গ্যালিলিও, নিউটন, কিংবা আইনস্টাইনকে বিজ্ঞানে যেরকম গুরুত্ব দেয়া হয়, সেরকম গুরুত্ব পাওনা ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানী সিসিলিয়া পাইন-এর। নক্ষত্রগুলির গাঠনিক উপাদান যে হিলিয়াম আর হাইড্রোজেন - তার প্রথম প্রমাণ দিয়েছিলেন সিসিলিয়া পাইন। আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্ররাজির উপাদান বিশ্লেষণে তিনিই প্রথম পারমাণবিক তত্ত্ব প্রয়োগ করেছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর অবদান সম্পর্কে যতটুকু স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন তার জন্য কঠোর পরিশ্রম তো করতে হয়েছেই - শুধুমাত্র মেয়ে হবার কারণে তাঁর প্রাপ্য সম্মান পেতেও তাঁকে করতে হয়েছে সীমাহীন সংগ্রাম।
সিসিলিয়া পাইনের জন্ম ১৯০০ সালের ১০মে ইংল্যান্ডের বাকিংহামশায়ারে। চার বছর বয়সে বাবাকে হারান। তাঁর মা অনেক কষ্ট করে তাঁকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। কেমব্রিজের নিউন্যাম কলেজে বোটানি, কেমিস্ট্রি ও ফিজিক্স নিয়ে বিএসসি পড়ার সময় বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের লেকচার শুনে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হন। সেইসময় ফিজিক্সের ক্লাসে তিনি ছিলেন একমাত্র মেয়ে। শুধুমাত্র সেই কারণে ক্লাসের ছেলেরা তাঁকে টিটকিরি মারতো। শুধু ছাত্ররা নয়, শিক্ষকরাও হাসিঠাট্টা করতো সিসিলিয়াকে নিয়ে। স্বয়ং আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, হ্যাঁ ঠিক পড়ছেন, সেই রাদারফোর্ড যিনি পরমাণুর নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেছেন, প্রোটন আবিষ্কার করেছেন, তিনিও তাঁর পুরুষালি মনোভাব দমন করতে পারেননি সেদিন। রাদারফোর্ডের ক্লাসে নিয়মিত হাসিঠাট্টার পাত্রী হতে হয়েছে সিসিলিয়াকে। তবুও তিনি ফিজিক্স ছেড়ে দেননি।
পাস করার পর ইংল্যান্ডের কোথাও তখন মেয়ে-পদার্থবিজ্ঞানীর সম্মানজনক চাকরি ছিল না। মেরি কুরি তখনও সারা ইওরোপে একমাত্র মহিলা পদার্থবিজ্ঞানী। আমেরিকায় তখন মেয়েদের জন্য কিছুটা সুযোগ বেশি ছিল ইংল্যান্ডের চেয়ে। সিসিলিয়া আমেরিকা গেলেন পদার্থবিজ্ঞানে যদি কোন সুযোগ পাওয়া যায়।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তখনো আমেরিকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু হার্ভার্ড ছিল প্রচন্ড রকমের নারীবিদ্বেষী বিশ্ববিদ্যালয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট অ্যাবট লরেন্স লাওয়েল লিখিতভাবে আদেশ জারি করেছিলেন - হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন নারীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে না। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনার জন্য কোন মেয়েকে ভর্তি করানো হতো না তখন।
সিসিলিয়া পড়াশোনা করলেন রেডক্লিফ কলেজে। এই কলেজটি মেয়েদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
হার্ভার্ড কলেজ অবজারভেটরির ডিরেক্টর হারলো শাপলি তখন মেয়েদের কে কাজ দিয়েছিলেন অবজারভেটরিতে। মেয়েদের জন্য গবেষণার সুযোগও তৈরি করছিলেন ধীরে ধীরে। সিসিলিয়া সেই গবেষণা-প্রকল্পে যোগ দিলেন। সিসিলিয়ার পিএইচডি গবেষণার কাজ এতই ভালো হয়েছিল যে আমেরিকার জ্যোতিপর্দার্থবিজ্ঞানী অটো স্ট্রুভ মন্তব্য করেছিলেন, 'সিসিলিয়ার পিএইচডি থিসিসের মতো এত উন্নতমানের থিসিস এর আগে কখনো লেখা হয়নি।"
পিএইচডি ডিগ্রি দেয়ার জন্য হার্ভার্ডে আবেদন করার পরও অনুমোদন পাওয়া যায়নি। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি তখনো কোন মেয়েকে পিএইচডি দেয়ার বিরুদ্ধে।
১৯২৭ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত শাপলির সহকারি হিসেবে অত্যন্ত কম বেতনে কাজ করতে হয়েছে সিসিলিয়াকে। সেই বেতনও তাঁকে দেয়া হতো যন্ত্রপাতি কেনার টাকা থেকে। কারণ কোন মেয়েকে সহকারি হিসেবেও নিয়োগ করার অনুমোদন ছিল না।
কত দীর্ঘ সংগ্রামের পর অবশেষে ১৯৫৬ সালে সিসিলিয়া পাইন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ পান। সিসিলিয়া ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী প্রফেসর। জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর অবদানের তালিকা অনেক দীর্ঘ। আমরা আজ নক্ষত্রগুলির রাসায়নিক গঠন জানি সিসিলিয়া পাইনের দৌলতে।
আজ ১০মে সিসিলিয়া পাইনের জন্মদিন।
শুভ জন্মদিন সিসিলিয়া।
No comments:
Post a Comment