মহাজাগতিক প্রথম আলো’র পাঠ প্রতিক্রিয়া
____________________
মাত্র পঁচিশ বছর আগেও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের বয়স হিসেব করেছিলেন আনুমানিক সাত থেকে বিশ বিলিয়ন অর্থাৎ সাত শ থেকে দুই হাজার কোটি বছর পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু স্যাটেলাইট আর টেলিস্কোপের আধুনিকায়ন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য যান্ত্রিক পদার্থবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিজ্ঞানের উন্নতির ফসল কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন প্রায় সুনির্দিষ্টভাবেই হিসেব করে দেখেছেন যে মহাবিশ্বের বর্তমান বয়স ১৩৭০ কোটি বছর, খুব বেশি হলে ২০ কোটি বছর এদিক ওদিক হতে পারে। মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের সৌরজগৎ তথা পৃথিবীর বয়স অনেক কম, মাত্র সাড়ে চারশ কোটি বছর। অর্থাৎ মহাবিশ্বের উৎপত্তি হবার প্রায় নয় শ কোটি বছর পর আমাদের সৌরজগতের উৎপত্তি হয়েছে। এই সাড়ে চারশ কোটি বছর বয়সী পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভব হয়েছে মাত্র দুই লক্ষ বছর আগে। আর এতসব আমরা জানতে শুরু করেছি মাত্র কয়েক শ বছর আগে থেকে।
এত অতীতের ঘটিনা – যখন মানুষ তো দূরের কথা, আমাদের সৌরজগতই ছিল না – সেই সুদূর অতীতের কথা আমরা কীভাবে জানলাম? এই জানার মূলে আছে আলো। মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং-এর পর প্রথম শক্তির বিকিরণ হয়েছিল যে আলোর আকারে – সেই মহাজাগতিক প্রথম আলোই আজ সাক্ষ্য দিচ্ছে মহাবিশ্বের আদি অবস্থার, একেবারে গোড়ায় কী হয়েছিল সেসব ঘটনার। মহাবিশ্বের পটভূমিতে ছড়িয়ে থাকা সে আদি আলোর অবশিষ্টাংশ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা খুঁড়ে আনছেন আমাদের মহাবিশ্বের অতীত ইতিহাস। আমাদের মাথার ওপর যে আকাশে জ্বলতে দেখছি লক্ষ কোটি তারার মেলা – তাদের অনেকেই হয়তো ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক বছর আগে – কিন্তু যে আলো রওনা দিয়েছিল মিলিয়ন বছর আগে – সেই আলো এসে পৌঁছাচ্ছে এতদিন পরে – মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্ব পার হয়ে।
থ্রিলারের চেয়েও রোমহর্ষক এসব মহাজাগতিক ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে একটার পর একটা ধারবাহিকভাবে চলে আসেনি। মহাবিশ্বের রহস্যের জটখোলা এত সহজ নয়। একেক সময় একেক ঘটনার ভেতর দিয়ে একেক রকমের আবিষ্কার ঘটে। সেসব আবিষ্কারের তথ্য থেকে মহাবিশ্বের রহস্যের ধারাবাহিকতা খুঁজে বের করতে বিজ্ঞানীদের বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করতে হয়। সেই গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে গবেষণাপত্র তৈরি হয়। নানাসময়ের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে তথ্য-প্রমাণসহ উপস্থাপন করতে হয় বিজ্ঞানের বইপত্রে। সেখান থেকে আমরা সাধারণ মানুষ জানতে পারি – মহাবিশ্বে কী ঘটলো কখন ঘটলো। সেরকম জুৎসই বই হলে বই পড়তে পড়তেই পাঠকের মানসভ্রমণ হয়ে যেতে পারে – মহাবিশ্বের একেবারে গোড়ার সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। আবুল বাসারের “মহাজাগতিক প্রথম আলো বিগ ব্যাং ও পটভূমি বিকিরণের খোঁজে” তেমনই এক সুখপাঠ্য বিজ্ঞানবই যা পড়ার সময় মহাজাগতিক মানসভ্রমণের অনুভূতি হলো।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই লেখা সহজ নয়। কারণ অনেক। প্রথমত বৈজ্ঞানিক শব্দগুলির যথাযথ বাংলা পরিভাষা আমাদের নেই। দ্বিতীয়ত আমরা বিজ্ঞানের বই হয়তো অনেক পড়ি, কিন্তু সেভাবে বিষয়ভিত্তিক বিজ্ঞানচর্চা আমাদের নেই। আমাদের বিজ্ঞানপাঠের প্রয়োজনীয়তা পরীক্ষা পাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে বেশিরভাগ সময়। ফলে বিজ্ঞান লেখকের জন্য পাঠকের কাছ থেকে যে চ্যালেঞ্জটা আসার কথা সেটা অনেকসময় আসে না। আরো একটা বড় কারণ হলো – বিজ্ঞানের জনপ্রিয় বই লিখতে গিয়ে আমরা ইংরেজিতে লেখা জনপ্রিয় বিজ্ঞান বইগুলির ভাষাশৈলিও অনুকরণ করি, অনেকসময় হয়ে ওঠে আক্ষরিক অনুবাদ। এটা দোষের কিছু নয়। একসময় জার্মান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হতো আমেরিকান বা ইংল্যান্ডের লেখকদের।
বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন এখন অনেকেই। তাঁদের মধ্যে অন্যতম লেখক আবুল বাসার। তিনি একাধারে জনপ্রিয় অনুবাদক, মাসিক বিজ্ঞানচর্চার নির্বাহী সম্পাদক। জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই অনুবাদের পাশাপাশি তিনি ইতোমধ্যে নিজস্ব বই লিখেছেন বেশ কয়েকটি। প্রথমা থেকে প্রকাশিত মহাজাগতিক প্রথম আলো তাঁর অত্যন্ত দরকারি একটি বই।
বিশটি অধ্যায় আছে এই বইতে। প্রত্যেকটি অধ্যায়ের শিরোনাম আকর্ষণীয় – যেমন ‘একঘেয়ে ভুতুড়ে হিসহিস’, ‘দুটি প্যারাডক্স ও আইনস্টাইনের মহা ভুল’, গ্যামো অ্যান্ড গং, একটি হরর মুভি ও থ্রি মাস্কেটিয়ার্স, কফিনের শেষ পেরেক, নোবেল ও শোক সমাচার – ইত্যাদি। শিরোনাম পড়ে মনে হচ্ছিলো থ্রিলার কাহিনিতে ঢুকতে যাচ্ছি। বিজ্ঞানের ইতিহাসের কাহিনিগুলিও তিনি সাজিয়েছেন সেভাবে সমান আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে।
শুরুতেই তিনি চমকে দিয়েছেন ১৯৬৫ সালে নিউ জার্সিতে বিজ্ঞানী আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসনের হর্ন অ্যান্টেনায় ধরা পড়া ভুতুড়ে হিসহিস নয়েজের ঘটনার মাধ্যমে। সেখান থেকে তিনি অতীতে গিয়েছেন, গিয়েছেন বিজ্ঞানীদের পরবর্তী কর্মকান্ডে।
বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ই স্বয়ং-সম্পূর্ণ আবার উপন্যাসের মতো ঘটনার প্রবাহে সচল। ঘটনাপ্রবাহে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর কাজকর্ম বর্ণিত হয়েছে, বিজ্ঞানীদের অতিসংক্ষিপ্ত জীবনীও আছে সাথে যেখানে যেটুকু দরকার। রাশিয়ান বিজ্ঞানী আলেকসান্দার ফ্রিডম্যান, বেলজিয়ামের জর্জ লেমিত্রি, আমেরিকার হেনরিয়েটা লিভেট, হার্লো শ্যাপলি, হেবার কার্টিস, এডুইন হাবল, জর্জ গ্যামো, র্যালফ আলফার, রবার্ট হারম্যান, ফ্রেড হয়েল, রবার্ট ডিকি – প্রায় প্রত্যেক মহারথির কথাই এসেছে যথাপ্রসঙ্গে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক দীপেন ভট্টাচার্য এই বইয়ের ভূমিকায় সঠিকভাবেই লিখেছেন – যে এই বই ধরতে গেলে জ্যোতির্বিদ্যার আধুনিকতার সূত্রপাতের কাহিনি। আমি তাঁর সাথে সম্পূর্ণ একমত। সাবলীল ভাষা এই বইয়ের প্রধান আকর্ষণ। ভাষার কারণে হোঁচট খেতে হয়নি তেমন কোথাও।
তবে কয়েকটি জায়গায় আমার সামান্য একটু মন্তব্য আছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে ৬৯ পৃষ্ঠায় বুনসেন ও কার্শভের যন্ত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে “যেখানে একটি সরু স্লিট বা নল বসানো ছিল” – স্লিট আর নল কিন্তু এক জিনিস নয়। একই অধ্যায়ে ৭২ পৃষ্ঠায় হাইড্রোজেন পরমাণুর শক্তিস্তর বোঝানোর ক্ষেত্রে ইলেকট্রনের ফোটন শুষে নেয়ার ঘটনাটি খুব একটা পরিষ্কার হয়নি। আগত ফোটনের শক্তি আর ইলেকট্রনের বাইন্ডিং এনার্জির উপর নির্ভর করে ফোটনটি শোষিত হবার পর ইলেকট্রন শক্তিস্তর অতিক্রম করতে পারবে কি না, নাকি উত্তেজিত হবার পর আবার ফোটন বের করে দিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়বে।
সপ্তম অধ্যায়ে ৮২ পৃষ্ঠায় কিছুটা রূপক অর্থে বলা হয়েছে রসায়নবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানীদের ভাগ্য কীভাবে জ্যোতির্বিদদের ভাগ্যের চেয়ে ভালো। এই ব্যাপারটিতে আমার মতো আরো অনেক পাঠকই হয়তো দ্বিমত পোষণ করবেন। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে পদার্থবিজ্ঞানী কিংবা রসায়নবিদ কাউকেই বাদ দেয়ার সুযোগ নেই।
৮৭ পৃষ্ঠার গ্রাফে উলম্বিক অক্ষে মন্দন বেগ কেন হিসেব করা হয়েছে তা ব্যাখ্যা করলে ব্যাপারটি আরো বোধগম্য হতো।
নবম অধ্যায়ে ১০২ পৃষ্ঠায় কথার ছলে লেখা হয়েছে বর “শুভদিন দেখে” নিজের দেশ ডেনমার্ক ছেড়ে আশ্রয় নিলেন ব্রিটেনে। এখানে কথার কথা হলেও “শুভদিন” ব্যাপারটি নীলস বোরের ক্ষেত্রে খাটে না। একই অধ্যায়ের ১১৪ পৃষ্ঠায় বিটা ক্ষয় বা বিটা ডিকের ব্যাখ্যাটিতে নিউট্রন প্রোটনে রূপান্তরিত হয়ে একটি ইলেকট্রন বিটা পার্টিক্যাল আকারে বের হয়ে আসার ব্যাপারটা উল্লেখ করা হয়নি।
একই অধ্যায়ে ১১৭ পৃষ্ঠায় যেখানে সূর্যের কেন্দ্রে শক্তির উৎপত্তি দেখানো হয়েছে – সেখানে আমাদের বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার আয়নাইজেশান সূত্রকে খুব বেশি মিস করেছি। এই বইতে মেঘনাদ সাহার কাজ খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল, অথচ মেঘনাদ সাহা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
১৫তম অধ্যায়ে ১৭৭ পৃষ্ঠায় ১৯৫৬ সালে ট্রানজিস্টার উদ্ভাবনের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন বেল ল্যাবের দুজন বিজ্ঞানীর জায়গায় তিনজন বিজ্ঞানী হবে।
এই বইয়ের শেষে তথ্যনির্দেশে কয়েকটি বৈজ্ঞানিক বিষয়ের টীকা দেয়া আছে – যা কোন পাঠককে কিছু অতিরিক্ত সুবিধা দেবে।
শুধু এই বইয়ের ক্ষেত্রেই নয়, যে কোনো বিজ্ঞানের বইতেই আমি বইয়ের শেষে শব্দের নির্ঘন্টটা খুব মিস করি। প্রকাশকরা হয়তো বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা না বাড়ানোর জন্য, বইয়ের দাম কম রাখার জন্য নির্ঘন্ট দেন না, কিন্তু ইনডেক্স বা নির্ঘন্ট ছাড়া যে কোনো মননশীল বই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কারণ এসব বই তো শুধুমাত্র একবার পাঠের জন্য নয়। পরে যখন এই বই আমি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবো – তখন পুরো বই আমাকে তন্ন তন্ন করতে হবে কোন নির্দিষ্ট তথ্যের জন্য।
আরো একটি ব্যাপার আমি খুব মিস করি বাংলা বইয়ে – সেটা হচ্ছে ক্রস রেফারেন্স বা টীকা। যেমন এই বই থেকেই উদাহরণ দিই – পৃষ্ঠা ৪৭ – “তাঁর এই গবেষণার ফল অচিরেই জার্নালে প্রকাশিত হলো।“ পাঠক এখানে জানতে চাইতে পারেন সেই জার্নালের ফুল রেফারেন্স। সেটা টীকা আকারে দেয়া যেতো। পৃষ্ঠা ৫৭ – হাবল তাঁর বাবার মৃত্যুর পর কীভাবে মনের অবস্থা বর্ণনা করেছেন তার উদ্ধৃতি আছে। কিন্তু রেফারেন্স নেই। পাঠকের কৌতূহল এখানে মিটছে না। সেজন্য লেখক ও প্রকাশকদের কাছে আমার আবেদন – বইয়ের পৃষ্ঠা কমিয়ে দাম যতই কম রাখার চেষ্টা করুন – যিনি বই কিনবেন না তিনি কিছুতেই কিনবেন না। আর ভালো বই ভালোভাবে বের করেন, পাঠক কিনবে। কারণ বাংলাদেশের বইয়ের দাম এখনো ফাস্টফুডের দামের চেয়ে অনেক কম।
মহাজাগতিক প্রথম আলোর পাঠক আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তি থেকে বর্তমান অবস্থায় আসার বিভিন্ন ধাপগুলির প্রমাণ তো পাবেনই – সাথে পাবেন মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা করার খোরাক। এধরনের বিজ্ঞানের বই চিন্তার খোরাক জন্মায় – এখানেই লেখকের সাফল্য।
বই - মহাজাগতিক প্রথম আলো
লেখক – আবুল বাসার
প্রকাশক – প্রথমা প্রকাশন
প্রকাশকাল – ২০২২
পৃষ্ঠাসংখ্যা – ২৪০
মুদ্রিত মূল্য – ৫০০ টাকা
ISBN 978 984 96885 0 1
No comments:
Post a Comment