল। এই ড্রাগন আগের ড্রাগনের চেয়ে সাড়ে পাঁচ টন বেশি মালামাল বহন করতে পারবে। কার্গোর জন্য নাসার খরচ হচ্ছে প্রায় সাত শ কোটি ডলার (প্রায় সত্তর হাজার কোটি টাকা)। নভোচারীরা গেটওয়েতে যাবেন অরিয়ন নভোযানে চড়ে। 


গেটওয়ের জন্য একটি নতুন কক্ষপথ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই কক্ষপথে আগে কোন নভোযান চাঁদের চারপাশে ঘোরেনি। এই কক্ষপথের নাম ‘নিয়ার রেকটিলিনিয়ার হ্যালো অরবিট (NRHO)’। এই কক্ষপথ থেকে চাঁদের দক্ষিণ মেরু একদম কাছে, কিন্তু অন্যান্য দিকে কিছুটা দূরে। এই কক্ষপথটি চাঁদের ভূমি থেকে তিন হাজার থেকে সত্তর হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই কক্ষপথে চাঁদের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে সাত দিন সময় লাগবে। 


আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন পৃথিবী থেকে মাত্র ৪০৮ কিলোমিটার দূরে লোয়ার আর্থ অরবিটে ঘুরছে। সে তুলনায় গেটওয়ে পৃথিবী থেকে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার দূরে চাঁদের চারপাশে ঘুরবে। পৃথিবী থেকে এই স্টেশনে নভোচারী এবং অন্যান্য সামগ্রী পাঠানো অনেক বেশি ব্যয়বহুল এবং জটিল। তাই গেটওয়েতে সবসময় নভোচারীরা থাকবেন এমন নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই স্টেশন চলবে। এমনকি অন্যান্য মহাকাশ মিশনের নভোচারীরাও এই স্টেশন ব্যবহার করতে পারবে ভবিষ্যতে। গেটওয়ে স্টেশন স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো চাঁদে অবতরণ এবং চাঁদ থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় নভোচারী এবং নভোযানগুলি এই স্টেশন ব্যবহার করবে। নাসা ভবিষ্যতে চাঁদের বুকে একটি স্থায়ী স্টেশন ‘আর্টেমিস বেইজ ক্যাম্প’ স্থাপন করার পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে। 


গেটওয়ে থেকে লুনার টেলিরোবটিক্স পরীক্ষা করে দেখা হবে – পৃথিবী থেকে কমান্ড পাঠালে আর গেটওয়ে থেকে কমান্ড পাঠালে তাদের কর্মদক্ষতায় কোন পার্থক্য দেখা যায় কি না তা পরীক্ষা করে দেখা হবে। পৃথিবী থেকে কমান্ড পাঠালে তা চাঁদে পৌঁছাতে দুই সেকেন্ড সময় লাগে। গেটওয়ে থেকে কমান্ড পাঠাতে কোন সময়ই লাগবে না। সময়ের পার্থক্য কি কোন পরিবর্তন আনে তা পরীক্ষা করে দেখা যাবে। সুদূর ভবিষ্যতে চাঁদ থেকে মঙ্গলে পাড়ি দেয়ার সময় গেটওয়ে স্টেশন ভীষণ দরকারি হয়ে উঠবে। 

আর্টেমিস মিশনের মাধ্যমে মানুষের দ্বিতীয় পর্যায়ে চাঁদে যাওয়ার প্রক্রিয়া চালু হয়ে গেছে। অচিরেই আমাদের চাঁদ হয়ে উঠবে মহাকাশের স্থায়ী স্টেশন। 


তথ্যসূত্র:

১। www.nasa.gov

২। www.space.com

৩। প্রদীপ দেব, চাঁদের নাম লুনা, মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭। 

৪। ডগলাস ব্রিংকলি, আমেরিকান মুনশট, হারপার পেরেনিয়াল, নিউইয়র্ক,২০১৯। 

____________
বিজ্ঞানচিন্তা জুলাই ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত










Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts