লেখক: Pauline Harmange
ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ: Natasha Lehrer
প্রকাশক: 4th State London
প্রকাশকাল: 2020, 2022.
পৃষ্ঠাসংখ্যা: 99
পলিন হামাঞ্জের জন্ম ১৯৯৪ সালে ফ্রান্সে |
তরুণ ফরাসী উগ্র নারীবাদী লেখক পলিন হামঞ্জ (Pauline Harmange – ফরাসি উচ্চারণ আমার আসে না, অনলাইনে কয়েকবার শুনে মনে হলো এরকমই কিছু বলা হয়েছে) কিংবা ইংরেজি উচ্চারণে পলিন হারমান্জ-এর নাম আমি আগে কখনো শুনিনি। অবশ্য শোনার কথাও নয়। নারীবিজ্ঞানীদের ব্যাপারে সামান্য খোঁজখবর রাখলেও, উগ্র নারীবাদীদের ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই। কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ কিংবা নীতি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে প্রবর্তিত সমাজবাদ, ভক্তিবাদ, যুক্তিবাদের মতোই নারীবাদেও অনেক ভালো ভালো ব্যাপার আছে। কিন্তু যখনই কোন মতবাদে উগ্রতা যুক্ত হয় – তখন তা যত বড় আদর্শই হোক – বাদ দিতে ইচ্ছে করে।
বইয়ের নাম “I Hate Men” দেখে বেশ অবাক হয়েই বইটি কিনেছি। নারীবাদীরা পুরুষদের ইচ্ছেমতো গালাগালি দিয়ে অনেক বইপত্র লিখে থাকেন। ডেইল ডিয়ানা সোয়ার্জ-এর চূড়ান্ত গালিময় একটি বই আছে “All Men Are Jerks” অবশ্য সেখানেও একটি স্টারমার্ক দিয়ে কিছুটা নমনীয় ভাব দেখানো হয়েছে “until proven otherwise” বলে। কিন্তু একেবারে সরাসরি সমগ্র পুরুষজাতিকে ঘৃণা করে “I Hate Men” নাম দিয়ে আর কোনো বই আগে লেখা হয়নি। পুরো অ্যামাজন ঘেঁটেও এরকম কোনো বই পাইনি। পুরুষরা নারীদের উপর একটা তীব্র যন্ত্রণাময় ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে সেটা বহুল প্রচারিত এবং প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু পুরুষরা এখনো “I Hate Women” নামে কোন বই লেখেনি। সেক্ষেত্রে “I Hate Men” নিসন্দেহে অগ্রদূত।
সব ঘৃণার উল্টোপিঠেই ভালোবাসা থাকে এরকম একটা আপ্তবাক্য ঘুরে বেড়ায় প্রেমিক-মনের অন্দরে। আমারও বিশ্বাস ছিল এই বইটিতে ঠাঁসবুনোট ঘৃণার পাশাপাশি না হোক, কোনো এক কোণায় হলেও কিঞ্চিৎ ভালোবাসার আভাস থাকবে ভালোবাসা পাবার যোগ্য মানুষদের জন্য। কিন্তু না, লেখক বইয়ের তৃতীয় পৃষ্ঠাতেই পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, “I hate men. All of them, really? Yes, the whole lot of them. By default, I have very little respect for any of them.”
লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন, তিনি উভয়কামী,এবং একজন পুরুষকে বিয়ে করে বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ঘরও করছেন। তাঁর নিজের স্বীকারোক্তিতেই পরিষ্কার যে তিনি তাঁর পুরুষ স্বামীকেও ঘৃণা করেন। ঘৃণা করেন, অথচ ছেড়ে দিচ্ছেন না। আবার এক বা একাধিক নারীর সাথেও তাঁর প্রেম কিংবা কামের সম্পর্ক। এরকম সম্পর্কের জোড়াতালি নিয়ে তিনি এত জোরের সাথে পৃথিবীর সমস্ত পুরুষের প্রতি ঘৃণা উগরে দিচ্ছেন। যুক্তি কী? পুরো বইতে কোনও একটা নতুন যুক্তি নেই – যা গত শত বছর ধরে নারীবাদীরা পুরুষদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেননি।
বইটি খুব একটা বড় নয়। মাত্র নব্বই পৃষ্ঠা – তাও ছোট্ট পুস্তিকার আকারে ছাপানো হয়েছে লন্ডনের বিখ্যাত প্রকাশনী ফোর্থ স্টেট থেকে। স্বাভাবিক বইয়ের আকারে ছাপানো হলে পঞ্চাশ পৃষ্টার বেশি হবে না।
এই বইতে লেখক মিসোজিনি বা নারীবিদ্বেষ এর অনুকরণে মিস্যানড্রি (misandry) বা পুরুষবিদ্বেষ প্রতিষ্ঠা করার উপর খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। পুরুষদের ঘৃণা করলেও তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন, “We don’t injure or kill men, we don’t prevent them from getting a job or following whatever their passion is, or dressing as they wish, or walking down the street after dark, or expressing themselves however they see fit.” (পৃষ্ঠা ৩৮)। অর্থাৎ পুরুষদের প্রতি এই ঘৃণা পুরোপুরি অহিংস। এই ঘৃণার বশবর্তী হয়ে তিনি পুরুষদের আহত কিংবা নিহত করছেন না, চাকরি পেতে বাধা দিচ্ছেন না, স্বপ্নপূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন না, পোশাক কিংবা চলন কিংবা বচন - কোথাও কোনো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছেন না। কেবল নির্ভেজাল ঘৃণাই করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো তাতে কী অর্জিত হবে? পুরুষরা তাতে বদলে যাবে? বদলালেও তো ঘৃণ্য পুরুষই থাকবে!
চাকরিক্ষেত্রে নারীদের প্রতি বৈষম্য এখনো অনেক ক্ষেত্রেই রয়ে গেছে। কিন্তু অনেক দেশেই এই বৈষম্য কমানোর ব্যাপারে কাজ চলছে। লেখকের নিজের দেশ ফ্রান্সে এই বৈষম্য উন্নয়নশীল অনেক দেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থেকে কম। তবুও তিনি তেমন কোন পরিসংখ্যানের উল্লেখ ছাড়াই দাবি করেছেন চাকরিক্ষেত্রে সব অযোগ্য মাঝারি মেধার শ্বেতাঙ্গ পুরুষরাই দখল করে আছে সবগুলি পদ। মেয়েরা যেখানে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে যোগ্য মনে না করলে দরখাস্তই করে না কোন চাকরিতে – সেখানে শ্বেতাঙ্গ পুরুষরা নিজের অযোগ্যতা নিয়েই নির্লজ্জভাবে চাকরি দখল করছে। এই ব্যাপারটা প্রমাণ করতে হলে নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান দরকার। যা এই বইয়ের কোথাও নেই।
পলিন হামাঞ্জ |
লেখক মনে করছেন নারী যে পুরুষকে ভালোবাসে, বিয়ে করে, পারস্পরিক শারীরিক আকর্ষণ – সবকিছুই একটা ফাঁদ। কিন্তু এই ফাঁদটি কে পেতেছে সে ব্যাপারে লেখক কোন প্রশ্ন করেন না। প্রকৃতি যদি এই ফাঁদ পেতে থাকে – প্রকৃতিও কি পুরুষ? পল ডোলানের ‘হ্যাপি এভার আফটার’ বইয়ের সূত্র ধরে লেখক দাবি করছেন যে নিসন্তান একা নারীরাই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখি। পৃথিবীর সব নারী কি এই কথা মেনে নেবেন? লেখক নিজের ব্যক্তিগত বিশ্বাস প্রায়ই অন্যদের নামে চালিয়ে দিয়েছেন বইয়ের সর্বত্র। এই বইটি নারীবাদকে কোনোভাবেই সাহায্য করবে বলে আমার মনে হয় না।
ভালোবাসার চেয়ে ঘৃণার কাটতি যে বেশি তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এটা কোন সভ্য সমাজের কাঙ্খিত প্রতিফলন হতে পারে না। তবুও মেনে নিতে নিতে অবস্থা এমন হয়েছে যে এই অনাকাঙ্খিত ফলাফল দেখে আমাদের সভ্য-ভ্রু যতটা কুঞ্চিত হবার কথা, ততটা এখন আর হয় না। ভালোবাসা-ঘৃণা-আনন্দ-বেদনা-প্রেম-ঈর্ষা-মিলন-বিরহ এরকম যত মানবিক বোধ আছে সেগুলি নিয়েই মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের বীজ-চারা-বৃক্ষ-ডালপালা। সাহিত্যের মূল উপাদানই হলো মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক। সেখানে ঘৃণার স্থান যে একেবারে নেই – তা নয়। যে কোনো মানুষিক সমাজে যেখানে ভালোবাসায় বসতি – সেখানে নানা টানাপোড়েনে ঘৃণাও উঁকিঝুঁকি দেয়। কিন্তু প্রকাশ্যে কোনো একটি নির্দিষ্ট জাতির প্রতি উদ্যত ঘৃণার ঘোষণা – শিল্প-সাহিত্য কিংবা সভ্য সমাজের কোথাও গ্রহণযোগ্য নয়। নির্দ্বিধায় একটি জাতির সবাইকে ঘৃণা করার সদম্ভ-ঘোষণাকে মেনে নেয়াকে আর যাই হোক – সহনশীলতা বলা চলে না। কিন্তু বাকস্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে যখন কেউ সরাসরি “I Hate Men” নামে বই লিখে পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দেন যে শুধুমাত্র পুরুষ হয়ে জন্ম নেয়ার কারণেই সব পুরুষই ঘৃণ্য – তখন কি মেনে নেয়া যায়? যদি মেনে নিতে হয় – তাহলে কাল কেউ যদি সরাসরি ধর্মভিত্তিক, বর্ণভিত্তিক ঘৃণা প্রকাশ করে তাও মেনে নিতে হবে।
এই বইটির ঘৃণানির্দেশক নামই হলো এর বাণিজ্যিক সাফল্যের মাপকাঠি। ২০২০ সালে ফ্রান্সের ছোট্ট একটা প্রকাশনী থেকে বইটি যখন বের হয় ফরাসি ভাষায়, সাড়ে চারশ কপি ছাপানো হয়েছিল। ওগুলি বিক্রি করতে পারলেই প্রকাশক খুশি হয়ে যেতেন। কিন্তু কলকাঠি নড়লো অন্য জায়গা থেকে। বইয়ের আপত্তিকর শিরোনাম দেখে ফরাসি সরকারের লিঙ্গ-সমতা বিভাগ থেকে আপত্তি জানানো হলো। প্রকাশককে নোটিশ পাঠানো হলো যে এই বইয়ের নাম গ্রহণযোগ্য নয়। ফ্রান্সে সহজে কোন বই নিষিদ্ধ করা যায় না। কিন্তু প্রকাশক জানেন নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই মানুষের আকর্ষণ বেশি। তিনি প্রচার করে দিলেন যে বইটি নিষিদ্ধ হতে পারে। তাতেই বইয়ের কাটতি বেড়ে গেল। ধাঁই করে তিনি আড়াই হাজার কপি ছাপিয়ে ফেললেন। বিক্রি হয়ে গেল হু হু করে। ছোট্ট প্রকাশক এবার বইটি বড় প্রকাশককে দিয়ে দিলেন। ইংরেজিসহ আরো আঠারোটি ভাষায় অনুবাদ করা হলো। বিখ্যাত হয়ে গেলেন লেখক পলিন হামাঞ্জ। বক্তব্য সারবস্তু থাকুক না থাকুক, অন্তসারশূন্য বিতর্কের ঝড় তুলতে পারলেই তো হয়ে গেলো। এখানেও তাই হয়েছে।
১১/৬/২০২৩
No comments:
Post a Comment