১১মে রিচার্ড ফাইনম্যানের জন্মদিন। ১৯১৮ সালের ১১ মে নিউ ইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ডায়নামিক পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান। এম-আই-টি থেকে বিএসসি ডিগ্রি পান ১৯৩৯ সালে। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ১৯৪২ সালে। কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত। তারপর ১৯৫০ থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ক্যালটেকে অধ্যাপনা করেছেন। কোয়ান্টাম ইলেকট্রো-ডায়নামিক্স এর অন্যতম জনক তিনি। ১৯৬৫ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন যে কাজের জন্য - মাত্র তেইশ বছর বয়সেই সে কাজের সূত্রপাত। পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক প্রকল্প - ম্যানহাটান প্রজেক্টের হিউম্যান-কম্পিউটার হিসেবে কাজ করেছেন ফাইনম্যান। যে ন্যানো-টেকনোলজির প্রয়োগ এখন ওষুধ থেকে শুরু করে জীবনের হাজারো ক্ষেত্রে সেই ন্যানো-টেকনোলজির প্রাথমিক ধারণার উৎপত্তি ফাইনম্যানের হাতে। মৌলিক কণার কার্যকলাপ বোঝার জন্য ফাইনম্যান-ডায়াগ্রাম সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি। পদার্থবিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যেখানে ফাইনম্যান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেননি। পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ফাইনম্যানের মত এমন ভালো শিক্ষক আর কখনো পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে ক্লাসিক টেক্সট বইয়ের নাম ‘ফাইনম্যান লেকচার অন ফিজিক্স’ যা রচিত হয়েছে তাঁর ক্যালটেকের ক্লাসরুমে দেয়া লেকচারগুলো থেকে। আইনস্টাইনের পরে ফাইনম্যানই ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে সৃষ্টিশীল বহুমাত্রিক পদার্থবিজ্ঞানী। ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হয় ফাইনম্যানের।
রিচার্ড ফাইনম্যানের এই সংক্ষিপ্ত জীবনকথা আজ আমরা সবাই জানি। এখন যারা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়ছে, আমি জানি তাদের মধ্যে রিচার্ড ফাইনম্যানের নাম শোনেনি এমন একজনও নেই। তাদের মধ্যে অনেকেই ‘ফাইনম্যান লেকচার অন ফিজিক্স’ পড়ে ফিজিক্স শিখছে। আমার অনুজা সতীর্থ আশরাফি নিতু রিচার্ড ফাইনম্যানের ‘সিক্স ইজি পিসেস’ অনুবাদ করে প্রকাশ করেছে তার ছাত্রাবস্থায়। আরেক অনুজ উচ্ছ্বাস তৌসিফও স্বতন্ত্রভাবে অনুবাদ করেছে এই বই। অনেকগুলি মুদ্রণ হয়েছে এই বইয়ের। বাংলা ভাষায় রিচার্ড ফাইনম্যানের অন্যান্য বইও অনুদিত হচ্ছে। রিচার্ড ফাইনম্যান বাংলাদেশেও এখন খুবই জনপ্রিয়।
কিন্তু আমার অনুজ সতীর্থদের কাছে এখন অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্যি যে আমাদের সময়ে আমাদের শিক্ষকরা একবারও রিচার্ড ফাইনম্যানের নাম উচ্চারণ করেননি আমাদের ক্লাসে। রিচার্ড ফাইনম্যানের বই এবং কাজের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে দেশের বাইরে পড়তে এসে। ফাইনম্যানের আশ্চর্য বিজ্ঞান ও ব্যক্তিত্বে যতই মুগ্ধ হয়েছি – ততই আফসোস হয়েছে – আগে কেন জানিনি তাঁর সম্পর্কে। কেমন যেন একটা ক্ষোভ জন্মেছিল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সেই সময় সিলেবাসের বাইরে অনেক কথা বলতেন – সেগুলির বেশিরভাগই ছিল হয় রাজনীতি, নয় ধর্ম সম্পর্কে। অথচ বিজ্ঞানীদের কাজকর্ম সম্পর্কে ধরতে গেলে কিছুই থাকতো না। সবচেয়ে আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে – আমরা যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই, ফাইনম্যান তখনো বেঁচে ছিলেন। সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর খবরও কোন গুরুত্ব পায়নি আমাদের ডিপার্টমেন্টের কারো কাছে। তখন হয়তো যোগাযোগের এত সুবিধা ছিল না। তাই এখনকার শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার কিছুটা ঈর্ষাও কাজ করে – কত্তো বেশি জানার সুযোগ এখন তাদের আছে!
কিন্তু এখন যখন দেখি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পুরোটাই তথ্য এবং তত্ত্ব মুখস্থ করার শিকলে আবদ্ধ হয়ে গেছে খুবই কষ্ট লাগে। আধুনিক প্রযুক্তির কী সাংঘাতিক অপচয় ঘটছে সেখানে। পদার্থবিজ্ঞানের জটিল সমীকরণগুলি, ধ্রুবকগুলির মান এখনো পরীক্ষায় মুখস্থ লিখতে হয়। অথচ তথ্য মুখস্থ করার মধ্যে যে কোন বিজ্ঞান তো দূরের কথা – জ্ঞানই অর্জিত হয় না – তা ফাইনম্যান নিজের ছোটবেলার অভিজ্ঞতার উদাহরণ দিয়ে লিখে গেছেন।
The making of a scientist প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “আমার বাবা পাখি সম্পর্কে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। তিনি বলেছেন- “দেখেছো পাখিটা? এটা হলো স্পেন্সার’স ওয়ার্বলার”। আমি জানতাম যে পাখিটার আসল নাম তিনি জানেন না। বাবা বললেন- “ইতালিয়ান ভাষায় এটা হলো ছুট্টু ল্যাপিটিডা। পর্তুগিজ ভাষায় বম ডা পেইডা। চায়নিজরা বলে চুং-লং-তা। জাপানিরা বলে কাতানো তেকেদা। এভাবে পৃথিবীর সবগুলো ভাষায় তুমি এই পাখিটার নাম জানতে পারো। কিন্তু এই নাম মুখস্ত করা যখন শেষ হবে - তখন? দেখবে পাখিটা সম্পর্কে তুমি কিছুই জানো না। তুমি আসলে জেনেছো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ পাখিটাকে কী নামে ডাকে।“
আজ ফাইনম্যানের জন্মদিনে আশা করছি – অদূর ভবিষ্যতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে বদলে যাবে। আমাদের দেশেও ফাইনম্যানের মতো বিজ্ঞানী তৈরি হবার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
No comments:
Post a Comment