ইন্ডিপেন্ডেন্স স্কয়ারের আর্কেড শপিংমলে ঢুকে মনেই হলো না যে অর্থনৈতিক একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে শ্রীলংকায় মাত্র কিছুদিন আগে। দোকানে জিনিসপত্র কিংবা ক্রেতা – কোনটিরই কোন অভাব দেখা যাচ্ছে না। অনেক জায়গা নিয়ে ব্রিটিশদের তৈরি করা উঁচু দোতলা দালানগুলি দেখলেই বোঝা যায় এখানে সরকারি কোন দপ্তর ছিল আগে। সেই দপ্তর অন্য কোথাও সরে গিয়ে এখন সেগুলি রূপান্তরিত হয়েছে আধুনিক বিপনিবিতানে। দোকানপাট দেখে মনে হচ্ছে বড়লোকদের পাড়া। বার্গার কিং, ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি এসব আমেরিকান চেইন এখানেও রাজত্ব করছে বিশাল প্রতিপত্তি নিয়ে। রাষ্ট্রের নামের ভেতর যে সমাজতান্ত্রিক শব্দটি আছে তা ধনতন্ত্রের চাপে পড়ে শব্দেই বন্দী হয়ে আছে। বিশ্বজুড়ে সমাজতন্ত্রের এখন যে হাল, শ্রীলংকার আর দোষ কী।
আর্কেড থেকে বের হয়েই রাস্তা। নামফলকের ইংরেজি থেকে সরাসরি উচ্চারণে রাস্তার নাম দাঁড়ায় বৌদ্ধলোক মাওয়াথা কিংবা মাওয়াধা। সরু সংক্ষিপ্ত রাস্তাকে এরা মাওয়াথা বলে। রোড, এভিনিউ, স্ট্রিট ইত্যাদির পাশাপাশি এখানে অনেক রাস্তার নামের শেষে মাওয়াথা আছে। সে হিসেবে বৌদ্ধলোক রাস্তাটি সরু এবং সংক্ষিপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু এটা বিশাল বড় রাস্তা। এটা ধরে কিছুদূর হেঁটেই পৌঁছে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।
ইউনিভার্সিটি অব কলম্বো |
কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব ম্যানেজমেন্ট আর ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন এর সাইনবোর্ড প্রায় পাশাপাশি। তাদের সামনে রাস্তার অন্যদিকে আরেকটি ছোট্ট বিশ্ববিদ্যালয় – বুড্ডিস্ট অ্যান্ড পালি ইউনিভার্সিটি অব শ্রীলংকা।
সুযোগ পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঘুরে দেখতে বেশ ভালো লাগে। অস্ট্রেলিয়ায় যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ানো যায়। কিন্তু এখানে সেই সুযোগ পেলাম না। ছুটির দিন বলে সবগুলি গেটই বন্ধ। রাস্তা থেকে বিভিন্ন ভবনের কিছু অংশ আর গেটে গেটে বিভিন্ন অনুষদের সাইনবোর্ড দেখা ছাড়া ভেতরে ঢোকার কোন সুযোগ নেই আজ। ক্যাম্পাসের চারপাশের রাস্তায় হেঁটে দেখলাম যতটুকু দেখা যায়।
শতবর্ষ উদ্যাপনের বিজ্ঞাপন |
কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি গেটে এখনো বড় বড় সাইনবোর্ডে শতবর্ষ উদ্যাপনের চিহ্ন। ১৯২১ থেকে ২০২১। এখানে সব সাইনবোর্ডেই সিংহলি, তামিল আর ইংরেজিতে লেখা থাকে। কিন্তু কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল মনোগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ লেখা আছে সংস্কৃতে। হাইস্কুলের ক্লাস সেভেন-এইটে যে সংস্কৃত পড়েছিলাম – তাতে লেখাটা যে সংস্কৃত তা চিনতে পারছি, কিন্তু পড়তে পারছি না। গুগলের কৃপায় জানা গেল – সেখানে লেখা আছে “বুদ্ধি সর্বত্র ভ্রজতে”। জ্ঞানের কদর সব জায়গায় – এরকম কিছু একটা অর্থ হবে। যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লোগোতে এরকম ভালো ভালো কথা লিখে রাখতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কথাগুলি শুধু লোগোতেই লেগে থাকে।
জাতিগঠনে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব যে জাতি যত ভালোভাবে বুঝেছে তারা তত উন্নতি করেছে। ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে অনেকগুলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। ইউনিভার্সিটি অব কলম্বো ছিল তাদেরই একটি। ১৯২১ সালে এই ইউনিভার্সিটির যাত্রা শুরু। কিন্তু তারও অনেক বছর আগে ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সিলন মেডিক্যাল স্কুল। ধরতে গেলে তাকে কেন্দ্র করে পরে গড়ে উঠেছে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু গত একশ বছরে কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রসারিত হয়েছে বলে মনে হয় না। বিজ্ঞাপনে এরা উপমহাদেশের প্রথম দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বলে দাবি করছে নিজেদের। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে করছে জানি না। ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং-এ শ্রীলংকার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই বিশ্বের প্রথম এক হাজারের মধ্যে নেই।
একটি গেটে লেখা আছে পলিথিনমুক্ত এলাকা। কিন্তু তার সামনেই ফুটপাতে পলিথিনের ঠোঙায় বিক্রি হচ্ছে পিঠাজাতীয় নানারকমের খাবার। তবে খেয়াল করে দেখলাম – লোকজন খাবার খেয়ে ময়লা পলিথিন নির্দিষ্ট বিনেই ফেলছে। এদিক থেকে এরা নিসন্দেহে ভারত কিংবা বাংলাদেশের জনগণের চেয়ে এগিয়ে। এই শিক্ষাটা এরা জাতিকে কীভাবে দিয়েছে তা ভাবার বিষয়।
ব্রিটিশরা চলে যাবার পর কিছু কিছু রাস্তা বা জায়গার নাম এরা পরিবর্তন করলেও এখনো শহরের অনেক রাস্তার আগের নামই রয়ে গেছে – আলফ্রেড হাউজ এভিনিউ, এডোয়ার্ড লেন, কুইনস রোড, আলফ্রেড প্লেস - এসব রাস্তা পার হয়ে এলাম গালে রোডে। কলম্বো শহরের প্রধান সড়কগুলির একটি। আধুনিক ব্যস্ত শহরগুলির মতোই আধুনিক ট্রাফিক সিস্টেম। সড়কবাতির নির্দেশ মেনে চলছে সবাই। পথচারি পারাপারে তেমন কোন সমস্যা দেখলাম না।
একটু পর পর যেটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে সেটা হলো বিদেশে পড়তে যাবার এজেন্টের বিজ্ঞাপন। কত কম খরচে কত সহজে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখাচ্ছে এরা। এদের পাল্লায় পড়ে কতজন যে কতভাবে বিভ্রান্ত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তার খবর কে রাখে। সরকারি হিসেবে বেকারত্বের হার পাঁচ শতাংশের নিচে। তবুও শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা কেন দেশ ছাড়তে চায়? অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য বেশিক্ষণ ভাবতে হয় না। পঁচিশ বছর আগে আমি কী কারণে দেশ ছেড়েছিলাম? এই পঁচিশ বছরে সেই কারণটা নিশ্চয় আরো অনেকগুণে বেড়েছে। এখানে যে চিত্র দেখতে পাচ্ছি, ঢাকা শহরে ঘুরলে হয়তো এর দশগুণ বেশি দেখতে পাবো।
তৃতীয় বিশ্বের রাজধানী শহরে আমেরিকান দূতাবাসের চেহারা সবসময়েই চকচক করে। এখানে গালে রোডের সাথে লাগানো বিশাল এলাকা জুড়ে আমেরিকান দূতাবাস। দূতাবাস না বলে দুর্গ বললেই বেশি অর্থবোধক হবে। সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনির যতজন সদস্য এখানে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে, শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টের বাসভবনেও ততজন পাহারাদার নেই। দেয়ালে খুঁটিতে যেদিকেই তাকাই সিসি ক্যামেরা চোখে পড়ছে। এখানকার রাস্তা দিয়ে যারাই হেঁটে যায়, সবাইকেই সম্ভবত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তারা। আমেরিকা এক আশ্চর্য দেশ। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সবাই তাদের গালি দেয়। যারা বেশি গালি দেয়, তারাই আবার বেশি পাগল তাদের দেশে যাবার জন্য।
অনেকগুলি বড় বড় হোটেল এই রাস্তার আশেপাশে। ট্যুরিজম অথরিটির বিশাল ভবনের সামনে রাস্তার ওপাড়ে সিনামন গ্রান্ড হোটেল। বেশ কয়েকটি সিনামন হোটেল আছে কলম্বোতে। আমি যেটাতে উঠেছি – সেটা সিনামন রেড। সেটার তুলনায় সিনামন গ্রান্ডের তারকা সংখ্যা বেশি, কিন্তু উচ্চতা কম। সিনামন গ্রান্ডে ঢোকার মুখে নিরাপত্তা তল্লাশীর বাহুল্য দেখে বোঝা যায় চার বছর আগে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ আক্রমণের পর থেকেই এ অবস্থা হয়েছে।
২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল ইস্টার সানডের দিন সিনামন গ্রান্ডসহ কলম্বোর তিনটি হোটেল আর তিনটি গীর্জায় হামলা চালিয়েছিল আইসিস সমর্থক জঙ্গিরা। মূল উদ্দেশ্য ছিল যত বেশি সম্ভব বিদেশী পর্যটককে হত্যা করা। মোট ২৬৯ জন নিরস্ত্র পর্যটককে খুন করেছিল তারা বোমা হামলা করে। মানুষ খুন করা কীভাবে ধর্ম পালনের অংশ হয় আমি জানি না। এই ঘটনার এক বছর পরেই কোভিড এসে আরো লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল শ্রীলংকার পর্যটন শিল্প। গত বছর থেকে তারা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। বড় বড় হোটেলগুলি এখন খ্রিস্টমাসের জন্য সেজেগুজে তৈরি হয়ে গেছে।
ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট অথরিটির বহুতল ভবনের পর একতলা একটি নতুন ভবনে পর্যটকদের জন্য তথ্যকেন্দ্র। রাস্তার পাশের বড় কাচের দরজা দিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করলাম। দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাবার কথা। কিন্তু ধাক্কাধাক্কি করেও খোলা গেল না। ভেতরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু শনিবার তো দশটা থেকে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকার কথা। এখনো দুটোও বাজেনি। অন্য কোন দরজা কি আছে? দেখলাম রাস্তা থেকে ভেতরের দিকে আরেকটি দরজা আছে। ওটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। খোলার কোন লক্ষণ নেই। সরকারি অফিস বলেই কি এ অবস্থা? চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াবার পর মনে হলো দরজা খুলছে। দেখলাম ছোট্ট একটা মেয়ে ভেতর থেকে চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে দিল। চায়নিজদের মতো শ্রীলংকান মেয়েদেরও বয়স বোঝা যায় না। এখানে যখন চাকরি করছে বয়স নিশ্চয় আঠারোর উপরে। ভেতরে কনকনে ঠান্ডা। এই গরমে অনেক মানুষই এখানে এসে বসে আরাম করতে পারতো। কিন্তু কেউ নেই। সবাই সম্ভবত দরজা বন্ধ দেখে চলে গেছে। আমি আসাতে মেয়েটি বিরক্ত হয়েছে কি না বুঝতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার মুখে ভাবলেশ নেই। সে দুই হাতে তার শরীরের তুলনায় দীর্ঘ চুল সামলাতে ব্যস্ত।
ভেতরের দেয়ালজুড়ে শ্রীলংকার ট্যুরিস্ট ম্যাপ, আর বিভিন্ন এলাকার সুন্দর সব ছবি। কলম্বোর একটি ম্যাপ চেয়ে নিলাম। বিভিন্ন স্পটের বুকলেট আশা করেছিলাম। নেই। আমি এটা ওটা জিজ্ঞেস করেও তেমন কোন উত্তর পেলাম না। এমন নিরুৎসাহী মানুষ কীভাবে এরকম একটা পর্যটন তথ্যকেন্দ্রে চাকরি পেলো জানি না। অবশ্য আজকাল পর্যটকরা এসব তথ্যকেন্দ্রের চেয়ে ইন্টারনেটের উপরই বেশি ভরসা করে।
“সরি ফর ডিস্টার্বিং ইউ” – বলে বের হয়ে আসার সময়ও আশা করেছিলাম মেয়েটি অন্তত বলবে যে সে ডিস্টার্বড হয়নি, ওটাই তার কাজ। কিন্তু সে কিছু না বলে দরজায় আবার তালা লাগিয়ে দিল। আরো দুঘন্টা ভেতরে বসে থেকে তারপর বাড়ি চলে যাবে। খুবই মজার চাকরি।
এক ব্লক পরেই ছোট্ট একটা ব্রিজ। নিচ দিয়ে ঝমঝম করে একটি লোকাল ট্রেন চলে গেল। মাত্র তিনটি বগির ছোট্ট ট্রেন। ব্রিজ থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে রেললাইনের অবস্থা দেখে ভীষণ হতাশ হলাম। শ্রীলংকার ট্যুরিস্টদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ থাকে এখানকার ট্রেনে চড়া। এই বিখ্যাত ট্রেন-সাম্রাজ্যের লাইনগুলির সংস্কার হয় না কত বছর জানি না। এরা যে রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থসংকটে ভুগছে তা দৈনন্দিন বেচাকেনায় বোঝা না গেলেও রাষ্ট্রের বড় বড় অবকাঠামোগুলি দেখলে বোঝা যায়।
ব্রিজ পার হয়েই ভারতীয় হাইকমিশন। আমেরিকানদের চেয়ে কোন অংশেই কম নয় এরা এখানে। নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারতকে একটু তোয়াজ করেই চলে শ্রীলংকা। শ্রীলংকায় ভারতের ইনভেস্টমেন্ট অনেক। তাছাড়াও শ্রীলংকায় সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসে ভারত থেকে। শ্রীলংকার মোট পর্যটকের শতকরা প্রায় আঠারো ভাগ ভারতীয় পর্যটক। শ্রীলংকান তামিলদের নিয়ে ভারতের সাথে টানাপোড়েনও ছিল অনেক, এখন হয়তো কিছুটা প্রশমিত হয়েছে।
ভারতীয় হাই কমিশনের সামনের ফুটপাত আমেরিকান দূতাবাসের সামনের ফুটপাতের মতো অতটা চওড়া নয়। প্রহরীদের পাশ দিয়ে যাবার সময় তাদের কাঁধে ঝোলানো অস্ত্র গায়ে লেগে যাবার সম্ভাবনা বাঁচিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত হাঁটছি। এমন সময় “ডু ইউ স্পিক ইংলিশ?” শুনে থমকে দাঁড়ালাম। নির্ভেজাল ব্রিটিশ উচ্চারণ, হাতে ঢাউস ট্রলিব্যাগ, পিঠে তার চেয়েও বড় ব্যাকপ্যাক। এত জিনিসপত্রের ভীড়ে চিকন গৌর মুখখানি চোখে পড়তে কয়েক সেকেন্ড লাগলো।
বললাম, “ইয়েস, আই ডু”
“এদিকে ব্যাগেজ রাখার লকার কোথায় আছে বলতে পারো?”
লকারে লাগেজ রেখে হালকা ভাবে শহর ঘুরে বেড়ানো যায়। ট্যুরিস্টবান্ধব এই শহরে লকারের ব্যবস্থা নিশ্চয় কোথাও আছে। কিন্তু আমার এখনো চোখে পড়েনি। বললাম, “সরি ম্যাম, আমি ঠিক জানি না। রেলস্টেশনে থাকতে পারে, কিন্তু সেটা তো বেশ দূরে এখান থেকে। আপনি সামনের এই হোটেলে দেখতে পারেন, যদি তাদের থাকে।“ সামনের ঐতিহাসিক গালে ফেস হোটেলের দিকে আঙুল তুলে দেখালাম।
ভদ্রমহিলা শুকনো একটা থ্যাংক ইউ বললেন, কিন্তু মনে হলো খুব একটা খুশি হলেন না। হোটেলেও উঠছেন না, কিন্তু একা এতগুলি ব্যাগ তিনি কেন এনেছেন কে জানে। ট্রাভেল লাইট ট্রাভেল মোর কথাটি কি তিনি শোনেননি?
যাই হোক, হাই কমিশনের সামনে এভাবে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে দুজন নিরাপত্তারক্ষী এগিয়ে এলো তার দিকে। আমি আবার হাঁটতে শুরু করলাম।
গার্লে ফেইস হোটেল |
গালে ফেস হোটেলটি একেবারে সমুদ্রের সাথে লাগানো। অনেক পুরনো ইতিহাসের সাক্ষী এই হোটেল। মহাত্মা গান্ধী কলম্বোতে এসেছিলেন যখন, এই হোটেলেই ছিলেন। লাল টেরাকোটার ছাউনি হলুদ রঙের চারতলা দালান। মূল সড়ক থেকে অনেকটাই ভেতরে এবং নিচে সাগরের দিকে। সামনে বেশ বড় পার্কিং লট। এবং তারও সামনে সাগর ঘেঁষে বিশাল সবুজ চত্বর। কলম্বো শহরের প্রাণকেন্দ্রের সাগর আর শহর মিশেছে এখানে।
ঝকঝকে গা ঝলসানো গরম রোদ। সাগরের কিনার ঘেঁষে বাঁধানো রাস্তা। রাস্তার এক পাশে সারি সারি অস্থায়ী দোকান, বেশিরভাগই খাবারের। চিংড়ি, কাঁকড়া, মাছসহ নানারকম তেলেভাজার দোকান। আইসক্রিম, সফ্ট ড্রিংকসের দোকানও আছে। এই গরমেও লোকে গমগম করছে। ডাব বিক্রি করছে অনেকে। সবুজের বদলে বেশিরভাগ ডাবই কেমন যেন হলুদ রঙের। এক বৃদ্ধার কাছ থেকে একটা ডাব কিনে খেলাম। দেড় শ রুপি। অনেক পানি। কিন্তু কেমন যেন নিস্তেজ স্বাদ।
গার্লে ফেইস গ্রিন |
এত বড় সাগর সামনে, অথচ সৈকত নেই এখানে। খুব সামান্য এক চিলতে বালির রেখা আছে – সেখানেই দাপাদাপি করছে অনেকে। একটা পাকা ব্রিজ আছে, পাড় থেকে চলে গেছে পানির উপর কিছুদূর। সেখানে অস্বাভাবিক ভীড়। যতটা নিজের চোখে দেখছে, তার চেয়ে বেশি দেখছে ক্যামেরার চোখে। ছবি তুলে পোস্ট করার উদ্দেশ্যেই এখন ঘুরে বেড়ায় অনেকে। অনেকে নাকি ভ্রমণের খরচ তুলে ফেলে ছবি আর ভিডিও পোস্ট করতে করতে।
প্রেমের ছত্রতল |
অস্থায়ী দোকানগুলির সাথে বেশ কিছু স্থায়ী দোকানও আছে। সেগুলি অনেকটা গুহার ভেতর। সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়। সেখানে গুহার ভিতর তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীর ভিড়। তাদের আচরণে পারস্পরিক ভালোবাসা প্রকাশ পাচ্ছে। ছাতার আড়ালে প্রেম এখানে খুবই সাধারণ একটি দৃশ্য। কেউই তাদেরকে বাধা দিচ্ছে না। শ্রীলংকা শুনেছি আমাদের মতোই রক্ষণশীল জাতি। কিন্তু এখন ক্রমশ উদার হচ্ছে মনে হচ্ছে। অথবা হতে পারে এটি শুধুমাত্র শহুরে উদারতা।
No comments:
Post a Comment