বিজ্ঞানের জগতকে আমরা যতটা বস্তুনিষ্ঠ বলে ভাবি, আসলে কিন্তু তা নয়। বিজ্ঞানের জগতে বিজ্ঞানীরা সবাই প্রচন্ড স্বার্থপর। নিজেদের কৃতিত্বের এতটুকু ছাড় দিতে তাঁরা রাজি নন, কিন্তু অন্যের কৃতিত্ব প্রায়ই তারা অস্বীকার করেন, এবং সুযোগ থাকলে নিজের বলে চালিয়ে দিতে পিছপা হন না। সে কারণেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে নিজেদের ভাবনা, যেকোনো ছোটখাট আবিষ্কার ঘটা করে প্রচার করার সংস্কৃতি চালু আছে। উদ্ভাবনের প্যাটেন্ট পাবার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করা হয়। সেখানে যাদের প্যাটেন্ট জোগাড় করার পদ্ধতিগত টাকা খরচ করার মতো সামর্থ্য থাকে না, তাদের প্যাটেন্ট চলে যায় সামর্থ্যবান কোম্পানির দখলে। প্যাটেন্ট অ্যাটর্নিদের ফি অনেক। বিজ্ঞানীদের মধ্যেও আছে প্রাতিষ্ঠানিক জাতপ্রথা। বাংলাদেশের অখ্যাত কোন কলেজের কোন শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর পক্ষে কোন একটি গবেষণাপত্র কোন নামী জার্নালে প্রকাশ করতে যে পরিমাণ বেগ পেতে হবে, হার্ভার্ড কিংবা এম-আই-টির কোন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে তার শতাংশ কষ্ট করতে হবে না। বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর পক্ষেও আইনস্টাইনের সাহায্য ছাড়া গবেষণাপত্র প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। এই জাতপ্রথা উচ্ছেদ করার জন্য গবেষণা সাময়িকীগুলো অনেক ধরনের ডাবল ব্লাইন্ড রিভিউ ব্যবস্থার প্রচলন করেছে – যেখানে রিভিউরাররা গবেষণাপ্রবন্ধের লেখকবিজ্ঞানীদের নাম পরিচয় জানতে পারেন না। কিন্তু রেফারেন্স লিস্ট থেকেই মোটামুটি বোঝা যায় – কোন্ প্রবন্ধ কোত্থেকে এসেছে। তাছাড়া ইদানীং যেকোনো নামী গবেষণাসাময়িকীতে প্রকাশনার জন্য গৃহীত হবার পরেও যে পরিমাণ পাবলিকেশান ফি দিতে হয়, তা অস্বাভাবিক রকমের বেশি। যেমন নেচার সাময়িকীতে একটি প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য প্রায় সাত-আট হাজার ডলার দিতে হয়। এই পরিমাণ টাকা একজন দরিদ্র অথচ মেধাবী বিজ্ঞানীর পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হয় না। তখন তাঁর খুব যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়তো কোন ফ্রি জার্নালে প্রকাশিত হয় – যা নামী বিজ্ঞানীদের কারো চোখেই পড়ে না।
এত কথা মনে হলো অস্ট্রিয়ার কণা পদার্থবিজ্ঞানী মারিয়েটা ব্লাউর কথা স্মরণ করে। তাঁর আবিষ্কৃত ফটোগ্রাফিক প্লেটের মাধ্যমে পারমাণবিক কণা শনাক্ত করার পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানী সিসিল পাওয়েল নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৫০ সালে, অথচ মারিয়েটার অবদানের কথা তিনি স্বীকারই করেননি।
মারিয়েটা ব্লাউ জন্মেছিলেন অস্ট্রিয়ার এক মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারে ১৮৯৪ সালের ২৯ এপ্রিল। ১৯১৯ সালে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করার পরেও তিনি কোনো চাকরি পাননি অস্ট্রিয়ার কোথাও। গবেষণা ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। তাই গবেষণা করার সুযোগ আছে এরকম কোন চাকরি খুঁজছিলেন তিনি। ১৯২১ সালে বার্লিনের একটি এক্স-রে টিউব তৈরি করার কারখানায় যোগ দেন। সেখানে তিনি অনেক কাজ শেখেন, কিন্তু রুটিন কাজের বাইরে স্বাধীনভাবে গবেষণার সুযোগ খুব একটা ছিল না। তাই ১৯২৩ সালে ভিয়েনায় ফিরে এসে বিনাবেতনে গবেষণা শুরু করলেন ভিয়েনার রেডিয়াম রিসার্চ ইন্সটিটিউটে। সেখানেই তিনি পরবর্তী আট বছর ধরে গবেষণা করে ফটোগ্রাফিক ইমালশানের মাধ্যমে নিউক্লিয়ার কণা শনাক্ত করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি শনাক্ত করেন মহাকাশের নক্ষত্র থেকে ছুটে আসা কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মি। অথচ ১৯৫০ সালে এই পদ্ধতির সাহায্যে মেসন কণা শনাক্তকরণের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সিসিল পাওয়েলকে।
১৯৩৮ সালে মারিয়েটা ব্লাউকে কাজ থেকে শুধু নয়, দেশ থেকেও তাড়িয়ে দেয়া হয় শুধুমাত্র ইহুদি হবার অপরাধে। এদেশ থেকে ওদেশে পালাতে পালাতে শেষপর্যন্ত আইনস্টাইনের সুপারিশ এবং সহায়তায় তিনি মেক্সিকোতে একটি চাকরি পান। অস্ট্রিয়া থেকে পালিয়ে যাবার সময় তিনি তাঁর গবেষণার কাগজপত্র সাথে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। হামবুর্গ এয়ারপোর্টে জার্মান সৈনিকেরা তাঁর সব কাগজপত্র কেড়ে নেয়। পরে তাঁর এই গবেষণার অনেককিছুই হারথা ওয়ামবাখার ও জর্জ স্টেটার নিজেদের নামে প্রকাশ করেন। অথচ এই দুইজন ছিলেন মারিয়েটা ব্লাউর সহকারি। হারথা ছিলেন তাঁর সরাসরি ছাত্রী। নাৎসি সমর্থক এই দুজন হিটলারের জার্মানিতে নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী হিসেবে অনেক নাম করেছিলেন।
মারিয়েটা ব্লাউয়ের মতো অনেকেই এখনো বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এই বঞ্চনার কথা অনেক সময় কেউ জানতেও পারে না।