আমাদের বর্তমান
জীবনযাত্রার প্রায় সবকিছুর উপরই ইন্টারনেটের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব আছে। মাত্র
বিশ বছর আগেও আমরা কোন তথ্য বা উপাত্ত খুঁজে বের করার জন্য লাইব্রেরির বইপত্র কিংবা
অন্যান্য তথ্যভান্ডারের সাহায্য নিতাম, এবং সেই তথ্যভান্ডারও ছিল অত্যন্ত সীমিত, সেখানে
আজ সারাপৃথিবীর তথ্যভান্ডার থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় তথ্য হাতের মুঠোয় চলে আসে কয়েক সেকেন্ডের
মধ্যেই – ইন্টারনেটের কল্যাণে। তথ্য এখন শুধুমাত্র জ্ঞানার্জনের সাথে সংযুক্ত নয়, অর্থ
উপার্জনের সাথেও সরাসরি সংযুক্ত। ২০২৪ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী কোম্পানিগুলির প্রথম
দশটির মধ্যে পাঁচটিই হলো কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ভিত্তিক কোম্পানি – অ্যাপল, মাইক্রোসফ্ট,
অ্যালফাবেট (গুগল), আমাজন, মেটা প্লাটফরমস (ফেসবুক, ইনস্টগ্রাম, হোয়াটসআপ)। ইন্টারনেটের
যাত্রা শুরুর সময়েই বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ইন্টারনেটকে তুলনা করেছিলেন মস্তিষ্কের নিউরনের
সাথে। নিউরন যেভাবে আমাদের মস্তিষ্কের স্নায়ুসংযোগ ঘটায়, সেরকম ইন্টারনেটও তার কোটি
কোটি সংযোগের মাধ্যমে আমাদের জীবনযাপনের সমস্ত কাজের সংযোগসূত্রে পরিণত হয়ে উঠেছে।
পৃথিবীর পাঁচশ কোটিরও বেশি মানুষ আজ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। বর্তমানে দুইশ কোটিরও
বেশি ওয়েবসাইট আছে ইন্টারনেটে। ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীর সাড়ে তিন হাজার কোটিরও বেশি
যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হবে।
কম্পিউটার এবং
ইন্টারনেট প্রযুক্তির মতো আর কোন প্রযুক্তি এত দ্রুত বিস্তার লাভ করেনি পৃথিবীর ইতিহাসে।
১৯৮৩ সালের ১ জানুয়ারিকে ইন্টারনেটের জন্মদিন বলে ধরে নেয়া হয়। তবে সাধারণের ব্যবহারের
জন্য ইন্টারনেট চালু হয় ১৯৯৩ সালে প্রথম ওয়েবসাইট তৈরির মাধ্যমে। সেহিসেবে ইন্টারনেটের
বয়স মাত্র তিরিশ পেরোল। এই তিরিশ বছরের মধ্যেই ঘটে গেছে ইন্টারনেটের অনেক বিবর্তন।
কম্পিউটার প্রযুক্তির যত উন্নতি হয়েছে, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা তত উন্নত হয়েছে – সাথে
সাথে উন্নত হয়েছে ইন্টারনেটও।
দেখা যাক এর
শুরুটা কোথায় হয়েছিল এবং কীভাবে।
শুরুর দিনগুলি
আমরা জানি কম্পিউটার
উদ্ভাবনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরমাণু বোমা তৈরির গবেষণার অনেক ভূমিকা আছে। হাঙ্গেরিয়ান
আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী জন ফন নিউম্যান ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের টেকসই কারিগরী নকশা
তৈরি করেছিলেন। কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং বিবর্তন কীভাবে ঘটেছে সেটা অন্য প্রসঙ্গ
বলে এখানে আর উল্লেখ করছি না। ইন্টারনেট উদ্ভাবনের পেছনেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পারমাণবিক
বোমার পরোক্ষ ভূমিকা আছে।
|
জন ফন নিউম্যান (২৮/১২/১৯০৩ – ৮/২/১৯৫৭) |
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
সময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন জোটবদ্ধ হয়ে হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও – যুদ্ধের
পর পরস্পর ঠান্ডাযুদ্ধে লিপ্ত হয়। সেই সময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ব্যাপক
প্রতিযোগিতার ফলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি হয়। মহাকাশ গবেষণায় তখন ব্যাপক
জোয়ার আসে। অন্যদিকে পারমাণবিক বোমা তৈরিতেও প্রচুর অর্থ ঢালে উভয় দেশ। দূর-নিয়ন্ত্রিত
অসংখ্য স্বয়ংক্রিয় মিসাইল তৈরি করে তারা। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের মিসাইলগুলি রাখে বড়
বড় ট্রেনের বগিতে। বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়নের রেলওয়ে নেটওয়ার্ক এতই বিস্তৃত যে মিসাইলগুলির
কোন্টা কোথায় আছে তার হিসেব রাখা এবং একেকটি মিসাইলের নিয়ন্ত্রণ টিমের সাথে অন্যগুলির
নিয়ন্ত্রণ টিমের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা বিরাট চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
এদিকে আমেরিকার
মিলিটারিদেরও একই সমস্যা। তারা তাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি রেখেছে বিভিন্ন গুদামে। প্রতিটি
ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে আছে উৎক্ষেপণ যন্ত্র এবং টিম। যুদ্ধকালীন সময়েই বেতার যোগাযোগ
ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলেছিল মিলিটারি ইঞ্জিনিয়াররা। নির্দিষ্ট গোপন বেতার কম্পাঙ্কে
এক ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে অন্য ক্ষেপণাস্ত্রের টিমের যোগাযোগ চলছিল। কিন্তু যদি যুদ্ধ
পরিস্থিতি তৈরি হয়, যদি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটে তখন তো বেতার যোগাযোগের যে ব্যবস্থা
– তা অব্যাহত থাকবে না। তখন পারমাণবিক মিসাইলগুলির অবস্থান ইত্যাদি নিশ্চিত করা যাবে
কীভাবে? আমেরিকান প্রতিরক্ষা বাহিনী এই সমস্যার নির্ভরযোগ্য সমাধান খোঁজার দায়িত্ব
দিল তাদের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান র্যান্ড (RAND) কে। র্যান্ডে তখন
ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন পল ব্যারন।
|
পল ব্যারন (২৯/৪/১৯২৬ – ২৬/৩/২০১১) |
পল ব্যারনের
জন্ম ১৯২৬ সালে পোলান্ডে। দুবছর বয়সেই তিনি মা-বাবার সাথে আমেরিকায় চলে এসেছিলেন। ফিলাডেলফিয়ার
ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে একার্ট-মসলি কম্পিউটার কোম্পানিতে
যোগ দিয়েছিলেন পল ব্যারন। এই কোম্পানিই পরে ইউনিভ্যাক (UNIVAC) কোম্পানি হয়েছিল – যেটা
ছিল পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিক কম্পিউটার কোম্পানি। পল ব্যারন সেই কোম্পানিতে কাজ করার
সময়েই সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসে।
১৯৫৯ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং মার্স্টার্স পাস করার পর যোগ দেন আমেরিকার মিলিটারিদের গবেষণা
প্রতিষ্ঠান র্যান্ড-এ। ১৯৬১-৬২ সালে দিনরাত গবেষণা করে পল ব্যারন কমিউনিকেশানস নেটওয়ার্কের
মূল ভিত্তি তৈরি করেন। তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতিতেই ইন্টারনেটে ডেটা আদান-প্রদান ঘটে।
কমিউনিকেশান
নেটওয়ার্ক দুই ধরনের হতে পারে; (১) কেন্দ্রিভূত
বা স্টার নেটওয়ার্ক – যেখানে সবগুলি উৎস থেকে ডেটা এসে এক কেন্দ্রে মিলিত হবে। এরকম
নেটওয়ার্ক কাঠামোগতভাবে খুবই দুর্বল। কারণ কোনোভাবে যদি কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে
সব ডেটা নষ্ট হয়ে যাবে। অথবা (২) বিকেন্দ্রিভূত বা গ্রিড নেটওয়ার্ক – যেখানে তথ্যগুলি
একাধিক কেন্দ্রের মধ্যে ভাগ করে রাখা হবে – যাতে একটি কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অন্য
কেন্দ্র থেকে তথ্য বিতরণ করা যায়। এই বিকেন্দ্রিভূত বা ডিসেন্ট্রালাইজড নেটওয়ার্কের
বর্তমান নাম – প্যাকেট সুইচিং অ্যান্ড ডায়নামিক রাউটিং। ১৯৬৩ সালে ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল
ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরির পদার্থবিজ্ঞানী ডোনাল্ড ড্যাভিস পল ব্যারনের মতোই তথ্য বিভাজন,
বিকেন্দ্রিকরণ এবং ছোট ছোট প্যাকেটে করে সঞ্চালনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করে তার নাম দেন
প্যাকেট সুইচিং। ডেটা আদান-প্রদানে এখনো এই পদ্ধতিই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।
|
ডোনাল্ড ডেভিস (৭/৬/১৯২৪ – ২৮/৫/২০০০)
|
ইন্টারনেটের
মূল কাজ ডেটা আদান-প্রদানের মূল ভিত্তি তৈরি করেছিলেন ডোনাল্ড ড্যাভিস। ডোনাল্ড ডেভিসের
জন্ম ১৯২৪ সালে ইংল্যান্ডের ওয়েল্স-এ। লন্ডনের ইম্পেরিয়েল কলেজ থেকে ১৯৪৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে
বিএসসি এবং ১৯৪৭ সালে গণিতে এমএসসি পাস করে তিনি ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবে গবেষক হিসেবে
যোগ দেন। ইন্টারনেটের নেটওয়ার্ক অব দ্য নেটওয়ার্কস পদ্ধতি উদ্ভাবনে তাঁর অবদান অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ।
সেইসময় (১৯৬০-৬৫
সালে) কম্পিউটার তৈরি হচ্ছিল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। একেকটি কম্পিউটারের সেইসময়কার মূল্য
ছিল দশ লক্ষ ডলারের বেশি। ধনী প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কারো পক্ষে কম্পিউটার কেনা স্বপ্নেরও
অতীত ছিল। প্রথম যুগের বিশালাকৃতির কম্পিউটারগুলির মেমোরি ছিল মাত্র কয়েক হাজার শব্দের
ম্যাগনেটিক ট্যাপ। প্রোগ্রামিং করা এবং প্রোগ্রামের ডিবাগিং করা ছিল প্রায় অসম্ভব।
প্রত্যেকটি কম্পিউটারই ছিল স্বতন্ত্র। একটি কম্পিউটারের সাথে অন্য কম্পিউটারের মধ্যে
ডেটা আদান-প্রদান করা ছিল তখন কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের স্বপ্ন। এই স্বপ্নেরই ফসল ইন্টারনেট।
|
ভ্যানেভার বুশ (১১/৩/১৮৯০ – ৩০/৬/১৯৭৪) |
অনেক বিজ্ঞানীর
মধ্যে দু’জন স্বপ্নবাজ বিজ্ঞানীর কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতেই হয়। প্রথমজন ভ্যানেভার
বুশ। আমেরিকার কম্পিউটার বিজ্ঞানী ভ্যানেভার বুশের জন্ম ১৮৯০ সালে ম্যাচাচুসেটস-এ।
এম-আই-টি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে তিনি আমেরিকার নৌবাহিনীর সাবমেরিন
ডিরেক্টর ছিলেন। মেকানিক্যাল কম্পিউটারে তিনি ডিফারেন্সিয়েল ইকোয়েশান সল্ভ করার পদ্ধতি
উদ্ভাবন করেন। আমেরিকান মিলিটারির সায়েন্টিফিক রিসার্চ অ্যান্ড ভেডেলপমেন্ট অফিসের
ডিরেক্টর হয়ে তিনি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় এবং মিলিটারির মধ্যে গবেষণা-সহযোগিতা জোরদার
করেন। ম্যানহাটন প্রজেক্টের অন্যতম বিজ্ঞানী ছিলেন ভ্যানেভার বুশ। ১৯৪০ সালেই তিনি
এক গবেষণাপত্রে কম্পিউটারের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদানের পদ্ধতির কথা লিখেছিলেন – যা
পরবর্তীতে হাইপারটেক্সট ও ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব উদ্ভাবনে দিকনির্দেশনা দিয়েছিল।
|
জোসেফ লিকলাইডার (১১/৩/১৯১৫ – ২৬/৬/১৯৯০) |
অন্য বিজ্ঞানী
ছিলেন আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী জোসেফ লিকলাইডার। জোসেফ লিকলাইডারের জন্ম ১৯১৫ সালে
সেন্ট লুইসে। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থবিজ্ঞান, গণিত এবং মনোবিজ্ঞানে বিএসসি
পাস করার পর মনোবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। পরে পিএইচডিও করেন মনোবিজ্ঞানে। মনোবিজ্ঞানী
হয়েও তাঁর শখ ছিল কম্পিউটার। ১৯৬০ সালে তিনি গবেষণা-পত্র রচনা করেছিলেন মানুষ ও কম্পিউটারের
মধ্যে মিথষ্ক্রিয়ার – যা বর্তমানে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স হিসেবে আমরা বাস্তবে দেখতে
শুরু করেছি। জোসেফ লিকলাইডার কল্পনা করেছিলেন একদিন সব কম্পিউটার একটি আরেকটির সাথে
যুক্ত হয়ে তথ্যের আদান-প্রদান করতে পারবে। শুধু কল্পনা করেই তিনি বসে ছিলেন না, কল্পনাকে
বাস্তবে রূপদান করতেও সচেষ্ট ছিলেন।
১৯৫০ সালের
শেষের দিকে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগ Advanced Research Project Agency (ARPA) প্রতিষ্ঠা
করে। এই এজেন্সির কম্পিউটার রিসার্চ প্রোগ্রামের প্রধান হিসেবে যোগ দেন জোসেফ লিকলাইডার।
তিনি এম-আই-টি, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেস এবং বিবিএন টেকনোলজি
কোম্পানির সাথে গবেষণা-সহযোগিতা স্থাপন করেন তাদের কম্পিউটারগুলির মধ্যে কীভাবে নেটওয়ার্ক
স্থাপন করা যায় তা দেখার জন্য।
১৯৬৩ সালে প্যাকেট
সুইচিং পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে তা আমরা আগেই বলেছি। জোসেফ লিকলাইডার এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীরা
তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে প্যাকেট সুইচিং পদ্ধতি ব্যবহারের উপযোগিতা অনুধাবন করতে
পেরেছেন। এখন এই পদ্ধতিকে কাজে লাগানোর পালা।
সেই সময় এক
এক কোম্পানির কম্পিউটার একেক ভাবে ডেটা উপস্থাপন এবং সংরক্ষণ করতো। যদি কম্পিউটারগুলির
মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে হয়, তাহলে ডেটা উপস্থাপনের পদ্ধতি একই হতে হবে। ফলে সবগুলি
কম্পিউটারের ডেটা উপস্থাপন পদ্ধতির সমন্বয়ের দরকার হয়ে পড়ে। আমেরিকান সরকার এ ব্যাপারে
কমিটি গঠন করে ১৯৬৩ সালে ঠিক করে American Standard Code for Information
Interchange (ASCII)। এটাই ছিল প্রথম সর্বজনীন ডেটা কোড – যা সব কম্পিউটার কোম্পানিই
ব্যবহার করতে শুরু করে।
এক কম্পিউটার
থেকে অন্য কম্পিউটারে ডেটা প্রেরণ প্রথম শুরু হয় ১৯৬৫ সালে। এমআইটির একটি কম্পিউটার
থেকে সান্টা মনিকায় অবস্থিত একটি কম্পিউটারে টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে ডেটা প্রেরণ করা
হয়। টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে ডেটা ট্রান্সফারের পথ খুলে যায়।
বিভিন্ন কম্পিউটারের
মধ্যে নেটওয়ার্ক স্থাপন করার লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে গঠন করা হয় ARPANET – যা ছিল ইন্টারনেটের
একেবারে শুরুর নেটওয়ার্ক। প্যাকেট সুইচিং-এর মাধ্যমে ডেটাগুলিকে ছোট ছোট প্যাকেটে ভাগ
করে আলাদা আলাদাভাবে গন্তব্যে পাঠানোর পর আবার সেগুলিকে একটার সাথে অন্যটা জোড়া লাগিয়ে
পুরো ডেটা একসাথে ডেলিভারি দেয়া হয়। ঐ সময় নেটওয়ার্ক স্পিডের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৬ কেবিপিএস
(প্রতি সেকেন্ডে ৫৬ কিলোবাইট)।
প্যাকেট সুইচিং
পদ্ধতিতে মোট ১৯টি নোডের নেটওয়ার্ক তৈরি করার কাজ দেয়া হয় বিবিএন টেকনোলজিকে। প্রথম
দুটো নোডের একটি ছিল ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসে (ইউসিএলএ), এবং
অন্যটি ছিল স্ট্যান্ডার্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটে (এসআরআই)। মূল কম্পিউটারের সামনে ইন্টারফেস
ম্যাসেজ প্রসেসর (IMP) লাগিয়ে নেটওয়ার্ক ম্যানেজ করা হয়। এই IMP-ই প্রযুক্তিগতভাবে
বিবর্তিত হয়ে এখনকার রাউটারে পরিণত হয়েছে।
নেটওয়ার্কে
কম্পিউটারগুলি কীভাবে একটি অন্যটির সাথে যোগাযোগ করবে তার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি
করার দায়িত্ব নিলো ইউসিএলএ। যারা নীতিমালা তৈরি করলো তাদের নাম হলো নেটওয়ার্ক ওয়ার্কিং
গ্রুপ। আর এই নীতিমালার নাম দেয়া হলো নেটওয়ার্ক কনট্রোল প্রটোকল বা এনসিপি।
১৯৬৯ সালের
২৯ অক্টোবর ইউসিএলএর কম্পিউটার থেকে এসআরআইর কম্পিউটারের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে
ডেটা ট্রান্সফার শুরু হলো। ১৯৭১ সালের মধ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯টি নোডের নেটওয়ার্ক
তৈরি হয়ে যায়।
১৯৭১ সালের
মধ্যে নেটওয়ার্ক ওয়ার্কিং গ্রুপ দুটো দরকারি প্রটোকল তৈরি করে ফেলে – টেলনেট প্রটোকল
এবং ফাইল ট্রান্সফার প্রটোকল (এফটিপি)। টেলনেট প্রটোকলের মাধ্যমে একটি কম্পিউটার ব্যবহারকারী
তার নিজের কম্পিউটারের মাধ্যমেই দূরবর্তী অন্য কোন কম্পিউটারে লগ ইন করতে পারে। আর ফাইল ট্রান্সফার
প্রটোকলের মাধ্যমে এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে ডেটা পাঠানোও যায় এবং গ্রহণও
করা যায়।
ARPANET-এর
সাথে যুক্ত হয় তিরিশটির বেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং তাদের কম্পিউটারের মধ্যে ডেটা বিনিময়
পুরোদমে শুরু হয়ে যায় ১৯৭১-এর মধ্যে। কম্পিউটার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের নিজেদের
কোম্পানির কম্পিউটার চালানোর জন্য নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করছিলো এবং ক্রমশ সেসব
অপারেটিং সিস্টেমের প্রযুক্তিগত উন্নতিও ঘটাচ্ছিলো। এর মধ্যে ডেটা ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে
একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যমের উদ্ভাবন করে ফেলেন বিবিএন টেকনোলজির সদ্য তিরিশ পেরোনো
যুবক প্রোগ্রামার রে টমলিনসন। ARPANET-এর দুটো কম্পিউটারের মাধ্যমে তিনি ইলেকট্রনিক
মেইল প্রেরণ ও গ্রহণ করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ফেললেন। শুরু হলো ইমেইলের যুগ।
|
রেমন্ড টমলিনসন (২৩/৪/১৯৪১ – ৫/৩/২০১৬) |
ইমেইল
রেমন্ড স্যামুয়েল
টমলিনসনের জন্ম নিউইয়র্কে ১৯৪১ সালের ২৩ এপ্রিল। ১৯৬৫ সালে এমআইটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল
ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মাস্টার্স পাস করে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে যোগ দেন বিবিএন টেকনোলজি
কোম্পানিতে। সেখানেই তিনি উদ্ভাবন করেন ইলেকট্রনিক মেইল পাঠানোর পদ্ধতি। এর আগে একই
মেইনফ্রেম কম্পিউটার ব্যবহারকারিরা একে অপরের কাছে বার্তা পাঠাতে পারতো। কিন্তু একটি
কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে বার্তা পাঠানো যেতো না। রে টমলিনসন @ চিহ্ন ব্যবহার
করে কম্পিউটারের নাম (হোস্ট) চিহ্নিত করার উপায় উদ্ভাবন করলেন। ইমেইলের প্রাথমিক ঠিকানা
লেখার নিয়ম ঠিক হলো username@hostname। ১৯৭১ সালের মধ্যেই APERNET নেটওয়ার্কের সাথে
সংযুক্ত সবগুলি নোডের সবগুলি কম্পিউটারে ইমেইল প্রেরণ এবং গ্রহণ করা চালু হয়ে গেল।
ধাপে ধাপে ইমেইল প্রযুক্তিরও অনেক উন্নতি ঘটেছে। হোস্টের নামের সাথে যুক্ত হয়েছে ডোমেইনের
নাম (ডোমেইন নেইম সিস্টেম বা ডিএনএস সম্পর্কে আমরা একটু পরে আলোচনা করবো)।
রে টমলিনসন
ইমেইল উদ্ভাবনের মাধ্যমে মানুষের যোগাযোগের পদ্ধতিতে বিরাট বিপ্লব সাধন করলেন। ইমেইল
সিস্টেমকে বলা হয় স্টোর-অ্যান্ড-ফরোয়ার্ড মডেল যেখানে ইমেইল সার্ভার ডেটা আকারে ইমেইল
গ্রহণ করার পর তা সিস্টেমে জমা রাখে, এবং সেখান থেকে নির্দিষ্ট ঠিকানায় ডেটা ফরোয়ার্ড
করে দেয়। ইমেইল গ্রহণ করার জন্য প্রাপককে কম্পিউটার খুলে অনলাইন অন করে বসে থাকতে হয়
না। ধাপে ধাপে ইমেইলের অনেকগুলি প্রটোকল তৈরি হয়েছে – সিম্পল মেইল ট্রান্সফার প্রটোকল
(SMTP), পোস্ট অফিস প্রটোকল (POP3), ইন্টারনেট
ম্যাসেজ অ্যাপ্লিকেশান প্রটোকল (IMAP) ইত্যাদি। ইমেইল সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনায়
আমরা যাবো না এই লেখায়। শুধুমাত্র ইন্টারনেটের বিবর্তনে ইমেইলের ভূমিকাটুকুই আলোচনা
করবো।
১৯৭১ সালে ইমেইল
চালু হলেও তখনো তা সীমাবদ্ধ ছিল প্রাতিষ্ঠানিক কম্পিউটারের মধ্যে। ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত
হয় প্রথম ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন কম্পিউটার কমিউনিকেশান। সেখানে ARPANET জনসাধারণের
জন্য এক প্রদর্শনীর মাধ্যমে কম্পিউটারের সাথে কম্পিউটারের যোগাযোগ কীভাবে ঘটছে তা হাতেকলমে
দেখায়। সেই প্রদর্শনীতেই প্রথম আর্টিফিসিয়েল ইন্টেলিজেন্স প্রোগ্রাম ELIZAর সাথে পরিচিত
হয় সাধারণ মানুষ।
ARPANET-এর
সাথে যুক্ত সবগুলি কম্পিউটারই ছিল আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের।
কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে গেলে টেলনেট প্রটোকল এবং ফাইল ট্রান্সফার
প্রটোকলে কিছু পরিবর্তন করে তাদেরকে আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করতে হবে। সেটা
করতে গিয়ে তৈরি হলো টিসিপি/আই-পি পদ্ধতি।
টিসিপি/আইপি
১৯৭৩ সালে
ARPAর নাম বদলে ডিফেন্স এডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি বা DARPA রাখা হয়। শুরুতেই
প্রকল্প নেয়া হয় স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক ও রেডিও-নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নরওয়ে এবং যুক্তরাজ্যের
চারটি কম্পিউটারের মধ্যে যোগাযোগ এবং সেই নেটওয়ার্কের সাথে ARPANET নেটওয়ার্ক সংযুক্ত
কম্পিউটারগুলির যোগাযোগের ব্যবস্থা করা। বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিলো এখানে। রেডিওনির্ভর
নেটওয়ার্ক, স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক এগুলির ধরন পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এদের ইন্টারফেস,
প্যাকেট সাইজ, ট্রান্সমিশান রেট সবগুলি আলাদা। এগুলির মধ্যে ডেটা এক্সচেঞ্জ করতে হলে
সবগুলি কম্পিউটারকে একটি নির্দিষ্ট প্রটোকল মেনে চলতে হবে। নেটওয়ার্ক টু নেটওয়ার্ক
কানেকশান প্রটোকল তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়লো।
এই কাজের জন্য
প্রতিষ্ঠিত হলো ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক ওয়ার্কিং গ্রুপ। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির
গবেষক ভিনটন সার্ফ এই ওয়ার্কিং গ্রুপের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। বিবিএন কোম্পানির রবার্ট
কান আর ভিনটন সার্ফ নেটওয়ার্ক থেকে নেটওয়ার্কের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ট্রান্সমিশান
কন্ট্রোল প্রটোকল (টিসিপি) তৈরি করেন ১৯৭৪ সালে। ARPANET এতদিন যে নেটওয়ার্ক কন্ট্রোল
প্রটোকল ব্যবহার করতো তাতে ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার সুযোগ ছিল না। এবার
তার বদলে টিসিপি ব্যবহার শুরু হলো।
টিসিপি নেটওয়ার্ক
স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করে দেয় – যেখানে নেটওয়ার্কের কম্পিউটারগুলি কীভাবে কাজ করবে,
তাদের ডেটার ধরন কী হতে হবে, প্যাকেট সাইজ কত হবে ইত্যাদি সুনির্দিষ্টভাবে ঠিক করে
দেয়া হয়। বিভিন্ন হোস্ট কম্পিউটারের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য তো থাকবেই। তাদের রাউটার
এবং নেটওয়ার্কিং এর মধ্যেও কিছুটা পার্থক্য থাকাটাও স্বাভাবিক। নতুন ট্রান্সপোর্ট কনট্রোল
প্রটোকল এবং ইন্টারনেট প্রটোকলের সমন্বয় – টিসিপি/আইপি হলো কম্পিউটার টু কম্পিউটার
নেটওয়ার্কিং এর স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকল।
ইন্টারনেট প্রটোকল
বা আইপিকে বলা হয় কানেকশানলেস প্রটোকল – অর্থাৎ ডেটাকে ছোট ছোট প্যাকেট করার পর তাদের
মধ্যে কোন কানেকশান থাকে না যতক্ষণ না সেগুলি একসাথে করে ডেলিভারি দেয়া হয়। অর্থাৎ
ডেটা প্যাকেটে ওলটপালট হলে বা কোন প্যাকেট নষ্ট হয়ে গেলে ডেটা ডেলিভারি হবে না।
ট্রান্সপোর্ট
কনট্রোল প্রটোকল বা টিসিপির চারটি স্তর বা লেয়ার থাকে – (১) নেটওয়ার্ক ইন্টারফেস লেয়ার
– ডেটা প্যাকেট ফরম্যাট করা এবং সেগুলিকে নেটওয়ার্কে পাঠানো এই লেয়ারের কাজ, (২) ইন্টারনেট
লেয়ার – নেটওয়ার্কের ঠিকানা নির্ধারণ এই লেয়ারের কাজ। ইন্টারনেট প্রটোকল এই লেয়ারের
অংশ; (৩) ট্রান্সপোর্ট লেয়ার – ডেটা ট্রান্সপোর্ট এই লেয়ারের কাজ, এবং (৪) অ্যাপ্লিকেশান
লেয়ার – ফাইল ট্রান্সপোর্ট প্রটোকল, ডোমেইন নেইম সিস্টেম (ডিএনএস), সিম্পল মেইল ট্রান্সফার
প্রোগ্রাম (এসএমটিপি) এই স্তরের অন্তর্ভুক্ত।
নেটওয়ার্কের
আই-পি অ্যাড্রেস হলো প্রত্যেক কম্পিউটার নেটওয়ার্কের জন্য স্বতন্ত্র সংখ্যা। যদি ঐ
কম্পিউটার ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হয় তখন সেই স্বতন্ত্র সংখ্যা দিয়ে সেই কম্পিউটার
নেটওয়ার্ককে চিহ্নিত করা যায়। যেমন 8.8.8.8 বা 8.8.4.4 হলো গুগলের আই-পি অ্যাড্রেস।
ইন্টারনেটে প্রত্যেকটি নেটওয়ার্কের পরিচিতি সংখ্যা স্বতন্ত্র। এগুলি মনে রাখা খুবই
কষ্টকর। তাই ১৯৮৩ সালে ইন্টারনেটের ডোমেইন নেইম সিস্টেম চালু করা হয়। ইন্টারনেট প্রোটোকল
বা আই-পি অ্যাড্রেসের বদলে ডোমেইন নাম দিয়ে সহজে ইন্টারনেটের ওয়েবসাইটে ঢোকা যায়। অর্থাৎ
8.8.8.8 এর বদলে google.com হলো গুগলের ডোমেইন নেইম।
ইন্টারনেটের
জন্ম
সেই ১৯৬৩ সালে
প্যাকেট সুইচিং-এর মাধ্যমে আস্তে আস্তে বিভিন্ন নেটওয়ার্কিং-এর প্রয়োজনীয় প্রটোকল এবং
ইমেইল যোগাযোগ সবকিছু ঠিক হবার পর ১৯৮৩ সালের
১ জানুয়ারি ইন্টারনেটের জন্ম হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। কারণ সেদিন থেকে ARPANET
TCP/IP-কে অনলাইনে ডাটা আদান-প্রদানের স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ঘোষণা করে। ধরতে গেলে সেদিন
থেকেই আধুনিক ইন্টারনেটের পথচলা শুরু হয়। তারপর থেকে সবগুলি কম্পিউটারই টিসিপি/আইপি
পদ্ধতি মেনে নিয়ে তৈরি করা হয়। ১৯৮০র দশক শেষ হবার আগেই এক লক্ষ ষাট হাজারের বেশি হোস্ট
কম্পিউটার ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হয়।
ইন্টারনেটের
মাধ্যমে ডেটা প্রবাহ (আদান-প্রদান) কয়েকটি ধাপে ঘটে। ধরা যাক আপনি বিজ্ঞানচিন্তার পাঠক,
অনলাইনে বিজ্ঞানচিন্তা পড়তে চান। এই কাজটি করার জন্য আপনার লাগবে একটি যন্ত্র যেটা
দিয়ে ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে পারবেন। এই যন্ত্র হতে পারে আপনার স্মার্টফোন, ল্যাপটপ
কম্পিউটার, ডেস্কটপ কম্পিউটার, ট্যাবলেট কম্পিউটার। এসব যন্ত্রে টিসিপি/আইপি আছে। অর্থাৎ
আপনার ইন্টারনেট সংযোগের জন্য আপনার কম্পিউটারের আই-পি অ্যাড্রেস আছে। এখন আপনার জানতে
হবে বিজ্ঞানচিন্তার ওয়েবসাইটের আই-পি অ্যাড্রেস বা ওয়েব অ্যাড্রেস। এখন আপনি ইন্টারনেট
ব্রাউজারের মাধ্যমে বিজ্ঞানচিন্তার ওয়েবসাইটের ঠিকানা টাইপ করলেন। এখানে আপনি হলেন
ক্লায়েন্ট আর বিজ্ঞানচিন্তার ওয়েবসাইট যে কম্পিউটার সার্ভার হোস্ট করে সেই সার্ভার
হলো হোস্ট। হোস্ট থেকে আপনার কাছে ডেটা (বিজ্ঞানচিন্তার লেখা) আসার ক্ষেত্রে কয়েকটি
ধাপ অতিক্রম করতে হয়। প্রথমত আপনার নেটওয়ার্কের সাথে বিজ্ঞানচিন্তার নেটওয়ার্কের সংযোগ
ঘটতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনি যেসব তথ্য দিলেন (ওয়েব সাইট টাইপ করলেন) তা হোস্ট কম্পিউটারে
পৌঁছার জন্য আপনার রাউটারের মাধ্যমে বিজ্ঞানচিন্তার নেটওয়ার্কের রাউটার পেরিয়ে বিজ্ঞানচিন্তার
সার্ভারে পৌঁছে যাবে। আই-পি আড্রেসে ভুল থাকলে আপনার তথ্য হোস্টের সার্ভারে পৌঁছাবে
না। সংযোগ স্থাপনের পর হোস্ট আপনাকে ডেটা পাঠাবে একই পদ্ধতিতে। বড় ডেটা ছোট ছোট প্যাকেটে
ভাগ হয়ে আপনার কম্পিউটারে এসে পৌঁছাবে। এই ডেটা প্রবাহের গতি নির্ভর করে আপনার ইন্টারনেটের
গতি এবং হোস্টের সার্ভারের ইন্টারনেটের গতির উপর। ইন্টারনেটের ডেটা প্রবাহে এখন অনেক
নিরাপত্তার ব্যবস্থা সংযোজিত হলেও, ডেটা প্রবাহের মূল পদ্ধতি একই আছে।
ইন্টারনেটের
প্রসার সত্যিকারে বাড়তে শুরু করে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (www)র উদ্ভাবনের পর থেকে।
ইন্টারনেটের
বাণিজ্য শুরু এবং wwwর জগত
ইন্টারনেটের
শুরুতেই কিন্তু ওয়েবসাইট ছিল না। ওয়েবসাইট তৈরি এবং wwwর সূচনা হয় ইন্টারনেট চালু হবারও
প্রায় ছয়-সাত বছর পর। একটি বিশেষ প্রয়োজন মেটাতেই ওয়েবসাইটের সূচনা হয়েছিল। ইওরোপিয়ান
সেন্টার ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ – সার্ন-এ গবেষণা করেন কয়েক হাজার পদার্থবিজ্ঞানী এবং
অন্যান্য গবেষক। আরো কয়েক হাজার অতিথি গবেষক আসেন এখানে বিভিন্ন মেয়াদে গবেষণা করার
জন্য। এই হাজার হাজার গবেষকের কাজ, কম্পিউটার, ডেটা, ডকুমেন্ট ইত্যাদির সঠিক ব্যবস্থাপনা
খুব সহজ ছিল না ১৯৮০র দশকে। কোন একটি ঘোষণা দিতে গেলেও সবার সাথে যোগাযোগ করা সহজ ছিল
না। ব্রিটিশ কম্পিউটার বিজ্ঞানী টিম বারনারস-লি সার্নে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৮৫ সালে। তিনি
এই সমস্যার কীভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করলেন। কয়েক বছরের মধ্যেই
তিনি এর একটি ইন্টারনেট ভিত্তিক সমাধান করে ফেললেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড
ওয়েব (www) উদ্ভাবন করেন।
|
টিম বারনারস-লি (জন্ম লন্ডন, ৮/৬/১৯৫৫) |
সবার জন্য ইন্টারনেট
ব্যবহার সহজ করে তুলেছেন টিম বারনারস-লি। প্রত্যেকটি ওয়েব পেজের জন্য স্ট্যান্ডার্ড
ওয়েব অ্যাড্রেস – ইউনিভার্সাল রিসোর্স লোকেটর (URL) সিস্টেম তৈরি করেন তিনি। তিনিই
প্রথম ওয়েব ব্রাউজার এবং ওয়েব সার্ভার উদ্ভাবন করেন। ওয়েবপেজ লেখার জন্য Hypertext
Markup Language (HTML) এবং সেই লেখা ওয়েবে পড়ার জন্য Hypertext Transfer Protocol
(HTTP) উদ্ভাবন করেন। পৃথিবীর প্রথম ওয়েবসাইট প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে।
ওয়েবসাইট ব্রাউজ
করার জন্য ইন্টারনেট ওয়েব ব্রাউজার তৈরি হতে শুরু হয় প্রায় একই সময়ে। ইউনিভার্সিটি
অব মিনেসোটায় তৈরি হয় ওয়েব ব্রাউজার গোফার। মোজায়েক ব্রাউজার তৈরি হয় ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ন্যাশনাল সেন্টার ফর সুপারকম্পিউটিং অ্যাপ্লিকেশন্স (NCSA) এর বিজ্ঞানী মার্ক অ্যান্ড্রিসেন
ও এরিক বিনা মোজেইক ওয়েব ব্রাউজার নির্মাণ করেন। ১৯৯৩ সালে তা সবার ব্যবহারের জন্য
চালু করা হয়। তখন থেকে ছবি এবং লেখা একসাথে ওয়েবপেজে প্রকাশিত হতে শুরু করে। এরপর নেটস্কেপ
আসার পর পরবর্তীতে এই ব্রাউজারগুলি আর চলেনি। ১৯৯৫ সালে মাইক্রোসফ্ট নিয়ে আসে ইন্টারনেট
এক্সপ্লোরার। এখন তো অনেক ইন্টারনেট ব্রাউজার।
|
মার্ক অ্যান্ড্রিসেন (জন্ম আইওয়া, আমেরিকা ৯/৭/১৯৭১) |
|
এরিক বিনা (জন্ম ইলিনয়, ২৫/১০/১৯৬৪) |
সাধারণের জন্য
ইন্টারনেট ব্রাউজিং চালু হয়ে যাবার পরপরই ইন্টারনেটের বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়ে যায়।
১৯৯৪ সালে ইয়াহু সার্চ ইঞ্জিন চালু হয়। বই বিক্রির প্লাটফরম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে
আমাজন ১৯৯৪ সালে। ১৯৯৫ সালে চালু হয় অনলাইন নিলামভিত্তিক বিক্রির প্রতিষ্ঠান ই-বে।
১৯৯৮ সালে জন্ম হয় সার্চ ইঞ্জিন গুগলের। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানিগুলি
টেলিফোনের তারের মাধ্যমে ডায়াল-আপ ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া শুরু করে।
২০০০ সালের
শুরু থেকে ডায়াল-আপ থেকে ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কের উত্তরণ শুরু হয়। ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক
হলো সারাক্ষণ ইন্টারনেট চালু থাকার ব্যবস্থা। ইন্টারনেটের গতি বাড়তে থাকে দ্রুত। ইন্টারনেটের
গতি বাড়ার সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় – বিভিন্ন ধরনের অনলাইন কাজকর্ম। ইন্টারনেটের মাধ্যমে
ভিডিও সম্প্রচার শুরু হয়ে যায়। শুরু হয় অনলাইন ভিডিও গেম, এবং সর্বোপরি সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যমের জন্ম হতে শুরু করে।
২০০০ সালের
পর থেকে ইন্টারনেট হয়ে যায় ইন্টার-অ্যাক্টিভ মাধ্যম। অর্থাৎ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরাও
অনলাইনে ডাটা তৈরি করতে থাকে। অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলি একের পর এক আত্মপ্রকাশ
করতে থাকে। ২০০৪ সালে শুরু হয় ফেসবুক। ২০০৫ সালে ইউটিউব। ২০০৬ সালে টুইটার। সাধারণ
জনগণই সক্রিয় হয়ে নিজেদের মধ্যে ডাটা আদান-প্রদান করতে শুরু করে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর
সংখ্যা বাড়তে থাকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে।
ওয়াই-ফাই
ও মোবাইল ইন্টারনেট
ইন্টারনেটের
ব্যবহার সবচেয়ে বেশি বেড়ে যায় যখন মানুষের নাগালের মধ্যে চলে আসে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক
এবং মোবাইল ইন্টারনেট। ল্যাপটপ কম্পিউটার, ট্যাবলেট কম্পিউটার, স্মার্টফোনের প্রসারের
সাথে সাথে বেড়ে যায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারির সংখ্যা। ওয়াই-ফাই প্রযুক্তি ইন্টারনেট সংযোগের
ধরনই বদলে দেয়। তাতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাই শুধু বাড়ে না, বাড়তে থাকে ইন্টারনেট
ব্যবহারের সময়ও। এখন তো ধরতে গেলে উন্নত বিশ্বের মানুষ সারাক্ষণই ইন্টারনেট সংযুক্ত
থাকে।
ওয়ারলেস ফাইডেলিটি
বা ওয়াই-ফাই প্রযুক্তির মাধ্যমে ইন্টারনেট রাউটারের সাথে কম্পিউটার বা কোন তারের সংযোজন
ছাড়াই ইন্টারনেট ব্যবহার করা সম্ভব হয়। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার তারের মাধ্যমে
বাসার কোন একটি নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছে দেয়। একটি ওয়াই-ফাই
রাউটারের সাথে ইন্টারনেট ক্যাবল সংযুক্ত থাকে। এই রাউটার থেকে কোন ধরনের তার ছাড়াই
বাসার সবগুলি ডিভাইসে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া সম্ভব হয়। ওয়াই-ফাই বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে
ডেটা সরবরাহ করে। ইন্টারনেট ক্যাবলের মাধ্যমে যে ডেটা মডেল পর্যন্ত আসে – সেই ডিজিটাল
ডেটা ওয়াই-ফাই রাউটার বেতার তরঙ্গে পরিণত করে এবং তার সাথে সংযুক্ত শক্তিশালী অ্যান্টেনার
মাধ্যমে সঞ্চালন করে। কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট ইত্যাদি যন্ত্রে ওয়াই-ফাই প্রযুক্তি
যুক্ত থাকলে সেটাও ইন্টারনেট রাউটারের মতোই বেতার তরঙ্গের আকারে ডেটা গ্রহণ করে তাকে
ডিজিটাল ডেটায় রূপান্তর করে। আবার ডিজিটাল ডেটা বেতার তরঙ্গে রূপান্তরিত করে ওয়াই-ফাই
রাউটারে পাঠাতে পারে।
মোবাইল ইন্টারনেট
সেলুলার ডেটা ব্যবহার করে ইন্টারনেট সংযোগ ঘটায়। এর জন্য মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলির
সঠিক কারিগরি অবকাঠামো স্থাপন করতে হয়। নেটওয়ার্ক টাওয়ার বা সেল টাওয়ারগুলি নির্দিষ্ট
পরিমাণ এরিয়া কভার করতে পারে। টাওয়ারগুলিতে অ্যান্টেনা এবং ট্রান্স-রিসিভার থাকে যাদের
মাধ্যমে ডেটা আদান-প্রদান করা হয়। সেলুলার ডেটা ট্রান্সমিশান মূলত সুনির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের
বেতার তরঙ্গের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যখন কেউ ইন্টারনেট ব্যবহার
করে তখন মোবাইল ফোন সেই ডিজিটাল ডেটাকে বেতার তরঙ্গে রূপান্তরিত করে সম্প্রচার করে।
সেই তরঙ্গ নিকটবর্তী মোবাইল টাওয়ারে রিসিভ করার পর রিডাইরেক্ট করা হয় যথাযথ আই-পি অ্যাড্রেসে।
হোস্ট সার্ভার থেকেও একই পদ্ধতিতে মোবাইল টাওয়ারের মাধ্যমে বেতার তরঙ্গের আকারে মোবাইল
ফোনে আসে।
ইন্টারনেটের
বিবর্তন
কম্পিউটার এবং
টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটেছে গত কয়েক বছরে। এর সরাসরি প্রভাব
পড়েছে ইন্টারনেট প্রযুক্তিতে। ফলে ইন্টারনেটের শুরু থেকে এপর্যন্ত বিবর্তন ঘটেছে অনেক।
এই বিবর্তনকে তিনটি ধাপে বর্ণনা করা যায় – ওয়েব ১.০, ওয়েব ২.০, এবং ওয়েব ৩.০।
ওয়েব ১.০ হলো
প্রাথমিক যুগের ইন্টারনেট যাকে স্ট্যাটিক ওয়েবও বলা হয়ে থাকে। ১৯৯০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত
সময়ের ওয়েবপেজগুলি এই ওয়েব ১.০ আওতাভুক্ত। এই সময়ের ওয়েবপেজগুলি একবার অনলাইনে প্রকাশিত
হবার পর আর আপডেট করা হয়নি। সেখানে পাঠকের মন্তব্য করার কোন সুযোগ ছিল না। সেই সময়ের
ওয়েব ব্রাউজারগুলি – যেমন নেটস্ক্যাপ নেভিগেটর এবং ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার তত উন্নত
ছিল না। সার্চ ইঞ্জিনগুলি – যেমন ইয়াহু – খুব একটা শক্তিশালী ছিল না। ওয়েবসাইটগুলি
ছিল মূলত টেক্সট ভিত্তিক। তেমন কোন ছবি বা ভিডিও আপলোড করার সুযোগ ছিল না।
ওয়েব ২.০ –
২০০০ সালের পর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যে ধরনের ইন্টারনেট কন্টেন্ট আমরা ব্যবহার
করছি তা ওয়েব ২.০ পর্যায়ভুক্ত। ওয়েব ২.০কে সোশাল ওয়েবও বলা হয়। ওয়েব ২.০ অনেক বেশি
গ্রাহকবান্ধব এবং মিথষ্ক্রিয়াসম্পন্ন। অর্থাৎ ওয়েবসাইট ব্যবহারকারী ওয়েবপেজে নিজের
পছন্দ অপছন্দ জানাতে পারে, ইউজার এবং প্রোভাইডারের মধ্যে সরাসরি অনলাইন ইন্টার-অ্যাকশান
ঘটে। ব্লগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, উইকিস, ভিডিও-শেয়ারিং ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীকে নিজেদের
কন্টেন্ট প্রকাশ করার সুযোগ দেয়। গুগল ডকের মতো রিয়েল-টাইম অনলাইন ফাইল এডিটিং সম্ভব
হচ্ছে ওয়েব ২.০তে।
ওয়েব ৩.০ –
২০১০ থেকে শুরু হয়ে দিনে দিনে উন্নত হচ্ছে এযুগের ইন্টারনেটের ওয়েবসাইটগুলি। এ পর্যায়ের
ওয়েবকে ডিসেন্ট্রালাইজড ওয়েবও বলা হয়। মানুষের বদলে কম্পিউটার (মেশিন)ও এই ওয়েব ব্যবহার
করতে সক্ষম। অনলাইন সার্ভিস প্রোভাইডারগুলি অনেক সার্ভিস স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেশিনের মাধ্যমেই
দিতে সক্ষম হচ্ছে। এটাকে ডিসেন্ট্রালাইজড বলা হচ্ছে – কারণ সব ডেটা এক কেন্দ্রে সংরক্ষণ
করার বদলে একাধিক সার্ভারে সংরক্ষণ করা হচ্ছে যেন ডেটা সুরক্ষিত থাকে। ব্লকচেইন টেকনোলজি
ব্যবহার করে ডেটা সুরক্ষিত রাখা হচ্ছে ওয়েব ৩.০তে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং
উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে ওয়েব ৩.০ ইন্টারনেটে। সব ধরনের প্লাটফরমেই কাজ করছে এযুগের
ইন্টারনেট। ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রাখা এবং সুরক্ষিত রাখার ব্যাপারে বিশেষ যত্নশীল ওয়েব
৩.০। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন অনেক বেশি ভূমিকা রাখছে ইন্টারনেটে।
মানুষের কাজে সহায়তা করছে ইন্টারনেট ভিত্তিক সাহায্যকারী – যেমন সিরি, আলেক্সা, গুগল
অ্যাসিস্ট্যান্ট।
বর্তমানের ইন্টারনেট
ক্লাউড কম্পিউটিং ব্যবহার করছে। ডাটা সংরক্ষণ করার জন্য এখন অনলাইন সার্ভার ব্যবহার
করা হচ্ছে। আমাজন ওয়েব সার্ভিস, গুগল ক্লাউড, মাইক্রোসফট ওয়ানড্রাইভ প্রভৃতি। চালু
হয়ে গেছে ইন্টারনেট অব থিংস। এখন শুধু মানুষই ইন্টারনেট ব্যবহার করছে তা নয়, আধুনিক
যন্ত্রপাতিগুলিও ইন্টারনেটের মাধ্যমে একে অপরের সাথে সংযোগ স্থাপন করে ডাটা আদান-প্রদান
করছে।
সারাপৃথিবী
সারাক্ষণ ইন্টারনেটের আওতায় রাখার জন্য বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি অনেক আধুনিক পরিকল্পনা
হাতে নিয়েছে। গুগলের লুন বেলুন, স্পেস-এক্স এর স্টারলিংক স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক, ফেসবুকের
ইন্টারনেট ড্রোন এব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে।
ইলন মাস্ক স্পেস-এক্স
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার জন্য স্টারলিংক নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছেন।
পৃথিবীর লো-আর্থ অরবিটে কয়েক হাজার ছোট ছোট স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়েছে যা পৃথিবী
থেকে ৫৫০ কিলোমিটার থেকে ১২০০ কিলোমিটার উচ্চতায় পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। ভবিষ্যতে আরো
প্রায় দশ হাজার এরকম স্যাটেলাইট পাঠানো হবে আকাশে। এই স্যাটেলাইটগুলির মাধ্যমে ইন্টারনেট
সেবা প্রদান করা হবে যেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো সম্ভব
হয়নি। এভাবে অদূর ভবিষ্যতে সারাপৃথিবী ইন্টারনেটের আওতায় চলে আসবে।
তবে সুদূর ভবিষ্যতের
ইন্টারনেট হবে কোয়ান্টাম ইন্টারনেট। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং সংক্রান্ত গবেষণা চলছে। কোয়ান্টাম
কম্পিউটার হতে চলেছে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিকতম কম্পিউটার প্রযুক্তি। কোয়ান্টাম কম্পিউটারে
ব্যবহার করার জন্য ইন্টারনেট আরো আধুনিক হবে। তার প্রটোকলও বদলে যাবে। তখন কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তা ও মেশিনের সহায়তায় মানুষ এক নতুন ইন্টারনেটের জগতে বাস করবে।
তথ্যসূত্র
১। লি বাইগ্রেভ
ও জন বিং (সম্পাদিত), ইন্টারনেট গভার্নেন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও ইন্সটিটিউশানস, অক্সফোর্ড
ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৯।
২। জি ও’রিগ্যান,
এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব কম্পিউটিং, স্প্রিংগার ন্যাচার, ২০২১
৩। চার্লস বাউম্যান,
হাউ থিংস ওয়ার্ক দ্য টেকনোলজি এডিশান, সি আর সি প্রেস, ২০২২।
৪। বার্নি ওয়ার্ফ
(সম্পাদিত), জিওগ্রাফিস অব দি ইন্টারনেট, টেইলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস গ্রুপ, ২০২০।
_________________
বিজ্ঞানচিন্তা সেপ্টেম্বর ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত