বিজ্ঞানচিন্তা জুন ২০২৩
সপ্তম বর্ষ, সংখ্যা ৯
মহাবিশ্বের রহস্য আমরা এপর্যন্ত যতটুকু জানতে পেরেছি তারচেয়ে এখনো অনেক কম জানি পৃথিবীর মহাসাগরগুলির গভীর পানির নিচে লুকিয়ে থাকা প্রাণিদের সম্পর্কে। এই ব্যাপারটিকে সামনে রেখে বিজ্ঞানচিন্তার জুন সংখ্যার প্রধান বিষয় নির্বাচন করা হয়েছে – সাগর তলের রহস্য। সাগরতলের অনেক অজানা তথ্যসমৃদ্ধ সাতটি রচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই সংখ্যায়।
বিজ্ঞানচিন্তার ডাকবাক্সে প্রকাশিত পাঠকদের চিঠিগুলি খুব উৎসাহব্যঞ্জক। আমি নিশ্চিত প্রতিমাসে অনেক চিঠি আসে বিজ্ঞানচিন্তার দপ্তরে। পাঠকরা বিজ্ঞানচিন্তা পড়ে যে ভালোলাগার অনুভূতি ব্যক্ত করে তা বিজ্ঞানচিন্তার সাথে যারা যুক্ত আছেন – প্রত্যেককেই আনন্দ দেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যেমন ইবনাতের চিঠিতে যখন জানতে পারি তার মা বলছেন, শুধুমাত্র স্কুলের বই পড়ার পাশাপাশি বিজ্ঞানমনস্ক হবার প্রয়োজনীয়তার কথা – বেশ ভালো লাগলো। পড়াশোনা শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাস করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে তা খুব একটা কাজে আসে না। এই ব্যাপারটি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকরাও যে ক্রমশ বুঝতে পারছেন তা বেশ আশা জাগানিয়া।
আহসান হাবীবের বিজ্ঞানরম্য “বিজ্ঞান পরীক্ষা” বরাবরের মতোই মজার। তবে বর্তমানে স্কুলের বিজ্ঞানপরীক্ষা কি আসলেই এত কঠিন যে সবাই বিজ্ঞান পরীক্ষায় ফেল করছে?
রোমেন রায়হানের বিজ্ঞান ছড়া ‘লাল আটার রুটি’ ছন্দোবদ্ধ স্বাস্থ্যকর মুচমুচে মজার।
কাজী আকাশের গ্রন্থণায় ‘সাত সমুদ্র পরিচয়’ অল্পশব্দে পৃথিবীর ম্যাপের উপর সাতটি সমুদ্রের অবস্থান ও ব্যাপ্তির চমৎকার উপস্থাপন।
সমুদ্রের বিভিন্ন গভীরতায় অত্যাশ্চর্য বাস্তব সামুদ্রিক প্রাণিদের অবস্থান, বিবর্তন ও পারিপার্শ্বিক সামুদ্রিক পরিবেশ নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন উচ্ছ্বাস তৌসিফ তাঁর “নীল সমুদ্রের অপার রহস্য” রচনায়। লেখার সাথে ছবিগুলিও চমৎকার।
কাজী আকাশের আরেকটি গ্রন্থণা “সমুদ্রের গভীরে জীবন” মহাসাগরের উপরের স্তর থেকে শুরু করে গভীরতম স্থান পর্যন্ত পর্যাক্রমিকভাবে সামুদ্রিক প্রাণিদের স্তরগত অবস্থান বর্ণনা করেছে।
এই সংখ্যার অন্যতম আকর্ষণ বিজ্ঞানী দীপেন ভট্টাচার্যর রচনা ‘বঙ্গীয় বদ্বীপের সূচনা’। তিরিশ কোটি বছর আগে যে প্রাকৃতিক বিবর্তন শুরু হয়েছিল – সেই ভৌগোলিক বিবর্তনের ফসল আমাদের এই অঞ্চলের অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটগুলির অবস্থান পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের বিন্যাস গভীরতা প্রভৃতি বদলেছে একটু একটু। লেখক অনেকগুলি ম্যাপ এবং রেখাচিত্রের সাহায্যে দেখিয়েছেন কীভাবে কী হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় আমাদের স্কুলশিক্ষার্থী বন্ধুদের হয়তো একাধিকবার পড়তে হবে। কিন্তু একবার আয়ত্বে এসে গেলে প্রাকৃতিক বিবর্তনের ধারাটি বুঝতে কষ্ট হবে না। এই রচনায় ম্যাপ এবং অন্যান্য তথ্যের সুনির্দিষ্ট রেফারেন্স উল্লেখ করা আছে রচনার টেক্সটে। কিন্তু রচনার শেষে রেফারেন্সের তালিকাটি ছাপানো হয়নি সম্ভবত স্থানাভাবে। কিন্তু বিজ্ঞানরচনার ক্ষেত্রে আমার মনে হয় রেফারেন্সকে অবহেলা করা উচিত নয় কিছুতেই। আগ্রহী পাঠক অনেক সময়েই আরো বিস্তারিত জানার জন্য সেইসব রেফারেন্স খুঁজে দেখতে চান।
বাংলাদেশের প্রবালদ্বীপ ‘সেন্ট মার্টিনের প্রাণবৈচিত্র্য’ সম্পর্কে চমৎকার লিখেছেন অধ্যাপক কাজী আহসান হাবীব। আমাদের নিজেদের সাগরেই এত বিচিত্র সব সামুদ্রিক প্রাণির বাস – যা আমরা অনেকেই জানি না।
আবদুল্লাহ আল মাকসুদের ‘প্রবাল প্রাচীরে জীবন’ রচনায় অল্পশব্দে চমৎকার রঙিন ছবির মাধ্যমে ফুটে উঠেছে কীভাবে প্রবাল তৈরি হয়, এবং কীভাবে টিকে থাকে বছরে পর বছর।
প্রচন্ড গরমে যখন আমরা হাসফাস করছি বাংলাদেশসহ আরো অনেক দেশে – তখন উচ্ছ্বাস তৌসিফ চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন ‘এল নিনো কী’।
পাঠকদের জন্য চমৎকার বোনাস হিসেবে কাজ করে বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আবদুল কাইয়ুমের বিজ্ঞান কমিক ‘কী ও কেন’। এবারের আকর্ষণ চাঁদ থেকে পৃথিবীর উদয়-অস্ত দেখা যাবে কি না।
মহাকর্ষ তরঙ্গের বেগ সম্পর্কিত আব্দুল্ল্যাহ আদিল মাহমুদের রচনাটি চিত্তাকর্ষক। মহাকর্ষ তরঙ্গের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন রেইনার ওয়েইস, ব্যারি ব্যারিশ এবং কিপ থোর্ন ২০১৭ সালে। রচনায় তাঁদের ব্যবহৃত লাইগো পরীক্ষার ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু তাঁদের নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির তথ্যটুকু বাদ গেছে। ছবিগুলির ক্যাপশান এবং লেবেল যখন ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয় – তখন আরেকটু সতর্কতার দরকার আছে, বিশেষ করে শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে। যেমন লাইগোর ছবিতে এক জায়গায় লেখা হয়েছে ‘আলোক তরঙ্গ বাড়ি খেয়ে ফিরে আসে’। বাড়ি খেয়ে শব্দটা কি এখানে যথাশব্দ?
এনরিকো ফার্মির নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির ঘটনা খুব চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন আবুল বাসার তাঁর “পোপ অব ফিজিক্স” রচনায়। এই নামে ফার্মির একটি জীবনী আছে। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে ফার্মির অবদান সংক্ষেপে বলা সম্ভব নয়। বিটা ক্ষয়ের তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে তাঁর হাতে। ফার্মির জীবন ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত এই রচনা শুধু বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের ইতিহাসও বটে।
ডিউক জনের বিজ্ঞান কল্পগল্প ‘গ্রহান্তরের দুঃস্বপ্ন’ ভয়ংকর। গল্পের স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় মনে হচ্ছে এটি রুপান্তরিত গল্প। যদি অনুবাদ করা হয়ে থাকে – অনুবাদকের নাম নেই।
আমাদের হাতেই বিলুপ্ত হতে বসেছে অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ। সাতটি বিলুপ্ত উদ্ভিদ এবং আরো বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ সম্পর্কিত ইফতেখার মাহমুদের প্রতিবেদনটি অত্যন্ত দরকারি একটি প্রতিবেদন।
বাংলাদেশে লিচু খেয়ে শিশুমৃত্যুর খবর আমরা মাঝেমধ্যেই পাই। জাভেদ ইকবাল তাঁর রচনায় ব্যাখ্যা করেছেন খালি পেটে লিচু খেলে মাঝে মাঝে কেন প্রাণসংশয়ী প্রতিক্রিয়া হতে পারে এবং কী কী সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার।
বাংলাদেশের করোনা রোগীদের উপর গবেষণা করে অস্বাভাবিক ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করেছেন প্রফেসর আদনান মান্নানের গবেষকদল। তাঁদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ফ্রন্টিয়ার্স ইন মেডিসিন জার্নালে। প্রফেসর আদনান মান্নানের রচনায় এসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের সম্পূর্ণ রেফারেন্স থাকলে উৎসাহী পাঠক প্রবন্ধটি পড়ে দেখতে পারতেন।
চিকিৎসাপ্রযুক্তির ভবিষ্যত এখন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ন্যানোটেকনোলজির দিকে যাচ্ছে। মাইক্রোরোবট সংক্রান্ত রচনায় সেই প্রযুক্তি ব্যাখ্যা করেছেন রিফাত আহমেদ।
এই সংখ্যার সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়েছে – বাংলার আইনস্টাইন নামে পরিচিত বিজ্ঞানী অমলকুমার রায়চৌধুরির জীবন ও কর্মের উপর একটি রচনা এই সংখ্যায় আছে। কিন্তু রচনাটি এই সংখ্যায় নেই। এতে পাঠক হয়তো একটু বিভ্রান্ত হতে পারেন।
বিজ্ঞানচিন্তার সম্পূর্ণ রঙিন ছবিগুলির পরিস্ফুটন এতটাই সুন্দর যে তার জন্য আলাদা ধন্যবাদ পেতে পারেন এর দায়িত্বে যারা আছেন তাঁরা।
No comments:
Post a Comment