Thursday, 15 June 2023

রিচার্ড ডকিন্সের সাথে একটি সন্ধ্যা


 [শুক্রবার ১৭/২/২০২৩ সন্ধ্যে ৭টা ৩০]


আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় – বিজ্ঞানের মতো সস্তা জিনিস আর নেই। এতটাই সস্তা যে পরীক্ষায় পাসের জন্য কোচিং সেন্টার ছাড়া বিজ্ঞানের জন্য আর কোথাও এক পয়সাও খরচ করতে রাজি নয় বেশিরভাগ মানুষ। নোরাহ ফাতেহির পনের মিনিট নাচ দেখার জন্য পনের হাজার টাকার টিকেট কেনার লোকের অভাব নেই, কিন্তু  বিনামূল্যেও বিজ্ঞান-বক্তৃতা শোনার জন্য লোক পাওয়া যায় না আমাদের দেশে।

তবে কিছু কিছু দেশে কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য নয়। যেমন ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী ও জনপ্রিয় লেখক ব্রায়ান কক্স-এর এক ঘন্টার একটি বিজ্ঞান বক্তৃতার টিকেটের দাম দু’শ থেকে পাঁচশ ডলার।  জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এরকম জনপ্রিয় বাগ্মী আছেন, যেমন রিচার্ড ডকিন্স, বিল ব্রাইসন, নীল টাইসন – যাদের কথা শোনার জন্য অনেক টাকার টিকেট কিনে জ্ঞানপিপাসু লোক ভীড় জমায়, বিশাল বিশাল কনভেনশান সেন্টার কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। এরকম দৃশ্য দেখে আনন্দ হয়, পাশাপাশি কষ্টও হয়। কষ্ট হয় এই কারণে যে জামাল নজরুল ইসলাম স্যার যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার বক্তৃতা দিতেন – তখন সায়েন্স ফ্যাকাল্টির গ্যালারির তিন ভাগের একভাগও পূর্ণ হতো না। অথচ সায়েন্স ফ্যাকাল্টির যেকোনো একটা সাবজেক্টে ভর্তি হবার জন্য কী পরিমাণ যুদ্ধ সবাই করে। 

সে যাই হোক, মূল কথায় আসি। রিচার্ড ডকিন্সের বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলাম। টিকেট কেনার সময় বেশ মজাই লাগছিল এই কারণে যে মেলবোর্নে অমিতাভ বচ্চনের বক্তৃতা শোনার জন্য যত ডলারের টিকেট লেগেছিল – রিচার্ড ডকিন্সের জন্য লাগলো তার দ্বিগুণেরও বেশি। 

রিচার্ড ডকিন্সকে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় বিবর্তন-জীববিজ্ঞানী বলা যায়। এই বিরাশি বছর বয়সেও পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে – লন্ডন – কানাডা – আমেরিকা – অস্ট্রেলিয়া - নিউজিল্যান্ড – দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বিশ্বের কোনো না কোনো শহরে তাঁর বিজ্ঞানবক্তৃতা থাকে। প্রতিটি বক্তৃতার জন্য তিনি পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ ডলার পর্যন্ত সম্মানী নেন। টিকেটের মূল্য থেকে এত আয় হয় যে আয়োজকদের গায়েই লাগে না। সাম্প্রদায়িকতামুক্ত যুক্তিবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রিচার্ড  ডকিন্স একটি ফাউন্ডেশান প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইগুলির রয়্যালটি এবং বিজ্ঞান-বক্তৃতা থেকে তিনি প্রতি বছর যে কয়েক মিলিয়ন ডলারের উপরে উপার্জন করেন তার পুরোটাই এই ফাউন্ডেশানে দিয়ে দেন। 




ভেবেছিলাম তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঝাঁঝালো ধর্মবিরোধী বক্তৃতা দেবেন তিনি। কিন্তু প্রোগ্রামের ফরম্যাট ছিল কথোপকথন। অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত আরেকজন পৃথিবীবিখ্যাত দার্শনিক প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োএথিক্সের অধ্যাপক পিটার সিঙ্গার এবং রিচার্ড ডকিন্সের কথোপকথন। পিটার সিঙ্গারের দর্শনের সবকিছুর সাথে আমি পুরোপুরি একমত না হলেও কিছু কিছু ব্যাপারে ভীষণ একমত। তিনি কম কাজে বেশি ইমপ্যাক্টে বিশ্বাসী। যেমন একজন অন্ধ মানুষকে একটি গাইড ডগ দিতে  – গাইড ডগের ট্রেনিংসহ সবকিছু মিলিয়ে কমপক্ষে চল্লিশ হাজার ডলার খরচ হয়। সেক্ষেত্রে চল্লিশ হাজার ডলার দিয়ে শুধুমাত্র একজন অন্ধ মানুষকে সহায়তা করা যায়। অথচ যদি অন্ধদের চোখ পরীক্ষা করে বোঝা যায় যে অপারেশান করলে চোখ ভালো হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে তাহলে চল্লিশ হাজার ডলার দিয়ে এরকম বিশ জন মানুষের চোখ ভালো করে দেয়া যায়। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও মানুষের জন্য করতে চাইলে অনেক কিছু করা যায়। অথচ আমরা এরকমও দেখি – আর্তজনকে দশ হাজার টাকা দেয়ার জন্য লাখ টাকা খরচ করে অনুষ্ঠান করা হয়, অতিথিদের বহুমূল্য ক্রেস্ট দেয়া হয়, লম্বা লম্বা বক্তৃতা দেয়া হয়। 

পিটার সিঙ্গার আর রিচার্ড ডকিন্স ঘন্টাখানেক কথা বললেন মানুষের বিভিন্ন মানবিক গুণাবলির উৎকর্ষ সাধনে কী কী করা যায় সেসব নিয়ে। দর্শকদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যা বেশি। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরি করতে পারা যে সভ্যতার লক্ষণ, এবং সেক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে একটা বিরাট দায়িত্ব থাকে – তা অনস্বীকার্য। 

আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি কি সেই দায়িত্ব পালন করতে পারছে? মোসায়েবি করা কি জ্ঞানের পর্যায়ে পড়ে? 


No comments:

Post a Comment

Latest Post

R. K. Narayan's 'The Grandmother's Tale'

There are many Indian authors in English literature. Several of their books sell hundreds of thousands of copies within weeks of publication...

Popular Posts