“I travel not to go anywhere, but to go. I travel for
travel’s sake. The great affair is to move.” রবার্ট লুই স্টিভেনসনের এই কথাগুলি আমার
খুব ভালো লাগে। মনে হয় আমার মনের কথা তিনি বলে গেছেন আমার জন্মের শত বছর আগে
- আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ। ভ্রমণে আসার সময়
তাই দ্রষ্টব্যের কোন নির্দিষ্ট তালিকা থাকে না আমার। যে কোনো নতুন জায়গায় নতুন পথ হেঁটে
আমি যে আনন্দ পাই – তার সাথে অন্য কোনকিছুর তুলনা চলে না। আজ সারাদিন হেঁটে বেড়িয়েছি
কলম্বোর পথে পথে।
হোটেলে ফিরেছি একটু আগে। পথ চিনতে সমস্যা হয়নি। রাস্তার নাম
পড়ারও দরকার পড়েনি। সকালে বের হবার সময় আশেপাশে তাকিয়ে দেখেছিলাম এই ব্লকে এই হোটেলটাই
সবচেয়ে উঁচু। ফেরার পথে সেটাই কাজে লেগেছে। দূর থেকে লাইটহাউজের কাজ করেছে আটাশ তলা
বিল্ডিং-এর মাথায় চারদিকে লাগানো “সিনামন রেড”-এর টকটকে লাল জ্বলন্ত অক্ষরগুলি।
শ্রীলংকানরা নাকি খুবই নিয়মনিষ্ঠ জীবনযাপন করে। কালচার শক
সিরিজের বইগুলিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রীতিনীতি সম্পর্কে অনেক কিছু লেখা থাকে। সেখানেই
পড়েছিলাম শ্রীলংকানরা আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ টাইপের। মেলবোর্নে আমার পরিচিত
যে ক’জন শ্রীলংকান আছে, তাদেরকে অবশ্য সেরকম নিয়মনিষ্ঠ বলে মনে হয় না। এখানেও আর্লি
টু বেডের তেমন কোন জোরালো প্রমাণ দেখলাম না। রাত সাড়ে দশটাতেও কলম্বো শহরের রাস্তাগুলি
ব্যস্ত, খাবারের দোকানে ভীড়, আর শহরের যে পাশে এসে মিশছে ভারত মহাসাগরের ঢেউ, সেখানে
এখনো আনন্দমুখর মানুষ কোলাহলে মত্ত।
অবশ্য শহুরে মানুষের জীবনযাপন সারাদেশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব
করে না কিছুতেই। বিশেষ করে তা যদি হয় শ্রীলংকার মতো উন্নয়নশীল কোনো দেশ। এই কলম্বো
শহরের আয়তন মাত্র ৩৭ বর্গকিলোমিটার। প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষ এই শহরের স্থায়ী বাসিন্দা।
আর এই শহরটি সারা পৃথিবীর পর্যটকদের এতই প্রিয় যে গড়ে প্রতিদিন পাঁচ লাখের বেশি পর্যটক
এখানে থাকে। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় সাড়ে তের হাজার মানুষ বাস করে এই শহরে। ঢাকার
সাথে তুলনা এসেই যায়। ঢাকা কলম্বোর চেয়ে প্রায় দশ গুণ বড় শহর। আজ একদিন ঘুরেই কলম্বো
শহর মোটামুটি দেখে ফেলেছি। অথচ শুরুতে আমি কলম্বোতেই পুরো সাত দিন থাকার প্ল্যান করেছিলাম।
কনিষ্ককে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। সে-ই আমাকে জোর করে প্ল্যান
বদল করিয়েছে। বলেছে কলম্বোতে সাত দিন ধরে দেখার কিছুই নেই। তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর
ক্যান্ডি, এল্লা, ডামবুল্লা।
কনিষ্ক আমার মেলবোর্নের প্রতিবেশী। কয়েক বছর থেকেই সে বলছিল
শ্রীলংকায় বেড়াতে যাবার জন্য। প্রসঙ্গ উঠলেই ঘ্যান ঘ্যান করতো - শ্রীলংকা কত সুন্দর,
কত কিছু দেখার আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজের দেশ সম্পর্কে আমরা নিজেদের মধ্যে যতই সমালোচনা
করি না কেন, অন্যদের কাছে নিজের দেশকে সবসময়ই স্বর্গের সাথে তুলনা করি। সেহিসেবে কনিষ্কের
কথায় শুরুতে আমি স্বাভাবিকভাবেই খুব একটা গুরুত্ব দিইনি।
তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম অজিতকে।
সে কাজের সূত্রে অনেকবার ঢাকা থেকে কলম্বো গেছে। সে বললো, “ওখানে সমুদ্র ছাড়া আর দেখার
কিছুই নেই। যেদিকেই হাঁটবি – সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছাবি। সমুদ্রের পাড়ে বসে বসে হাওয়া খাবি,
ডাব খাবি, আর সন্ধ্যা হলে হোটেলে ফিরে আসবি।“
“শ্রী লংকায় আর কিছু নেই?” আমি কিছুটা হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
“আর কী থাকবে? বানর আছে, হাতি আছে। আর রত্নপুর নামে কলম্বো
থেকে কিছু দূরে একটা জায়গা আছে – যেখানে রত্ন-টত্ন-পাথর-টাথর পাওয়া যায়। তুই যদি ওসব
কিনতে চাস – তাহলে ওখানে যেতে পারিস।“
“রত্ন-টত্ন-পাথর-টাথর”-এ আমার কোন আকর্ষণ নেই, কৌতূহলও নেই।
সুতরাং ওখানে যাবার দরকার নেই। তবে শ্রীলংকার পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ট্রেনে ভ্রমণ করার
খুব ইচ্ছে আছে। সে হিসেবে মোটামুটি একটা প্ল্যান করে এসেছি - দু-রাত কলম্বোয়, দু-রাত
ক্যান্ডিতে, এক রাত এল্লায় আবার ফেরার পথে দু’রাত কলম্বোতে।
কলম্বোর প্রথম রাতের ঘণ্টাখানেকও পাইনি। হোটেলে পৌঁছাতেই
ভোর হয়ে গেছে। একটা ক্লান্তিনিবারণী হট শাওয়ার নিয়ে এলিয়ে পড়েছিলাম বিছানায়। শুয়ে শুয়ে
ভোরের কলম্বো দেখতে দেখতে ভাবছিলাম ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু ইতিহাস।
সামনে টলটলে নীল পানির যে হ্রদ দেখা যাচ্ছে – তার পাড়ে বিশাল
বিশাল আম গাছের সারি। কলম্বো নামের সাথে আছে আম গাছের নিবিড় সম্পর্ক। শ্রীলংকানরা আমকে
বলে আম্বো। আর কোলা হলো যে গাছে প্রচুর পাতা হয়, কিন্তু ফল হয় না। এখানে অনেক আম গাছে
প্রচুর পাতা হয়, কিন্তু ফল হয় না। সেই নিস্ফলা-আমগাছ ‘কোলা-আম্বো’ থেকে হয়েছে কলম্বো।
কত দীর্ঘ ঝড় ঝাপটা টানাটানি গেছে এই শহর এই দ্বীপ নিয়ে। মানচিত্রে
বঙ্গোপসাগরের পশ্চিমে আর ভারত মহাসাগরের উত্তরে বাংলাদেশের অর্ধেকের চেয়েও কম আয়তনের অশ্রুবিন্দুর মতো এই ছোট্ট দ্বীপটিকে পশ্চিমারা
আদর করে নাম দিয়েছে ‘ইন্ডিয়াস টিয়ারড্রপ’। দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তর শ্রীলংকার দূরত্ব
মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার। আবার এই দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে যারা মুগ্ধ হয়েছেন
– তাদের কাছে এর নাম হয়েছে ‘পার্ল অব দি ইন্ডিয়ান ওশেন’ – ভারত মহাসাগরের মুক্তা।
মণি-মুক্তার প্রতি মানুষের লোভ সাংঘাতিক। সেই লোভের বশবর্তী
হয়ে ভারত মহাসাগরের মুক্তার মতো সুন্দর এই দ্বীপের দখল নিতে হামলে পড়েছে যুগে যুগে
অনেকেই।
প্রায় দশ হাজার বছর আগে থেকে এই দ্বীপে আদিবাসিরা বাস করে
আসছে। প্রস্তর যুগের মানুষের বসবাসের চিহ্ন পাওয়া গেছে এখানে। সাড়ে নয় হাজার বছর নিজেদের
মতো বাস করেছে তারা – দলভুক্ত গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ যেভাবে বাস করতো। ভারতবর্ষের এত কাছাকাছি
দ্বীপ হওয়ার কারণে ভারতবর্ষ থেকে অনেকবার অনেকে দখল করে নিয়েছিল এই দ্বীপভূমি। ইতিহাস
সেই সব দখলদারদের সেভাবে মনেও রাখেনি। রামায়ণ রচিত হয়েছিল যেই সময় – সেই সময় রামায়ণে
এই দ্বীপের নাম লংকা হলেও – এই দ্বীপের সাংবিধানিক নাম শ্রীলংকা হয়েছে মাত্র সেদিন
- ১৯৭২ সালে।
ইতিহাস যে রাজাকে মনে রেখেছে তার নাম বিজয় সিংহ। ক্রিস্টপূর্ব
৪৮০ সালে ভারত থেকে এখানে এসে তিনি রাজা হয়ে বসেন। বলা যায় – তখন থেকে এই দ্বীপের নাম
হয় সিংহল, ভাষার নাম হয় সিংহলি। বর্তমানে বৌদ্ধধর্মের প্রাধান্য হলেও গৌতম বুদ্ধ কখনো
এই দ্বীপে আসেননি। এই দ্বীপে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার এবং প্রভাব শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব
২৫০ থেকে ২১০ সালের মধ্যে। ভারতের সম্রাট অশোকের আমলে। তিনি ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের
সিংহলে পাঠিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার এবং প্রসার ঘটান।
পনের শ সাল পর্যন্ত অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়েছে এই দ্বীপের সম্পদ
আহরণের লোভে দক্ষিণ ভারত থেকে আসা বিভিন্ন শাসকের মধ্যে। ১৫০৫ সালে পর্তুগিজরা এলো
এই দ্বীপের দারুচিনির লোভে। ততদিনে বিশ্বজোড়া নাম হয়ে গেছে দারুচিনি দ্বীপ – উন্নত
মানের দারুচিনির প্রভূত উৎপাদনে। পর্তুগিজরা দ্বীপের চারপাশের সবকিছু দখল করে নিজেদের
দুর্গ তৈরি করে ফেললো। ক্ষমতা দখলের পর চলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। তৈরি হতে থাকে গীর্জার
পর গীর্জা। লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে চলে ধর্মান্তর।
প্রায় দেড়শো বছর ধরে চলে পর্তুগিজদের শাসন শোষণ সম্প্রসারণ।
এরপর আসে ওলন্দাজরা ১৬৫৬ সালে। পর্তুগিজদের হটিয়ে তারা দখল নেয় এই দ্বীপের। দামী মসলার
রপ্তানী বাজার চলে আসে ওলন্দাজদের হাতে। কেটে যায় আরো ১৪০ বছর। ১৭৯৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানি ডাচদের হটিয়ে দখল নেয় সিলনের। পুরো ভারতবর্ষ তখন তাদের দখলে। ব্রিটিশ রাজত্ব
চলে ১৯৪৮ পর্যন্ত। মূলত ব্রিটিশ আমলেই আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হয় সিলন।
ঘন্টা চারেকের একটা ঘুম দিয়ে উঠলাম। জেটল্যাগের জট পাকিয়ে
গেছে। সময় পিছিয়ে গেছে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা। এখানে সকাল সাড়ে দশ হলেও শরীরে বিকেল চারটার
ক্লান্তি। কিন্তু ক্লান্তিকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। দ্রুত রেডি হয়ে বের হয়ে গেলাম।
লিফ্টে দেখা হলো একজন শ্বেতাঙ্গ ইওরোপিয়ানের সাথে। বুড়ো
আমাকে দেখেই সহাস্যে মাথা নেড়ে বললেন, “আয়ুবাওয়ান”। ভদ্রলোক নিশ্চয় আমাকে শ্রীলংকান
মনে করেছেন। শ্রীলংকান শব্দ মুখস্ত করে মুগ্ধ করতে চাচ্ছেন। আমিও মাথা নেড়ে বললাম,
“আয়ুবাওয়ান”। সিংহলি এই শব্দটির অর্থ ওয়েলকাম গুডবাই দুটোই হতে পারে। আমার বাংলা-কানে
হঠাৎ শুনলে মনে হয় ‘আয়ু বাড়ান’।
হোটেলের বাইরে পা দিয়েই বুঝলাম চামড়া পুড়ে যাবার মত গরম এখানে।
যেমন গরম, তেমন আর্দ্র আবহাওয়া। বাংলাদেশে এপ্রিল মে মাসে এরকম আর্দ্রতা থাকে। এখানে
নাকি সারা বছরই এরকম - শুধুমাত্র দুটো ঋতু – গ্রীষ্ম এবং বর্ষা। এখন গ্রীষ্ম চলছে
– অর্থাৎ বৃষ্টি তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম হবে।
নতুন শহরে আমি যেদিকে দুচোখ যায় – চলি। রাস্তা ঝকঝকে না হলেও
মোটামুটি পরিষ্কার। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলার বদভ্যাস নেই এখানকার মানুষের। কিন্তু
প্রচুর গাছপালায় ঢাকা ফুটপাত – পাখিদের মলে মলাকার। গাছের নিচ দিয়ে ছাতা খুলে না হাঁটলে
বিপদের সম্ভাবনা আছে।
শনিবার, ছুটির দিন হলেও রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। ইন্ডিয়ান টাটা
অনেক, কিন্তু জাপানি গাড়ির আধিক্য চোখে পড়ে। মার্সিডিজ এবং বিএমডাব্লিউর সংখ্যাও চোখে
পড়ার মতো। শ্রীলংকা গরীব দেশ নয়। এদের মাথাপিছু বার্ষিক গড় আয় তিন হাজার এক শ ডলার,
বাংলাদেশের দুই হাজার চারশ ডলার।
ট্রাফিক আইন মেনে চলে সবাই। সবচেয়ে যেটা ভালো লাগলো সেটা
হলো রাস্তা পার হতে কোন সমস্যা হচ্ছে না, কারণ রেড লাইটে সব গাড়ি থামছে। বাংলাদেশ এবং
ভারতের বিভিন্ন শহরে হেঁটে রাস্তা পার হওয়া একটা বিরাট সমস্যা। এখানে সেই সমস্যা নেই।
পানি কেনার জন্য ছোট্ট একটা দোকানে ঢুকলাম। চমৎকার ইংরেজি
বললেন মধ্যবয়সী দোকানি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে ইংরেজি শিক্ষার যে প্রভাব রেখে
গেছে – তা অনেক ভালো ফল দিচ্ছে। ২০২৩ সালে প্রায় পনের লক্ষ পর্যটক এসেছেন শ্রীলংকায়।
ভাষা নিয়ে কোন অসুবিধা হয় না তাদের। রাস্তার নামফলকও সিংহলি, তামিল আর ইংরেজিতে লেখা।
পর্যটকবান্ধব শহর হবার পূর্বশর্ত এরা ঠিকই পূরণ করছে।
হাঁটতে হাঁটতে ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছাকাছি চলে এসেছি। এই
পার্কের নাম বদলে এখন বিহারা-মহাদেবী পার্ক রাখা হয়েছে। নাম বদলানোর ব্যাপারটাকে অনেকেই
দেশাত্মবোধের পরিচয় মনে করেন। পার্কের কাছে খোলা জায়গায় ছোট্ট মেলা বসেছে। স্যাটারডে
মার্কেট। শ্রীলংকান লোকজ খাবার পরখ করে দেখা যাক। কাঠাল পাতায় মোড়ানো পিঠে একটির দাম
একশ রুপি, একটি বড় জিলাপি একশ রুপি। পিঠে সম্ভবত আজ সকালে বানানো হয়েছে – আমাদের তালের
পিঠের স্বাদ। কিন্তু জিলাপির স্বাদ জঘন্য - নারকেল তেল দিয়ে ভাজা।
সারি সারি দারুচিনি গাছের সাজানো বাগান পার্কের এক পাশে।
এই গাছের ছালের লোভেই কত যুদ্ধ হয়েছে এই দেশে, ছড়িয়েছে কত হিংসা। হয়তো সেজন্যই তার একটু দূরে খোলা জায়গায় পাথরের বেদীর উপর স্থাপন
করা হয়েছে ধ্যানরত সোনালী বুদ্ধমূর্তি – অহিংসার প্রতিমূর্তি।