“01110111 01100101 01101100 01100011 01101111 01101101 01100101 00100000 01110100 01101111 00100000 01110001 01110101 01100001 01101110 01110100 01110101 01101101 00100000 01100011 01101111 01101101 01110000 01110101 01110100 01101001 01101110 01100111”
প্রিয় পাঠক, উপরের লাইনটি দেখে আপনি বুঝতে পারছেন শুধুমাত্র 0 এবং 1 ব্যবহার করে ডিজিটাল সংকেতে কোনোকিছু লেখা হয়েছে। ডিজিটাল জগতের সাথে সামান্য একটু পরিচয় থাকলেই আপনি পড়তে পারছেন লাইনটি – যেখানে লেখা আছে, “Welcome to quantum computing”। বুঝতেই পারছেন, আজ এই লেখায় আমরা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে আলোচনা করবো। কিন্তু সেই আলোচনায় আসার আগে আমাদের পরিচিত পদ্ধতিতে কম্পিউটিং-এর মূল ব্যাপারগুলি একটু দেখে নেয়া যাক, তাতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর ধরন বুঝতে সুবিধা হবে।
“Welcome to quantum computing”-এ যে উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করেছি সেটাও যদি ডিজিটালি লিখতে যাই - তাহলে 00100010 লিখতে হবে। আপনি যে কম্পিউটার বা ট্যাব বা স্মার্টফোন ব্যবহার করে কোনকিছু লেখেন বা ক্যালকুলেটরে হিসেব করেন – তার সবকিছুই হয় ডিজিটাল সংকেতের মাধ্যমে। আমাদের প্রচলিত ডিজিটাল সংকেতের সবকিছুই হলো 0 এবং 1 এর সমন্বয়। কম্পিউটারের আদিযুগ থেকে শুরু করে বর্তমানের সুপারকম্পিউটারের যুগেও ডিজিটাল সংকেতের কোন পরিবর্তন হয়নি। ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্যপ্রবাহের জন্য ASCII (American Standard Code for Information Interchange) কোডের পাশাপাশি ইউনিকোডসহ আরো অনেক কোড তৈরি হয়েছে ঠিকই – কিন্তু সবকিছুরই মূলে আছে সেই শূন্য এবং এক। ডিজিটাল প্রযুক্তির মূল কাজ করে যে ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্স- সেই ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্সেরও মূল চাবিকাঠি হলো এই দুইটি অংক – 0 এবং 1। ইলেকট্রনিক সুইচ বন্ধ থাকার সংকেত যদি 0 হয়, সুইচ চালু থাকার সংকেত হবে 1; ‘হ্যাঁ’ যদি 1 হয়, তবে ‘না’ হবে 0; উত্তর দিক যদি 1 হয়, 0 হবে দক্ষিণ দিক ইত্যাদি।
কম্পিউটারের আদিযুগে (১৯৫০ – ১৯৭০) খুব কম শক্তির একটি কম্পিউটার রাখার জন্য যেখানে বিশাল আকৃতির গুদামের দরকার হতো, সেখানে এখন মানুষের হাতের মুঠোয় ঘুরে বেড়াচ্ছে তার চেয়ে কয়েক লক্ষ গুণ শক্তিশালী কম্পিউটার। কম্পিউটারের আকার এবং আকৃতি দিনে দিনে ছোট হচ্ছে, আর শক্তি ও কর্মক্ষমতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে মূলত ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্সের ক্রমাগত বিবর্তনের ফলে। শূন্য এবং এক -এর কেরামতিতে যে কম্পিউটিং প্রযুক্তির সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে এবং ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে আমরা তার নাম দিয়েছি ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং। অবশ্য এই নামটি দেয়ার দরকার হয়েছে তখন – যখন অন্য আরেক ধরনের কম্পিউটিং (কোয়ান্টাম কম্পিউটিং)-এর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ফিজিক্সের জগতে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জন্মের পর যেমন নিউটনের সূত্র মেনে চলা কাজকর্মকে ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স নাম দিতে হয়েছে, তেমনি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধর্মকে কাজে লাগিয়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর সম্ভাবনার অঙ্কুরোদ্গম হবার পর প্রচলিত কম্পিউটিং নাম দিতে হয়েছে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং।
ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং এর মূল উপাদানের নাম বিট – যা এসেছে বাইনারি ডিজিট থেকে। বাইনারি ডিজিটের ভিত্তি হলো দুই – 0 এবং 1। প্রচলিত দশ ভিত্তিক সংখ্যা যেমন 10n পদ্ধতিতে চলে যেখানে n = 0, 1, 2, 3, 4…, (100 = 1, 102 = 100, 103 = 1000, 104 = 10000 ইত্যাদি), তেমনি বাইনারি ডিজিটের রূপ হলো 2n (20 = 1, 21 = 2, 22 = 4, 23 = 8, 24 = 16 ইত্যাদি)। যদি বলা হয় এক বিট তথ্য – তখন সর্বোচ্চ 0 এবং 1 এই দুইটি ইনপুট হতে পারে। দুই বিট হলে 00, 01, 10, 11 এই চারটি ইনপুট হতে পারে। তিন বিট হলে 000, 001, 010, 011, 100, 101, 110, 111 এই আটটি ইনপুট হতে পারে। এভাবে বিট সংখ্যা যত বাড়বে তত বেশি ইনপুট হবে। দশ বিট হলে 1024, ষোল বিট হলে 65536 ইনপুট। বর্তমানে ৬৪ বিট অপারেটিং সিস্টেমের পার্সোনাল কম্পিউটার এক সাথে 18446744073709551616 (কত কোটি কোটি হিসেব করে দেখুন) ইনপুট নিয়ে কাজ করতে পারে। ইনপুট থেকে প্রাপ্ত ডিজিটাল আউটপুট জমা রাখা হয় কম্পিউটারের ইন্টারনাল হার্ড-ড্রাইভ কিংবা এক্সটার্নাল ড্রাইভে। জমা রাখার জন্য যে ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্স ব্যবহার করা হয় – তারও পরিমাপ করা হয় বিট এবং বাইটের এককে। আট বিটে এক বাইট হয়। 1024 বাইটে এক কিলোবাইট। 1024 কিলোবাইটে এক মেগাবাইট, 1024 মেগাবাইটে এক গিগাবাইট, 1024 গিগাবাইটে এক টেরাবাইট ইত্যাদি। ইলেকট্রনিক চিপ্সের আকার ছোট হতে হতে বর্তমানে এমন পর্যায়ে এসেছে যে এক বর্গ সেন্টিমিটার আকারের একটি ইলেকট্রনিক চিপ্সেই এখন শত শত গিগাবাইট তথ্য জমা রাখা যায়।
ট্রানজিস্টর উদ্ভাবিত হবার আগে বড় বড় ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করা হতো কম্পিউটারের প্রতিটি ইনপুট দেয়ার জন্য এবং সেগুলির ক্রিয়াকলাপ ঘটানোর জন্য। ছোট ছোট ট্রানজিস্টর যখন ভ্যাকুয়াম টিউবের জায়গা নিলো, কম্পিউটারের আকার ছোট হতে শুরু করলো। এখন ট্রানজিস্টরের কর্মক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি আকার এত ছোট হয়ে গেছে যে এখনকার ল্যাপটপ কম্পিউটারে ব্যবহৃত আমাদের হাতের আঙুলের নখের আকারের একটি মাইক্রোচিপ্স-এ পাঁচ কোটি ট্রানজিস্টরের জায়গা হয়। ট্রানজিস্টরের আকার আরো ছোট করার গবেষণা চলছে। কিন্তু এই ছোট হবার কি কোন সীমারেখা আছে? এই প্রশ্নের উত্তরেই আছে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের সীমাবদ্ধতার কথা।
কীভাবে? বস্তুর পরমাণুর ব্যাসার্ধ আনুমানিক 10-10 মিটার বা এক ন্যানোমিটারের দশ ভাগের এক ভাগ। সিলিকন ট্রানজিস্টরের আকার পাঁচ ন্যানোমিটারে এসে থেমেছে। এর চেয়ে ছোট হলে সিলিকন ট্রানজিস্টর আর ঠিকভাবে কাজ করে না। কারণ তখন ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের নিশ্চয়তার বদলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনিশ্চয়তা এসে যায়। বিজ্ঞানীরা অবশ্য কার্বন ন্যানোটিউব আর মলিবডিনাম ডাই-সালফাইডের সমন্বয়ে এক ন্যানোমিটার আকারের ট্রানজিস্টর উদ্ভাবন করেছেন যা ঠিকভাবে কাজ করছে। তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার উদ্ভাবনের জন্য ট্রানজিস্টরের আকার দায়ী নয়। ট্রানজিস্টরের আকার যেটাই হোক – ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্সের সেমিকন্ডাক্টর ফিজিক্সের মূলনীতি কোয়ান্টাম ফিজিক্স নির্ভর, ক্লাসিক্যাল ফিজিক্স নয়।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং আর ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং – ধরতে গেলে সম্পূর্ণ আলাদা। অনেকেই এই পার্থক্যকে মোমবাতি আর ইলেকট্রিক লাইটবাল্বের সাথে তুলনা করেছেন। মোমবাতি আর লাইটবাল্ব দুটোই আলো দেয়, তবে তাদের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার যদি মোমবাতি হয়, কোয়ান্টাম কম্পিউটার হাজার ওয়াটের লাইটবাল্ব। অর্থাৎ ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার যেসব কাজ করতে পারে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেই কাজ করতে পারবে আরো অনেক অনেক গুণ বেশি দক্ষতায়। কিন্তু এক হাজার মোমবাতিকে একসাথে করলেও যেমন সেটা লাইটবাল্ব হয়ে উঠবে না , তেমনি ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের কর্মক্ষমতা বাড়াতে বাড়াতে লক্ষ লক্ষ গুণ বাড়ালেও তা কিছুতেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার হয়ে যাবে না।
চলুন এবার দেখা যাক – কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কীভাবে কাজ করে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের হার্ডওয়ার আইবিএম, গুগল ইত্যাদি বড় বড় কোম্পানির ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষামূলক পর্যায়ে থাকলেও সর্বজনগ্রাহ্য রূপ পেতে আরো কত বছর অপেক্ষা করতে হবে আমরা এখনো জানি না। তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর মূলনীতি অর্থাৎ কীভাবে এই কম্পিউটারের মূল মস্তিষ্ক কাজ করতে পারে সেব্যাপারে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি একমত। কারণ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মূলনীতিই হলো কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর মূলনীতি।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার কী তা এক লাইনে বলা যায় এভাবে – কোয়ান্টাম কম্পিউটার হলো কোয়ান্টাম ফিজিক্স ও কম্পিউটার সায়েন্সের সমন্বিত রূপ। কম্পিউটার সায়েন্সের কাজ হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তাত্ত্বিক ধর্মকে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ব্যবহারিক রূপ দেয়া।
১৯০০ সালে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের যাত্রা শুরু হলেও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধজুড়ে তাকে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। পরমাণুর কোয়ান্টাম তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের বুঝতে শিখিয়েছে পদার্থের পারমাণবিক ধর্ম। সেমিকন্ডাক্টরের বিপ্লব ঘটতে অনুঘটকের কাজ করেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। ১৯৪৭ সালে সেমিকন্ডাক্টর ট্রানজিস্টর উদ্ভাবিত হবার পর কম্পিউটারের জগত পুরোপুরি বদলে গেলেও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধর্ম সরাসরি প্রয়োগ করে কম্পিউটিং-এর ধারণা তখনো কারো মনে আসেনি। কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর প্রাথমিক ধারণা দেন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান ১৯৮২ সালে। তিনি দেখান যে কোয়ান্টাম স্টেটের সুপারপজিশনকে কম্পিউটারের ইনফরমেশান ইনপুট হিসেবে ব্যবহার করলে অনেকগুলি ইনপুট এক সাথে দেয়া যায়। ফলে কম্পিউটিং-এর কর্মদক্ষতা অনেক অনেক গুণ বেড়ে যেতে পারে। তবে তার জন্য দরকার হবে নতুন ধরনের অ্যালগরিদম। তার তিন বছরের মধ্যেই কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর ধারণা বিস্তৃত হতে শুরু করে। রিচার্ড ফাইনম্যান তাঁর ধারণার বাস্তব রূপ দেখে যেতে পারেননি। ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ক্যান্সারে মারা যান।
১৯৮৫ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞানী ডেভিড ডিউশ (David Deutsch) বাস্তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কীভাবে কাজ করতে পারে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তারপর কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর গবেষণা দ্রুত বাড়তে থাকে।
ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং-এর মতোই কোয়ান্টাম কম্পিউটিংও বাইনারি
ডিজিট 0 এবং 1 ব্যবহার করে, তবে ভিন্নভাবে।
ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে 1 এবং 0 র স্টেট বা দশা সুনির্দিষ্ট; বিদ্যুৎপ্রবাহ আছে
(1) অথবা নেই (0)। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এ কোয়ান্টাম কণার (ইলেকট্রন কিংবা ফোটন)
কোয়ান্টাম স্টেট ব্যবহার করা হয় – যাতে কোয়ান্টাম সুপারপজিশানের মাধ্যমে একটি কণা একই
সাথে একাধিক স্টেটে থাকার সম্ভাবনার কারণে একাধিক মান নির্দেশ করতে পারে। সেজন্য ক্লাসিক্যাল
কম্পিউটারের মূল চাবিকাঠি ‘বিট’ এর অনুকরণে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর মূল চাবিকাঠির নাম
কোয়ান্টাম বিট বা সংক্ষেপে কিউবিট। বলা চলে কিউবিটের কেরামতিই হলো কোয়ান্টাম কম্পিউটিং।
চিত্র-১ কিউবিটের কোয়ান্টাম স্টেট |
চিত্র-১ থেকে কিউবিটের কোয়ান্টাম স্টেটের সুপারপজিশনের একটি ধারণা পাওয়া যায়। ধরা যাক ক্লাসিক্যাল বিট 0 হলো পৃথিবীর উত্তর মেরু, সেক্ষেত্রে 1 হবে পৃথিবীর দক্ষিণ মেরু। কিন্তু কোয়ান্টাম কণার সুপারপজিশানের কারণে কিউবিটের দশা বা স্টেট পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর যে কোনো জায়গায় হতে পারে। সেক্ষেত্রে কিউবিটকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ডিরাক নোটেশানের মাধ্যমে লেখা যায়: |Q> = α|0> + β|1>
যেখানে α এবং β হলো জটিল রাশি, যেগুলি
দিয়ে 0 এবং 1 এর আনুপাতিক হিসেব করে কিউবিটের
সঠিক দশা নির্ণয় করা যায়। নিচের দুটো চিত্র (২ ও ৩) থেকে ব্যাপারটি আরো পরিষ্কারভাবে
বোঝা সম্ভব।
চিত্র-২ কোয়ান্টাম দশা 0 এবং 1 এর সুপারপজিশনের ফলে কিউবিটের অবস্থান হতে পারে উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুর ঠিক মাঝামাঝি বিষুবরেখা বরাবর পূর্বদিকে। |
কোয়ান্টাম সুপারপজিশানের ব্যাপারটিকে আরো সহজভাবে বোঝার জন্য যদি শুধু এটুকুই আমরা ধরে নিই যে একটি ইলেকট্রন বা ফোটন একই সাথে দুইটি অবস্থানে থাকতে পারে, (কিংবা ইলেকট্রনের স্পিন আপ ও স্পিন ডাউন), সেক্ষেত্রে ক্লাসিক্যাল বিটের যেখানে 0 এবং 1 এই দুটো বিট লাগে, সেখানে একটি কিউবিট দিয়েই তা হয়ে যায়। এখন ২টি কিউবিট ব্যবহার করে আমরা পেতে পারি 00, 01, 10, 11 এই চারটি দশা। আরেকটি কিউবিট বাড়ালে আমরা পাবো 000, 001, 010, 011, 100, 101, 110, 111 এই আটটি দশা। এভাবে একটি করে কিউবিট যোগ করলেই দ্বিগুণ দশা পাওয়া যাচ্ছে। আট কিউবিট বা এক কিউবাইটে পাওয়া যাবে ২৫৬টি দশা। অর্থাৎ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এ আটটি ইনপুট দিয়ে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের ২৫৬টি ইনপুটের সমান কাজ করানো সম্ভব। বর্তমানের সুপারকম্পিউটারগুলিও যে হিসেব করতে দিনের পর দিন সময় নেয় (যেমন জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াগুলির সঠিকভাবে যান্ত্রিক বিশ্লেষণ ইত্যাদি), সেই কাজগুলি কয়েক সেকেন্ডেই সম্পন্ন করা সম্ভব হবে ৫০ কিউবিটের একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে।
এ তো গেলো সুপারপজিশনের কথা। কিউবিট যে শুধু সুপারপজিশনেই থেমে থাকে তা নয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দ্বিতীয় যে ধর্মটি এরা কাজে লাগাতে পারে – সেটা হলো কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট বা কোয়ান্টামের জটাজাল। কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট ব্যাপারটি খুবই অদ্ভুত। কোয়ান্টাম কণাগুলি এমন ব্যবহার করে যেন একটি কোয়ান্টাম কণা অন্য আরেকটি কণার সাথে অদৃশ্যভাবে যুগলবন্দী হয়ে থাকে – সেটা যত দূরেই থাকুক না কেন। ধরা যাক হাইড্রোজেন পরমাণুর কথা। এর একটিমাত্র ইলেকট্রন। এই ইলেকট্রনের অন্তঃঘূর্ণন বা স্পিন হতে পারে +১/২ কিংবা -১/২। দেখার আগ পর্যন্ত কিছুতেই সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয় যে কোন একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রনের স্পিন +১/২ হবে কি -১/২ হবে। হাইড্রোজেন পরমাণুর বদলে যদি হিলিয়াম পরমাণুর কথা বিবেচনা করি – দেখা যাবে ব্যাপারটা আরো রহস্যময়। হিলিয়াম পরমাণুতে দুটো ইলেকট্রন আছে। তারা একই কক্ষপথে থাকে। পাউলির বর্জননীতি মেনে চলতে হয় তাদের। সেই নীতি অনুযায়ী একটি ইলেকট্রনের স্পিন যদি +১/২ হয়, অন্য ইলেকট্রনের স্পিন অবশ্যই -১/২ হবে। কোন ইলেকট্রনের স্পিন কী হবে তা না দেখে সুনির্দিষ্টভাবে বলার উপায় নেই। তবে এক্ষেত্রে একটি ইলেকট্রনের স্পিন যদি জানতে পারি, অন্যটির স্পিন কী হবে তা না দেখেই বলে দেয়া যায়। কিন্তু একটাও না দেখা পর্যন্ত কোনটারই স্পিন কী হবে তা বলা যাচ্ছে না। তার মানে কি এই দাঁড়ায় যে ফলাফল নির্ভর করছে দর্শকের উপর? কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে - ঠিক তাই । যতক্ষণ দেখা না হচ্ছে – ততক্ষণ সম্ভাবনার সুপারপজিশান স্টেটেই থাকছে ইলেকট্রনের স্পিন।
আইনস্টাইন এরকম অনিশ্চয়তা মেনে নিতে না পেরে এর নাম দিয়েছিলেন ভূতুড়ে ঘটনা। তিনি কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্টকে চ্যালেঞ্জ করে তাঁর দুই সহকর্মী বরিস পডোলস্কি ও নাথান রোজেনের সাথে যৌথভাবে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন ১৯৩৫ সালে। এই গবেষণাপত্র ইপিআর পেপার নামে পরিচিত। এর সপক্ষে ১৯৬৪ সালে আইরিশ পদার্থবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট বেল একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন যেটা বেল্স ইনইকুইলিটি বা বেলের অসমতার পেপার হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিল। তিনি আহ্বান করেছিলেন কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্টের পক্ষে পরীক্ষামূলক প্রমাণ থাকলে তা হাজির করার জন্য। বেলের অসমতা পরীক্ষাগারে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য ২০২২ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন আলান এস্পেক্ট, জন ক্লাউজার এবং আন্তন সাইলিঙ্গার। [বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন কোয়ান্টামের জটাজাল]
একটি কিউবিটকে যদি অন্য একটি কিউবিটের সাথে এন্টেঙ্গেল করানো
যায়, তবে একটি কিউবিটের ইনপুট দিয়েই অপর কিউবিটেরও আউটপুট পাওয়া যাবে। নিচের চিত্র (চিত্র-৪) থেকে ব্যাপারটা বোঝা সম্ভব।
চিত্র ৪: কিউবিট A যদি কিউবিট B এর সাথে এন্টেঙ্গেলমেন্টে থাকে, তবে Aর ইনপুট যদি 00 হয়, Bর ইনপুট যে 11 হবে তা না দেখেই বলে দেয়া যায় । সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র A কিউবিট ইনপুট থেকে পাওয়া যাবে চারটি আউটপুট। |
এভাবে শুধু দুটো কিউবিট নয়, অনেকগুলি কিউবিটকে জটাজালে আবদ্ধ করে কোয়ান্টাম লজিক গেটে পাঠানো যায়। এখানে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং-এ ব্যবহৃত লজিক গেট সম্পর্কে একটু উল্লেখ করা যাক। কম্পিউটারের ইনপুটগুলিকে পাঠানো হয় প্রয়োজনীয় লজিক গেটের ভেতর দিয়ে। যেমন AND গেটের ভেতর দিয়ে যদি দুটো ইনপুট 0 এবং 1 পাঠানো হয়, তখন 0 AND 0 = 0, 0 AND 1 = 0, 1 AND 0 = 0, 1 AND 1 = 1 পাই। যখন OR গেটের ভেতর দিয়ে পাঠানো হয় তখন 0 OR 0 = 0, 0 OR 1 = 1, 1 OR 0 = 1, 1 OR 1 = 1 পাওয়া যায়। আবার NOT গেটের ভেতর দিয়ে পাঠানো ইনপুট উল্টে যায়। যেমন 0 NOT = 1, 1 NOT = 0 ইত্যাদি।
কোয়ান্টাম লজিক গেটও অনেকটাই ক্লাসিক্যাল লজিগ গেটের মতো,
তবে অনেক বেশি জটিল। কারণ কিউবিটের ইনপুটগুলি নির্ভর করে কোয়ান্টাম প্রোবেবিলিটি বা
সম্ভাবনার উপর। তাই কোয়ান্টাম লজিক গেটগুলি সময় নির্ভর। সবচেয়ে বেশি পরিচিত কোয়ান্টাম
গেট হলো হাডামার্ড গেট বা H গেট। ফরাসী গণিতবিদ জাঁক হাডামার্ডের নামে এই কোয়ান্টাম
গেট। এই H গেট কিউবিট ইনপুটকে সুপারপজিশন ইনপুটে পরিবর্তন করে দেয়। অর্থাৎ কিউবিট
0 এবং 1 কে H কোয়ান্টাম গেটের ভেতর দিয়ে পাঠালে তা 0 এবং 1 এর সুপারপজিশন স্টেট তৈরি
করে দেবে। (চিত্র-৫)
চিত্র-৫: হাডামার্ড গেট কিউবিট (0 এবং 1) কে সুপারপজিশন কিউবিট (+ এবং -) এ রূপান্তর করে দেয়। |
আরেকটি দরকারি এবং বহুল ব্যবহৃত কোয়ান্টাম গেট হলো
Controlled NOT gate বা CNOT গেট। ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং এর Exclusive OR (XOR) গেটের
মতোই কাজ করে CNOT কোয়ান্টাম গেট। এটা কন্ট্রোলড কিউবিট ইনপুটের কোন পরিবর্তন ঘটায়
না। কিন্তু এন্টেঙ্গেলড কিউবিটের মান উল্টে দেয়।
এরকম আরো অনেক কোয়ান্টাম গেট আছে এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক গেট তৈরি হবে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এ কোন সমস্যার সমাধানের শুরুতে দরকারি কিউবিটগুলিকে নির্বাচন করার পর তাদেরকে সঠিক কোয়ান্টাম লজিক গেটের মাধ্যমে অন্য কিউবিটগুলির সাথে এন্টেঙ্গেল করানো হয়। তারপর একে অপরের সাথে জটাজালে আবদ্ধ সবগুলি কিউবিটের ইনপুট একই সাথে প্রসেস (কোয়ান্টাম কম্পিউটিং) করা হয়। প্রসেসিং শেষ হবার পর কিউবিটগুলিকে জটাজাল থেকে ছাড়িয়ে স্বাভাবিক বিটে ফিরিয়ে আনা হয়, তখন তাদের আউটপুট বাইনারি ডিজিটে (0,1) পাওয়া যায়। বাইনারি কোড থেকে ডিকোড করে সেই ফলাফল কম্পিউটারে স্বাভাবিক আউটপুট ফাইল হিসেবে পাওয়া যায়।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর তত্ত্ব বোঝা গেলেও কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে বাস্তবে রূপ দেয়া খুব একটা সহজ নয়। কারণ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর সফ্টওয়ার কিংবা এলগরিদম ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং-এর এলগরিদম থেকে ভিন্ন। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য সর্বপ্রথম কোয়ান্টাম এলগরিদম লিখেছিলেন বেল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী পিটার শোর ১৯৯৪ সালে। তার দুবছর পর ১৯৯৬ সালে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনাময় এলগরিদম তৈরি করেন ভারতীয় আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী লব কুমার গ্রোভার। পিটার শোর আর লব গ্রোভারের দেখানো পথে এখন কার্যকর কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ব্যবহার করার উপযোগী অনেক এলগরিদম লেখা হচ্ছে, হার্ডওয়ার ও সফ্টওয়ার তৈরির কাজ চলছে। সে সম্পর্কে এই সংখ্যার অন্যান্য প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কার্যকর কোয়ান্টাম কম্পিউটার দেখতে
পাবো এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।
তথ্যসূত্র
১। জন গ্রিবিন, কম্পিউটিং উইথ কোয়ান্টাম ক্যাটস, প্রমিথিউস
বুক্স, নিউ ইয়র্ক, ২০১৪।
২। জিম আল-খলিলি, কোয়ান্টাম এ গাইড ফর দ্য পারপ্লেক্সড, ওয়েইডেনফিল্ড
অ্যান্ড নিকলসন, লন্ডন, ২০১২।
৩। ক্রিস বার্নহার্ডট, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ফর এভরিওয়ান,
র্যান্ডম হাউজ, আমেরিকা, ২০২০।
৪। কিয়ারান হিউজেস, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ফর দ্য কোয়ান্টাম
কিউরিয়াস, স্প্রিঙ্গার, সুইজারল্যান্ড, ২০২১।
৫। বিয়াট্রিস ম্যারি ইলেরফ, ক্যালকুলেটিং উইথ কোয়ান্টা, স্প্রিঙ্গার,
জার্মানি, ২০২২।
বিজ্ঞানচিন্তা নভেম্বর ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment