লেখক ফাল্গুনী
মুখোপাধ্যায়কে আমি এই সেদিনও লেখিকা মনে করতাম। এখন অবশ্য লেখক শিক্ষক পরিচালক এরকম
সব পেশাগত পরিচয়ের আর লৈঙ্গিক বিভাজন হয় না। এখন তসলিমা রুদ্র দুজনই লেখক। লেখিকা,
শিক্ষিকা, পরিচালিকা এরকম শব্দগুলির ব্যবহার এখন খুবই অনাধুনিক। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের
প্রথম বই কখন পড়েছিলাম হুবহু দিন-তারিখ মনে নেই। তখন এমন একটা সময়, যখন পরীক্ষার জন্য
‘সময়ের মূল্য’ রচনা মুখস্থ করতে হতো, কিন্তু সময়ের আলাদা কোন মূল্যই সেই সময় ছিল না
আমার কাছে। সুনীলের ‘সেই সময়’ তখনো প্রকাশিত হয়নি, পড়া তো আরো অনেক পরের ব্যাপার।
বাড়িতে একজন
ইঁচড়ে পাকা খুড়তুতো বড়ভাই ছিলেন। তার অনেকগুলি শখের একটি ছিল বইপড়া। নানান জায়গা থেকে
নানান রকমের বই জোগাড় করে আনতেন তিনি। তক্কে তক্কে থাকতাম কখন হাত ঘুরে আমার হাতে আসবে।
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের প্রথম বই যেটা আমার হাতে এসেছিল – মধুমিলন টাইপের কিছু একটা
নাম ছিল তার। তখন সবে গোঁফ গজাতে শুরু করেছে, শরীরে গোলমেলে নতুন হরমোনের প্রভাব প্রকট।
মাথার ভেতর যখন তখন উঁকি মারে নানান নিষিদ্ধ কৌতুহল। নামের কারণেই বইটির প্রতি আকৃষ্ট
হওয়া। পড়ার পর মনে হয়েছিল বইটির নামকরণের স্বার্থকতা নেই।
পরে ফাল্গুনী
মুখোপাধ্যায়ের আরো অনেক বই পড়া হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। তাঁর কাহিনি থেকে তৈরি ভারতীয়
সিনেমা ‘শাপমোচন’ও দেখেছিলাম। তখন চট্টগ্রাম শহরে অনেকগুলি বইয়ের দোকান ছিল, বইয়ের
ক্রেতাও ছিল অনেক। ফুটপাতেও বই বিক্রি হতো অনেক। বেশিরভাগই পাইরেটেড বই। তখন অবশ্য
পাইরেসি সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। তিন-চার টাকা দিয়ে ফালগুনী, আশুতোষ, নীহাররঞ্জন,
নিমাই ভট্টাচার্যের বই কিনতে পেরেই আমি খুশি ছিলাম। ফুটপাত থেকে কিনেই পড়েছিলাম ফাল্গুনী
মুখোপাধ্যায়ের ‘চিতা বহ্নিমান’। বইটি পড়ে তখন কেমন লেগেছিল এখন আর মনে নেই। মানব-মানবীর
মানসিক জটিলতার পুরোটা বোঝার মতো বয়স কিংবা অভিজ্ঞতা কোনটাই ছিল না তখন। তাই সেই সময়ের
অনুভূতির বিস্মরণ ঘটেছিল।
এতদিন পরে এই
ফাল্গুনের প্রাক্কালে আবার নতুন করে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় পড়তে হলো। বাংলাদেশে হাতেগোনা
যে ক’টা বইয়ের দোকান এখনো টিকে আছে, দেখলাম সেখানে ‘ফাল্গুনী অমনিবাস’ নামে ফাল্গুনী
মুখোপাধ্যায়ের তিনটি বইয়ের একটি সংকলন বেশ প্রকটভাবেই শোভিত হচ্ছে। আমার এক বন্ধু সেই
বইটি আমাকে পাঠানো কর্তব্য মনে করে পাঠিয়ে দিয়েছে। হাতে পেয়েই পড়তে বসে যেতো যে পাঠক
– সেই পাঠক এখন আর নেই। আমার বন্ধুটিও তা জানে বলেই বারবার জিজ্ঞেস করে বইটি পড়েছি
কি না।
‘অনেক আগে পড়েছি’
– বিরক্তি চেপে বলি।
‘অনেক আগে পড়েছিস
সেটা তো জানি। এখন পড়ে বল – আগের মতো লেগেছে কি না।‘ কন্ঠ থেকে বিরক্তির ভাব চাপা দেয়ার
ভদ্রতা আমি দেখালেও সে দেখায় না।
না পড়েই পড়েছি
বলে ফেলতে পারতাম। শুনেছি অনেকে নাকি ফ্ল্যাপের দশ লাইন পড়েই বইয়ের রিভিউ করে ফেলে।
কিন্তু প্যাথোলজিক্যাল লায়ারও কারো কারো কাছে মিথ্যা বলে না। বইটি – মানে ফাল্গুনীর
তিনটি উপন্যাস আবার পড়তে হলো। চিতা বহ্নিমান, চরণ দিলাম রাঙায়ে, এবং স্বাক্ষর। এই বইগুলি
প্রথম পড়ার কী অনুভূতি ছিল তা এখন মনে নেই। কিন্ত এখনকার পাঠে আগের যদি কোন ভালো লাগা
থেকেও থাকে তা উধাও হয়ে গেছে। ঘটনা, বর্ণনা, পরিণতি – কোনটাই যুতসই মনে হলো না। তার
চেয়েও বেশি যেটা খচখচ করছে সেটা হলো ঘটনা তৈরির পেছনের দর্শন। যুক্তিহীন দর্শন মেনে
নিতে হলে মানসিক স্বাধীনতা বিপন্ন হয়।
চিরায়ত সাহিত্য
আমরা তাদেরকেই বলি – যারা বহুবার পাঠেও পুরনো হয়ে যায় না, ভালো লাগা একটুও কমে না।
ফাল্গুনীর এই বইগুলি সেরকম নয়। তবে অনেক দিন আগের পড়া বই আবার পড়তে গেলে – ফেলে আসা
দিনগুলির কথা মনে পড়ে যায়, সেটাই লাভ। ফাল্গুনী অমনিবাস উসকে দিয়েছে কিছু পুরনো দিনের
স্মৃতি। এখন মনে পড়লো ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের দুইটি বই আমার বুকশেলফ থেকে কে নিয়ে গিয়ে
আর ফেরত দেয়নি।
No comments:
Post a Comment