আমার বাবার সাথে তোলা এটাই আমার প্রথম ছবি। তখন আমি ক্লাস নাইনে উঠে গিয়েছি, দিদি অনার্সে পড়ে, দাদা এসএসসি দিয়েছে। চকবাজারে গুলজার সিনেমার পাশে স্টুডিও আলেয়ায় গিয়ে এই ছবি তোলা হয়েছিল।
এর আগে আমি মোট তিনবার স্টুডিওতে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিলাম। ক্লাস থ্রিতে ওঠার পর প্রথম শহরে এসেছিলাম। বাবা আমাদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে গিয়েছিলেন শহর দেখাতে। লালদীঘির কাছে মুকুল স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে একটি ছবি তোলা হয়েছিল আমাদের তিন ভাইবোনের। ওটা ছিল আমার জীবনের প্রথম ছবি, কিন্তু আমার দাদা ও দিদির দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়। তারা মা-বাবার সাথে প্রথম যে ছবিটি তুলেছিল তাতে আমি অদৃশ্য ছিলাম। তখন আমি ছিলাম আমার মায়ের গর্ভে। বলা বাহুল্য ওটা ছিল মায়ের সাথে তাদের প্রথম এবং শেষ ছবি। মায়ের সাথে ছবি তোলার কোন সুযোগ আমার হয়নি। মুকুল স্টুডিওতে আমরা তিন ভাইবোনের একটি ছবি তোলা হয়েছিল, কিন্তু বাবা কেন সেই ছবিতে যোগ দেননি আমি জানি না। পরে এটা বুঝতে পেরেছি যে একাধিক ছবি তোলাবার অর্থনৈতিক সামর্থ্য সেদিন আমার বাবার ছিল না।
আমার দ্বিতীয়বার ছবি তোলা হয়েছিল ক্লাস সিক্সে ওঠার পর। ওটা ছিল একটা হাফ-ছবি, যেখানে শুধু মুখটা দেখা যায়। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পাওয়ার পর আমার বাবার শখ হয়েছিল ছেলের ছবি পত্রিকায় ছাপাবেন। তাই ছবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু পত্রিকা অফিসে যাওয়ার পর ওরা যে পরিমাণ টাকা লাগবে বলেছিল – সেই পরিমাণ টাকা খরচ করার সামর্থ্য ছিল না মানুষটার। আমি বাবার সাথে ছিলাম। মাথা নিচু করে তিনি যখন আন্দরকিল্লার আজাদী অফিস থেকে বের হচ্ছিলেন, ক্লাস সিক্সে ওঠা আমি কেমন যেন নিজেকেই দায়ী ভাবছিলাম। সাধ আর সামর্থ্যের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলে নিম্নবিত্ত সৎ মানুষদের – সেই দ্বন্দ্ব কোনদিনই ঘোচেনি আমার বাবার।
আমার তৃতীয় ছবিটি তোলা হয় পটিয়ার একটি স্টুডিওতে। ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষার পর। তখন দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবগুলি স্কুলের বৃত্তিপরীক্ষার একটি মাত্র সেন্টার ছিল পটিয়া আবদুস সোবহান রাহাত আলি হাই স্কুলে। সেবারও বাবার সাথে আমার একটি ছবি তোলা যেতে পারতো। কিন্তু তোলা হয়নি। তার মাস ছয়েক পর তোলা হলো এই ছবিটি - আমরা তিনভাইবোনের সাথে বাবার প্রথম ছবি।
এই ছবিটি চিকন একটি কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই করে বাড়ির কার্ডবোর্ডের দেয়ালে টাঙানো হয়েছিল। সময়ের বিবর্তনে আমরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বাড়ি ছেড়ে নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছি। ছবিটি দেয়ালে থাকতে থাকতেই ঝাপসা থেকে ঝাপসাতর হয়ে গেছে। বাবার মৃত্যুর পর খেয়াল হলো ছবিটির আর কোন কপি নেই। বেশ কয়েকবছর পর বাবার অগোছানো কাগজপত্রের ভেতর পাওয়া গেল পুরনো ছবির নেগেটিভ। তখন স্টুডিও থেকে নেগেটিভ দিয়ে দেয়া হতো, নাকি বাবা চেয়ে নিয়েছিলেন ঠিক জানি না। তবে নেগেটিভ পাওয়া গেল। যদিও বিভিন্ন জায়গায় কেমিক্যাল নষ্ট হয়ে গেছে। ডিজিটাল স্ক্যানারে নেগেটিভ থেকে ছবি প্রিন্ট করা কোন ব্যাপারই না এখন।
আমার বাবা এই প্রযুক্তি দেখার সুযোগ পাননি। কিন্তু তাঁর নাতি-নাতনিরা ডিজিটাল যুগে জন্মেছে। এই ছবি তারা যতবারই দেখে, মন খারাপ করে ফেলে। একজন আবার বেশি নরম - “তোমাদের তো ভালো কোন জামাকাপড়ও ছিল না কাকু। ঠাকুরদার স্যান্ডেলও ছেঁড়া।“
একথা আমার কোনদিনই মনে হয়নি যে আমাদের ভালো জামাকাপড় ছিল না। সেদিন আমরা আমাদের সর্বোত্তম পোশাকে ছবি তুলতে গিয়েছিলাম স্টুডিওতে। আমার গায়ের শার্টটি স্কুল ড্রেসের শার্ট। ওটা ছাড়া আমার আরো একটি শার্ট ছিল। বাবার স্যান্ডেল কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেলেও, বাবা বলতেন,এখন নতুন স্যান্ডেল কেনার দরকার নেই। টাকার টানাটানির কথা তিনি কোনদিনই স্বীকার করতেন না। মুচির কাছ থেকে সেলাই করিয়ে নিয়ে বাবা আরো কয় বছর সেগুলি পরেছিলেন এখন ঠিক মনে পড়ছে না।
No comments:
Post a Comment