Wednesday, 24 May 2023

ট্রানজিস্টরের মহাগুরু - উইলিয়াম শকলি

 



একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে প্রযুক্তি। যে আধুনিক প্রযুক্তি আমরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছি – তা হলো তথ্যপ্রযুক্তি। আমাদের প্রায় সব কাজই এখন কোনো না কোনোভাবে কম্পিউটারনির্ভর। ১৯৪৫ সালে যখন প্রথম কম্পিউটার এনিয়াক (ENIAC – Electronic Numerical Integrator and Computer) তৈরি হয় – তখন তাতে ব্যবহার করা হয়েছিল হাজার হাজার ভ্যাকুয়াম টিউব। তখন একটি কম্পিউটারের জন্য জায়গা লাগতো কমপক্ষে ৫০ ফুট বাই ৩০ ফুট। সেই সময় কেউ ভাবতেও পারেনি যে একদিন কম্পিউটার চলে আসবে আক্ষরিক অর্থেই মানুষের হাতের মুঠোয়। আজ এই ২০২৩ সালে পৃথিবীর আট শ কোটি মানুষের হাতে রয়েছে চৌদ্দ শ কোটি স্মার্ট ফোন। ইলেকট্রনিকসের যে উদ্ভাবনের ফলে বিশাল শিল্প-বিপ্লব ঘটে গেছে পৃথিবীজুড়ে – তার মূলে আছে ট্রানজিস্টরের উদ্ভাবন। প্রযুক্তির ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর – যেদিন আমেরিকার বেল টেলিফোন ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়েছিল প্রথম ট্রানজিস্টর। 

এই ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের জন্য ১৯৫৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান বেল ল্যাবরেটরির তিনজন বিজ্ঞানী – জন বার্ডিন, ওয়াল্টার ব্র্যাটেইন এবং উইলিয়াম শকলি। ট্রানজিস্টরের উদ্ভাবনকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় – কারণ তথ্যপ্রযুক্তির যে বিপুল উন্নতি আজ ঘটেছে পৃথিবীতে তার মূলে রয়েছে ট্রানজিস্টর। ট্রানজিস্টরকে ইলেকট্রনিক যুগের “নার্ভ সেল” বা স্নায়ুকোষের সাথে তুলনা করা হয় । উইলিয়াম শকলি বেল ল্যাবরেটরির রিসার্চ গ্রুপের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও বার্ডিন ও ব্র্যাটেইনের কাজের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। ফলে বেল ল্যাবরেটরির প্রথম ট্রানজিস্টরের প্যাটেন্ট নেয়া হয়েছিল জন বার্ডিন ও ওয়াল্টার ব্র্যাটেইনের নামে। কিন্তু তাতে ভীষণ রেগে যান উইলিয়াম শকলি। তিনি নিজেই আরো উন্নত একটি ট্রানজিস্টরের প্যাটেন্ট নিয়ে প্রমাণ করেন যে বার্ডিন ও র‍্যাটেইন যদি ট্রানজিস্টরের গুরু হন, তাহলে শকলি হলেন ট্রানজিস্টরের মহাগুরু। এই উইলিয়াম শকলির হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ট্রানজিস্টর তৈরির প্রথম কারখানা – যা পরবর্তীতে পথ দেখায় সিলিকন ভ্যালির। বিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবকদের একজন হিসেবে উইলিয়াম শকলি একদিকে ছিলেন ভীষণ নন্দিত, আবার অন্যদিকে তাঁর ব্যক্তিগত উন্নাসিক স্বভাব আর সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদী মনোভাবের কারণে হয়ে পড়েছিলেন ভীষণ নিন্দিত। আজকের কাহিনি উইলিয়াম শকলির কাহিনি। 

উইলিয়াম ব্র্যাডফোর্ড শকলির জন্ম ১৯১০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। তাঁর আমেরিকান বাবা-মা তখন কাজের সূত্রে লন্ডনে বাস করছিলেন। বাবা উইলিয়াম হিলম্যান শকলি ছিলেন মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার, আর মা মে শকলি ছিলেন খনিজসম্পদ জরিপের প্রধান। মা-বাবা দু’জনই উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চপদে কর্মরত থাকার সুবাদে এবং একমাত্র সন্তান হওয়াতে ছোটবেলা থেকেই বিশেষ জ্ঞান এবং আভিজাত্যের ভেতর দিয়ে মানুষ হয়েছেন উইলিয়াম শকলি। তাঁর তিন বছর বয়সে ১৯১৩ সালে তিনি মা-বাবার সাথে ফিরে আসেন আমেরিকায় - ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আল্টোয়। তাঁদের প্রতিবেশী ছিলেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিজিক্সের প্রফেসর পার্লি রস। প্রফেসর রস শকলিকে খুবই স্নেহ করতেন। তাঁর প্রভাবেই শকলি ছোটবেলা থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। 

শকলির মা-বাবা নিজেরাই বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষা দেন শকলিকে। তারপর তাকে ভর্তি করানো হয় পালো আল্টো মিলিটারি একাডেমিতে। এরপর হলিউড হাইস্কুলে। ১৯২৭ সালে স্কুল শেষ করে ভর্তি হলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস এঞ্জেলেসে। এক বছর এখানে পড়ার পর চলে গেলেন ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি – ক্যালটেকে। সেখান থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৩২ সালে। স্নাতকের রেজাল্টের ভিত্তিতে এমআইটির টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ লাভ করেন শকলি। সোডিয়াম ক্লোরাইডের কৃস্টালে ইলেকট্রনের ওয়েভ ফাংশান সংক্রান্ত গবেষণা করে এমআইটি থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি অর্জন করেন ১৯৩৬ সালে।

সলিড স্টেট ফিজিক্সে ভীষণ দক্ষতা ছিল শকলির। পিএইচডি লাভের সঙ্গে সঙ্গেই চাকরি পেয়ে গেলেন বেল টেলিফোন ল্যাবরেটরিতে। সেই সময় টেলিফোন প্রযুক্তি খুব একটা শক্তিশালী ছিল না। ট্রান্সমিটার ও রিসিভারে ব্যবহার করা হতো বড় বড় ভ্যাকুয়াম টিউব। টেলিফোনের তার দিয়ে হাজার দেড় হাজার কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে শব্দ পাঠাতে গেলে শব্দের মান খুব কমে যেতো, নয়েজ বেড়ে গিয়ে আসল শব্দের কিছুই শোনা যেতো না। বেল টেলিফোন ল্যাবরেটরিতে উইলিয়াম শকলির প্রথম গবেষণা প্রকল্প হলো – আরো উন্নত মানের ভ্যাকুয়াম টিউব উদ্ভাবন করা যাদের সাহায্যে শব্দের প্রাবল্য বাড়ানো সম্ভব হবে।

সলিড স্টেট সেমিকন্ডাক্টরের তত্ত্বকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলেন শকলি। কিন্তু তখনো জার্মেনিয়াম কিংবা সিলিকনের মতো সেমিকন্ডাক্টর সহজে ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠেনি। ১৯৩৯ সালে শকলি ফিল্ড ইফেক্ট ট্রানজিস্টরের তত্ত্ব দেন এবং ল্যাবরেটরিতে তৈরি করার চেষ্টা করেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল ভ্যাকুয়াম টিউবের বদলে ট্রানজিস্টর ব্যবহার করে টেলিফোন সিস্টেমের ব্যাপক উন্নতি ঘটানো। কিন্তু সে পরিকল্পনা কার্যকর হবার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেল ল্যাবরেটরি আমেরিকান মিলিটারির হয়ে অনেকগুলি প্রজেক্টে গবেষণা করে। রাডারের যন্ত্রপাতির ইলেকট্রনিক ডিজাইনের দায়িত্ব পড়ে উইলিয়াম শকলির উপর। ১৯৪২ সালে তিনি আমেরিকান নৌবাহিনীর অ্যান্টিসাবমেরিন অপারেশান রিসার্চ গ্রুপের ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। তাঁর তত্ত্বাবধানে আমেরিকান নৌবাহিনী সাবমেরিন ধ্বংস করার অনেক কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। ১৯৪৪ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি আমেরিকান সরকারের যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উইলিয়াম শকলি নতুন নতুন যুদ্ধকৌশল উদ্ভাবন করে খুব আনন্দ পেতেন। 

যুদ্ধশেষে আবার বেল ল্যাবে ফিরে এলেন উইলিয়াম শকলি। ল্যাবের প্রেসিডেন্ট মারভিন কেলি সেমিকন্ডাক্টর ফিজিক্স ভালোভাবে বোঝার জন্য একটি রিসার্চ গ্রুপ তৈরি করলেন। ইলেকট্রনিক্সে সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছিল তখন। সিলিকন ক্রিস্টালের অদ্ভুত কিছু ধর্ম সেই সময় আবিষ্কৃত হয়েছে। সেগুলির তত্ত্ব তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উইলিয়াম শকলি রিসার্চ গ্রুপের সুপারভাইজার নিযুক্ত হলেন। তিনি বেছে বেছে উদীয়মান পদার্থবিজ্ঞানীদের নিয়ে এলেন নিজের গ্রুপে। জন বার্ডিন, ওয়াল্টার ব্র্যাটেইন , জেরাল্ড পিয়ারসন, মরগান স্পার্কস – প্রমুখ তরুণ বিজ্ঞানীদের নিয়ে এসেছিলেন তিনি তাঁর রিসার্চ গ্রুপে। 

সলিড স্টেট ফিজিক্সে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগ তখন শুরু হচ্ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উইলিয়াম শকলি রাডারের ডিটেক্টর হিসেবে জার্মেনিয়াম ও সিলিকন পয়েন্ট কন্টাক্ট ডিটেক্টর ব্যবহার করেছিলেন। এবার তিনি একইভাবে ফিল্ড ইফেক্ট ট্রানজিস্টর উদ্ভাবন করার চেষ্টা করলেন। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের হিসেব অনুসারে জার্মেনিয়াম ফিলামেন্টে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালনা করলে ভ্যাকুয়াম টিউবের গ্রিডের মতো বিদ্যুৎ প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হবার কথা। কিন্তু উইলিয়াম শকলি পরীক্ষাগারে আশানুরূপ ফল পেলেন না। শুধু তাই নয়, কেন আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন না তার কোন বিশ্বাসযোগ্য কারণও খুঁজে পেলেন না। 
 
শকলির পরীক্ষণের ব্যর্থতা থেকে  নতুন ধারণা পেলেন জন বার্ডিন। বার্ডিনের ব্যাখ্যা ছিল এরকম – জার্মেনিয়াম সেমিকন্ডাক্টরে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালনা করলে এর উপরিতলে কিছু ইলেকট্রন আটকে থাকে। এই আটকে থাকা ইলেকট্রনের কারণে বিদ্যুৎক্ষেত্রের মধ্যে রাখলেও ইলেকট্রন আর সেমিকন্ডাক্টর ক্রিস্টালে প্রবেশ করতে পারে না। এই ধারণার সত্যতা পরীক্ষা করে দেখার জন্য অনেকগুলি পরীক্ষণ ডিজাইন করা হলো বেল ল্যাবে। জন বার্ডিন আর ওয়াল্টার ব্র্যাটেইন এই পরীক্ষণগুলি করলেও উইলিয়াম শকলি সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। বার্ডিন ও ব্র্যাটেইন উদ্ভাবন করলেন প্রথম পয়েন্ট কন্টাক্ট ট্রানজিস্টর। 

উইলিয়াম শকলি যেমন প্রতিভাবান ছিলেন, তেমনি ভীষণ রকমের প্রশংসাপ্রিয় ছিলেন। যে কোনো কিছুতেই তিনি নিজের কৃতিত্ব দাবি করতেন। তাঁর রিসার্চ গ্রুপ থেকে প্রথম ট্রানজিস্টর উদ্ভাবিত হয়েছে – অথচ তার কৃতিত্বের ভাগ তিনি পাবেন না তা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। ট্রানজিস্টরের প্যাটেন্ট বার্ডিন ও ব্র্যাটেইনের নামে হবার পর সেটার পরীক্ষামূলক ব্যবহার যখন শুরু হলো তখন উইলিয়াম শকলি উদ্ভাবন করলেন জাংশান ট্রানজিস্টর। সেই ট্রানজিস্টরের প্যাটেন্ট পেলেন তিনি। 

১৯৫০ সালে উইলিয়াম শকলি লিখলেন তাঁর প্রথম বই ‘ইলেকট্রনস অ্যান্ড হোল্‌স ইন সেমিকন্ডাক্টরস’। এই বইটি সেই সময়ের সলিড স্টেট গবেষকরা বাইবেলের মতো ব্যবহার করতেন। ১৯৫১ সাল থেকে শুরু হলো ট্রানজিস্টরের উৎপাদন। ইলেকট্রনিক্সের জগতে বিপ্লব শুরু হয়ে গেল। 

এই বিপ্লবের অন্যতম নায়ক উইলিয়াম শকলি তাতে সন্দেহ ছিল না কারোরই। নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানী ধারণায় ভরপুর ছিলেন শকলি। প্রতি সপ্তাহে তিনি মিটিং ডেকে নতুন নতুন গবেষণার ফলাফল ঘোষণা করতেন। তিনি উৎসাহে টইটুম্বুর থাকতেন সবসময়।  উদ্ভাবক হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। নব্বইটির বেশি প্যাটেন্ট লাভ করেছিলেন তিনি। ১৯৫১ সালে মাত্র ৪১ বছর বয়সে তিনি আমেরিকার ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের ফেলো মনোনীত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সেই সময়ের সর্বকনিষ্ঠ ফেলো। 

গবেষণার বাইরে আরো অনেক বিষয়ে উৎসাহ ছিল তাঁর। জাদু দেখাতে পছন্দ করতেন, খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠার নেশা ছিল তাঁর। প্রচন্ড বেগে গাড়ি চালাতেন। গাড়িতে পিস্তল রাখতেন। সিনেমা দেখতেন এবং নিজেকে সিনেমার নায়ক ভাবতেন। নিজের ব্যাপারে এতটাই উচ্চধারণা পোষণ করতেন যে, বেশিরভাগ সময়েই তিনি তাঁর অধীনস্তদের কোন মতামতের দাম দিতেন না। এ নিয়ে বেল ল্যাবের বিজ্ঞানীদের সাথে মনোমালিন্য শুরু হয়ে গেলে তাঁর পক্ষে আর বেল ল্যাবে থাকা সহজ হলো না। 

১৯৫৫ সালে উইলিয়াম শকলি স্ট্যানফোর্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে স্থাপন করলেন নিজের কোম্পানি ‘শকলি সেমিকন্ডাক্টর ল্যাবরেটরিজ’। বেকম্যান ইন্সট্রমেন্ট কোম্পানি তাঁকে কারখানা স্থাপনের অর্থ জুগিয়েছিল। শকলির কোম্পানি ছিল পৃথিবীর প্রথম সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি। সেদিন কেউই ভাবতে পারেনি যে একদিন এই পথেই ঘটে যাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিল্প-বিপ্লব, এখানেই গড়ে উঠবে সিলিকন ভ্যালি। শকলির পরিকল্পনা ছিল উন্নতমানের গবেষণার পাশাপাশি প্রচুর সিলিকন ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী উৎপাদন করা। ১৯৫৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পাবার পর একেবারে প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের দলে উঠে এলেন শকলি। তবুও শেষরক্ষা হলো না। 

শকলি যতটা দক্ষ বিজ্ঞানী ছিলেন, ততটাই অদক্ষ ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত দুর্ব্যবহার ও অদক্ষতার কারণে কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর কোম্পানি থেকে তাঁর বেশিরভাগ বিজ্ঞানী বের হয়ে গেলেন। শকলির কোম্পানি থেকে বের হয়ে তাঁরা নিজেরা প্রতিষ্ঠা করলেন ফেয়ারচাইল্ড সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি। পরবর্তী বিশ বছরের মধ্যে এখান থেকেই তৈরি হয় ইন্টেল কর্পোরেশন, এডভান্সড মাইক্রো ডিভাইসেস (এ এম ডি) ইত্যাদি বিশাল শিল্পগোষ্ঠী। 

দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের হারিয়ে উইলিয়াম শকলির পক্ষে আর কারখানা চালানো সম্ভব হলো না। কয়েক বছরের মধ্যেই কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেল। ১৯৬৩ সালে উইলিয়াম শকলি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রফেসর হিসেবে। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে অধ্যাপনা করেছেন। 
কিন্তু তাঁর পেশাগত জীবনের শেষের দিকে তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণার বদলে তাঁর নিজস্ব কিছু উগ্র সাম্প্রদায়িক মতবাদ প্রতিষ্ঠার দিকে ঝুঁকে পড়লেন। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের মেধা এবং সক্ষমতার জন্য পরিবেশ ও সুযোগের চেয়েও বেশি দায়ী জন্মগত উত্তরাধিকার। তিনি প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেন – কৃষ্ণাঙ্গদের আই-কিউ অনেক কম, তারা আরো কম আই-কিউ সম্পন্ন শিশুর জন্ম দিচ্ছে। তাদেরকে সুযোগ সুবিধা দিলে সমাজের কোন উন্নতি হবে না, বরং সমাজ দ্রুত মেধাহীন হয়ে যাবে। 

তাঁর এরকম স্বভাবের কারণে দ্রুতই তিনি বন্ধুহীন হয়ে যেতে শুরু করলেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতিগুলি ম্লান হয়ে যেতে লাগলো। ১৯৩৩ সালে তিনি বিয়ে করেছিলেন জিন বেইলিকে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে তাঁদের। ১৯৫৫ সালে জিনকে ডিভোর্স দিয়ে তিনি আবার বিয়ে করেছিলেন এমি ল্যানিং-কে। জীবনের শেষের দিকে তাঁর ছেলেমেয়েরাও তাঁর সাথে ছিল না। কিন্তু যতই তিনি সমালোচিত হচ্ছিলেন ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছিলেন। তাঁর সাম্প্রদায়িক মতবাদকে নাৎসিদের মতবাদের সাথে তুলনা করে ১৯৮০ সালে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ‘আটলান্টা কনস্টিটিউশন’। শকলি এই পত্রিকার বিরুদ্ধে আদালতে সোয়া মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ দাবি করে মানহানির মামলা করেছিলেন। আদালত শকলির পক্ষে রায় দিয়ে মাত্র এক ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দিয়েছিল। ১৯৮২ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর হবার জন্য নির্বাচনে দাঁড়িয়ে আটজনের মধ্যে অষ্টম হয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালের ১২ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয় ক্যালিফোর্নিয়ায় নিজের বাড়িতে একা। 


তথ্যসূত্র
১। জোয়েল এন শুরকিন, ব্রোকেন জিনিয়াস, পলগ্রেভ ম্যাকমিলান, লন্ডন ২০০৮।
২। বো লোজেক, হিস্ট্রি অব সেমিকন্ডাক্টর ইঞ্জিনিয়ারিং, স্প্রিঙ্গার, জার্মানি ২০০৭।
৩। রজার পিয়ারসন, শকলি অন ইউজেনিক্স অ্যান্ড রেইস, স্কট-টাউনসেন্ড পাবলিশার্স, ওয়াশিংটন ডিসি, ১৯৯২। 
৪। ওয়ার্ল্ড বুক্‌স বায়োগ্রাফিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব সায়েন্টিস্টস, সপ্তম খন্ড, ওয়ার্ল্ড বুক, শিকাগো, ২০০৩। 
৫। www.nobelprize.org

--------------------

বিজ্ঞানচিন্তা মার্চ ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত





No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts