Saturday, 14 October 2023

সাগরতলে অভিযান




ছোটবেলায় আমরা যখন রুপকথার পাতালপুরীর রহস্যময় জগতের কথা পড়েছি তখন হয়তো ভেবে দেখিনি যে পাতাল বলতে আসলে আমরা কী বুঝি। আকাশ যেরকম আমাদের  উর্ধ্বদিকের দৃষ্টিসীমা নির্দেশ করে, সেরকমই পাতাল কি আমাদের পৃথিবীর নিম্নদিকের সীমানা? বড় হতে হতে আমরা জানলাম অন্যান্য সব গ্রহ-নক্ষত্রের মতোই পৃথিবী মহাশূন্যে ভাসমান সামান্য একটি গোলাকার গ্রহ। এই ভাসমান পৃথিবী মানুষ এবং অন্য সব প্রাণি, উদ্ভিদ সবকিছু নিজের পিঠের উপর নিয়েই প্রচন্ড বেগে ঘুরছে এবং ঘুরতে ঘুরতেই ঘুরে আসছে সূর্যের চারপাশে নির্দিষ্ট নিয়মে অবিরাম। আমরা বুঝলাম - পাতাল খুঁজে বের করতে হলে আমাদের পৃথিবী খুঁড়ে ঢুকতে হবে তার ভেতরে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি কাজে লাগিয়ে মানুষ ইতোমধ্যেই আকাশ জয় করে ফেলেছে। আকাশপথে ভ্রমণ এখন কোন সমস্যাই নয়। পৃথিবী ছাড়িয়ে আকাশযান চলে গেছে সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে মহাশূন্যের অন্যান্য সব নক্ষত্রলোকের দিকে মহাবিশ্বের অজানা জ্ঞান অনুসন্ধানে। চাঁদের পিঠে হেঁটে এসেছে পৃথিবীর বারোজন মানুষ। চাঁদে বসতি গড়ার কথা হচ্ছে, চেষ্টা চলছে মঙ্গল গ্রহে যাবার। পৃথিবীতে আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম চালানোর জন্য পৃথিবীর বাইরে স্থাপন করা হয়েছে শতাধিক স্যাটেলাইট – যেগুলি সারাক্ষণ পৃথিবীর উপর নজরদারি করছে। পৃথিবীর স্থলভাগের এমন কোনো জায়গা আর অবশিষ্ট নেই – যেখানকার কোন ছবি তোলা হয়নি। শুধু মাটির উপরিভাগ নয়, মাটির গভীরেও চলছে মানুষের অনুসন্ধান। মানুষ মাটি খুঁড়ে বের করে ফেলেছে তেল, গ্যাস, সোনা, রূপা, হীরা, তামা, কয়লাসহ প্রয়োজনীয় অনেককিছু। ভূস্তরের শত শত মিটার নিচ থেকে তুলে আনছে  বিশুদ্ধ পানি – পান করার জন্য, শুকনো মৌসুমে চাষ করার জন্য। কিন্তু পৃথিবীর স্থল এবং অন্তরীক্ষ  সম্পর্কে মানুষ যে পরিমাণ জ্ঞান আহরণ করেছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এত উন্নতির পরেও সেই তুলনায় স্থলভাগের দ্বিগুণেরও বেশি যে জলভাগ, সেই গভীর জলভাগ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান এখনো অনেকক্ষেত্রেই ততটা গভীর নয়। 


এর প্রধান কারণ হলো প্রতিবন্ধকতা। মানুষ খালি চোখে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রগুলি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনের আগেই অনেক হিসেবনিকেশ করে ফেলতে পেরেছিল মহাবিশ্ব সম্পর্কে। কিন্তু সাগরতলের গভীর পানির নিচে কী হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করা সহজ ছিল না। মানুষ পানিতে নেমে সাঁতার শিখেছে, ডুব দিতে শিখেছে। ডুব দিয়ে কতক্ষণ পানির নিচে নিশ্বাস বন্ধ করে থাকা যায় দেখেছে, চেষ্টা করেছে যতদূর সম্ভব গভীরে যাওয়ার। কিন্তু অক্সিজেন ছাড়া পানির নিচে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। প্রয়োজনীয় কারিগরি ব্যবস্থা ছাড়া পানির গভীরে প্রচন্ড চাপ সহ্য করা মানুষের শরীরের পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া পানির অনেক নিচে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে না বলে সেখানে ভীষণ অন্ধকার। সহনীয় গভীরতার নিচে সেই অন্ধকার, প্রচন্ড চাপ এবং অক্সিজেনবিহীন পরিবেশে কোন প্রাণী বাস করতে পারবে না বলেই ধারণা ছিল মানুষের। তাই যোগাযোগের প্রয়োজনে মানুষ যখন বিভিন্ন ধরনের জলযান তৈরি করে ফেলেছে – মহাসাগরগুলির দ্বীপগুলি আবিষ্কৃত হয়ে গেছে, আস্তে আস্তে মনোনিবেশ করেছে পানির গভীরে। সেই ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। 


বৈজ্ঞানিকভাবে ডিপ সি বা গভীর সমুদ্র বলতে বোঝানো হয় পানির সেই গভীরতা যেখানে পানির তাপমাত্রা আর সূর্যের আলোর উপর নির্ভর করে না। পানির উপর সূর্যের আলো পড়লে পানির তাপমাত্রা কিছুটা বাড়ে, তার প্রভাব থাকে যতদূর পর্যন্ত সূর্যালোক প্রবেশ করে ততদূর পর্যন্ত। চার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বিশুদ্ধ পানির ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বাড়তে থাকলে কিংবা কমতে থাকলে পানির ঘনত্ব কমতে থাকে। পানির উপরিস্তর থেকে একটা গভীরতার পর পানির উপর সূর্যালোকের আর কোন প্রভাব থাকে না – যার নাম থার্মোক্লাইন লেয়ার (thermocline)। সাধারণত ২০০ মিটার থেকে এক হাজার মিটার পর্যন্ত গভীরে এই লেয়ার থাকে। গভীর সমুদ্রে অনেকক্ষেত্রে ১৮০০ মিটার গভীরতায় এই থার্মোক্লাইন স্তর থাকতে পারে। এই গভীরতায় পানির তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি থেকে তিন ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। 


পানির গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে চাপ বাড়তে থাকে। তিন হাজার মিটার গভীরে পানির চাপ প্রায় ১৫,৭৫০ পিএসআই, অর্থাৎ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে চাপের পরিমাণ ১৫,৭৫০ পাউন্ড – যা পৃথিবীর বায়ুর চাপের এক হাজার গুণেরও বেশি। তাই এই চাপ সহ্য করার মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা উদ্ভাবনের আগপর্যন্ত গভীর পানিতে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান সম্ভব হয়নি। 


সাগরতলে অভিযানের ইতিহাস থেকে দেখা যায় – প্রাচীনকালে দড়িতে পাথর বেঁধে পানির গভীরতা মাপার চেষ্টা করা হতো। পর্তুগিজ নাবিক ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান ১৫২১ সালে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা মাপার চেষ্টা করেছিলেন। স্পেনের সাথে ইস্ট ইন্ডিজের সামুদ্রিক বাণিজ্য স্থাপনের লক্ষ্যে প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্র যাত্রা করেছিলেন ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান ১৫১৯ সালে। সমুদ্রপথে বিশ্বভ্রমণের সূচনা করেছিলেন তিনি। প্রশান্ত মহাসাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে সংযোগের নৌপথ তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বলে সেই সংযোগ পথের নাম দেয়া হয়েছে স্ট্রেইট অব ম্যাগেলান। প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা মাপার জন্য তিনি ২,৪০০ ফুট লম্বা দড়ির মাথায় ভারী লোহা বেঁধে জাহাজ থেকে পানিতে ফেলেছিলেন। ২,৪০০ ফুট দড়ি দিয়েও তিনি সাগরের তল স্পর্শ করতে পারেননি। সেই বছরই তিনি প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হবার পর আর চেষ্টা করার সুযোগ পাননি। 


পরবর্তী তিনশ বছরধরে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হয়েছে সমুদ্রের গভীরতা মাপার। সমুদ্রের গভীরতা ভৌগোলিক কারণেই বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন। বিজ্ঞানীরা তখনো বিশ্বাস করতেন যে থার্মোক্লাইন লেয়ারের নিচের গভীরতায় কোন প্রাণি থাকতে পারে না। তাই শুধুমাত্র নিষ্প্রাণ গভীর অন্ধকারের প্রতি তেমন কৌতূহল কারো ছিল না।     


কিন্তু ১৮১৮ সালে স্কটিশ রয়্যাল নেভি অফিসার স্যার জন রস যখন আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তরপশ্চিম অংশে সমুদ্র-জরিপ করছিলেন সমুদ্রের বিভিন্ন জায়গা থেকে সামুদ্রিক প্রাণির নমুনা সংগ্রহ করছিলেন। লম্বা তারের মাধ্যমে ধাতব খাঁচা পানিতে ফেলে বিভিন্ন গভীরতায় নমুনা সংগ্রহ চলছিল। তিনি আটলান্টিক মহাসাগরের প্রায় দুই হাজার মিটার গভীরতায় কিছু সামুদ্রিক পোকামাকড় এবং জেলিফিস পান। পূর্বধারণা অনুযায়ী এই গভীরতায় কোন প্রাণীর থাকার কথা নয়। তাহলে কি সেই ধারণা ভুল ছিল? এত চাপের মধ্যেও সমুদ্রে প্রাণ থাকা সম্ভব? বিজ্ঞানীদের কৌতূহল বেড়ে গেল। ছোট পরিসরে বিভিন্ন রকমের সামুদ্রিক অভিযান চলতে থাকলো। 


কিন্তু বৃহৎ পরিসরে সামুদ্রিক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান শুরু হয় ১৮৭০ সালে। ব্রিটিশ সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী চার্লস থমসন এবং উইলিয়াম কার্পেন্টার প্রস্তাব করলেন পৃথিবীর সবগুলি মহাসাগরে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান শুরু করার। এর প্রায় দশ বছর আগে থেকে তাঁরা স্কটল্যান্ডের সমুদ্রে এবং ফ্যারো দ্বীপে গভীর পানিতে অনুসন্ধান চালিয়ে প্রমাণ পেয়েছেন যে এক কিলোমিটারেরও অধিক গভীরে সামুদ্রিক প্রাণী আছে। এখন তাঁরা দেখতে চান সমুদ্রের সর্বোচ্চ কত গভীরতায় সামুদ্রিক প্রাণী খুঁজে পাওয়া যায়। গেলে সেগুলির বৈশিষ্ট্য কী? একটি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক জরিপ তাঁরা করতে চান। তাঁরা বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি করে রয়্যাল সোসাইটি এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন পাঠালেন। 


সেই সময় পৃথিবীর টেলিগ্রাফ যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যে টেলিগ্রাফ যোগাযোগের জন্য সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে টেলিগ্রাফের তার নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে টেলিগ্রাফের তার নিয়ে যেতে হলে সমুদ্রের গভীরতা কোথায় কত, এবং পরিবেশ কীরকম তা জানা খুবই জরুরি ছিল। তাই থমসন ও কার্পেণ্টারের বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবটি ছিল খুবই সময়োপযোগী। ব্রিটিশ সরকার তাঁদের বৈজ্ঞানিক প্রস্তাব অনুমোদন করে দুই লক্ষ পাউন্ড বরাদ্দ করল। সেই সময়ের দুই লক্ষ পাউন্ড বর্তমানে প্রায় এক কোটি পাউন্ডের সমতুল্য। এই প্রকল্পের নাম দেয়া হলো রয়্যাল নেভির জাহাজ এইচ-এম-এস চ্যালেঞ্জারের নামানুসারে এক্সপেডিশান ‘চ্যালেঞ্জার’। 


জুল ভার্নের 'টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগ্‌স আন্ডার দ্য সিজ' বইয়ের প্রথম প্রচ্ছদ


এদিকে কল্পকাহিনির জগতেও এর প্রভাব পড়লো। ফরাসি কল্পবিজ্ঞানলেখক জুল ভার্নের সাগরতলের রহস্যজনক দৈত্যাকৃতি প্রাণির অনুসন্ধানকেন্দ্রিক সামুদ্রিক অভিযানের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ‘টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সিজ’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭০ সালে। এর চার বছর পর ১৮৭৪ সালে সাগরতলের অভিযান নিয়ে জুল ভার্নের আরো একটি কল্পকাহিনি ‘দ্য মিস্টেরিয়াস আইল্যান্ড’ প্রকাশিত হয়। দুটো কাহিনিতেই দুর্ধর্ষ চরিত্র ক্যাপ্টেন নিমো ‘নটিলাস’ নামে যে সাবমেরিন ব্যবহার করেছিলেন – সেই সাবমেরিন পুরোপুরি কাল্পনিক ছিল না। প্রথম বাস্তব সাবমেরিনের নাম ছিল ‘নটিলাস’। আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট ফুলটন ‘নটিলাস’ সাবমেরিন তৈরি করেছিলেন এবং ১৮০০ সালে তা প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে পানির নিচে চালানো হয়েছিল। 


অবশ্য পানির নিচে চালানোর মতো নৌযানের ধারণা এবং প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল আরো প্রায় দু’শ বছর আগে। ১৬২০ সালে ওলন্দাজ (ডাচ) ইঞ্জিনিয়ার করনেলিস ড্রেবেল বিশ্বের প্রথম সাবমেরিন তৈরি করেছিলেন। পরবর্তী দেড়শ বছর ধরে প্রয়োজনের সাথে পাল্লা দিয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে সাবমেরিন প্রযুক্তির। আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রথমবার ব্যবহৃত হয়েছিল সাবমেরিন “টার্টল”। কচ্ছপের মতো পানির নিচে বিচরণ করতে পারতো বলেই এই নাম। আমেরিকার কানেকটিকাট রাজ্যের ডেভিড বুশনেল ছিলেন অসম্ভব দক্ষ একজন উদ্ভাবক। তিনি একাধারে ছিলেন ডাক্তার, শিক্ষক, উদ্ভাবক এবং প্রকৌশলী। তিনি ছিলেন আমেরিকার স্বাধীনতাযোদ্ধা। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ১৭৭৫ সালে তিনি তৈরি করেছিলেন পানির নিচে থেকে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জাহাজে আক্রমণ করার উপযোগী সাবমেরিন ‘টার্টল’। ১৭৭৬ সালে নিউইয়র্ক হারবারে ব্রিটিশ জাহাজে আক্রমণ করার কাজে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয়েছিল “টার্টল’। যদিও সেই আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছিল – ‘টার্টল’ ইতিহাসে নাম লিখিয়ে ফেলেছিল। ১৮০০ সালে রবার্ট ফুলটন যখন ‘নটিলাস’-এর নকশা তৈরি করেছিলেন তাতে ড্রেবেলের সাবমেরিন এবং বুশনেলের ‘টার্টল’-সাবমেরিনের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা ছিল। জুল ভার্নের কাল্পনিক সাবমেরিন ‘নটিলাস’ ছিল অনেকটাই বাস্তব নটিলাসের আধুনিক প্রতিফলন। কল্পকাহিনিতে অন্যান্য যেসব যন্ত্রপাতি এবং আনুষঙ্গিকতার বর্ণনা আছে – তাদের সাথে বাস্তবের অনেক মিল আছে। পানির নিচে শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়ার জন্য যন্ত্রপাতির প্রথম প্যাটেন্ট দেয়া হয়েছিল ১৮৬৫ সালে ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার বেনট রকোয়ারল এবং অগাস্তি ডেনায়রসকে। 


চ্যালেঞ্জার অভিযানের জন্য ব্রিটিশ রয়েল নেভি – তাদের পুরনো যুদ্ধজাহাজ এইচ-এম-এস চ্যালেঞ্জারকে কিছুটা পরিবর্তন করে ব্যবহারের জন্য দেয়। কাঠের তৈরি দুইশ ফুট লম্বা এই জাহাজ থেকে কামান এবং অন্যান্য যুদ্ধসরঞ্জাম সরিয়ে সেখানে ল্যাবরেটরি আর নমুনা রাখার ঘর তৈরি করে অভিযাত্রা শুরু হয় ১৮৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে। পোর্টসমাউথ বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে পরবর্তী চার বছর ধরে গভীর সমুদ্রপথে উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, প্রশান্ত এবং আটলান্টিক মহাসাগরের সবগুলি দ্বীপ পরিভ্রমণ করে ১৮৭৬ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে আসে চ্যালেঞ্জার। প্রায় ৭০ হাজার নটিক্যাল মাইল পরিভ্রমণকালে ৩৬২টি জায়গায় থেমে নমুনা সংগ্রহ করেছেন চ্যালেঞ্জারের বিজ্ঞানীরা। ধাতব জাল এবং পাত্রের সাহায্যে তাঁরা সংগ্রহ করেছেন সামুদ্রিক প্রাণী, মাটি, পানি, কীটপতঙ্গ, মাছ ইত্যাদি নমুনা। ৫৬৩টি বাক্সভর্তি ২,২৭০টি বড় কাচের পাত্র, ১৭৪৯টি ছোট কাচের বোতল, ১৮৬০টি কাচের টিউব, ১৭৬টি টিনভর্তি নমুনা নিয়ে ফিরেছিল চ্যালেঞ্জার। পরবর্তীতে বিশ বছর সময় লেগেছে সবগুলি নমুনা পরীক্ষা করতে। পরীক্ষালব্ধ ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে পঞ্চাশটি খন্ডে মোট তিরিশ হাজারের বেশি পৃষ্ঠায়। 


চ্যালেঞ্জার অভিযানে বিজ্ঞানী চার্লস থমসন ও উইলিয়াম কার্পেন্টারের তত্ত্বাবধানে যে অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল তাতে পৃথিবীর পাঁচটি মহাসাগরের বিভিন্ন স্থানের গভীরতা মাপা হয়েছে। গভীরতা মাপার জন্য সাথে নেয়া হয়েছিল প্রায় ১৫০ মাইল লম্বা তামার তার। এই তারে ধাতব ওজন ঝুলিয়ে পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হতো। সেই সময় গভীরতা মাপা হতো ফ্যাদমে। ছয় ফুটে এক ফ্যাদম। তারের প্রতি ফ্যাদমে একটি করে মার্কিং ফ্ল্যাগ লাগানো ছিল। কত গভীরতায় গিয়ে তারের মাথায় লাগানো ওজন সমুদ্রের তলে গিয়ে ঠেকেছে তা দেখে সহজেই সেই জায়গায় পানির গভীরতা মাপা যেতো। চ্যালেঞ্জার দক্ষিণ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ গুয়াম ও পালাউর মাঝামাঝি জায়গায় খুঁজে পেয়েছে পৃথিবীর গভীরতম খাদ – ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চ। এউ ট্রেঞ্চের গভীরতা মাপা হয়েছিল প্রায় আট কিলোমিটার। 


ভূপদার্থবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন এর উৎপত্তির ইতিহাস। প্যাসিফিক ও ফিলিপাইন টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল প্রায় ষাট লক্ষ বছর আগে। সংঘর্ষের ফলে প্যাসিফিক প্লেট ঢুকে যায় সমুদ্রতলের প্রায় আট থেকে দশ কিলোমিটার গভীরে। ফলে এমন গভীর খাদের সৃষ্টি হয় যাতে পৃথিবীপৃষ্ঠের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্ঘ এভারেস্টও ডুবে যাবে পুরোপুরি। 


সমুদ্রের গভীরতা মাপার পদ্ধতির অনেক উন্নতি হয়েছে পরবর্তীতে। ১৯১২ সালে টাইটানিক জাহাজ ডুবে যায় আটলান্টিক মহাসাগরে। পানিতে শব্দের প্রতিফলন কাজে লাগিয়ে বস্তুর অবস্থান এবং দূরত্ব হিসেব করার ইকো রেঞ্জিং পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯১৪ সালে। কানাডিয়ান উদ্ভাবক এবং বেতার পদার্থবিজ্ঞানী রেজিনাল্ড ফেসেনডেন তাঁর তৈরি ফেসেনডেন অস্‌সিলেটর ব্যবহার করে পানির ভেতরের দূরত্ব এবং গভীরতা নির্ণয় করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তাঁর অস্‌সিলেটর পানির নিচে প্রচন্ড শব্দ তৈরি করে পাঠায়। পরে সেই শব্দ তরঙ্গ কোথাও প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এলে তা নির্ণয় করতে পারে। প্রেরণের সময় এবং গ্রহণের মধ্যবর্তী সময় হলো শব্দ যাওয়া এবং আসার মোট সময়। পানিতে শব্দের বেগ দিয়ে এই সময়কে গুণ করে শব্দের উৎস থেকে প্রতিফলক বস্তুর দূরত্ব নির্ণয় করা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফেসেনডেনের ইকো রেঞ্জিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল ব্যাপকভাবে। 


ইকো রেঞ্জিং পদ্ধতি থেকে উদ্ভাবিত হয়েছে আধুনিক সাউন্ড ন্যাভিগেশন অ্যান্ড র‍্যাঞ্জিং বা সোনার (SONAR) পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে আলট্রাসাউন্ড পাঠিয়ে এবং তার প্রতিফলন শনাক্ত করে দুটো সময়ের পার্থক্যকে শব্দের বেগ দিয়ে গুণ করে দূরত্ব নির্ণয় করা হয়। সোনার পদ্ধতিতেই ডুবে যাওয়া টাইটানিক জাহাজের সঠিক অবস্থান খুঁজে বের করা সম্ভব হয়েছে আটলান্টিক মহাসাগরের ১২,৬০০ ফুট গভীরে।


১৯৫১ সালে ব্রিটিশ জরিপ জাহাজ চ্যালেঞ্জার-২ আরো আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে চ্যালেঞ্জার অভিযাত্রার পুনরাবৃত্তি করে। সেই সময় আবিষ্কৃত হয়েছে পৃথিবীর গভীরতম স্থান – ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চ যার গভীরতা ৩৬,২০১ ফুট বা ১১,০৩৪ কিলোমিটার যা মাউন্ট এভারেস্টের চেয়ে ২,১৮৫ মিটার বেশি। চ্যালেঞ্জার অভিযাত্রার নাম অনুসারে  এই গভীরতম স্থানের নাম দেয়া হয়েছে চ্যালেঞ্জার ডীপ। 


পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গে হেঁটে উঠে গেছে এমন মানুষের সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি। পৃথিবী থেকে তিন লক্ষ চৌত্রিশ হাজার কিলোমিটার দূরের চাঁদের পিঠে গিয়ে হেঁটে এসেছে বারোজন মানুষ। অথচ ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশে গিয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা মাত্র তিন। 


পানির গভীরে অক্সিজেন নেই এবং চাপ অত্যন্ত বেশি। পানিতে স্কুবা ডাইভিং-এর জন্য স্বয়ংক্রিয় শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্র একুয়ালাং আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯৪৩ সালে। ফরাসি বিজ্ঞানী জ্যাকস-ইয়েভিস কসটেউ এবং এমিল গ্যাংনান একুয়ালাং উদ্ভাবন করেন। একুয়ালাং-এর সাহায্যে পানির গভীরে ভেসে বেড়ানো অনেকটাই সহজ হয়েছে সাহসী মানুষের জন্য। কিন্তু আরো গভীরে অনুসন্ধান চালানোর জন্য ডুবুরীর সরঞ্জামের সাথে দরকার আধুনিক সাবমেরিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাবমেরিন প্রযুক্তির অনেক উন্নতি ঘটে।


১৯৬০ সালে আমেরিকান নেভির তত্ত্বাবধানে সমুদ্রের গভীরে অভিযান এবং গবেষণা চলছিল। প্রজেক্ট নেকটন ছিল সমুদ্রের গভীরে সাবমেরিনের মাধ্যমে মানুষ গিয়ে – প্রচন্ড গভীরে গিয়ে মেরিন লাইফ, তাপমাত্রা চাপ এবং শব্দের মিথষ্ক্রিয়া কী রকম – এসমস্ত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানী প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য। সাবমেরিন ট্রিয়েস্টি ছিল এই প্রজেক্টের অংশ। ১৯৬০ সালের ২৩ জানুয়ারি ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশে প্রথম দুজন মানুষ – আমেরিকান নেভি ল্যাফটেনেন্ট ডন ওয়ালশ  এবং এক্সপ্লোরার জ্যাকস পিকার্ড সাবমেরিন নিয়ে পৌঁছে যান। আমেরিকান নেভি এই সাবমেরিন কিনেছিল এই অভিযানের জন্য। সাবমেরিনের দেয়াল ছিল পাঁচ ইঞ্চি পুরো স্টীলের তৈরি যেন ওটা ওই গভীরতায় পানির প্রচন্ড চাপ  (প্রতি বর্গইঞ্চিতে আট টন) সহ্য করতে পারে। 


সমুদ্রের তলদেশে পৌঁছানোর আগে সাবমেরিনের হেডলাইটের আলোতে  তাঁরা একটি শোল মাছের মতো মাছ দেখতে পান। তার মানে সমুদ্রের অত গভীরেও মাছের শ্বাস প্রশ্বাস নেয়ার মতো অক্সিজেন আছে, খাদ্য আছে। সেখানে একটি মাছ আছে মানে আরো মাছ আছে যারা সমুদ্রের তলদেশে থাকে। তলদেশে পৌঁছে তাঁরা কোন ছবি তুলতে পারেননি। কারণ সাবমেরিনটি সমুদ্রের তলদেশ স্পর্শ করার সাথে সাথে বালি এবং কাদা ছিটকে চারপাশের পানি প্রচন্ড ঘোলা হয়ে যায়।  সমুদ্রের তলদেশে তারা সাবমেরিনের ভেতর আধঘন্টা ছিল। এরপর উপরে চলে আসেন। যাওয়া-আসা মিলিয়ে প্রায় বাইশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে তাঁদের সময় লেগেছিল প্রায় পাঁচ ঘন্টা।  


জেমস ক্যামেরুন


পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে আর কেউই যাননি ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশে। ১৯৬০ সালে যে দুজন মানুষ পৃথিবীর গভীরতম স্থানে গিয়েছিলেন তাঁদের মৃত্যু হয়েছে অনেক বছর আগে। তাঁদের অভিযাত্রার বায়ান্ন বছর পর যে সাহসী মানুষটি পা রাখলেন পৃথিবীর গভীরতম স্থানে – তিনি আমাদের সবার পরিচিত জেমস ক্যামেরন । টার্মিনেটর, অ্যালিয়েন, টাইটানিক, অবতার প্রভৃতি বিপুল জনপ্রিয় সিনেমার পরিচালক জেমস ক্যামেরন যে একজন অভিযাত্রিক তা আমরা অনেকেই জানি না। অনেক বছর ধরে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন গভীর সমুদ্রে অভিযান চালানোর জন্য। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, রোল্যাক্স এবং নিজের টাকায় তিনি তৈরি করিয়েছেন অত্যাধুনিক সাবমেরিন ডিপ সী চ্যালেঞ্জার। ২০১২ সালের ২৬ মার্চ তিনি পৌঁছান ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতম স্থান চ্যালেঞ্জার ডীপে। তলদেশে পৌঁছার পর তিনি সাবমেরিন থেকে বের হয়ে পাঁচ ঘন্টা ধরে পানির নিচে ছবি এবং ভিডিও ধারণ করেন। পরবর্তীতে ‘ডিপ সি চ্যালেঞ্জ’ নামে  ত্রিমাত্রিক তথ্যচিত্র তৈরি করেন তিনি যাতে ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চের পুঙ্খানুপূঙ্খ বাস্তব চিত্র দেখা সম্ভব হয় আমাদের। বর্তমানে জেমস ক্যামেরনই পৃথিবীর একমাত্র জীবিত ব্যক্তি যিনি  ৫৮ বছর বয়সে পৃথিবীর গভীরতম স্থানে পা রেখেছিলেন। 


বর্তমানে সামুদ্রিক অভিযান ক্রমাগত চলছে আধুনিক রোবটের মাধ্যমে। রিমোর্টলি অপারেটেড ভ্যাহিকল বা রোভ-এর সাহায্যে সমুদ্রের তলদেশে ক্যামেরা, সোনার এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে বসেই তথ্য সংগ্রহ করছেন। অটোনোমাস আন্ডারওয়াটার ভেহিকলস অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয় মনুষ্যবিহীন সাবমেরিনের মাধ্যমেও বর্তমানে সামুদ্রিক গবেষণা চলছে। সমুদ্রের তলদেশে নোঙর করা স্বয়ংক্রিয় ল্যাবরেটরি পানির গভীরে থেকে সমুদ্রের গভীরের অনেক প্রাকৃতিক ঘটনার দিকে নজর রাখছে এবং নিয়মিত ডাটা পাঠাচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশ থেকে ৯৮০ মিটার উচ্চতায় পানির ভেতর ভেসে আছে মনটেরে এক্সিলারেটেড রিসার্চ সিস্টেম বা মার্স যা প্রশান্ত মহাসাগরের ভূমিকম্প রেখার পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করছে। তবুও এখনো মহাসাগরের অনেককিছুই অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে আগামী দিনের বিজ্ঞানীদের জন্য।


তথ্যসূত্র

১। Wolf H. Berger, Ocean Reflection of a century of exploration, University of California Press, Berkeley, 2009.

2. Deepseachallenge.com

3. Helmenstine, Anne Marie, Ph.D. "Deep Sea Exploration History and Technology." Thought Co, Aug. 27, 2020, thoughtco.com/deep-sea-exploration-4161315.

4. Alok Jha, The Water Book, Headline publishing, London, 2016. 

5. The Lonely Planet guide to the middle of nowhere, Australia 2006. 

_________
বিজ্ঞানচিন্তা জুন ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত










No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts