ছবির মানুষটির হাতের আঙুলগুলির দিকে তাকান। বয়সের কারণে তাঁর হাত-পায়ের আঙুল এভাবে বেঁকে যায়নি, একুশ-বাইশ বছর বয়সেই তিনি আক্রান্ত হয়েছেন ক্রনিক রিউম্যাটয়েড আর্থাইটিসে। তখন থেকেই হাত-পায়ের আঙুলে প্রচন্ডরকমের ব্যথা ও ক্রমশ বেঁকে যাওয়াকে সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে আমৃত্যু। এরকম ব্যথা আর কুঁকড়ে যাওয়া হাত-পা নিয়েই তিনি ক্রমাগত গবেষণা করেছেন। এই মানুষটি ডরোথি ক্রোফুট হজকিন। যিনি এক্স-রে কৃস্টালোগ্রাফি প্রয়োগ করে আবিষ্কার করেছেন পেনিসিলিনের গঠন, ভাইটামিন বি-১২ এর রাসায়নিক গঠন, ইনসুলিনের গঠন। পৃথিবীর কত কোটি মানুষ যে তাঁর আবিষ্কারের সুফল ভোগ করছে তা একটু ভেবে দেখলেই আমরা বুঝতে পারবো।
ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী জন ক্রোফুট এবং বোটানিস্ট গ্রেইস ক্রোফুটের প্রথম সন্তান ডরোথির জন্ম নিশরের কায়রোতে ১৯১০ সালের ১২ মে। সেইসময় মিশর ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। ডরোথির বাবা তখন মিশরের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন। ডরোথির বয়স যখন চার বছর তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে – ডরোথিকে ইংল্যান্ডে রেখে তার মা-বাবা আবার মিশরে কর্মস্থলে চলে গিয়েছিলেন। চার বছর ডরোথি ইংল্যান্ডে মা-বাবা ছাড়া ন্যানির কাছে থেকেছে। তখন থেকেই স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারটা তার জীবনে জড়িয়ে গেছে।
ছোটবেলা থেকেই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা নিয়ে বড় হয়েছে ডরোথি। মা-বাবা সমানে উৎসাহ দিয়েছেন তাকে। পদার্থবিজ্ঞানী উইলিয়াম হেনরি ব্র্যাগ ও তাঁর ছেলে লরেন্স ব্র্যাগ এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি আবিষ্কার করে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯১৫ সালে। ডরোথি ষোল বছর বয়সে উইলিয়াম হেনরি ব্র্যাগের ক্রিস্টালোগ্রাফি বই পড়ে এই বিষয়ের প্রতি প্রচন্ডভাবে আগ্রহী হয়ে পড়ে। স্কুলে তখন মেয়েদেরকে বিজ্ঞান পড়তে দেয়া হতো না। মেয়েদের জন্য বিজ্ঞান বলতে শুধুমাত্র গার্হস্থ্য বিজ্ঞান পড়ারই অনুমতি ছিল। ডরোথি এবং তার অন্য একজন সহপাঠী নোরা অনেক দেনদরবার করে রসায়নের ক্লাস করার অনুমতি পেয়েছিল।
কিশোরী ডরোথি |
১৯২৮ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সামারভিল কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৩২ সালে রসায়নে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ইংল্যান্ডে তখন ক্রিস্টালোগ্রাফির সবচেয়ে বিখ্যাত অধ্যাপক ছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন বারনাল। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের অধ্যাপকরা তখনো সবাই পুরুষ। তবে কোন কোন শিক্ষক মেয়েদের বিজ্ঞান গবেষণায় সুযোগ দেবার পক্ষে মত দিতে শুরু করেছেন। প্রফেসর বারনাল ছিলেন তাঁদেরই একজন। তিনি ডরোথির আগ্রহ এবং স্নাতকের ফলাফল দেখে তাঁর ল্যাবে গবেষণার সুযোগ দিলেন ডরোথিকে। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৪ পর্যন্ত জন বারনালের সহকারি হিসেবে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিস্টালোগ্রাফি নিয়ে গবেষণা করলেন ডরোথি।
তার কয়েক বছর আগেই ধরা পড়েছে তার রিওম্যাটয়েড আর্থাইটিস। হাত-পায়ের আঙুলে প্রচন্ড ব্যথা, ক্রমশ কুঁকড়ে যেতে শুরু করেছে সেগুলি। কিন্তু কোন ব্যথাতেই দমে যাবার পাত্রী নন ডরোথি। চিকিৎসা আর গবেষণা একই সাথে চলছিল। ১৯৩৪ সালে বারনালের ল্যাবে এক্স-রে প্রয়োগ করে প্রোটিনের ছবি তোলা গেল – যাতে বোঝা গেল জৈবযৌগ ক্রিস্টাল হতে পারে।
প্রফেসর বারনালের কাছ থেকে ক্রিস্টালোগ্রাফির দরকারি জ্ঞান অর্জন করে ১৯৩৪ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে চলে এলেন ডরোথি। এবার সেখানে পড়ানোর পাশাপাশি নিজের পিএইচডি গবেষণা শুরু করলেন। শুরু করলেন ইনসুলিনের ত্রিমাত্রিক গঠন আবিষ্কার করার গবেষণা। ১৯৩৭ সালে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি অর্জন করলেন। অক্সফোর্ডেই তিনি কাটিয়েছেন তাঁর পুরো একাডেমিক জীবন। কিন্তু অক্সফোর্ডের ফ্যাকাল্টি মেম্বার হওয়া সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগ পর্যন্ত তিনি কোন গবেষণা কমিটির মিটিং-এ যোগ দেয়ার সুযোগ পাননি শুধুমাত্র নারী হবার কারণে।
১৯৩৭ সালে তিনি বিয়ে করেন ইতিহাসবিদ থমাস হজকিনকে। বিয়ের পর ডরোথি ক্রোফুট হলেন ডরোথি ক্রোফুট হজকিন, কিন্তু অফিশিয়ালি ডরোথি হজকিন বলেই ডাকতে শুরু করলো সবাই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার কারণে – যুদ্ধাহত সৈনিকদের চিকিৎসার জন্য পেনিসিলিনের দরকার হচ্ছিলো অনেক বেশি। কিন্তু পেনিসিলিনের ত্রিমাত্রিক গঠন তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে পেনিসিলিনের ব্যবহারকে আরো বেশি কার্যকর করা যাচ্ছিলো না। ডরোথি ইনসুলিনের গঠন আবিষ্কারের কাজে সাময়িক বিরতি দিয়ে পেনিসিলিনের গঠন আবিষ্কারের গবেষণা শুরু করলেন। সতেরোটি পরমাণুসমৃদ্ধ পেনিসিলিনের ত্রিমাত্রিক গঠন আবিষ্কার করতে চার বছর সময় লাগলো ডরোথি হজকিনের। ১৯৪৮ সালে আবিষ্কৃত হলো পেনিসিলিনের ত্রিমাত্রিক গঠন। ডরোথি এরপর শুরু করলেন ভাইটামিন বি-১২ এর ত্রিমাত্রিক গঠন আবিষ্কারের গবেষণা। আট বছর নিরলস গবেষণার পর ১৯৫৭ সালে আবিষ্কৃত হলো ১৮১টি পরমাণুসমৃদ্ধ ভাইটামিন বি-১২ এর গঠন। এই আবিষ্কারের জন্য ১৯৬৪ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করলেন ডরোথি হজকিন।
ভাইটামিন বি-১২ এর গঠন আবিষ্কারের পর ডরোথি আবার শুরু করলেন ইনসুলিনের ত্রিমাত্রিক গঠন আবিষ্কারের কাজ। ৭৮৮টি পরমাণূসমৃদ্ধ অন্ত্যন্ত জটিল ইনসুলিনের ত্রিমাত্রিক গঠন আবিষ্কার করতে চৌত্রিশ বছর নিরলস গবেষণা করতে হয়েছে ডরোথিকে। যে কাজ শুরু করেছিলেন ১৯৩৫ সালে, ১৯৬৯ সালে সেই কাজে সাফল্য এলো। পাওয়া গেল ইনসুলিনের ত্রিমাত্রিক গঠন।
ডরোথি হজকিন সারাজীবন বিজ্ঞানের জন্য কাজ করেছেন, পাশাপাশি শান্তির কাজে বিজ্ঞান কাজে লাগানোর পক্ষে কাজ করেছেন। আরেক নোবেলজয়ী লিনাস পাউলিং – যিনি রসায়নের পরে শান্তিতে পেয়েছেন দ্বিতীয় নোবেল, তাঁর সাথে বিশ্বশান্তির জন্য কাজ করেছেন ডরোথি হজকিন। এজন্য তিনি লেনিন পুরষ্কারসহ অনেকগুলি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পেয়েছেন।
ডরোথি হজকিন এবং তাঁর স্বামী সন্তান সবাই ছিলেন খুবই আন্তর্জাতিক। ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে যখন নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার খবর পেলেন – ডরোথি তখন ছিলেন ঘানায়। তাঁর স্বামী তখন ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব আফ্রিকান স্টাডিজের ডিরেক্টর। তাঁদের মেয়ে এলিজাবেথ শিক্ষকতা করতো জাম্বিয়ার একটি স্কুলে, ছেলে টোবিয়াস কাজ করতো দিল্লীতে।
শুধুমাত্র গবেষণা করে নিজের দায়িত্ব শেষ করেননি ডরোথি। পাশাপাশি সারাজীবন যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, পারমাণবিক বোমা নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে ছিলেন উচ্চকন্ঠ।
১৯৯৪ সালের ২৯ জুলাই মারা যান ডরোথি।
No comments:
Post a Comment