Saturday, 11 March 2023

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন: উড়ন্ত গবেষণাগার

 




মহাবিশ্বের রহস্য ভেদ করার জন্য মানুষ মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানো শুরু করেছে আজ থেকে প্রায় ৬৫ বছর আগে। ১৯৫৭ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন  সফলভাবে মহাকাশে প্রথম স্যাটেলাইট স্পুটনিক-১ পাঠাতে সক্ষম হয়। তারপর মহাবিশ্বের গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ হতে থাকে একের পর এক। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মহাকাশ  সংস্থা নাসা। এক নতুন যুগের সূচনা হয় মহাকাশে। পৃথিবী থেকে উৎক্ষিপ্ত হতে থাকে আধুনিক থেকে আধুনিকতর স্যাটেলাইট। বর্তমানে পৃথিবীর বাইরে বিভিন্ন কক্ষপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য স্যাটেলাইট। এই স্যাটেলাইটগুলিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায় – বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট ও ব্যবহারিক স্যাটেলাইট। বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইটগুলি মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন জ্ঞানের সন্ধান দিচ্ছে আর ব্যবহারিক স্যাটেলাইটগুলি ক্রমশ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। পৃথিবী থেকে মানুষ এ পর্যন্ত যতগুলি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় স্যাটেলাইট হলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন – যাকে বলা যায় মহাকাশের উড়ন্ত গবেষণাগার যা গত চব্বিশ বছর ধরে পৃথিবী থেকে চারশ কিলোমিটার দূরে থেকে দেড় ঘন্টায় একবার করে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে আসছে ঘন্টায় প্রায় আটাশ হাজার কিলোমিটার বেগে। রাতের বেলা পৃথিবীর আকাশে এই স্টেশন উজ্জ্বলভাবে দেখা যায়। খালি চোখেই দেখা যায়। এই স্টেশন একদিনে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তা পৃথিবী থেকে চাঁদে গিয়ে আবার ফিরে আসার দূরত্বের সমান।

সাধারণ স্যাটেলাইটের সাথে মহাকাশ স্টেশনের পার্থক্য আছে। সাধারণ স্যাটেলাইটগুলি এমনভাবে তৈরি করা হয় যেন নির্দিষ্ট কক্ষপথে থেকে মহাকাশে নির্দিষ্ট গতিতে এবং গতিপথে ঘুরতে ঘুরতে পূর্বনির্ধারিত কাজগুলি সম্পন্ন করতে পারে। তাদের মূল নিয়ন্ত্রণ থাকে পৃথিবীতে অবস্থিত নিয়ন্ত্রণকক্ষে। এই স্যাটেলাইটগুলিতে কোন মানুষ থাকে না। কিন্তু মহাকাশ স্টেশনের মূল উদ্দেশ্যই হলো সেখানে মানুষের যাতায়াত থাকবে। এই স্টেশনগুলিকে পৃথিবী থেকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তেমনি স্টেশনে থেকে নভোচারীরাও অনেক কিছুর নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন সরাসরি। মহাকাশ স্টেশনগুলি সীমিত পরিসরে ভাসমান বিমানবন্দরের মতো কাজ করে যে বন্দরে পৃথিবী থেকে পাঠানো নভোযান ভিড়তে পারে।

মহাকাশ স্টেশন তৈরিতে প্রথম সাফল্য দেখিয়েছে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই ১৯৭১ সালে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘স্যালিউট’ প্রকল্পের আওতায় ১৯৭১ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে ছয়টি মহাকাশ স্টেশন মহাকাশে পাঠায়। সোভিয়েত স্যালিউট-১ ছিলো পৃথিবীর প্রথম মহাকাশ স্টেশন যে স্যাটেলাইটে মানুষ পাঠানো হয় মহাকাশে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ছয়টি মহাকাশ স্টেশনের মধ্যে তিনটি ছিল বেসামরিক এবং বাকি তিনটি ছিল সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য। সামরিক মহাকাশ স্টেশনগুলিকে বলা হতো ‘আলমাজ’ স্টেশন। সোভিয়েত ইউনিয়নের রকেট ‘সয়ুজ’ তাদের মহাকাশ স্টেশনগুলিকে কক্ষপথে পাঠায়।

এদিকে আমেরিকানরাও তাদের প্রথম মহাকাশ স্টেশন ‘স্কাইল্যাব’ তৈরি করে ফেলে। ১৯৭৩ সালে মহাকাশে পাঠানো হয় স্কাইল্যাব। স্কাইল্যাব-২, ৩, এবং ৪ এর মাধ্যমে তিন জন করে মোট নয়জন নভোচারী পর্যায়ক্রমে এই মহাকাশ স্টেশনে অবস্থান এবং গবেষণা করেছেন। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত কর্মক্ষম ছিল স্কাইল্যাব।

স্কাইল্যাবের কার্যকারিতা শেষ হয়ে যাবার পর মহাকাশ স্টেশনের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। ১৯৮৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে পাঠায় আরো আধুনিক মহাকাশ স্টেশন ‘মির’। পৃথিবীর কক্ষপথের একটু নিচে (লো আর্থ অরবিট) কক্ষপথ নির্ধারিত হয় মিরের। পরবর্তী দশ বছর ধরে ধাপে ধাপে অনেকগুলি কারিগরি মডিউল যোগ হয় মির মহাকাশ স্টেশনে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত মহাকাশে থেকে মহাকাশ গবেষণায় দোর্দন্ড প্রতাপে কাজ করেছে মির।

আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ স্টেশনের চেয়েও বড় এবং বেশি কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন মহাকাশ স্টেশন তৈরি করার এক মহাপ্রকল্প গ্রহণ করে। ১৯৮৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এই প্রকল্প ‘ফ্রিডম’-এর ঘোষণা দিয়ে এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিশ্বের মানুষের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে আমেরিকার বৈজ্ঞানিক দক্ষতা যে অনেক বেশি তা প্রমাণ করার সংকল্প ব্যক্ত করেন। কিন্তু পরে এই প্রকল্পের খরচ এত বেশি বেড়ে যায় যে আমেরিকার পক্ষে আর তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। খরচ মেটানোর জন্য আমেরিকা ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির মাধ্যমে ইওরোপ এবং জাপানের স্পেস প্রকল্পকে আমেরিকার সাথে যোগ দিয়ে একযোগে ফ্রিডম প্রকল্পে কাজ করার আহ্বান জানায়।

স্যাটেলাইট যুগের প্রথম কয়েক দশকজুড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চললেও আশির দশক থেকে মহাকাশ গবেষণায় আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা প্রাধান্য পেতে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাকাশে একটি সমন্বিত আন্তর্জাতিক  স্টেশন স্থাপন করার উপযোগিতার ব্যাপারে উন্নত দেশের রাষ্ট্রনেতাদের বোঝাতে সক্ষম হন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে আমেরিকা রাশিয়ার সাথেও মহাকাশ স্টেশন প্রকল্পে সহযোগিতার আহ্বান করে। ফলে ১৯৯৩ সালে আমেরিকার ভাইস-প্রেসিডেন্ট আল-গোর এবং রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর চেরনোমিরডিন এ ব্যাপারে এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন তৈরির কাজ শুরু হয়। আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান, কানাডা, এবং ইওরোপের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার ফসল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন।

মহাকাশ স্টেশন তৈরিতে সময় লেগেছে বেশ কয়েক বছর। স্টেশন তৈরি করা হয়েছে ধাপে ধাপে। বিভিন্ন কাঠামো নিয়ে যাওয়া হয়েছে একের পর এক, এবং পরে জোড়া দেয়া হয়েছে কক্ষপথে স্থাপনের পর। ভারী কাঠামো নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে নাসার স্পেস শাটল। কিছু কিছু অংশ রকেটের মাধ্যমেও পাঠানো হয়েছে। সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হয়েছে বৈদ্যুতিক জ্বালানি সংগ্রহের জন্য। ১৯৯৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে সমন্বিত হয়েছে এর অনেকগুলি অংশ। নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকল্পের প্রয়োজনে সংযুক্ত হয়েছে নতুন নতুন যন্ত্রাংশ এবং পরিকাঠামো।

১৯৯৮ সালের ২০ নভেম্বর রাশিয়ার ‘প্রোটন’ রকেটের মাধ্যমে প্রথম মডিউল ‘রাশিয়া জারিয়া’ কক্ষপথে পাঠানো হয়। এর দু’সপ্তাহ পর স্পেস শাটল ফ্লাইটের মাধ্যমে পাঠানো হয় নাসার ইউনিটি/নোড-১ মডিউল। নভোচারীরা স্পেসওয়াক করে এই মডিউলের সাথে অন্য মডিউল জুড়ে দেন। এভাবে ধাপে ধাপে অনেকগুলি মডিউল যোগ করা হয় স্টেশনের সাথে। প্রথম দুই মডিউলের পর পাঠানো হয় কাঠামোগুলিকে একটির সাথে অন্যটি শক্তভাবে আটকে রাখার জন্য ধাতব কাঠামো এবং সোলার প্যানেল। ২০১৭ সালে যোগ করা হয় ডকিং অ্যাডাপ্টার যার মাধ্যমে যে কোনো নতুন মহাকাশযান স্টেশনে ভিড়তে পারে। ২০০০ সালে পাঠানো হয় রাশিয়ান জেভেজদা। ২০০১ সালে পাঠানো হয় নাসার ডেসটিনি ল্যাবরেটরি মডিউল। একই বছর কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সির উদ্যোগে পাঠানো হয় রোবোটিক হাত ‘কানাডার্ম-২’। স্পেসওয়াক এবং রিমোট-কন্ট্রোল মেরামতের সময় এই হাত ব্যবহার করা হয়। স্পেস স্টেশনে কার্গো মহাকাশযান ভিড়লে সেগুলি নিয়ন্ত্রণ করার জন্যও এই যান্ত্রিক হাত ব্যবহার করা হয়। ২০০৭ সালে নাসা পাঠায় হারমোনি/নোড-২। ২০০৮ সালে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি পাঠায় কলম্বাস অর্বিটাল ফ্যাসিলিটি, কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি পাঠায় ডেক্সটার রোবোটিক হ্যান্ড। ২০০৮-২০০৯ সালে জাপান পাঠায় এক্সপেরিমেন্ট মডিউল – কিবো। ২০১০ সালে নাসা পাঠায় ট্রাঙ্কুইলিটি/নোড-৩। ২০১১ সালে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি পাঠায় লিওনার্ডো পার্মানেন্ট মাল্টিপারপাস মডিউল। ২০১৬ সালে স্থাপিত হয় বিগেলো এক্সপ্যান্ডেবল এক্টিভিটি মডিউল। ২০২০ সালে স্থাপিত হয় ন্যানোরক বিশপ এয়ারলক। ২০২১ সালে স্থাপিত হয় মাল্টিপারপাস ল্যাবোরেটরি মডিউল – নৌকা। ২০২১ সালে রাশিয়ান ডকিং মডিউল – প্রিশাল।

মহাকাশ স্টেশনের ক্ষেত্রফল একটি ফুটবলের মাঠের সমান। শুধুমাত্র স্টেশনটির ভর প্রায় ৪২০ টন। স্টেশনে নভোচারীদের জন্য থাকার ঘর, বাথরুম, ব্যায়ামাগারসহ সব আধুনিক ব্যবস্থাই আছে। স্টেশনের ভেতরে সাতজন নভোচারীর থাকা এবং কাজ করার ব্যবস্থা আছে। তবে মাঝে মাঝে এই সংখ্যার তারতম্য ঘটে। ২০০৯ সালে ১৩ জন নভোচারী ছিলেন। নভোচারীদের ঘুমানোর জন্য ছোট্ট বিছানা আছে। ছোট্ট ঘরের মধ্যে এই  বিছানায় ভাসমান অবস্থায়ও ঘুমাতে পারেন, অথবা দেয়ালের সাথে বেঁধে রেখে স্থিরভাবেও ঘুমাতে পারেন। 

পৃথিবী থেকে নভোচারীরা স্টেশনে যান স্পেস এক্স-এর ক্রু ড্রাগন ক্যাপসুলে করে। রাশিয়ান নভোচারীরা ব্যবহার করেন রাশিয়ান সয়ুজ ক্যাপসুল। ২০১১ পর্যন্ত আমেরিকান নভোচারীরা ব্যবহার করতো নাসার স্পেস শাটল। কিন্তু স্পেস শাটল বন্ধ হয়ে যাবার পর আমেরিকানরাও ব্যবহার করতো রাশিয়ান সয়ুজ ক্যাপসুল। ২০২০ সাল থেকে স্পেস-এক্স এর ক্রু ড্রাগন ক্যাপসুল চালু হয়েছে।

২০০০ সালের ২ নভেম্বর থেকে এই স্টেশনে সবসময়েই কোন না কোন মহাকাশচারী এই স্টেশনে আছেন। মহাকাশে পাঠানোর পর থেকে এ পর্যন্ত আড়াইশোর বেশি মানুষ মহাকাশ স্টেশনে থেকে এসেছেন। পৃথিবীর বিশটি দেশের ২৫৮ জন (মে ২০২২ পর্যন্ত) নভোচারী এই স্টেশনে থেকেছেন। আমেরিকা থেকে সবচেয়ে বেশি ১৫৮ জন, রাশিয়া থেকে ৫৪ জন। নাসার নভোচারী মার্ক হেই একটানা ৩৫৫ দিন স্টেশনে ছিলেন ২০২১-২২ সালে। আমেরিকান নভোচারী ক্রিস্টিনা কোচ একটানা ৩২৮ দিন স্টেশনে ছিলেন ২০১৯-২০ সালে। পেগি হিটসন মোট ৬৬৫ দিন স্টেশনে ছিলেন। ২০০৯ সালের এনডোভার মিশনে ১৩ জন নভোচারী স্টেশনে ছিলেন। পরবর্তীতে আরো কিছু মিশনেও এরকম হয়েছিল।

কোন্‌ দেশের কতজন বিজ্ঞানী কতক্ষণ এই স্টেশন ব্যবহার করতে পারবেন তা নির্ধারিত হয় সেই দেশের মহাকাশ সংস্থা কী পরিমাণ অর্থ কিংবা প্রকল্প সহায়তা করেছে তার উপর। নাসা প্রতি বছর প্রায় তিনশ কোটি ডলার খরচ করছে এই প্রকল্পের পেছনে। রাশিয়া, কানাডা, জাপান এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাকি খরচ সামলায়।

নভোচারীরা সাধারণত একবারের মিশনে স্টেশনে গেলে ছয় মাস থাকেন এবং কাজ করেন। এই ছয় মাস ধরে তাঁরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার পাশাপাশি স্টেশন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যা যা করতে হয় সব করেন। কাজের বাইরে নিজেদের ফিট রাখার জন্য দিনে কমপক্ষে দুঘন্টা ব্যায়াম এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত কাজ করেন।

মাঝে মাঝে তাঁদের স্টেশন থেকে বাইরে গিয়ে মহাশূন্যে ভেসে ভেসেও তাঁদের কিছু কারিগরী ত্রুটি সারাতে হয় (স্পেসওয়াক)। যখন স্টেশনের বাইরের দিকের কোন যান্ত্রিক রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতের দরকার হয় তখন তাদের স্পেসওয়াক করতে হয়। কয়েকবার অ্যামোনিয়া সিস্টেম কাজ করছিল না যখন তখন সারাতে হয়েছে বাইরে গিয়ে। আমেরিকান নভোচারী জিম ভস এবং সুজান হেল্‌মস স্টেশনের একটি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার জন্য আট ঘন্টা ছাপ্পান্ন মিনিট স্টেশনের বাইরে শূন্যে ভেসে কাজ করেছেন। স্টেশনের অ্যান্টেনা মেরামত করার জন্য রাশিয়ান নভোচারী আলেক্সান্ডার মিসুরকিন এবং আন্তন স্কাপ্লেরভ আট ঘন্টা তেরো মিনিট স্পেসওয়াক করেছেন – শূন্যে ভেসেছেন।

স্পেস স্টেশনের বাইরে গিয়ে মহাশূন্যে হাঁটা অনেক বিপজ্জনক। এই বিপদ এড়াতে নাসা এখন মানুষের মতো রোবট রোবোনট তৈরি করেছে। মানুষের বদলে এই রোবটগুলিকে এখন স্পেস স্টেশন থেকে নিয়ন্ত্রন করে কাজ করানো হয়। কিছু রোবটিক হাতও তৈরি করা হয়েছে (প্রায় ৫৭ ফুট লম্বা) যাদেরকে স্টেশনের বাইরে পাঠিয়ে কাজ করিয়ে নেয়া হয়। ইওরোপিয়ান রোবোটিক আর্ম তৈরি করা হচ্ছে এখন।

মহাকাশ স্টেশনে নিয়মিত যাতাযাত করেছে আমেরিকান স্পেস শাটল এবং রাশিয়ান সয়ুজ। এগুলি ছাড়াও আরো অনেক মহাকাশযান এই স্টেশনে ভিড়েছে বিভিন্ন সময়ে। মানুষহীন রাশিয়ান প্রগ্রেস নভোযানগুলি নিয়মিত আসাযাওয়া করে। ইওরোপের স্বয়ংক্রিয় নভোযানগুলিও নিয়মিত যাতাযাত করছে। ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কমার্শিয়ান অরবিটাল ট্রান্সপোর্টেশান সার্ভিস প্রোগ্রামের আওতায় কমার্শিয়াল কার্গো নভোযান এই স্টেশনে ভেড়ার সুযোগ দিয়েছিল। ২০১২ সাল থেকে চালু হয়েছে স্পেস-এক্স এর বাণিজ্যিক নভোযান – ড্রাগনের যাত্রা যা এখনো চালু আছে। বোয়িং কোম্পানি স্টারলাইনার নভোযানের মাধ্যমে ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষের জন্য বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশ ভ্রমণের সুযোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

মানুষ ভবিষ্যতে চাঁদে কিংবা মঙ্গলে গিয়ে বসবাস করার কথা ভাবছে। কিন্তু দীর্ঘদিন মহাশূন্যের অভিকর্ষহীন পরিবেশে বসবাস করলে শরীরের উপর কী প্রভাব পড়ে তা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ ঘটে এই মহাকাশ স্টেশনে নভোচারীরা যখন মাসের পর মাস বাস করেন তখন। মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে থাকতে থাকতে নভোচারীদের মাংসপেশী, হাড়, চোখ, পরিপাকতন্ত্র ও শ্বাসতন্ত্রে প্রভাব পড়ে। এই প্রভাবের ফলে কী কী পরিবর্তন হয় তা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই পরিবর্তন কতটুকু স্থায়ী কিংবা ক্ষতিকর তাও দেখা হয়। পৃথিবীর যন্ত্রপাতিগুলি মহাকাশে ব্যবহার করলে তার কোন পরিবর্তন হয় কি না, আবার উদ্ভিদ কিংবা অন্যান্য প্রাণির উপর কী প্রভাব আছে তাও দেখা হয়। ছোট ছোট শাকসব্জি স্টেশনে ফলানোর চেষ্টা করা হয়, যা পরীক্ষার অংশ আবার খাদ্যেরও। এপর্যন্ত এই মহাকাশ স্টেশনই মহাকাশে ভাসমান একমাত্র গবেষণাগার যেখানে এই পরীক্ষাগুলি করা হচ্ছে। এপর্যন্ত সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গবেষক আড়াই হাজারেরও বেশি গবেষণা-প্রকল্প সম্পন্ন করেছেন এই মহাকাশ স্টেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত ব্যবহার করে।

মহাকাশ স্টেশনের মিশন কন্ট্রোল সেন্টার আছে আমেরিকার হিউস্টনে এবং রাশিয়ার মস্কোয়। জাপান, কানাডা এবং ইওরোপ থেকেও সীমিত পর্যায়ে কিছু মিশন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টানে মহাকাশ স্টেশন কিছুদিন পর পর পৃথিবীর দিকে ঝুঁকে পড়ে। তখন তাকে আবার কক্ষপথে ঠেলে দিতে হয়। এই কাজগুলির নিয়ন্ত্রণ করে রাশিয়া।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে রাশিয়ার সাথে আন্তর্জাতিক মহাকাশ চুক্তির অনেক কিছুই বাতিল করেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। ফলে  রাশিয়ার প্রভাব এবং গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। রাশিয়া ২০২৪ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে তাদের অংশগ্রহণ প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া প্রত্যাহার করে নিলে বেশ কিছু কারিগরী জটিলতা দেখা দেবে। আমেরিকা মহাকাশ স্টেশনে জ্বালানি সরবরাহ করে, কিন্তু রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে মহাকাশ স্টেশনের চলাচল। রাশিয়ার কারিগরী নিয়ন্ত্রণ বন্ধ হয়ে গেলে নাসাকেই সব দায়িত্ব নিয়ে মহাকাশ স্টেশন পরিচালনা করতে হবে।

আশা করা হচ্ছে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মহাকাশ স্টেশন যেভাবে চলছে সেভাবে চলবে। এরপর এর পরিচালনায় কিছু পরিবর্তন ঘটবে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত নাসা এর অর্থায়ন যেভাবে করছিল সেভাবে করবে। ২০৩০ সালের পর আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের ভবিষ্যত কী হবে তা এখনো নির্ধারিত হয়নি।


তথ্যসূত্র:  (১) এলিজাবেথ হাওয়েল, স্পেস ডট কম (২০২২); (২) প্রদীপ দেব, সবার জন্য স্যাটেলাইট, তাম্রলিপি, ঢাকা (২০১৮); (৩) জন ক্যাচপোল, দি ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশান বিল্ডিং ফর দ্য ফিউচার, স্প্রিঙ্গার, জার্মানি (২০০৮); (৪) ফিলিপ ব্যাকার, দ্য স্টোরি অব ম্যানড স্পেস স্টেশানস, স্প্রিঙ্গার, জার্মানি (২০০৭);

______________

বিজ্ঞানচিন্তা জানুয়ারি ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত










No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts