“আমার যাবার
দরকার নেই। তুমি বের হও এখন।“ আমার বাক্য শেষ হবার আগেই দাঁত কিড়মিড় করে ঝাঁঝিয়ে উঠলো
সে। “পিকনিকে যাবার জন্য রাত থেকে উঠে বসে আছো। যাচ্ছো না কেন এখনো?”
আমি মোটেও রাত
থেকে উঠে বসে থাকিনি। তবে আরেকটু পরে রেডি হলেও ক্ষতি ছিল না। গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে
বলতে পারি সাড়ে আটটায় বাস ছাড়ার কথা থাকলেও কেউই সময় মতো আসবে না। কিন্তু সময়ের ব্যাপারে
আমার সামান্য একটু খুতখুতানি আছে। কোথাও যাবার কথা থাকলে ঠিক সময়ে পৌঁছার জন্য ভেতরে
এক ধরনের ছটফটানি হয়। কিন্তু যস্মিন দেশে যদাচার। জাপানিরা নাকি সময়ের কয়েক মিনিট আগে
চলে আসে। আবার চৈনিকরা নাকি দশটায় কারো সাথে কোন জায়গায় দেখা করার কথা থাকলে – দশটায়
ঘর থেকে বের হয়। আবার আফ্রিকানরা নাকি দশটায় দেখা করার কথা থাকলে এগারোটার দিকে ঘুম
থেকে উঠে। এখানে ব্যাপারটা কী রকম তা ঠিক বলা যায় না। আন্তনগর বাস-ট্রেন এখানে ঠিক
সময়েই যাত্রা করে। কিন্তু পিকনিকের বাস? কখনোই না।
শামার দিকে
তাকালাম। সে পারলে আমাকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দরজা বন্ধ করতে পারলে বাঁচে। বাসার আর
কাউকে এখন ডাকা যাবে না। শুক্রবার সকালের ঘুম তাদের ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’। আবার দেখা
যায় দুপুরেও ঘুমাতে হয় তাদের। আমি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেই শান্তিতে ঘুমাতে পারে সবাই।
কিন্তু আমি অপেক্ষা করছি গুলশানের ফোনের জন্য।
আটটার দিকে তার বাসা থেকে বের হবার সময় আমাকে ফোন করার কথা। গতবার ভাটিয়ারির পিকনিকের
সময় গুলশান সবাইকে সাড়ে আটটায় আসার জন্য তাগাদা দিয়ে নিজে এসেছিল পৌনে দশটায়। এবার
তাই তাকেই বলেছিলাম বের হয়ে ফোন করতে। কিন্তু তার আটটা ক’টায় বাজবে কে জানে।
“ফিজি দ্বীপপুঞ্জের
মানুষ সময়ের ব্যাপারে ভীষণ উদাসীন। তাদের কথা হলো – এত তাড়াহুড়ো করে কী হবে? দু-তিন
ঘন্টা দেরিতে পৌঁছালে এমন কোন ক্ষতি নেই।“ দীর্ঘদিন মাস্টারি করলে সারাক্ষণ বকর বকর
করে তথ্য বিলি করার বদভ্যাস তৈরি হয়। আমারও হয়েছে। কিন্তু সব শিক্ষার্থীর মতো শামারও
পরীক্ষায় আসে না এরকম তথ্যের প্রতি প্রচন্ড বিতৃষ্ণা আছে। সে মেজাজ হারিয়ে আমাকে ঠেলে
বের করে দেয়ার সময়েই ফোন বেজে উঠলো। ফোনের পর্দায় আটটা একচল্লিশ। গুলশানের গলায় উচ্ছ্বাস,
“স্যার, অঁনে কন্ডে?”
“এই তো বের
হচ্ছি। তোমরা কি চলে এসেছো?”
“আমরাও বের
হচ্ছি।“
মনে হলো তাদের
আরো সময় লাগবে আসতে। হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাওয়া যাবে ওয়াসার মোড়। ভালোবাসা
গলি শুরু হয়েছে যেখানে সেখানে ফুটপাতে বাজার বসেছে। ফুটপাত বলা ঠিক হচ্ছে না। পথচারীদের
জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা নেই ভালোবাসা গলিতে। ভালোবাসায় যেরকম খানাখন্দ বাঁচিয়ে চলার
দায়িত্ব নিজের, এই গলিতেও তাই।
চমৎকার দিন।
জানুয়ারির শীত গায়ে লাগছে না একটুও। হালকা একটু কুয়াশার আভাস দেখতে দেখতেই মিলিয়ে গেল।
আউটার স্টেডিয়ামের সামনে অন্যান্য দিন কর্মজীবী মানুষের ভীড় থাকে, আজ ফাঁকা।
সার্কিট হাউজের
সামনের রাস্তা পার হতে একটুও অপেক্ষা করতে হলো না। দীর্ঘদিন অটোম্যাটিক ট্রাফিক লাইটের
শৃঙ্খলে অভ্যস্ত হয়ে যাবার ফলে এখানে রাস্তা পার হওয়াটা একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
আজ সেই সমস্যায় পড়তে হলো না দেখে বেশ হালকা লাগলো।
ভি-আই-পি টাওয়ারের
দিকে চোখ গেল। বাংলাদেশের শহরগুলির সম্প্রসারণ এখন উর্ধ্বমুখি। আমেরিকার শহরগুলির মতো
আকাশ ছুঁয়ে না ফেললেও আমরা মোটামুটি আমাদের আকাশ আড়াল করে ফেলেছি কংক্রিটের জঞ্জাল
দিয়ে। আমাদের ইকবাল এখন টাওয়ারসূত্রে ভিআইপি। আজ তার সাথে দেখা হবে কি না জানি না।
গতকাল গুলশান বলেছিল – এবার অনেকেরই অনেক কাজ পড়ে গেছে।
সবার এতসব ব্যক্তিগত
কাজের পরেও পিকনিকের মতো দলগত অকাজ করার উৎসাহ ও শক্তি যে এদের এখনো আছে সেটা দেখেই
আমি অবাক এবং উৎসাহিত হই। তারুণ্য অনেকটা চৌম্বকীয় আবেশের মতো কাজ করে। প্রাণশক্তিতে
ভরপুর এই তরুণদের সংস্পর্শে এলে আমার মতো বুড়োর মনেও তারুণ্য সঞ্চালিত হয়।
পদার্থবিজ্ঞানের
ছাত্র হিসেবে সেই স্কুলে থাকতেই শিখেছি ক্ষমতা কাকে বলে। কাজের পরিমাণকে সময়ের পরিমাণ
দিয়ে ভাগ করে ক্ষমতার হিসেব করা হয়। সে হিসেবে এরা এত কম সময়ে এত বেশি কাজ করে ফেলেছে
যে এদের ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। আজকের পিকনিকের দিনতারিখ অনেকদিন আগে ঠিক হলেও তারা কেনাকাটা
করেছে গতকাল বিকেলে। এব্যাপারে গুলশান একাই একশ। পরে শুনেছি রুনুও গিয়েছিল গুলশানের
সাথে, কিন্তু ব্যাগ বহন করা ছাড়া আর কোন কাজ করেছে বলে মনে হয় না। কারণ তার কানাডায়
বাজার করার অভিজ্ঞতা চট্টগ্রামের বাজারে কোন কাজে লাগবে বলে মনে হয় না।
আলমাস সিনেমার
সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম। আমার কৈশোর-তারুণ্যে সিনেমাদেখার দিনগুলিতে কত সিনেমা যে
দেখেছি এই হলে। একসময়ের অভিজাত এই হল এখন মৃত। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে মাথার ভেতর।
প্রায়-ফাঁকা রাস্তা শিথিল পায়ে পার হয়ে গেলাম অন্যপাড়ে। বহুতল ভবনের কাজ চলছে এদিকে।
নির্মাণসামগ্রী পড়ে আছে ফুটপাত জুড়ে। জংধরা লোহার শিক সুঁচালো বর্শার মতো মাথা উঁচিয়ে
আছে। একটু অসাবধান হলেই বিধবে যে কারো যে কোনো জায়গায়, যার দায়িত্ব কেউ নেবে না।
সিটি কর্পোরেশন
কোনো এক সময় যাত্রীছাউনি বানিয়েছিল এখানে ফুটপাত ঘেঁষে। এখন সেখানে অস্থায়ী চায়ের দোকান।
বন্ধ দোকানের ছাউনি থেকে ঝুলছে ময়লা কার্ডবোর্ডে লেখা “বেলেক কপি ১০ টাকা, দুত কপি
২০ টাকা”। কফি সংস্কৃতি খুব জনপ্রিয় হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। অবশ্য এই সংস্কৃতিরও প্রকারভেদ
আছে। মূল প্রভেদ অর্থমূল্যে। কাল সন্ধ্যায় গুলশান যে কফি খাইয়েছে তার সাথে এই “দূত
কপি”র পার্থক্য পনেরো গুণ।
পিকনিকের আয়োজনে
আমি কোন কাজে লাগতে পারি কি না, ভদ্রতার খাতিরে জানতে চেয়েছিলাম গতকাল। গুলশান ততোধিক
ভদ্রভাবে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দিয়েছিল - আমাকে তাদের কোন কাজে লাগবে
না। তবে আমি চাইলে কফি খেতে যেতে পারি। অকর্মাকে কফি খাওয়ানোটাও নেট লস জানার পরেও
গুলশান ভদ্রতার খাতিরে প্রস্তাবটা দিয়েছিল। মনে মনে নিশ্চয় আশা করেছিল – আমি ‘সময় নেই’
বলবো। কিন্তু বাংলাদেশে আমার আর যাই হোক, সময়ের অভাব নেই।
আমি ড্যাং ড্যাং
করে চলে গিয়েছিলাম কফি খেতে। চট্টগ্রাম শহরের রাস্তায় জ্যাম, ভীড় আর উপচে পড়া মানুষের
ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করে। কাউকেই চিনি না, অথচ মনে হয় কতদিনের
চেনা।
চট্টগ্রাম শহরে
এখন কফিশপের অভাব নেই। বাহারি তাদের নাম, ভারী ভারী মেন্যু, আর আকাশছোঁয়া দাম। ডলারে
কনভার্ট করলে অস্ট্রেলিয়া কিংবা কানাডার চেয়েও বেশি কিছু কিছুর দাম। গৌরী গৌরী সেন
গুলশানের সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে পারলে কেকপেস্ট্রি চা কফি সব একসাথে অর্ডার দেয়।
এখানে কফির সাথে বিস্কুট ফ্রি!
|
কফি আড্ডা |
দুর্গার মতো
দশটি হাত না থাকলেও দুই হাতে দশ হাতের কাজ সামলাতে দেখলাম গুলশানকে। একটু পরপর ফোন
আসছে তার। নিজেও করছে একে ওকে। কান আর কাঁধের মাঝখানে ফোন চেপে কথা বলতে বলতে কফিতে
চুমুক দিচ্ছে। এরই মধ্যে জিজ্ঞেস করছে আমার কুশল। দেশে আসার পর এই প্রথম দেখা তাদের
সাথে।
“স্যার, শুটকি
খাবেন?”
“কফির সাথে
শুটকি? এখানে পাওয়া যায়? তাইলে খাওয়া যায়।“ – আমি নির্লজ্জ পেটুকের মতো বলে ফেলি। রুনু
শব্দ করে হেসে ওঠে। গুলশান বিরক্তি চেপে বলে, “এখন না। কালকের কথা বলছি। মেন্যুতে কি
শুটকি রাখবো?”
জামিয়াতুল ফালাহ
মসজিদের সাইড গেটের সামনে পিকনিকের বাস দেখা যাচ্ছে। কোট পরা একজন হন্তদন্ত হয়ে বাসের
দিকে হেঁটে যাচ্ছে। পেছন থেকে জাভেদের মতো লাগছে। এরা তো দেখি আজ ঠিক সময়েই চলে এসেছে!
আমিই তো মনে হচ্ছে দেরি করে এলাম! মহাভারতের অর্জুন লক্ষ্যভেদ করার জন্য যেরকম একাগ্রমনে
মাছের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল, ঠিক সেরকম না হলেও, বেশ খানিকটা সেরকমভাবে আমিও বাসের
দিকে নজর দিয়ে এগুচ্ছি। বাসের কাছাকাছি পৌঁছে দেখলাম যাকে এতক্ষণ জাভেদ ভেবেছিলাম তাকে
আমি আগে কোনদিন দেখিনি। বাসের ভেতরে আশেপাশে যারা আছে তাদের কাউকেই আমি চিনি না। লক্ষ্য
ভুল ছিল।
এতক্ষণে কানে
এলো ওপারের ডাক - “এদিকে, এদিকে স্যার, এদিকে, টার্ন ব্যাক স্যার।“
মুন যে গলায়
“টার্ন ব্যাক” বললো – কাছের ল্যাম্পপোস্টে বসা কাক গেলো উড়ে, রাস্তায় চলমান গাড়ির গতি
গেলো কমে। সে যে শাহীন কলেজের ভূতপূর্ব প্রিফেক্ট তা তার গলার জোরেই বোঝা যায়।
রাস্তার অন্যদিকে
দাঁড়িয়ে আছে বাস, আর তার সামনে জুয়েলভাই, গুলশান, রুনু, আর মুন। আমাকে নাকি অনেকক্ষণ
থেকে ডাকাডাকি করছে তারা। একটু লজ্জা পেলাম।
“কোন্ জগতে
থাকেন স্যার? ডাকাডাকি শুনতে পান না?”
ডাক শুনতে পাই
না – আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নতুন নয়। তাই গুলশানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ
টানলাম। “আমি তো ভেবেছিলাম তুমি অনেক দেরি করে আসবে আজ। এখন তো দেখি সবার আগে চলে এসেছো।
এই নাহলে ক্যাপ্টেন?”
“গুলশান আপুকে
তো আমি নিয়ে এসেছি স্যার। ছোটাপু ক্যা ক্যা করছিল – সবাই চলে আসবে, দেরি করা যাবে না।
তাই ছোটাপুকে নিয়ে গুলশান আপুর বাসায় গেলাম। তারপর রাস্তা ফ্রি ছিল, এক টানে চলে এসেছি।“
– মুনের কথা শুনতে শুনতে চোখ গেলো তার গাড়ির দিকে। মুন পিকনিকে যাচ্ছে না, কিন্তু রুনু
তাকে যতটা পারে খাটিয়ে নিচ্ছে। এরকম করিৎকর্মা ছোটভাই থাকলে আপুদের অনেক সুবিধা।
|
মুনের বাসায় (বাম থেকে - জাভেদ, গুলশান, রুনু, হারুন, প্রদীপ, লায়লা) |
দীর্ঘ পঁচিশ
বছর পর মুনের সাথে দেখা হয়েছে গত সন্ধ্যায়। প্রাক-পিকনিক প্রস্তুতি মিটিং করার উদ্দেশ্যে
কফি শেষে হাঁটতে হাঁটতে মুনের বাসায় গিয়েছিলাম সবাই মিলে। কফিশপ থেকে কাছেই। এত্তোগুলি
বছর পর দেখা হলেও মনেই হলো না যে তার এসএসসি পরীক্ষার পর আর দেখা হয়নি কোনদিন। ধন্যবাদ
ফেসবুক। ইতোমধ্যে সে বিরাট কোম্পানির বিরাট অফিসার হয়েছে। দুই ছেলে-মেয়ে
নিয়ে রুম্পা আর মুনের সুখের সংসার দেখে খুব ভালো লাগলো। একটু পরে সুমন, জাভেদ-লায়লা,
হারুনও এসেছিল তাদের বাসায়। সবাই যার যার কর্মক্ষেত্রে সফল কর্মবীর। রুম্পা নিজেও অফিস
থেকে ফিরেছে একটু আগে। অথচ দশ মিনিটের মধ্যেই বিশাল ডাইনিং টেবিল ভর্তি করে ফেললো হরেক
রকমের খাবার দিয়ে। আমি জানি না কোন্ জাদুবলে এরা এতসব আয়োজন করে ফেলে এত কম সময়ে।
হৈচৈ গল্প আর প্রচুর খাওয়া-দাওয়া করতে করতে দেখলাম গুলশান হারুন-জাভেদ-সুমনের সাথে
তার দরকারি কথা সেরে নিচ্ছে। এরপর তারা আবার শপিং-এ গেলো র্যাফেল ড্র’র পুরষ্কার কিনতে।
নয়টা-পাঁচটা কাজ করে বাসায় আসার পর আমার আর নড়াচড়া করতেও ইচ্ছে করে না, অথচ এরা সবাই
সারাদিন অফিস করে আসার পরও উদ্যমে ভরপুর।
জুয়েলভাইয়ের
সাথে তিন বছর পর আজ প্রথম দেখা। কিন্তু মনেই হয় না এই তিন বছরে তার কোন পরিবর্তন হয়েছে।
কাঁচাপাকা চুলদাড়িগোঁফের আধুনিক কবির মতো লাগে তাকে। শাহীনের ছাত্রী বিয়ে করে নিজেই
শাহীন হয়ে গেছেন। গুলশান যথারীতি ফোন করে ডাকতে শুরু করেছে সবাইকে। মনে হচ্ছে ঘুম থেকে
ডেকে তুলছে সবাইকে।
চঞ্চল এসেই
চঞ্চল হয়ে সেলফি তুলতে শুরু করলো। ইদানীং সে গানের ভিডিও করছে খুব। বিভিন্ন জনপ্রিয়
গানের সাথে ঠোঁট মেলাচ্ছে আর ফেসবুকে আপলোড করছে। সম্ভবত সে ইতোমধ্যে অনেক জনপ্রিয়
হয়ে গেছে। কথা বলার সময় তার গলার স্বাভাবিক স্বর বদলে যায়। খুব সহজ এলেবেলে ব্যাপারকেও
যে গুরুগম্ভীর করে তুলতে পারে। জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছো চঞ্চল?”
“ঠিক আছি স্যার,
তবে একটু ব্যস্ত আছি। প্রতি সপ্তাহে পাঁচ-ছটা প্রোগ্রাম অ্যাটেন্ড করতে হয়। বন্ধুরা
ছাড়তে চায় না। অফিস আছে, বউ-বাচ্চা আছে –তার উপর মিউজিক ভিডিও বানাতে হয়, লিপ দিতে
হয়। সব ম্যানেজ করে মাঝে মাঝে দিনে দুই-তিনটা দাওয়াতেও যেতে হয়। “
“দিনে দুই তিনটা
দাওয়াত? কীভাবে?”
“স্কিলের ব্যাপার
স্যার। স্কিল লাগে। আমি ম্যানেজ করে ফেলি। এক কমিউনিটি সেন্টারে একটা মারার পর আরেক
জায়গায় গিয়ে আরেকটা মেরে দিই।“
“মেরে দাও মানে?”
“মেরে দেই মানে,
খেয়ে ফেলি আর কী।“ কথা বলতে বলতেই অনবরত সেল্ফি তুলছে চঞ্চল। তার সেল্ফি স্টিকের
গতি সর্বত্র – বাসের সামনে, পেছনে, সাইডে, মুনের গাড়িতে হেলান দিয়ে। সব ছবিতে একই রকম
না লাগার জন্য সে একাধিক শার্ট-টি শার্ট সাথে রাখে। দেখলাম তার গাঢ় কমলা রঙের টিশার্টে
ঝুলছে দুইটি রোদচশমা – কখন কোন্টা পরবে সেটা সে কীভাবে ঠিক করে জানি না।
ঘন্টাখানেকের
মধ্যে নাসির, আখতার, স্বপ্না, কাইয়ুম, মোজাম্মেল, সুমন, সাঁজলি সবাই এসে পড়লো। বাসে
উঠার আগেই সবার সাথে হৈচৈ করে আনন্দ প্রকাশ করা হলো। ইভা আসার পর আরেক প্রস্থ হৈ চৈ
হলো। শাহীন কলেজে থাকতে ইভা যেরকম জনপ্রিয় ছিল, এত বছর পরেও সমান জনপ্রিয়। বায়েজিদ
বোস্তামি থেকে উঠলো মনির। বালুচরা থেকে উঠলো রাসেল।
অনেকদিন পর
পুরনো বন্ধুর দেখা হলে যা হয়, অনেক স্মৃতিচারণ, হাসিঠাট্টা খুনসুটি। মনে হলো অনেক বছর
অতীতে– শাহীনের সেই দিনগুলিতে ফিরে গেলাম।
শহর থেকে এয়ারফোর্সের বাসে আসা-যাওয়ার সময়ের কত স্মৃতি, কলেজের করিডোর, টিচার্স রুম
– কত শত কথা হতো আমাদের। গুলশানদের ধন্যবাদ দিতেই হয়। তারা না ডাকলে হয়তো দেখাই হতো
না কারো সাথে।
হাটহাজারি রোড
– অত্যন্ত পরিচিত স্মৃতিজাগানিয়া রোড। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরোটাই কেটেছে এই রাস্তায়
আসা-যাওয়ায়। এখন বদলে গেছে পথের দু’ধার। মানুষ, বিল্ডিং, ব্যবসা, গাড়ি, জ্যাম, আমাদের
বয়স - সবই বেড়েছে। কিন্তু রাস্তার প্রস্থ বাড়েনি। অনেক বছর পর পরিচিত পথ ধরে যাওয়া
মানেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসা।
শহর থেকে খুব
বেশি দূরে নয় আমাদের গন্তব্য - উদালিয়া চা বাগান। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম।
নাজিরহাট-ফটিকছড়ি মেইন রোড থেকে পুবদিকে ছোট্ট একটা রাস্তা ধরে যেতে হয়। উন্নয়নের জোয়ার
এখানেও পৌঁছে গেছে। ছোট্ট রাস্তার দুপাশেও গড়ে উঠেছে দোকানের পর দোকান। এই অঞ্চলটা
চট্টগ্রামের বিদেশপাড়া নামে পরিচিত আমাদের কাছে। বাংলাদেশের মানুষ যখন থেকে মধ্যপ্রাচ্যে
যাওয়া শুরু করেছিল, তখন থেকেই মধ্যপ্রাচ্যমুখী হয়েছিল এ অঞ্চলের মানুষ। ফলে অনেক পরিবারের
অর্থনৈতিক অবস্থা ফিরেছে। তার নিদর্শন এদিকে সর্বত্র। তবে এদিকে যে এত সুন্দর চা বাগান
আছে তা কেন যেন শুনিওনি এতদিন।
উদালিয়া চা-বাগান
শুরু হয়েছে যেখান থেকে সেখানে স্কুলের মাঠে বাস পার্ক করে নামলাম সবাই। আরো একটি পিকনিক-পার্টি
ইতোমধ্যেই এসে জড়ো হয়েছে মাঠের এক কোণায়। মাঠের বিপরীত কোণায় চা-বাগানের ম্যানেজারের
বাংলো। বাংলোর দারোয়ান গেট খুলে দিলেন আমাদের দেখে। এলোমেলো ইট বিছানো রাস্তা পাহাড়ের
দিকে উঠে গেছে। খুব গোছানো বলা যাবে না। তবে বাংলোর আয়তন এবং সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলকভাবে
এখনো রাজকীয়। একসময় চা-বাগানের ম্যানেজাররা চা-সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন।
সম্ভবত এখনো আছেন।
চঞ্চল অস্থিরভাবে
সেলফি তুলে চলেছে, পথের সাথে, গাছের সাথে, ফুলের সাথে এবং অবশ্যই মানুষের সাথে। ফ্রেশ
হবার জন্য সবাই ম্যানেজারের বাংলোয় ঢুকে গেলো। বাংলোর প্রশস্ত বারান্দার সামনে সুন্দর
লন। অনেকরকম ফুলের গাছ সেখানে। বোঝা যাচ্ছে ম্যানেজারের মালির সংখ্যাও অনেক।
“স্যার, আমি
কিন্তু আমার কথা রেখেছি।“ – পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রাসেল বললো। এই গরমেও সে দাবার
বোর্ডের মতো বড় বড় চেকের স্যুট পরে আছে।
“অবশ্যই রাসেল।
নিশ্চয়ই। তুমি তো এক কথার মানুষ, কথা বললে সেই কথা রাখার ব্যাপারে তুমি এক নম্বর। এবার
বলো কোন্ কথা।“
“সেই যে স্যার,
ভাটিয়ারি থেকে আসার সময় বলেছিলাম – বিয়ে করবো। বিয়ে করেছি স্যার।“ – রাসেলের আকর্ণবিস্তৃত
হাসি দেখে মনে হলো বিয়ে করেছে বেশিদিন হয়নি,
এখনো ঘোরের মধ্যে আছে।
“এবার স্যার
আপনি একটা বিয়ে করে ফেলেন।“ রাসেল একেবারে কানের কাছে নিশ্বাস ফেলে বললো। চঞ্চল ছিল
কাছে। সে সেল্ফি স্টিক আকাশে তুলে নিজের মুখ স্ক্রিনে ফিট করতে করতে বললো – “রাসেল তার বিয়ের দাওয়াত এখনো খাওয়ানি স্যার।“
একটা দাওয়াত
মিস হয়ে যাওয়াতে চঞ্চলের কী কষ্ট হচ্ছে তা বুঝতে পারছি।
ম্যানেজারের
বাংলোর আশেপাশে অনেক জায়গা। বিশাল এক বরই গাছে অনেক বরই ধরেছে। পাহাড় থেকে একটু নিচে
বেশ বড় পুকুর। তার অন্যপাশে আগাছাভর্তি জংলা। বেশি কিছু মুরগীর ছানা ঘুরে বেড়াচ্ছে
তাদের মায়ের পিছু পিছু।
গুলশান একজন
হাফপ্যান্ট-টিশার্ট পরা যুবকের সাথে কথা বলছে। কাছে যেতেই পরিচয় করিয়ে দিলো - এই বাগানের
ডেপুটি ম্যানেজার, শাহীন কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। বললো, শুক্রবারেও তাদের পালাক্রমে
ডিউটি করতে হয়।
|
আমলকি গাছে চার শাখামৃগ |
বাংলোর একপাশের
কাঠের গেট খুলে গেলাম পুকুরের দিকে। এখানে সম্ভবত অনেক মাছ আছে। বড়শি পেতে মাছ ধরার
ব্যবস্থাও আছে দেখলাম। পুকুরপাড়ে বরই গাছ, জলপাই গাছ, আর আমলকি গাছ – ঝুঁকে আছে পানির
দিকে। কিছু আমলকি এখনো অবশিষ্ট আছে। বেশ কয়েকটি বড় বড় কামরাঙা গাছ পুকুরপাড়ের লাগোয়া
বাগানে। থোকা থোকা কামরাঙা ঝুলে আছে হাতের নাগালের বাইরে। সুমন লাফ-ঝাপ দিয়ে ডাল ধরে
টেনে ঝাঁকিয়ে অনেকগুলি পাকা কামরাঙা পেড়ে ফেললো। ফলগুলি এত নরম – গাছ থেকে মাটিতে পড়েই
কেমন যেন চ্যাপ্টা হয়ে যায়। এদেরকে ‘কামরাঙা’ নাম কেন দেয়া হয়েছে জানি না। কামনার কি
রঙ হয়? পানিতে ঝুঁকে পড়া আমলকি গাছে তরতর করে উঠে গেলো সুমন। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময়
তার যে ওজন ছিল – এখনো সেই ওজনই আছে। তার ভরে গাছের কিছুই হলো না। সে শাখামৃগের মতো
দাপাদাপি করতে করতে আমলকি পাড়তে লাগলো। গাছে ওঠার লোভ সামাল দেয়া মুশকিল। শৈশব কৈশোরের
দিনগুলি যেন ফিরে ফিরে আসছে। গাছে উঠে গেলাম। গাছ ভেঙে পড়ার ভয়ে সুমন কিছুটা আঁৎকে
উঠলেও তেমন কিছু বললো না। কিন্তু গুলশানও যখন গাছে উঠে গেলো – তখন আমারও ভয় লাগছিলো
যদি গাছ গোড়াসহ থুপড়ে পড়ে পানিতে! পানি কি খুব ঠান্ডা!
“অ্যাই রুনু,
খবরদার তুই উঠিস না গাছে।“ – সুমনের নিষেধ রুনুর কানে গেল বলে মনে হলো না। রুনুও উঠে
দাঁড়ালো আমলকি গাছের উপর। আর যায় কোথায়। পাড়ে দাঁড়ানো পাঁচ ছ’টা ক্যামেরা ছবি তুলতে
শুরু করলো আমলকি বৃক্ষে নৃত্যরত শাখামৃগদের।
চঞ্চল তো আছেই,
সাথে সাঁজলি। মাওয়াহেবের নাম যে সাঁজলি সেটা আমি জানতাম না। সাঁজলি শুনে ভেবেছিলাম
মেয়েদের নাম। সাঁজলির ছবি তোলার হাত ভালো। সে কয়েকটা ছবি দেখালো – বেশ নতুন নতুন অ্যাঙ্গেলে
তোলা।
পুকুরপাড় দিয়ে
হেঁটে এসে বাংলোর গেট পার হয়ে রাস্তায় এলাম। বাগানের বাইরে ইট বিছানো ছোট্ট রাস্তা
ধরে কিছুদূর হেঁটে এসে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান। এধরনের দোকানগুলিকে বলা হয় – টং-এর
দোকান। চায়ের তৃষ্ণা জাগলো সবার। গুলশান টং-এর
দোকানের চা খাওয়াবে বলেছিল – সেটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম, কিন্তু সে ভোলেনি। সকালে গাড়িতেই
হেভি ব্রেকফাস্ট খেয়েছি সবাই। চা খাওয়া হয়নি তখন।
|
টং-এর চা |
দোকানের ভেতরে
বাইরে চেয়ার পেতে বসলাম সবাই। গরম পিঁয়াজু, কলা, চা – আর পরিবেশ সব মিলিয়ে খুব ভালো
লাগার একটা অনুভূতি। এই অনুভূতি শহরের চাকচিক্যময় আলোঝলসিত অভিজাত রেস্তোরাতেও পাই
না অনেক সময়। স্বাদ নয়, সামগ্রী নয় – এই অনুভূতি জন্মে নস্টালজিয়া থেকে। যেসব দিন আমরা
ফেলে আসি, সেইসব দিনগুলির কাছাকাছি কোনকিছু পেলে কী যে ভালো লাগে।
হাঁটতে হাঁটতে
চা-বাগানে ঢুকলাম এবার। নাসির এই চা-বাগান সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। টিলা ও সমতল মিলিয়ে
প্রায় তিন হাজার একর জায়গাজুড়ে এই বাগান। রাস্তা ধরে অনেকক্ষণ হাঁটলাম। কেমন যেন নির্জন
এলাকা। রাস্তায় ধুলো আছে, কিছুটা রুক্ষতাও। কিন্তু দৃষ্টি রাস্তা পেরিয়ে বাগানের দিকে
নিলেই ঘন সবুজে চোখ জুড়িয়ে যায়। সবাই মিলে কিছু ছবি তোলা হলো। এখানে আরো কিছুক্ষণ সময়
কাটাতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু ডাক পড়লো।
|
(বাম থেকে) আখতার, প্রদীপ, চঞ্চল, রুনু, নাসির |
দুপুরের খাবার
নিয়ে এসেছে জাভেদ-লায়লা, আর হারুন। তাদের ক্ষমতা দেখে আমি মুগ্ধ। গুলশানের কাছে শুনলাম
কাল গভীর রাতে খাবারের মেন্যু ঠিক করে তা আজ সকালের মধ্যে রান্না করে দুপুরে সোজা গাড়ি
চালিয়ে নিয়ে এসেছে তারা যেন আমরা সদ্য তৈরি গরম খাবার খেতে পারি। চিকেন, মাটন, শুটকি
আর সীমের বিচি – এ স্বাদের নেই কোন তুলনা। রান্না কে করেছে জানি না – হুমায়ূন আহমেদের
ভাষায় বলা যায় – তাঁর হাত সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া উচিত। সবাই মিলে একসাথে বসে খাওয়ার
মধ্যেও খাদ্যের স্বাদ এবং আনন্দ বেড়ে যায় বহুগুণ। যারা এত কম সময়ে এরকম আয়োজন করতে
পারে – বড় বড় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট তাদের জন্য কিছুই না।
|
(বাম থেকে) স্বপ্না, ইভা, প্রদীপ, রুনু, গুলশান, সাজলি |
আনন্দের ঘড়ি
জোরে চলে। মিউজিক্যাল চেয়ারের নিজস্ব সংস্করণ – বালিশ খেলা হলো। অবশ্য সুনির্দিষ্টভাবে
বলতে গেলে বলা চলে জ্যাকেট খেলা হলো। একজনের একটা জ্যাকেট দলা পাকিয়ে সেটাকেই মিউজিকের
সাথে বালিশের মতো ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয়া। কোন কোন ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় এই খেলাকে শুধুমাত্র
মেয়েদের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা হয়। কিন্তু আমরা জেন্ডার ইক্যুয়েলিটি বিশ্বাস করি। খেলায়
জিতলো আখতার। স্বপ্না, মোজাম্মেল, ও কাইয়ুমের ছেলে-মেয়েদের সাথে শিশুতোষ এই খেলা খেলতে
গিয়ে সবাই যেভাবে শিশু হয়ে উঠেছিল – দেখে ভীষণ ভালো লাগলো। আমাদের ভেতরের শিশুটা যদি
গম্ভীরভাবে বড় হয়ে যায়, জীবন থেকে আমাদের আনন্দ চলে যায়। এরা সবাই বয়সভুলে এখনো যেভাবে
একজন আরেকজনের পেছনে লাগে নির্মল হাসিঠাট্টায়, একে অন্যের পাশে এসে দাঁড়ায় যখন দরকার
পড়ে – তা অমূল্য।
সন্ধ্যা নামতেই
বাস ছাড়লো। র্যাফেল ড্র’র ব্যবস্থাও করেছে তারা। সাধারণত র্যাফেল ড্রর টিকেট বিক্রি
করার পর লটারি হয়। এরা কোন টিকেট বিক্রি করেনি। বিনামূল্যেই টিকেট দিলো প্রত্যেককে
একটি করে। দুটো এক্সট্রা টিকেট ছিল। জাভেদ সে দুটোর একটি আমাকে দিয়ে বললো – ওটা ম্যাডামের
– অর্থাৎ ইভার। অন্যটি ইভাকে দিয়ে বললো ওটা আমার। তার মানে আমার টিকেটে যদি পুরষ্কার
ওঠে, ওটা ইভা পাবে। আর ইভার যদি ওঠে ওটা আমি পাবো। গতকাল অনেক রাতে বের হয়ে গুলশানরা
পুরষ্কারগুলি কিনেছে, রাতজেগে র্যাপিং করেছে। শুধুমাত্র আনন্দের খাতিরেই এরা এত কাজ
হাত পেতে নেয়।
|
সাজলির নির্দেশে লাইন |
ইউনিভার্সিটির
এক নম্বর গেটের কাছে নতুন একটি কমিউনিটি সেন্টার
হয়েছে। বাস থামানো হলো এখানে। আজ কোন অনুষ্ঠানে নেই। কমিউনিটি সেন্টার বন্ধ। তার সিঁড়িতে
দাঁড়িয়ে ছবি তোলার ইচ্ছে হলো সাঁজলির। সাঁজলি ছবি তোলার সময় অনেক খুঁতখুঁত করে – একটু
ডানে কাত হও, মাথা সোজা করো, সামনে আসো, পেছনে যাও! অবশ্য এসব না করলে ভালো ছবি ওঠে
না। সাঁজলির ছবি ভালো হবার এটাও একটি কারণ। এবার সাঁজলি সবাইকে কমিউনিটি সেন্টারের
সিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে দিলো। সবাই একসাথে দাঁড়ালে কোন সমস্যা হতো না। কিন্তু তার কথা হলো
এক সিঁড়িতে শুধু একজন দাঁড়াতে পারবে। শাহীন কলেজের অ্যাসেম্বলির মতো একজনের পেছনে একজন
করে দাঁড়াতে হবে। ইভা নিচের সিঁড়িতে ক্যামেরার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে প্রায় টেনে
উপরে তুলে ফেললাম। সিঁড়ির সবচেয়ে উপরের ধাপে উঠতে উঠতে হাঁটু ব্যথা হয়ে গেল। এবার সাঁজলির
ক্যামেরা এতদূর দেখতে পেলেই হয়। অবশ্য আশেপাশে ইভা থাকলে ক্যামেরা তাকে মিস করবে না
এ ব্যাপারে নিশ্চিত।
এখানে একটি
টং-দোকান আছে – যেখানে ‘রং ছা’ ‘ধুত ছা’ আর ‘ধুত কপি’ পাওয়া যায়। সবার জন্যই চা-কফির
ব্যবস্থা হয়ে গেলো। রঙ-চা পাওয়া যায় কি না জিজ্ঞেস করতেই দ্রুত রঙ চা তৈরি হয়ে গেল,
সাথে লেবু। কে কী করছে তা আলাদাভাবে দেখাও যাচ্ছে না, অথচ সবাই কী এক আশ্চর্য প্রাণশক্তিতে
ভরপুর। এই প্রাণশক্তির উৎসের নাম বন্ধুত্ব। এদের পারস্পরিক বন্ধুত্ব ঈর্ষণীয়। কলেজ
ছাড়ার আটাশ বছর পরও কলেজের বন্ধুদের এক হয়ে থাকা সহজ কথা নয়।
ওরা তো বন্ধু
সবাই। কিন্তু আমি? কিছুদিন তাদের ক্লাস নিয়েছিলাম শুধু – এর বাইরে আর কিছুই করিনি তাদের
জন্য। আটাশ বছরের মধ্যে চব্বিশ বছর আমি দেশের বাইরে। ঠিকমতো যোগাযোগও রাখা হয় না কারো
সাথে। তারপরও তারা কীভাবে যেন আমাকে মনে রেখেছে। শাহীন কলেজে আমার এক জ্যেষ্ঠ সহকর্মী
বলতেন, কষ্ট না দিলে কেউ কাউকে মনে রাখে না। এদেরকে আমি কত কষ্ট দিয়েছিলাম কে জানে।