সিটবেল্ট বেঁধে রাখার সাইনটা টুং করে অফ হয়ে যাবার সাথে সাথেই
সিট থেকে উঠে দাঁড়ালেন আমার পাশের সিটের ভদ্রমহিলা। যেভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন,
আমি ভয় পেয়েছিলাম পাছে তাঁর মাথা মাথার ওপরের লাগেজ কেবিনে ধাক্কা খায়। কিন্তু সেরকম
কিছু হলো না। স্বাভাবিক উচ্চতার মানুষের পক্ষে যেখানে মাথা না নুইয়ে প্লেনের জানালার
পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হয় না, সেখানে তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
কেবিনের আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলাম
তিনি গোলাকার গম্ভীর মুখে সরু চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ‘এক্সকিউজ মি’ টাইপের কিছুর
জন্য কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পরেও তিনি কিছু বলছেন না দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি
কি বের হতে চান?”
তিনি কিছু না বলে আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। ছোট ছোট চোখগুলি
মনে হলো আরো ছোট হয়ে গেল। তিনি কি আমার কথা বুঝতে পারেননি? হয়তো ইংরেজি বোঝেন না। আমি
সিট থেকে উঠে তাঁকে বের হবার জায়গা দিলাম। হ্রস্বদৈর্ঘ্যের কারণে তিনি কিছুটা সুবিধাপ্রাপ্ত
হলেও বহরের বাহুল্য তাঁকে করে তুলেছে অত্যন্ত ধীরগামী। দেড়ফুট দৈর্ঘ্যের একটি সিট অতিক্রম
করতে মনে হলো অনন্তকাল সময় নিলেন তিনি।
তিনি সামনে টয়লেটের দিকে রওনা হতেই আমি আবার বসে পড়লাম। ঘুমে
দুচোখ জড়িয়ে আসছে। কিন্তু খাবার দেবার আগে ঘুমিয়ে পড়া ঠিক হবে না। তাছাড়া এই মহিলা
ফিরে এলে আবার উঠতে হবে। জানালার পাশে বসলে পারলে এই ঝামেলা থাকতো না। এবার জানালার
পাশে সিট পাইনি – কারণ অনলাইন চেক ইন করতে দেরি করে ফেলেছি। সাধারণত চব্বিশ ঘন্টা আগে
অনলাইন চেক ইন ওপেন হয়। কিন্তু আমি জানতাম না যে শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সে আটচল্লিশ ঘন্টা
আগে অনলাইন চেক ইন করা যায়। আমি চেক ইন করার সময় সামান্য যে ক’টি সিট অবশিষ্ট ছিল তাদের
মধ্যে পেছনের দিকের এই আইল সিটটাই সবচেয়ে সুবিধাজনক মনে হয়েছিল। ফুল ফ্লাইট। একটা সিটও
খালি নেই আজ। ওঠার সময় বিজনেস ক্লাসের ভেতর দিয়ে আসতে হয়েছে। সেখানকার বেশিরভাগ সিটই
খালি। সেগুলি খালিই থাকবে, তবুও ইকোনমি ক্লাসের কাউকে সেখানে গিয়ে বসতে দেবে না। অর্থনৈতিক
শ্রেণিবিদ্বেষ বর্ণবিদ্বেষের চেয়েও মারাত্মক।
ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের কর্মতৎপরতা বেড়ে গেছে। মেয়েদের পরনে
শাড়ি আর ছেলেরা কোট-টাই। মেয়েরা যেভাবে জাতীয় পোশাক পরেছে, পুরুষ অ্যাটেনডেন্টদেরও
উচিত ছিল সারং বা লুঙ্গি পরা। অবশ্য সেরকম কোন এয়ারলাইন্সেই দেখা যায় না। সিঙ্গাপুর
এয়ারলাইনসেও দেখা যায় মেয়েরা লুঙ্গি পরে, কিন্তু ছেলেরা স্যুট-টাই।
পনের-বিশ মিনিট কেটে গেছে, কিন্তু আমার পার্শ্ববর্তীনি তখনো
ফিরেননি। তিনি সম্ভবত স্পেশাল মিলের অর্ডার দিয়েছিলেন। বিমানবালা খাবার এনে রেখে গেলেন
তাঁর সিটের ট্রে-টেবলে। আরো মিনিট দশেক পর আমি খাবার পেলাম। শ্রীলংকান খাবারে যেরকম
ঝাল থাকার কথা, সেরকম কিছুই নেই। খাবারের গন্ধটাও খুব একটা আকর্ষণীয় মনে হলো না, কেমন
যেন ভিনেগার দেয়া আচারের গন্ধ।
আরো কিছুক্ষণ পর ভদ্রমহিলা ফিরলেন। শরীরের ভারে তাঁর হাঁটাচলার
কষ্ট দেখেই বোঝা যায়। আধখাওয়া খাবারের ট্রে এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে ট্রে-টেবিল গুটিয়ে
উঠে দাঁড়ালাম। ইকোনমি সিটে যেটুকু জায়গা থাকে সেটুকুতেই আমার হয়ে যায়, কিন্তু ভদ্রমহিলার
জন্য তার দ্বিগুণ জায়গার দরকার ছিল। মনে হচ্ছে তিনি আমার সিটে ঢুকে আটকে গেছেন, অথবা
বুঝতে পারছেন না তাঁর সিটের সামনের ট্রেতে রাখা খাবার নিয়ে কী করবেন। আমার হাতের ট্রেতে
একটু ধাক্কা লাগলেই উল্টে যাবে প্লাস্টিকের গ্লাস। আমি চুপচাপ ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছি।
বিরক্তি লাগছে, আবার কেমন এক ধরনের মায়াও হচ্ছে। বয়স্ক ভদ্রমহিলার চেহারা আর গায়ের
রঙ অনেকটাই শ্রীলংকানদের মতো। কিন্তু শ্রীলংকানদের মধ্যে এত মোটা মানুষ সাধারণত দেখা
যায় না। ইন্ডিয়ানও হতে পারেন। প্লেনে ওঠার সময় দেখেছি তাঁর সাথে আরো কয়েকজন ছিল। উনি
হয়তো ওদের কাছাকাছি সিট পাননি।
“আর ইউ ওকে ম্যাম?” উত্তর পাবো না জেনেও জিজ্ঞেস করলাম পরোক্ষভাবে
তাড়া দেয়ার উদ্দেশ্যে। তাতে কিছুটা কাজ হলো। তিনি কোনরকমে ঠেসেঠুসে বসলেন তাঁর সিটে।
আমি আধখাওয়া খাবার শেষ করতে গিয়ে দেখলাম ঠান্ডা হয়ে গেছে সব।
শ্রীলংকা চায়ের জন্য বিখ্যাত। সেই বিখ্যাত চায়ের এক পেয়ালা
নিয়ে চুমুক দিলাম। আমার স্বাদ্গ্রন্থি সম্ভবত ঠিকমতো কাজ করে না। পৃথিবীবিখ্যাত সিলন
টি আর অখ্যাত টং-এর দোকানের টি-র মধ্যে আমি তেমন কোন পার্থক্যই খুঁজে পেলাম না। দ্বিতীয়
বার চুমুক দিতেই কেমন যেন একটা বিশ্রী গন্ধের ঝাঁপটা নাকে এসে লাগলো। আশেপাশের কেউ
একজনের প্রচন্ড বদহজম হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই কেউ একজন আমার পাশের জন
হলে তো আমার ঘুমের বারোটা বাজবে আজ।
বিমানভ্রমণ যত দীর্ঘ হয়, আমার ততই ভালো লাগে। মেলবোর্ন থেকে
কলম্বো সাড়ে দশ ঘন্টার ফ্লাইট। এখনো মাত্র দু’ঘন্টা গেছে। আট ঘন্টার একটা লম্বা ঘুম
দেয়াই যায়। কম্বল ঢেকে সামনের মনিটর অফ করে চোখ বন্ধ করলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ বন্ধ করে
রাখা গেল না। পাশের ভদ্রমহিলা আবার দাঁড়িয়ে গেছেন। ফিসফিস করে কিছু একটা বললেন যার
একটা শব্দও আমি বুঝতে পারলাম না। তবে মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তাঁর পেটে অশান্তি
চলছে। ভ্রমণে পেট খারাপ হওয়া মানে চরম অশান্তি।
তিনি বের হবার পর মনিটর অন করে ফ্লাইটের গতিপথ দেখলাম। প্লেন
এখনো সাউথ অস্ট্রেলিয়া পার হয়ে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার উপর দিয়ে ভারত মহাসাগরের দিকে
যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া পার হয়ে কলম্বো
পৌঁছাতে আরো সাড়ে সাত ঘন্টা লাগবে।
“এক্সকিউজ মি”
চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম সিটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন একজন স্বাস্থ্যবতী
মহিলা।
“ক্যান ইউ পাস মি দ্য ব্যাগ আন্ডার দ্যাট সিট?” উচ্চারণে
ইন্ডিয়ান টান স্পষ্ট।
“আপনি?”
“ওই সিটে যিনি বসেছিলেন তিনি আমার মা।“
নিচু হয়ে পাশের সিটের নিচ থেকে একটা ছোট্ট কাপড়ের ব্যাগ টেনে
নিয়ে মহিলার হাতে দেয়ার সময় জিজ্ঞেস করলাম, “ইজ শি ওকে?”
“শি ইজ নট ফিলিং ভেরি ওয়েল।“
ব্যাগ নিয়ে দ্রুত চলে গেলেন মহিলা। তার চেহারার সাথে তার
মায়ের চেহারা ও ফিগারে যথেষ্ট মিল আছে। আমাদের উপমহাদেশের প্রবাসীরা তাদের মা-বাবাকে
এদেশে নিয়ে আসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদের প্রয়োজনে। প্রয়োজন শেষ হলে আবার দেশে পাঠিয়ে
দেয়। এই ভদ্রমহিলাও মেয়ের কাছে এসেছিলেন, এখন দেশে ফিরে যাচ্ছেন বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু
মা-কে এভাবে একা বসতে কেন দিলো বুঝতে পারছি না।
একটু চোখ লেগে এসেছিল। গায়ে ধাক্কা লাগতেই উঠে দাঁড়ালাম।
আইল সিটে বসার মজা বের হচ্ছে। এভাবে আরো কতবার উঠবস করতে হয় জানি না।
এর মধ্যেই লম্বা একটা ঘুম হয়ে গেল। ব্রেকফাস্ট দেয়ার ঘোষণা
শোনা গেল। মনিটর অন করে দেখলাম আর দেড় ঘন্টা আছে কলম্বোতে পৌঁছানোর।
ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টরা ইতোমধ্যে ফ্রেশ হয়ে গেছেন। ব্রেকফাস্ট
দেয়া হচ্ছে। সিট সোজা করতে গিয়ে পাশের সিটের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। মহিলা এত
শীর্ণ হয়ে গেলেন কীভাবে? ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম - সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন। সিট পেছনে
ঠেলে গলায় বালিশ লাগিয়ে জানালার দিকে মুখ গুঁজে শুয়ে আছেন যিনি তিনি কখন এই সিটে এলেন?
ব্রেকফাস্ট দিতে এসে ফ্লাইট অ্যটেনডেন্ট তাকে ডেকে তুলে সিট
সোজা করতে বললেন। দেখলাম আঠারো উনিশ বছরের এক তরুণ। মহিলার নাতি? এই ছেলে তো শুরুতেই
এখানে বসতে পারতো!
ফ্লাইট ল্যান্ড করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অ্যারাইভাল কার্ড
বা অন্য কোন ফরম পূরণ করতে হলে তো ফ্লাইটে দেয়ার কথা। কোন ফরম দেয়া হলো না। নিশ্চিত
হবার জন্য একজন অ্যাটেনডেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন,
“এয়ারপোর্টের ভেতরে গেলে সব জানা যাবে।“
ফ্লাইট ভালোভাবে ল্যান্ড করলো। ফোনে মেলবোর্ন সময় দেখাচ্ছে
সকাল আটটা। শ্রীলংকা মেলবোর্নের চেয়ে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা পিছিয়ে। শ্রীলংকায় এখন রাত আড়াইটা।
প্লেনের জানালা দিয়ে যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে এয়ারপোর্টের মূল বিল্ডিং থেকে
অনেক দূরে প্লেন থেমে আছে। সবাই কেবিন ব্যাগ হাতে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নড়াচড়া নেই।
যাত্রীদের কথাবার্তা থেকে বুঝতে পারছি অনেকের কানেকটিং ফ্লাইট ছিল – কলম্বো থেকে দিল্লী।
সেই ফ্লাইট অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছে। এই ফ্লাইটটাই আবার মেলবোর্নে যাবে। যাবার শিডিউল
ছিল রাত সাড়ে বারোটায়। আমাদের তো নামতে নামতেই তিনটা বেজে যাবে।
গুণে গুণে যাত্রী নামানো হচ্ছে। সবকিছু এত ধীরে ধীরে হচ্ছে
যে মনে হচ্ছে আপেক্ষিকতার তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগ হচ্ছে এখানে। প্লেনের দরজায় লাগানো
সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো অনেকক্ষণ। সিঁড়ির গোড়ায় বাস আসার পর নিচে নেমে বাসে
উঠলাম। গুণে গুণে ঠিক কতজনকে বাসে তোলা হলো জানি না, কিন্তু বাসে ঠাসাঠাসি ভীড় হলো।
মূল টার্মিনালে এসে আবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হলো। রাতের
অন্ধকারে খুব একটা বুঝতে পারছি না এয়ারপোর্টিটি কত বড়। তবে ব্যবস্থা দেখে মনে হচ্ছে
আমাদের ঢাকার শাহজালাল বিমান বন্দরের সাথে অনেক মিল আছে।
ইমিগ্রেশান এরিয়ায় বিরাট গন্ডগোল। অনেকগুলি কাউন্টার, অনেকগুলি
লাইন। একটা আগমণী ফরম পূরণ করতে হয়। সেটা পূরণ করার পর কোন্ লাইনে দাঁড়াবো তা কয়েকজন
উর্দিধারী এয়ারপোর্ট কর্মীকে জিজ্ঞেস করেও সদুত্তর পেলাম না।
অন এরাইভাল ভিসার লম্বা লাইন। অস্ট্রেলিয়ানদের ভিসা নিতে
হয় অনলাইনে। সেটা নিয়ে এসেছি। তাতে কিছুটা সময় বেঁচেছে। ইমিগ্রেশান অফিসাররা ভীষণ ধীরস্থির।
একেকটা পাসপোর্ট চেক করে সিল দিতে মনে হচ্ছে অনন্তকাল সময় নিচ্ছেন। লাইনে আমার ঠিক
আগে একটা ভারতীয়-অস্ট্রেলিয়ান পরিবার। দুটো ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে তারা দিল্লী যাচ্ছিলেন।
কানেকটিং ফ্লাইট চলে গেছে। এখন শ্রীলংকায় এক রাত থাকতে হচ্ছে। এতক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর
পর কাউন্টারে যখন পৌঁছলো – তখন তাদের বলা হলো আগমণী ফরম পূরণ করে আনতে। অথচ তাদেরকে
নাকি বলা হয়েছে ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার হবার কারণে এই ফরম পূরণ করতে হবে না। সরকারি ব্যবস্থাপনায়
দক্ষতা কেন বাড়ানো যায় না আমাদের মতো দেশগুলিতে আমি জানি না।
ইমিগ্রেশান পার হয়ে লাগেজের জন্য আবার অপেক্ষা প্রায় ঘন্টা
খানেক। লাগেজ নিয়ে মানি এক্সচেঞ্জ। শ্রীলংকান রুপির দাম এখন অনেক কম। অস্ট্রেলিয়ান
এক ডলারে ২১৭ রুপি পাওয়া যায়। বাংলাদেশের এক টাকায় তিন রুপির চেয়েও বেশি।
অ্যারাইভাল গেটে বের হয়েই চোখে পড়লো অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন
হাতে প্লাকার্ড নিয়ে। আমার জন্যও হোটেল থেকে একজনকে পাঠানোর কথা। এত কম আলোতে ছোট ছোট
প্লাকার্ডের লেখাগুলি পড়াও যাচ্ছে না। কাছে গিয়ে দেখতে হলো। হ্যাঁ, আমার জন্য হোটেল
সিনামন রেড থেকে একজন এসেছেন। আমার নাম লেখা একটা পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নইলে
এই ভোর চারটায় আমি কীভাবে হোটেলে যেতাম জানি না।
হোটেল থেকে যিনি এসেছেন – তাঁর বয়স বোঝার কোন উপায় নেই। শীর্ণ
খর্বকায় একজন মানুষ। খুবই মৃদুভাষী। এয়ারপোর্টের কোলাহলের মধ্যে তাঁর কথাবার্তার অর্ধেকই
আমি শুনতে পাচ্ছি না, যেটুকু শুনতে পাচ্ছি – তার বেশিরভাগই বুঝতে পারছি না। ইংরেজি
তিনি বলছেন – তবে তা অনায়াসে বোঝার মতো নয়। তাঁর নাম কনিস্ক না কলিন ঠিক বুঝতে পারলাম না।
এয়ারপোর্টের বাইরে এসে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। নাতিশীতোষ্ণ ভোরের
বাতাস। এত ভোরেও অনেক গাড়ি, ট্যাক্সি, আর অনেক মানুষ। অনেকটাই বাংলাদেশের মতো লাগলো।
কনিস্ক বা কলিন আমাকে রাস্তার ফুটপাতে দাঁড় করিয়ে রেখে গাড়ি আনতে গেলেন। আমি দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে মানুষ দেখতে লাগলাম। যাত্রীদের বেশিরভাগই শ্রীলংকান-অস্ট্রেলিয়ান। নিজেদের
বাড়িতে এসেছেন। আত্মীয়স্বজনরা তাদের নিতে এসেছেন এয়ারপোর্টে। এই মিলনমেলা দেখতে কী
যে ভালো লাগছে। একটি প্রায় বালিকা-বধূ এসেছে কয়েকমাস বয়সী ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে তার প্রবাসী
স্বামীকে স্বাগতম জানাতে। স্বামীটি তার বাচ্চাকে সম্ভবত এই প্রথম দেখছে। কোলে নিয়ে
আনন্দে কেঁদে ফেললো। তাদের মুখের ভাষা আমি বুঝতে পারছি না, কিন্তু আবেগের ভাষা, ভালোবাসার
ভাষা বুঝতে পারছি।
আরো আধঘন্টা পর কনিস্ক বা কলিন এলেন গাড়ি নিয়ে। হোটেলের নাম
লেখা ছোট্ট গাড়ি। এয়ারপোর্ট থেকে কলম্বো শহরের দূরত্ব প্রায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার। এই
ভোরে রাস্তা প্রায় ফাঁকা। এক্সপ্রেস ওয়ে ধরে যেতে প্রায় চল্লিশ মিনিটের মতো লাগলো।
এক্সপ্রেস ওয়েতে টোল দিতে হয় চারশ রুপি।
শুনশান মসৃণ রাস্তা। ঘন সবুজ দুপাশে। কলম্বো শহরে ঢোকার পর
বিল্ডিংগুলি বেশ সুন্দর বলে মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ভবনগুলি আলোকমালায় সজ্জিত। ক্রিসমাস
আর নিউইয়ারের জন্য প্রস্তুত এই নগরী। এই শহরকেই ভালোবেসে আপন করে নিয়েছিলেন কল্পবিজ্ঞান
লেখক আর্থার সি ক্লার্ক।
কনিস্ক বা কলিন টুকটাক পরিচিতি দিচ্ছেন শহরের। ভিক্টোরিয়া
পার্কের পাশ দিয়ে এসে অনেকগুলি অলিগলি পার হয়ে হোটেল সিনামন। দারুচিনি দ্বীপের দারুচিনি
হোটেল।
বহুতল ভবনের সাত তলায় হোটেলের রিসিপশান।
নিচের তলায় মেটাল ডিটেক্টরের ভেতর দিয়ে এসে লাগেজ স্ক্যান
করে তারপর ঢুকতে হয়। নিরাপত্তা ব্যবস্থা যত ভালো হবে – পর্যটকদের পর্যটন তত নিরাপদ
হবে।
রিসিপশানের ছেলেটা বেশ চটপটে, রসিক। বললো, “আপনার দুই রাতের
মধ্যে এক রাত তো চলেই গেল। অন্য দিন এবং রাতটা ভালো কাটবে আশা করি। এয়ারপোর্ট থেকে
নিয়ে আসার গাড়িভাড়া ৪৫ ইউএস ডলার এখন দিয়ে ফেললে ভালো হয়।“
চব্বিশ তলার চৌদ্দ নম্বর রুমে ঢুকে জানালার পর্দা সরাতেই
চোখের সামনে জেগে উঠলো আলো ঝলমলে কলম্বো শহরের অনেকখানি।
No comments:
Post a Comment